হৃদমোহিনী
পর্ব ৫৮
মিশু মনি
.
৮৪
সকালে নাস্তা সেরে মেঘালয় অফিসে চলে গেলো। ব্যবসায়ের ঝামেলা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে ওকে। মিশু আগ বাড়িয়ে আর ভিসার কথা তোলে নি। কিন্তু ওর মনে একটা বিষয় খুঁতখুঁত করেই যাচ্ছে। দোটানায় পড়ে গেলে যা হয়। রাত্রিবেলা বিষয়টাকে এড়িয়ে গেলেও সকাল থেকে মনে দুশ্চিন্তা দানা বাঁধছে। একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো দরকার। এভাবে দোটানা নিয়ে না নিজে ভালো থাকা যায়, না কারো সাথে ভালোভাবে কথা বলা যায়।

দুপুরে মেঘালয় বাসায় ফিরে সবার সাথে বসে খাবার খেলো। তারপর মিশুকে ডাকলো কথা বলার জন্য। মিশু থালাবাসন পরিষ্কার করে রেখে হাত ধুয়ে রুমে আসতে দেরি করে ফেললো। মেঘালয় চোখ পাকিয়ে বললো, ‘ডাকার সাথে সাথে আসা যায় না?’
– ‘থালাবাসন মাজছিলাম।’
– ‘থালাবাসন মাজার জন্য কাজের লোক আছে না?’
– ‘আমার তো এ বাড়িতে কোনো কাজ নেই। সারাক্ষণ শুয়ে বসে থাকতে আমার ভালো লাগে না। ছোটবেলা থেকেই বাসার টুকিটাকি কাজগুলো করার অভ্যাস আমার।’
– ‘বসো, সিরিয়াস হয়ে দুটো কথা বলবো। তুমিও সিরিয়াস ভাবে নিও।’
– ‘আজ পর্যন্ত আপনার কোনো কথা আমি ফাজলামির ছলে নিয়েছি?’
– ‘নাও নি। কিন্তু এখন যেটা বলবো সেটা শোনার জন্য তোমার মানসিক প্রস্তুতি দরকার।’

মিশু সোফায় বসতে বসতে ওড়নায় হাত মুছলো। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বলুন কি কথা?’
– ‘ওড়নায় হাত মুছলে কেন? বাসায় কোনো ন্যাপকিন নেই? টিস্যু নেই?’
– ‘আজকে এরকম ক্যাটকেটে গলায় কথা বলছেন কেন? আপনার কথা শুনবো সে কারণে তাড়াহুড়ো করে ওড়নায় হাত মুছলাম।’
– ‘এতক্ষণ ধৈর্য ধরে বসে থাকলাম আর দু মিনিট থাকতে পারতাম না?’

মেঘালয়ের গলায় রাগ স্পষ্ট। মিশুরও মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ও নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ‘আমি হাত মুছতে গেলে আপনি আরো রেগে যেতেন। তর্ক ছেড়ে দিয়ে এখন বলুন কি কথা?’
– ‘কথা বলার মুডটাই নষ্ট করে দিয়ে এখন বলছে বলুন কি কথা?’

মিশুর কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। মেঘালয়ের আচরণ অন্যরকম লাগছে। সামান্য দেরি করার কারণে এত রেগে যাওয়ার কি মানে হয়?
মিশু প্রশ্নটা করতেই মেঘালয় বললো, ‘দেরি করে এসে একটা অন্যায় করেছো। এখন আবার প্রশ্ন করছো??’

মিশু ফোঁস করে জবাব দিলো, ‘বাব্বাহ! মনে হচ্ছে স্কুলে ক্লাসে দেরি করে এসেছি। খাওয়ার পর রেস্ট নেয়ার জন্য কয়েক মিনিট বসতেই পারেন। আমি কি এমন অন্যায় করেছি?’
– ‘ইদানীং তোমার মুখে কথা ফুটেছে দেখি। প্রত্যেকটা কথা শোনার পর এক সেকেন্ড ভাবছো না। সাথে সাথে পাগলের মত তর্ক জুরে দিচ্ছো।’
– ‘তর্ক তো আপনিও করছেন। সামান্য একটু দেরি করে রুমে এসেছি বলে এভাবে রিয়েক্ট করতে হবে?’
– ‘আমাকে বাইরে যেতে হবে। জরুরি কাজ আছে। আমি তো তোমার মত বাসায় বসে থাকি না তাই না?’

মিশু রেগে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মুখ বাঁকা করে বললো, ‘জানতাম কোনো একদিন এই খোঁটা শুনতেই হবে। ইভেন প্রত্যেকটা মেয়েকেই এই কথা শুনতেই হয়। এ জন্য মেয়েদেরকে নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে করা উচিৎ না।’

মেঘালয় চুপ করে রইলো। গালে হাত দিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে রাগ সংবরণ করলো। মিশু রীতিমত রাগে ফুঁসছে। রাগের সাথে সাথে গা জ্বলছে ওর। মেঘালয় আর কথা বাড়াতে চাইলো না। যে কথাটা বলতে চেয়েছিলো সেটা বলার মন মানসিকতা নষ্ট হয়ে গেছে।

মিশু বললো, ‘কি জানি কখন আবার বলবেন ওড়নায় হাত মোছাটা কাজের মেয়েদের স্বভাব। আপনারা এলিট শ্রেণী, ছোট্ট একটা ব্যাপারকেও আপনাদের কাছে অসহ্য লাগে।’

মেঘালয় স্বাভাবিক গলাতেই বললো, ‘তোমাকে না বললে এই স্বভাবটা থেকেই যাবে। আর কথাটা তো অযৌক্তিক বলিনি তাই না? বাসায় এত ন্যাপকিন আছে, তোয়ালে, টিস্যু এতকিছু থাকার পরও আমার বউ আমার সামনে ওড়নায় হাত মুছছে।’
– ‘আপনাদের মত বড়লোক দের সমস্যা টা এখানেই। ছোট্ট একটা বিষয়, এড়িয়ে গেলেই পারেন। তা নয়, এটা নিয়েই লংকাকান্ড বাঁধাবেন।’

মেঘালয় ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘আমি মোটেও বাড়াবাড়ি কিছু করিনি। তোমার একটা বদভ্যাস থাকলে সেটা নিয়ে কথা বলার অধিকার আমার আছে।’
– ‘কোনো মানুষ ই বদভ্যাসের বাইরে নয়। আপনি নিজে একেবারে নিঁখুত?’
– ‘মিশু, তুমি কিন্তু ঝগড়া লাগানোর চেষ্টা করছো।’

মিশু রেগে বললো, ‘ঝগড়া লাগানোর বাকি আছে? তবে আমি না, আপনি শুরু করেছেন। সত্যিই আমার নিজেকে নিয়ে নিজেই গিলটি ফিল করছি। কখন না জানি আমাকে আপনার অসহ্য লাগতে শুরু করে। আসলেই যোগ্যতায় সমান সমান না হলে এরকমই হয়।’

এবার মেঘালয়েরও মেজাজ চড়ে গেলো। কোথ থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে। মিশুর দিকে রাগত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেঘালয় বললো, ‘একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলাম। তোমার কাছ থেকে এরকম আচরণ আমি আশা করিনি মিশু। এসব কি?’
– ‘আমিও আপনার কাছ থেকে এরকম কিছু আশা করি নি। সামান্য দেরি হলেই যার রাগে গায়ে আগুন জ্বলতে থাকে।’
– ‘উফফ অফিসের কত টেনশন আমার মাথায়। তাই রেগে গেছি। আমিও তো মানুষ তাই না? মাথায় এতকিছুর প্রেশার থাকলে একটা সময় সামান্য কারণেই রাগ উঠে যায়।’
– ‘কথা সেটা নয়। আজকে যদি আমিও আপনার মতই কোনো বড় বিজনেসম্যান হতাম, আমাকে রাগ দেখানোর আগে আপনিও একবার ভাবতেন।’
– ‘ধেৎ, এত বেশি বেশি বুঝলে তো হবে না। তোমার মাথায় না আসলেই কিচ্ছু নাই।’

মিশুর চোখে জল এসে গেলো হঠাৎ। কাঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ছুটে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। রাগে বিষিয়ে গেলো মেঘালয়ের মনটা। যেখানে ও ভেবেছিলো মিশু’র সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে ভালো সময় কাটাবে, নিজেকে হালকা লাগবে। সেখানে উলটো দুজনের মাঝে ছোটখাটো একটা ঝগড়া হয়ে গেলো। অসহ্য লাগছে এখন।

এদিকে মিশু সোজা ছাদের উপরে চলে এসেছে। চিলেকোঠার ঘরে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর ভাবছে, এত সুন্দর মানুষেরও বুঝি এমন রাগ থাকে? ব্যবসায়ের ঝামেলা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে। সেই রাগ স্ত্রী’র উপর কেন ঝাড়বে? আর যাই হোক, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রয়োজন অবশ্যই আছে। নয়তো কখন কিভাবে আঘাত করবে কেউ জানেনা। আমি এখানে থেকে পড়াশোনা করলে যদি একদিন মুখ ফসকে বলে, ‘তোমাকে পড়াশোনা করিয়েছি, তোমাকে এই করিয়েছি, সেই করিয়েছি’ এভাবে বললে তো আমি সহ্য করতে পারতাম না। আমার বাবা আমাকে পড়াশোনা করালে কখনো তো এমন বলবে না। নিজের বাবা আর পরের বাবার মাঝে বুঝি এটাই পার্থক্য।

মেঘালয়ের বাবা, মা এমন কখনোই বলবেন না। কিন্তু মানুষের মন বড়ই অবুঝ। যখন মেজাজ গরম হয়ে যায়, তখনই মানুষ সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত গুলো নেয়। ঝগড়া কিংবা মনোমালিন্য’র সময়েই মানুষের মাথায় রাজ্যের আজেবাজে চিন্তা এসে ভর করে। কখনো নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়, কখনো নতুন কিছু করার জেদ চাপে। রাগের বশে এই জেদের জন্ম নেয়াটা যে কতটা ভয়ংকর সেটা তখন বোঝা যায় না। এটা অনুধাবন করার সময় আসবে তখন, যখন প্রিয়জন দূরে সরে যাবে। চাইলেও দূরত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না, সেই সময়ে মনেহবে একদিন ভূল বুঝে এতদূরে চলে এসেছিলাম। আজ মিশু ঠিক প্রথম অবস্থাতে দাঁড়িয়ে। রাগের মাথায় আজেবাজে ভাবতে শুরু করেছে। এদিকে মেঘালয়েরও আজ চরম মন খারাপ। এ সময়ে মিশুকে শান্ত করে সবচেয়ে ভালো বিষয়টা বোঝানোর অবস্থায় সে ও নেই। সবমিলিয়ে দুজনের অবস্থা এখন সাংঘাতিক রকমের খারাপ! আজকে কেউ কারো পাশে নেই।

৮৫
রাত দশটায় বাসায় ফিরলো মেঘালয়। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। প্রত্যেকেই যে যার মত ব্যস্ত। কেউ বিছানার এক কোণে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে সেটা দেখার সময় আজ কারো নেই। মা খেয়েদেয়ে নাইট ডিউটিতে চলে গেছেন। বাবা এখনো বাইরে থেকে ফেরেননি।

মেঘালয় রুমে এসে লাইট জ্বালিয়ে দিতেই দেখলো মিশু বিছানার এক কোণে হাঁটু বুক পর্যন্ত তুলে ছোট্ট একটু হয়ে শুয়ে আছে। ছ বছরের ছোট বাচ্চারা যেভাবে ঘুমায় ঠিক সেভাবে। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো মেঘালয়ের। শার্ট খুলে রেখে বিছানার কাছে এগিয়ে আসলো।
মিশু ঘুমিয়ে পড়েছে। মেঘালয় ওর গায়ে হাত দিয়ে ডাকলো, ‘ঘুমাচ্ছো?’

মিশু’র কোনো সাড়া শব্দ নেই। মেঘালয় সরে যাওয়ার সময় মিশু খপ করে ওর কোমর জাপটে ধরলো। মেঘালয়ের ঘামে ভেজা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আছে। মিশু মেঘালয়ের পেটের কাছে সরে এসে ওর ঘামের গন্ধ শুঁকলো। মেঘালয় মিশু’র চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘খেয়েছো?’
– ‘না।’
– ‘দুপুর থেকে খাওনি কিছু?’
– ‘না।’
– ‘ওঠো, একসাথে খাবো।’
– ‘আমি খাবো না।’
– ‘এইটুকু শরীরে এত রাগ কোথায় লুকিয়ে থাকে বলতে পারেন ম্যাডাম?’

মিশু মেঘালয়ের গায়ে দুটো কিল বসিয়ে বললো, ‘আপনি অনেক খারাপ।’
– ‘আমি ঘামে জবজবা হয়ে আছি। গোসল করে আসি। তুমি ফ্রেশ হয়ে খাবার রেডি করো।’

মেঘালয় মিশুকে ছেড়ে দিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো। মিশু বিছানার উপর বসে আনমনা হয়ে কি যেন ভাবছে। মেঘালয় বাথরুমের দরজা খুলে বললো, ‘কি হলো? বসে আছো কেন? গোসল করিয়ে দিবো?’

মিশু বাঁকা চোখে মেঘালয়ের দিকে তাকালো। সে দৃষ্টির ভাষা বোঝা গেলো না। মেঘালয় বললো, ‘গোসল করলে আসো।’
– ‘করবো না।’

করবো না বলার পরও ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে বাথরুমে ঢুকলো মিশু। গোসলের সময় মিশু’র গায়ে আটকে থাকা জলের বিন্দুগুলো ঠোঁট দিয়ে শুষে নেয়াটা মেঘালয়ের স্বভাব। তাছাড়া শাওয়ারের ঠাণ্ডা জলে ভিজতে ভিজতে কোনদিক থেকে শুরু করে কোথায় পৌঁছে আদর করে সমস্ত অভিমান জলে ভেসে যাবে সেটা বোঝার উপায় থাকবে না।

খাবার টেবিলে এসে মিশুর ভেজা চুল থেকে টুপটুপ করে জল পড়ছিলো। তোয়ালে এনে মুছে দিতে দিতে মেঘালয় বললো, ‘সারাদিনে একটা বারও ফোন দাওনি। খুব রেগে ছিলে সেটা বোঝাই যায়।’
– ‘রেগে তো এখনো আছি।’
– ‘বাব্বাহ! রাগমোচনের পরও রাগ থাকার কথা থাকে, আগে তো জানা ছিলো না।’
– ‘আপনি যে প্রচণ্ড খারাপ লোক সেটা কি আপনি জানেন?’
– ‘আমার জানার দরকার নেই, আমার বউ জানলেই হবে।’
– ‘আজকে ঝগড়া’র শুরুটা আপনার ছিলো।’
– ‘ওকে, নেক্সট টাইম তুমি শুরু কইরো।’

মিশু আর কথা বাড়ালো না। মেঘালয়ের প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে নিজে খেতে আরম্ভ করলো। মাছের তরকারি দেখে মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, ‘কাটা বেছে দিবো?’
– ‘না। নিজের কাটা নিজেই বাছতে পারবো।’
– ‘আর নিজে যে আমার গলায় কাটা হয়ে বিঁধেছো সেটা কে সরাবে?’

তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো মিশু। মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, ‘মজা করছিলাম। রাগ কোরো না আবার।’
– ‘করুন, আর কয়েকটা দিন ই তো। তারপর তো আর এই অসহ্য কাটা টা আপনার সামনে থাকবে না।’

মেঘালয় খাওয়া বন্ধ করে মিশু’র দিকে তাকালো- ‘তুমি তাহলে শান্তিনিকেতনে যাচ্ছো?’

মিশু মাথা নিচু করে বললো, ‘হয়তো বা। সেটাই বোধহয় ভালো হবে।’
– ‘রাগ করে যাচ্ছো?’

মিশু একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘আমার রাগ এত শক্তিশালী নয় যে ৩ বছর সেটা পুষে রাখবো। অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম, আমার ম্যাচিউরিটি দরকার। আর মানুষ সবচেয়ে বেশি জ্ঞানার্জন করে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। আমার মনেহয় সেটার দরকার আছে। সংসার করার সময় তো সারাজীবন পাবো।’
মেঘালয় চুপচাপ খাবার খাচ্ছে। মিশুর কথা শুনছে মনোযোগ দিয়ে। মাঝেমাঝে মেয়েটা মুরুব্বীদের মত কথা বলে।

মিশু বললো, ‘আজকে দুপুরেই আপনার সাথে আমার তুমুল ঝগড়া হয়ে গেলো। এরকম আবার হবে। এভাবে একদিন যদি আমি আপনার কাছে অসহ্য হয়ে যাই?’
– ‘খাওয়া শেষ করে তারপর উত্তর দেই?’

মিশু আর কিছু বললো না। দুজনে চুপচাপ খাবার শেষ করলো। মেঘালয় প্লেট হাতে রান্নাঘরে ঢুকতেই মিশু পিছু পিছু ছুটে গিয়ে বললো, ‘আপনি কেন এসেছেন? এটা আমি ধুয়ে দিচ্ছি রাখুন।’
– ‘আমার প্লেট আমি কেন ধুতে পারবো না? নিজের কাজ নিজে করার স্বভাব তোমার থাকলে স্বভাবটা আমিও করি।’
মিশু তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো মেঘালয়ের দিকে। ছেলেটা মাঝেমাঝে কেমন অদ্ভুত হয়ে যায়!

মেঘালয় প্লেট ধুয়ে রেখে বাটিতে থাকা তরকারি ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখলো। ডাইনিংয়ের সবগুলো জানালা, দরজা লাগিয়ে দিয়ে লাইট নিভিয়ে দিলো। মিশু হা হয়ে ওর কাজকর্ম দেখছে। মেঘালয় ওর হাত ধরে বললো, ‘এখন রুমে চলো। কাজ শেষ।’
– ‘আপনার আজকে কি হয়েছে বুঝলাম না।’
– ‘এগুলো তো সবসময় তুমি করো, আজকে নাহয় তোমাকে একটু হেল্প করলাম।’
– ‘ঝগড়ার পর এমন মনে হলো?’
– ‘হ্যাঁ। আমি তোমার কাজে কিছু হেল্প করলাম, তুমিও আমার কাজে হেল্প করবা। তাহলেই তো আর ঝগড়া লাগবে না।’

মিশু ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছে মেঘালয়ের দিকে। মেঘালয় ওকে রুমে নিয়ে এসে সামনা সামনি হয়ে বসল। তারপর চোখে চোখ রেখে বললো, ‘আমার বয়স এখন আঠাশ। ধরো আমি আর চল্লিশ বছর বাঁচবো। তোমার কি ইচ্ছে হয় না এই চল্লিশটা বছর আমার সাথে কাটাতে? আমার তো মনেহয় একশো বছর তোমার সাথে থাকার পরও আমার অতৃপ্তি থেকে যাবে। আমি তো মৃত্যুর পরেও তোমাকে আমার সাথে চাই।’

মিশু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এই মেঘালয়টা মাঝেমাঝে অচেনা হয়ে যায় সেটা ভাবাই যায় না।

মেঘালয় বললো, ‘আজকে যে ঝগড়াটা হয়েছে সেটা আমার রাগ থেকেই হয়েছে। এ জন্য সরি।’

‘সরি’ বলে মিশু’র হাত ধরলো মেঘালয়। মিশু ব্যস্ত হয়ে বললো, ‘আরে না না। ঠিক আছে। আমিও সরি। তবে আর ঝগড়া কক্ষনো করবো না।’
– ‘একসাথে থাকলে মাঝেমাঝে এরকম হবেই। তাই জন্য দূরে সরে যাওয়ার কথা ভাব্বে?’
– ‘আমার কি যাওয়া উচিৎ না?’

মেঘালয় বললো, ‘না। কারণ, একটা মেয়ে আঠারো থেকে পঁচিশ বছর বয়সে কারো প্রেমে পড়লে প্রবলভাবে ভালোবাসতে পারে। আর এই সময়ে শারীরিক চাহিদাটাও বেশি থাকে। যদিও মানুষ বলে প্রেমে পড়তে মন লাগে। কিন্তু স্বামী স্ত্রী’র সম্পর্কে শরীর আর মন দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমার শারীরিক অক্ষমতা থাকলে তুমি কখনোই আমার সাথে সংসার করতে চাইতে না। একইভাবে তোমার কোনো শারীরিক সমস্যা থাকলে আমি মেঘালয় নিজেও আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করতাম। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত মানুষের শরীর ও মন কাউকে প্রবলভাবে চায়। সেখানে আমরা দুইজন দুজনকে নিয়ে অনেক সন্তুষ্ট। তাহলে অযথা আমাদের জীবন থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টাকে জলে ফেলে দেয়ার কোনো মানে হয় না মিশু। তোমার সাথে একশো বছর থাকতে চাই আমি। সেটা তো সম্ভব না। যে কয় বছর বাঁচবো, থাকি না একসাথে? একসাথে থাকার জন্য এই চল্লিশটা বছর অনেক সামান্য। আল্লাহ চাইলে তো তার আগেও মরে যেতে পারি।’

মিশু মেঘালয়কে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘এভাবে বলবেন না। তবে এটা সত্যি যে আপনার সাথে আরো অনেক বছর কাটাতে চাই আমি।’
– ‘এখন বলো মাঝখান থেকে এই তিন/চার বছর কষ্ট করে বাকি জীবনে কি হবে? তোমার জীবনে যদি আমি না থাকতাম, তাহলে নির্দ্বিধায় যেতে পারতে। ধরো, তোমার ফিরতে যদি আমার বয়স পঁয়ত্রিশ হয়ে যায়। আমি আমার ম্যারেড লাইফটাকে এনজয় করবো কখন?’

মিশু থমকে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মুখে প্রসন্ন হাসি লেগে আছে। ভালো লাগছে কথা বলতে।

মেঘালয় মিশুর হাত ধরে বললো, ‘তুমি আমার সাথেই থাকো। চার বছরে তোমার অনার্স শেষ হোক। এর মাঝে আমরা আল্লাহর কাছে একটা ফুটফুটে বাচ্চা চাইবো। ততদিনে দুজন মিলে আমার বিজনেসটাকে একটা ভালো জায়গায় দাড় করাই? তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট কিংবা পিএইচডি করার জন্য স্কলারশিপের আবেদন কোরো। পোস্ট গ্রাজুয়েটের জন্য স্কলারশিপ পাওয়াটা অনেক সহজ। তুমি নিজেও দেশের বাইরে পড়তে চাও, আর আমিও চেষ্টা করবো আমার বিজনেসটাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার। চার পাঁচ বছর দুজন মিলে আমাদের দাম্পত্য জীবনটাকেও অনেক এনজয় করতে পারবো। আল্লাহর রহমতে যদি একটা মেয়ে হয়েই যায়, বাবুটাকে নিয়ে নাহয় বিদেশে গিয়ে তোমার পোস্ট গ্রাজুয়েট শেষ করে আসবো। আমেরিকা কিংবা কানাডার মত কোনো দেশ থেকে। সবমিলিয়ে ব্যাপারটা অনেক সুন্দর হবে, ভেবে দেখো?’

মিশু মেঘালয়ের দিকে অবাক হয়ে তাকালো!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here