হৃদমোহিনী
পর্ব ১৭
মিশু মনি
.
মৌনির আচরণে মুগ্ধ সকলেই। মৌনি যখন বসার ঘরে মিশুর বাবা মায়ের সাথে কথা বলছিলো মিশু তখন রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিলো। মৌনি কি পরিমাণ স্মার্ট একটা মেয়ে, ভাবলেই বুকটা কেমন যেন করে। ইচ্ছে করে মৌনির মত হয়ে যাই। যেমনি চলার ভংগী, তেমনি কথা বলার স্টাইল। গলার স্বর আর প্রত্যেকটা উচ্চারণে অন্যরকম মাধুর্যতা ফুটে ওঠে। একবার শুনলেই ইচ্ছে হয় আরো শুনি, এমন স্মার্ট কেন মেয়েটা?

মিশু যখন আনমনা হয়ে এসব ভাবছিলো, পেছন থেকে মেঘালয় জড়িয়ে ধরলো ওকে। চমকে উঠে আয়নায় তাকালো মিশু। আয়নায় দেখতে পাচ্ছে মেঘালয় ওর কাঁধের উপর মাথাটা রেখে আয়নার দিকেই তাকিয়ে ওকে দেখছে। মেঘালয় ভ্রু দুটো নাচালো। মিশু বললো, ‘কি?’
– ‘একটা জিনিস খুব মজার সেটা খেয়াল করেছো?’
– ‘কি জিনিস?’
– ‘খাটো মেয়েকে বিয়ে করলে একটা মজা আছে।’
– ‘কিরকম?’

মেঘালয় মিশুকে আচমকা একবার ঘুরিয়ে সামনা সামনি দাড় করিয়ে নিলো। তারপর বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘জড়িয়ে ধরলে মাথাটা বুকে এসে ঠেকে যায়।’
– ‘কিহ!’

লজ্জায় কথাই বলতে পারলো না মিশু। মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে দুহাতে জাপটে ধরার চেষ্টা করলো। মেঘালয় বললো, ‘লম্বা মেয়েকে বিয়ে করলে সমানে সমান হয়ে যেতাম। জড়িয়ে ধরলে ওর কাঁধে মাথা রাখতে হবে নয়ত মাথাটা রাখতে পারবো না শান্তিমত। অথচ তোমার মাথাটা আমার বুকে এসে ঠেকে যাচ্ছে, আমার শান্তি লাগছে বুকে চেপে ধরতে। আর তোমার ও শান্তি লাগছে আমার বুক বরাবর মাথা রাখতে পেরে।’

মিশু লাজুক স্বরে বললো, ‘আপনি অনেক দুষ্টু।’
– ‘সেটা শুধুমাত্র তুমি জানবে। আর কারো জানার সাধ্য নেই।’
– ‘হুম। সবাই জানে লোকটা কি পরিমাণ সুন্দর, কিন্তু এতটা দুষ্টু সেটা কল্পনাও করা যায়না। ভিজা বিড়ালের মতন।’

মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো,’ প্রথম থেকেই একে অপরকে জড়াজড়ি করে ছিলাম তাইনা? কোলে নেয়া, সিনজিতে বুকে জড়িয়ে ধরা, ট্রেনে বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছো। ট্রাকেও গায়ের সাথে লেপ্টে ছিলে। সবসময়ই একজন আরেকজনকে স্পর্শ করে আছি, সে কারণেই বোধহয় একজন আরেকজনের হয়ে গেছি এত দ্রুত৷ শরীরটা হচ্ছে চুম্বক বুঝলে? বিপরীত ধর্মী চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণ করে।’

মিশু লজ্জায় কিছু বলতে পারল না। মেঘালয় বললো, ‘তুমি সুস্থ এখন?’
– ‘হুম। কেন?’
– ‘তাহলে আজকে রাতে তো তোমার খবরই আছে।’

শিউরে উঠলো মিশু৷ কেঁপে উঠতে লাগলো বারবার। হাতের বাঁধন আলগা হয়ে এলো ওর। মেঘালয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আলতো করে কোলে তুলে নিলো মিশুকে। মিশু দুহাতে মুখ ঢেকে আছে। মেঘালয় ওকে কোলে নিয়েই আয়নার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দেখেছো আমাদেরকে কতটা হ্যাপি কাপল মনেহচ্ছে?’
– ‘উহু আমি দেখবো না।’
– ‘দেখে নাও, দেখে নাও। এক সপ্তাহে তোমার চেহারা চেঞ্জ করে দিবো ‘
– ‘কিভাবে?’
– ‘পুরুষ মানুষের স্পর্শ পেলে কি হয় জানোনা? আকর্ষণীয় বানিয়ে দিবো।’

মিশু দুহাতে কিল বসাতে শুরু করলো মেঘালয়ের বুকে। মারতে মারতে বলতে লাগলো, ‘দেখে মনেহয় সাধুবাবা। কি খারাপ একটা লোক। ছিইহহ ছাড়ুন আমাকে। খুব খারাপ আপনি।’

মেঘালয় হা হা করে হাসছে। পুতুলটাকে কোলে নিয়ে দারুণ মজা লাগছে ওর। মিশু সমানে মারছে আর মেঘালয় হাসছে। এমন সময় মৌনি এসে দাঁড়ালো দরজায়। ওদের দুজনকে এভাবে দেখে বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেলো ওর। ভাইয়া তাহলে মেয়েটাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে! সুখী হলেই হয়, ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসে মৌনি।

মৌনি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আসবো?’
মিশু কোল থেকে নামার জন্য সমানে দুইপা ছুঁড়তে আরম্ভ করেছে। কিন্তু মেঘালয় কোল থেকে কিছুতেই নামাবে না। ও বললো, ‘মৌনি ভেতরে আয়। দরজাটা বন্ধ করে দিস তো।’

মৌনি ভেতরে ঢুকে দরজা লাগানোর পর যখন সামনে তাকিয়ে দেখলো মেঘালয় এখনো মিশুকে কোল থেকে নামায় নি, ওর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। মিশু লজ্জায় মরে যাচ্ছে প্রায়। দুহাতে মুখটা ঢেকে নিশ্চুপ হয়ে আছে। মেঘালয় বললো, ‘বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামাতে ইচ্ছে করছে না। বলতো আমাদের কেমন মানিয়েছে?’
– ‘ভাইয়া, সিরিয়াসলি তোদেরকে যা মানিয়েছে! এনিওয়ে, আমি কি এখন এয়ারপোর্টে গেলে টিকেট পাবো?’

মেঘালয় একটু ভেবে বললো, ‘প্লেনে যাওয়ার চেয়ে বাসে যা। এত তাড়ার কিছু নেই৷’
– ‘বাবা মাকে রাজি করাতে হবে তো৷’
– ‘হ্যা, সেজন্যই বাসে যাবি। বাসে বসে চিন্তা করতে করতে পৌঁছে যাবি।’
– ‘আচ্ছা। রাতের বাসে উঠবো। আরাফ ভাইয়াকে সাথে নিয়ে যাবো?’
– ‘তোর ইচ্ছা৷’

মৌনি ব্যাগ থেকে ওর ফোনটা বের করে দিয়ে বললো, ‘তোর তো ফোন নেই। আমার ফোনটা তোর কাছে রাখ, আমি আরাফের নাম্বার থেকে কল দিবো।’

মৌনি ফোনটা বিছানার উপর রেখে বললো, ‘আমি তাহলে আসি। ভাবি কি মুখ ঢেকেই রাখবে?’

মিশু কি করবে বুঝতে পারলো না। প্রচন্ড লজ্জা লাগছে ওর। ননদের সামনে এভাবে কোলে নিয়ে থাকলে লজ্জা লাগাটাই স্বাভাবিক। তবুও মুখটা ঢেকেই রইলো। বললো, ‘আপু আমি সরি।’

মৌনি হাসতে হাসতে বললো, ‘সরি বলার মত কিছু করোনি। দেখি একটু মুখটা?’

মিশু কিছুতেই মুখ খুলতে চাইছিলো না। এবার আর না খুলে পারলো না। মুখ থেকে হাত সরিয়ে চোখ বন্ধ করেই রইলো। মেঘালয় মিশুকে কোলে নিয়ে বিছানার উপর বসে পড়লো। মিশু বারবার মনে মনে ভাবছে, কোল থেকে নামালে কি হয়? এমন কেন লোকটা?

মিশুকে অবাক করে দিয়ে মৌনি নিজের গলা থেকে একটা স্বর্ণের চেইন খুলে মিশুর গলায় পড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘প্রথম ভাবির মুখ দেখার গিফট এটা৷ আমার ভাইকে বেশি বেশি আদরে রাখবা, সে একটু বেশিই রোমান্টিক। টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স দৌঁড়ের উপর রাখবা ওকে?’

মিশু চোখ মেলে বললো, ‘আমার না লজ্জা করছে। আপনারা এত ভালো কেন?’
– ‘আমার বাসায় গেলে বুঝবা, আব্বু আম্মুও এরকম ফ্রি। এখন ভাবছি কিভাবে বলবো কথাটা৷ ছেলে না জানিয়ে বিয়ে করেছে শুনলে একটু শকড হবে।’

মেঘালয় বললো, ‘যা ঘটেছে সরাসরি সব বলবি। আমি মিশুকে নিয়েই বাকিটা জীবন কাটাতে চাই, মন থেকেই চাই এটাও বলবি।’
– ‘বেশ। সাবধানে থাকিস ভাইয়া৷ তোকে একদিন না দেখলে আমি থাকতে পারিনা রে৷ নিজের খেয়াল রাখিস ‘
– ‘তুইও নিজের খেয়াল রাখিস।’

মৌনি এগিয়ে এসে মিশুর হাতটা ধরে বললো, ‘সামলে রেখো আমার ভাইটাকে৷ ভালোবেসো হ্যা?’

মিশু লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেললো। এখনো মেঘালয়ের কোলে বসে আছে ও। মৌনি বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। মেঘালয় মিশুর মুখটা দুহাতে ধরে একটু কাছে এগিয়ে এনেছে এমন সময় আরাফ এসে বললো, ‘ভাই ভূলে গেলি?’

মেঘালয় ক্ষেপে বললো, ‘বিয়ের পরের দিন বউ ছাড়া বাকি সবাইকে ভূলে যাওয়াটা নৈতিক দায়িত্ব। এর বিরুদ্ধে গেলে বউ মামলা করতে পারে। এবার যা।’

আরাফ হেসে ফেললো। মেঘালয়কে সবাই একটু বেশিই ভালোবাসে। আরাফের ইচ্ছে করছিলো একবার এগিয়ে এসে মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরতে৷ কিন্তু মিশুকে কোলে নিয়ে বসে আছে বলে সেটা করতে পারল না। ও মুচকি হেসে চলে আসলো সেখান থেকে।

ওরা চলে যাওয়ার পর মেঘালয় মিশুকে কোলে নিয়ে এসেই দরজা লাগিয়ে দিলো। মিশু বললো, ‘আপনার লজ্জা করেনা বোনের সামনে এভাবে কোলে নিয়ে থাকতে? কেউ না থাকলে কোলে নিতে পারতেন না? খুব খারাপ আপনি।’

মেঘালয় বিছানায় এসে বসলো। মিশুকে কোলের উপর বসিয়ে নিয়ে বললো, ‘ম্যাডাম, আমি একটু চালাকি করছিলাম বুঝেন নি? আমি তোমাকে বুঝাতে চাইছিলাম যে আমার বোনের চেয়েও আজকে আমি আমার বউকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি, আর মৌনিকে বোঝাতে চাইছিলাম যে এই মেয়েটাকে আমি ভালোবাসতে আরম্ভ করেছি। এটা আমার পুতুল, সারাক্ষণ কোলে বসিয়ে রেখে আদর করার জন্য৷ বুঝলেন?’

মিশু অবাক হয়ে বললো, ‘কি চালাক! আমাকে চালাক বানিয়ে ছাড়বেন মনেহচ্ছে?’
– ‘উহু, তোমাকে আমার বাবুর আম্মু বানাবো।’

মিশু আবারও দুটো কিল বসালো মেঘালয়ের বুকে। মেঘ হেসে বললো, ‘স্বপ্নে দেখেছো কি যেন? আমরা একগাদা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে হানিমুনে গেছি? হা হা হা।’
মিশু লজ্জা পেয়ে বললো, ‘হুম।’
– ‘আচ্ছা একটা হানিমুন করা যাক না। এখানে শান্তিমত প্রেমও করতে পারবো না, শ্বশুর শ্বাশুড়ির সামনে সংকোচ লাগবে। আর এরপর বাসায় আব্বু আম্মু ব্যাপারটা মেনে নেয়ার পরও হানিমুনের কথা তোলা যাবেনা৷ এখনই সেরে ফেলা যায়না?’

মিশু অবাক হয়ে বললো, ‘সবকিছু স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে৷ হুট করেই বিয়ে, হানিমুন। কি থেকে কি হয়ে গেলো!’
– ‘এখনো অনেক সারপ্রাইজ বাকি আছে ম্যাম। ওয়েট।’

মিশু হা হয়ে চেয়ে রইলো। মেঘালয় সত্যিই হানিমুনের ব্যাপারে সিরিয়াস সেটা দেখে অবাক হতেই হলো। মেঘালয় মৌনিকে কল দিয়ে টাকা পাঠানোর ব্যাপারে বলে দিলো। এখন কথা হচ্ছে শ্বশুর শ্বাশুরিকে কিভাবে বলা যায় কথাটা?

২৩.
মেঘালয় সরাসরি মিশুর বাবার পাশে বসে বললো, ‘বাবা একটা কথা বলার ছিলো।’

বাবা মেঘালয় ও মৌনির প্রতি অনেক খুশি হয়েছেন। উনি আগ্রহের সাথে জানতে চাইলেন, কি কথা?

মেঘালয় বললো, ‘মিশুর সাথে অনেক বাজে একটা ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছিলো সেটা তো জানেন। যেকোনো মেয়ের কাছেই ধর্ষণের মত আতংক আর হয়না। অনেক শকড হয়েছে মেয়েটা।’

বাবা একটু চিন্তিত মুখে বললেন, ‘হুম। ওই তন্ময় ছেলেটাকে সামনে পেলে মেরে ফেলতাম আমি।’

মেঘালয় বললো, ‘বাবা এখন আর ওর কথা বলে কিছুই হবেনা। মিশু সুস্থ শরীরে ফিরেছে এটাই অনেক।’
– ‘এরজন্য তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো বাবা। আর এখন তুমিই ওর সবকিছু। আমার মেয়েটাকে একটু আগলে রেখো’
– ‘সেটা আমার দায়িত্ব বাবা। আর গতকাল এরকমভাবে বিয়েটা হলো, মিশু এখনো স্বাভাবিক হতে পারছে না। ওর মনের অবস্থা খারাপ, লোকজন আমাদেরকে এভাবে অপমান করেছে সেটা ভূলতেই পারছে না।’
– ‘হুম। বুঝতে পেরেছি।’
– ‘বাবা আমি সেজন্যই চাচ্ছিলাম ওকে নিয়ে কোথাও গিয়ে দুটো দিন ঘুরে আসতে। আমাকেও মন থেকে গ্রহণ করতে পারছে না, আর ওর মানসিক অবস্থাও ভালো নেই। ঘুরে এলে আশাকরি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’

বাবা একটু নিশ্চুপ থেকে বললেন, ‘হুম এটা ভালো বলেছো। যাও ঘুরে আসো। সমস্যা নেই।’
– ‘আপনাদের আত্মীয় স্বজন কিভাবে নেবে ব্যাপারটা সেটাই ভাবছি।’
– ‘এদিক ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার। শুনলাম তোমার বন্ধুর বিয়ে হচ্ছে, ইচ্ছে হলে বিয়ে বাড়ি থেকে ঘুরে আসো। লোকজনের কথা ধরে চললে তো হবেনা।’

মেঘালয় মনেমনে খুশি হয়ে উঠল। বাবাকে সন্তুষ্ট করতে পেরে আনন্দ হচ্ছে ওর৷ যে কাউকে বশ করতে মেঘালয়ের বেশি সময় লাগেনা। ও হাসিমুখে বললো, ‘বাবা আমরা একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসতে চাইছিলাম।’
– ‘বাইরে বলতে? দেশের বাইরে?’
– ‘না মানে কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসি?’
– ‘আচ্ছা বেশ। যা ভালো মনে করো। তোমার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করতে দ্বিধা নেই আমার।’
মেঘালয় বাবাকে রীতিমতো জাপটে ধরে বললো, ‘আপনি আমার আব্বু, আমার বাবা। মিশুকে নিয়ে কোনোরকম দুশ্চিন্তা করবেন না আপনি।’

বাবা মেঘালয়ের পিঠ চাপড়ে দিলেন।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here