হৃদমোহিনী
পর্ব ৩১
মিশু মনি
.
৪২
রাত নেমেছে অনেক্ষণ আগেই। মিশু সদ্য শ্বশুরবাড়িতে এসেছে। বাড়ি দেখেই হতবাক হয়ে গেছে ও। মেঘালয়ের রুমটা একেবারে ওর স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর। এরকম একটা ঘর ওর হবে ভাবতেও পারেনি কখনো। ঘরের সবকিছুতেই এক ধরণের শুভ্রতা ছেয়ে আছে। মনটা না চাইতেও ভালো হয়ে যায়। প্রশান্তিতে ছেয়ে যায় ভেতরটা। আর বিছানা দেখেই মনেহয় শুয়ে পড়লেই ঘুমে চোখ বুজে আসবে।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিশু মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘালয় সোফার উপর বসে ল্যাপটপ কোলে বসিয়ে কি যেন করছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবছে কিছু একটা নিয়ে। মিশু বিছানা থেকে উঠে ধীরেধীরে এগিয়ে এলো মেঘালয়ের কাছে। পাশে বসে বললো, ‘কি করছেন?’
– ‘একটা ইম্পরট্যান্ট কাজ করছি। একটু অপেক্ষা করো।’

মিশু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আজকে মেঘালয়ের কাজ শেষ করতে করতে অনেক দেরি হয়ে যাবে হয়ত। হতাশ হয়ে উঠতে যাবে এমন সময় মেঘালয় ওর হাত টেনে ধরে বললো, ‘মন খারাপ কোরোনা। কাজটা শেষ করেই আসছি।’

মিশু মুচকি হেসে বললো, ‘মন খারাপ করিনি। আপনি কাজ শেষ করেই আসুন।’

মিশু বেলকুনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। শহরটাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে এখান থেকে দেখতে। কত মোহময় একটা রূপ আছে এই শহরের। চেনা শহরটাকেও রাত্রিবেলা কেমন যেন অচেনা লাগে। মুগ্ধ হয়ে অনেক্ষণ তাকিয়ে রইলো মিশু। মেঘালয়ের কাজ কি এখনো শেষ হয়নি? তখন তো খুব করে বলেছিলো আজ রাতে তোমার খবরই আছে। তাহলে এখন আবার কি হলো? এরপর আবার নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, ‘আচ্ছা কাজ করছে যখন করুক।’

হঠাৎ মেঘালয় ডেকে বললো, ‘কল এসেছে ফোনে।’

মিশু একটু অবাকই হলো। মেঘালয় কি পারতো না ফোনটা নিয়ে বেলকুনিতে এসে দাঁড়াতে? কাজের প্রতি খুব মনোযোগী ছেলেটা সেটা বোঝাই যাচ্ছে। মিশুর মন খারাপ হলেও রুমে এসে ফোন রিসিভ করলো। বাবা ফোন করেছে। ও রিসিভ করে বললো, ‘ঘুমাওনি?’
– ‘ঘুম আসছে না মা। আমি কাল সকালে বাসে উঠবো। ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি।’

মিশু কি যেন ভেবে বললো, ‘আব্বু তুমি আরো কয়েকদিন পরে এসো।’
বাবা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, ‘কেন?’

মিশু ফোন নিয়ে বেলকুনিতে এসে দাঁড়ালো। বললো, ‘আমাকে দুটো দিন এদের সাথে একাকী মিশতে দাও। আমি দেখতে চাই সবাই আমার সাথে কেমন আচরণ করে। তুমি কয়েকদিন পরে আসো।’
– ‘ঠিক আছে মা। কিন্তু তোর শ্বশুরকে কি বলবো?’
– ‘আমি বলে দিবো আম্মুর শরীরটা একটু খারাপ। তাই তুমি দুদিন পরে আসবে।’
– ‘তুই যা ভালো মনে করিস। রাতে খেয়েছিস মামনি?’
– ‘হ্যা। তুমি?’
– ‘হ্যা রে মা। তোর কি মন খারাপ?’

মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘না আব্বু। কাল কথা বলবো, ঘুম পেয়েছে আমার।’

ফোন কেটে দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মিশু। মেঘালয়কে ছাড়া একটা মুহুর্তও ভালো লাগেনা ওর। তাহলে কি ধীরেধীরে মেঘালয়ের প্রতি এক ধরণের মায়া তৈরি হচ্ছে? মায়া জিনিসটা বড্ড অদ্ভুত। কিভাবে কখন কার প্রতি জন্মে যায়, বোঝাই যায়না।

এমন সময় মেঘালয় এসে আচমকা কোলে তুলে নিলো মিশুকে। রুমে এসে আলতো করে বিছানায় শুইয়ে দিলো। মেঘালয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে মিশু শিউরে উঠে দুহাতে খামচে ধরলো মেঘালয়ের শার্ট। মেঘালয় নিচু হয়ে এসে মিশুর কপালে আলতো চুমু এঁকে দিয়ে বললো, ‘আমার বউটা একটু বেশিই মিষ্টি দেখতে। কি বলেছি মনে আছে তো?’

মিশু চোখেচোখে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, ‘কি?’

মেঘালয় বললো, ‘আমার বউকে আমার মত হতে হবে।’

মিশু চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। মেঘালয় আরো কাছে এসে ওর গলায় মুখ গুঁজে দিলো। চোখ বন্ধ করে ফেললো মিশু। চোখের কোণা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো দুফোটা। এটা কিসের কান্না বুঝতে পারলো না ও। হয়ত সুখের কিংবা অচেনা কোনো যন্ত্রণার…

৪৩.
চারদিন কেটে গেছে। মিশুর বাবা এসেছেন, আগামীকাল ফ্লাইটে চলে যাবেন মিশুকে নিয়ে। বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছে পনের দিন পর। আয়োজন করতে একটু সময় তো লাগবেই। মিশুর মনটা আজ একটু বেশিই খারাপ। চলে যাওয়ার কারণে নয়। মন খারাপ অন্য একটা কারণে। বিয়ের পর থেকে এই কয়েকদিন মেঘালয় ওর শরীরটাকে ইচ্ছেমত ঘেটেছে। এমনকি মিশুও অনেক নতুন কিছু অধ্যায় আবিষ্কার করেছে মেঘালয়ের সম্পর্কে। এখন ও ছেলেদের সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানে যা আগে জানা ছিলো না। প্রতিটা রাতেই নতুন ভাবে একটা অন্যরকম জগতে ঘুরিয়ে আনে মেঘালয়। হঠাৎ করেই মিশু বড় হয়ে যাচ্ছে এরকম অনুভব করছে। দাম্পত্য জীবনে সুখী হওয়ার ব্যাপারে যেকেউ জিজ্ঞেস করলে মিশু নিঃসন্দেহে বলবে সে অনেক সুখী মেয়ে। কিন্তু মিশু কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেনা। একটা শূন্যতায় ভুগছে সবসময়। এটা কিসের শূন্যতা?

আকাশ আহমেদের আচরণ, ভালোবাসা, কেয়ারনেস সবকিছুই একজন মেয়ের সত্যিকার বাবার মতন। মা ও নিজের মেয়ের মতই গ্রহণ করেছেন মিশুকে। মৌনি যতক্ষণ বাসায় থাকে সবসময়ই চেষ্টা করে মিশুকে গল্পে ব্যস্ত রাখার। স্মার্টনেসের নতুন কিছু সংজ্ঞা মৌনির কাছেই জেনে ফেলেছে মিশু। কিন্তু তবুও কিসের যেন শূন্যতা?

মিশু অনেক ভেবে যে জিনিসটা সবার আগে উপলব্ধি করলো সেটা গভীরভাবে ভাবতে গেলে চোখে জল এসে যাবে। তবুও ভাবতেই হলো মিশুকে। সবচেয়ে কঠিন সত্য হলো, মেঘালয় নিজের দায়িত্ব খুব কঠোরভাবে পালন করলেও, এখনো ওদের দুজনের মধ্যে যে সম্পর্ক সেটা শুধুই একজন স্বামী স্ত্রী’র সম্পর্ক। যেখানে দায়িত্ববোধ আছে, বিশ্বাস আছে, সম্পর্ক আছে কিন্তু ভালোবাসার মত ভালোবাসাটা নেই। মিশু ছোটবেলা থেকেই সবসময় চেয়েছিলো কেউ ওকে পাগলের মত ভালোবাসুক। কিন্তু মেঘালয় এখনো ওকে সেভাবে ভালোবাসছে না। তাহলে কি মেঘালয়ের মাঝে এখনো ওর প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়নি?

মিশু খুব গভীরভাবে ভাবছে। এই কয়েকদিন ধরেই ও বুঝতে পেরেছে এই শূন্যতা টুকু সবসময় ঘিরে রাখে ওকে। মেঘালয় দায়িত্ববোধ সম্পর্কে অত্যধিক সচেতন থাকলেও মন থেকে ভালোবাসছে না। মন থেকে গ্রহণ করতে পারেনি কি তবে? এই একটা প্রশ্নই মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো মিশুর। অনেক সময় এমন হয় যে, দিনের পর দিন হাসিমুখে সংসার চালিয়ে যায় ঠিকই কিন্তু সবকিছুর আড়ালে ভালোবাসার একটু ফাঁক ফোঁকর থেকেই যায়। কক্সবাজারে গিয়ে অনেক কেয়ারনেস দেখালেও এখন কেবলই মনেহয় মেঘালয় নিজের দায়িত্ববোধ টুকুই মন দিয়ে পালন করে। কিন্তু ভালোবাসা? প্রত্যেকটা মনই যে ভালোবাসার কাঙাল। কেউ স্বীকার করে আর কেউ করেনা।

মেঘালয় রুমে এসে মিশুকে এভাবে মনমরা হয়ে ভাবতে দেখে বললো, ‘তুমি কি কোনোকিছু নিয়ে আপসেট?’
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘না।’
– ‘দেখে আপসেট মনেহচ্ছে। কিছু লাগবে?’
– ‘হ্যা।’
– ‘কি লাগবে বলো? কিছু দরকার হলে অবশ্যই আমাকে বলবা।’

মিশু চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বললো, ‘ভালোবাসা।’

চমকে উঠলো মেঘালয়। চোখ নামিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকালো। নিজেরই কেমন যেন লাগছে। সত্যিই মেঘালয় এখনো মিশুকে মন থেকে ভালোবাসতে পারেনি। দিনের পর দিন একই ঘরে থাকছে, একসাথে সব কাজই করছে কিন্তু প্রিয়জনের প্রতি যেরকম আলাদা একটা টান থাকে সেটা এখনো মিশুর প্রতি হয়নি ওর। মেঘালয় নিজেই এটা স্বীকার করে। মিশুর প্রতি মন থেকে আকর্ষণ অনুভব করেনা ও। যেটা অনুভব করে সেটা শুধুমাত্র শারীরিক আকর্ষণ। এটাই কি হবার কথা ছিলো?

দুজনেই নিশ্চুপ হয়ে মেঝের দিকে চেয়ে আছে। কেউই মুখে কিছু বলছে না। কিন্তু একজন ঠিকই বুঝতে পারছে আরেকজন কি ভাবছে। দৈহিক আকর্ষণ কয়েকদিন পর আর থাকবে না। দায়িত্ববোধ থেকেই হয়ত সংসার থেকে যাবে, দিনের পর দিন একসাথে থাকা হবে, রাতের পর রাত একই বিছানায় ঘুমানো হবে। কিন্তু আত্মার জন্য আত্মার ছটফটানি অনুভব করাটা যে একান্তই জরুরী। একসাথে চলতে চলতে কি সেটা হয়ে যাবে? যদি না হয় তাহলে দুজনে সুখী হবে কি করে?

কেউ কথা বলছে না। মিশু ই প্রথমে বললো, ‘অনেক বিয়ের ক্ষেত্রেই তো পাত্র পাত্রীর কখনো কথাও হয়না বিয়ের আগে। শুধু একজন আরেকজনকে দেখে, বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করে একজন অচেনা মানুষকে মেনে নিতে হয়। আমাদের বিয়েটা তো সেরকম ছিলোনা। আমাদের পরিবারও চায়নি আমাদের বিয়ে হোক, আমরাও চাইনি বিয়ে করতে। হুট করেই প্রকৃতি আমাদের এক করে দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতি আমাদের মাঝে ভালোবাসার বন্ধনটা কতটুকু শক্ত করে দিয়েছে? জানেন আপনি?’

মেঘালয় একটু চুপ থেকে বললো, ‘অনেক জটিল ধাঁধায় ফেলেছো। আমি কখনো মিথ্যে বলতে পারিনা। তাই খারাপ লাগলেও সত্যিটাই বলছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু আমার প্রিয়জনকে যতটা ভালোবাসার কথা ছিলো এখনো ততটা বাসতে পারিনি।’

মিশুর খুব খারাপ লাগলো কথাটা শুনতে কিন্তু মেঘালয়ের সততা দেখে ভালো লাগছে। কথাটা একদমই সত্যি। ধীরেধীরে মিশুর মাঝে এক ধরণের শুন্যতা কাজ করতে আরম্ভ করেছে। একটা সময় এটা বেড়েও যেতে পারে। বাড়তে বাড়তে যদি সম্পর্কটাই নষ্ট হয়ে যায়?’

মিশু একটু ভেবে বললো, ‘আমিতো কাল সকালে চলেই যাবো। এরপর অনেক দিন দেখা হবেনা।’

মেঘালয় কাছে এসে মিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি কি আমাকে অপরাধী ভাবছ? আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি তোমাকে মানিয়ে নেওয়ার।’
– ‘মানিয়ে নেয়া আর ভালোবাসা একদমই আলাদা জিনিস। আমি একটা কথা ভাবছি।’
– ‘কি?’

মিশু বলল, ‘বিয়ে আরো পনেরো দিন পর। পনেরো দিন আমরা দূরে থাকবো কিন্তু আমরা সময় নেবো দশদিন।’

মেঘালয় অবাক হয়ে বললো, ‘দশদিন মানে! কিসের দশদিন?’

মিশু বললো, ‘এই দশদিন আমাদের যোগাযোগ থাকবে না। এরমধ্যে যদি আমাদের দুজনেরই মনেহয় আমরা একে অপরকে ভালোবাসি, যদি মন থেকে ফিল করতে পারি তবেই আমি আসবো। আর যদি আমাদের মনেহয় মন থেকে ফিলিংস আসছে না, তাহলে বিয়েটা ক্যানসেল করে দিবো অর্থাৎ আমি আর এ বাড়িতে আসবো না। আমরা আলাদা হয়ে যাবো।’

মেঘালয় চমকে উঠলো। আলাদা হয়ে যাবো কথাটা শুনেই বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে চাইলো। অবাক হয়ে তাকালো মিশুর দিকে। এটা কেমন শর্ত? মিশু কি পাগল হয়ে গেলো নাকি?

মিশু বললো, ‘এই কয়েকদিনে আমরা দুজন দুজনকে এতটাই কাছে পেয়েছি যে এতটুকুও দূরত্ব ছিলোনা। কিন্তু দৈহিক আকর্ষণের বাইরেও একটা টান থাকে। স্ত্রী শুধুমাত্র বিছানার সাথী নয়।’
– ‘আমার কোনোকিছুতে কখনো সেটা প্রকাশ পেয়েছে?’
– ‘সেরকম নয়। কিন্তু চোখের দিকে তাকালে বুকটা ধক করে ওঠা, একজন আরেকজনের আত্মাকে অনুভব করা, আত্মার জন্য আত্মার ছটফটানি, সবসময় অস্থির লাগা, এক পলক না দেখলে পাগল হয়ে যাওয়া এই জিনিসগুলোকে মিস করি আমি।’

মেঘালয় কিছু বললো না। অবাক হয়ে তাকিয়েই রইলো মিশুর দিকে। মিশু কি যেন বলতে চেয়েও বললো না। মেঘালয় এগিয়ে এসে মিশুর কাঁধে হাত রাখলো। দুজনে দুদিকে তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে। কেমন যেন লাগছে। একট অশান্তি অনুভব করছে দুজনেই। সবকিছু পেয়েও কি যেন না পাওয়ার অতৃপ্তি গ্রাস করে ফেলেছে ক্রমশই।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here