আমি পদ্মজা – ৩৭
_____________________
মদন কিছুতেই যাচ্ছে না। আর পদ্মজা অন্দরমহলের ভেতর ঢুকতে চাইছে না। সে বার বার বলছে, ‘আমি একটু হাঁটব এদিকে। আপনি যান।’
‘রাইতের বেলা একলা থাকবেন। আমার কাম আপনারারে দেইখা রাখা।’
‘এদিকে তো আলো জ্বলছে। উনিও আসবেন এখন। আপনি যান। আর আপনার পা তো কাদামাখা। বেশিক্ষণ এভাবে না থেকে ধুয়ে আসুন।’
মদন পায়ের দিকে তাকাল। লুঙ্গি হাঁটু অবধি তুলে বেঁধে রাখা। সে হেসে বলল, ‘আইচ্ছা তাইলে আমি ধুইয়া আইতাছি। বেশিখন(বেশিক্ষণ) লাগব না।’
‘আচ্ছা,আসুন।’
মদন চলে যেতেই পদ্মজা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। গলার মাঝে যেন কাঁটা বিঁধে ছিল। বাড়ির পিছনে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দেখলে পেল আমিরকে। আমির আলগ ঘর পেরিয়ে এদিকেই আসছে। পদ্মজা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারল না। আলগ ঘরের দিকে চেয়ে রইল। আমির পদ্মজাকে দেখতে পেয়ে লম্বা করে হাসল। বলল, ‘পদ্মবতী কী আমার জন্য অপেক্ষা করছে?’
‘বোধহয় করছি।’
আমির ভ্রুকুটি করে বলল, ‘বোধহয় কেন?’
‘ঘরে একা ভালো লাগছিল না। তাই হাঁটতে বের হয়েছিলাম। আপনি নামায পরেছেন?’
‘এইযে মাথায় টুপি। মসজিদ থেকে আসলাম।’
পদ্মজা আড়চোখে অন্দরমহলের ডান দিকে তাকায়। সেখানে কী সে যেতে পারবে না? পদ্মজা উসখুস করতে থাকল। আমির পদ্মজাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। আমিরের কাজে পদ্মজা হতভম্ব হয়ে গেল। দ্রুত এদিকওদিক তাকিয়ে দেখল,কেউ আছে নাকি। এরপর আমিরের হাতের বাঁধন ছুটানোর চেষ্টা করতে লাগল। আর বলল, ‘ছাড়ুন,কেউ দেখবে। ‘
‘কেউ দেখবে না। এদিকে কেউ নেই।’ আমিরের কণ্ঠ মোহময়। সে পদ্মজার ঘাড়ে থুতুনি রাখল। এরপর ঠোঁটের ছোঁয়া লাগাতেই পদ্মজা কেঁপে উঠল। জোর করে আমিরের হাতের বাঁধন ছুটিয়ে সরে গেল। বলল, ‘আপনি ঘরে যান।’
‘আচ্ছা,চলো।’
‘আপনি যান,আমি আসছি।’
‘কেন? তুমি কোথায় যাবে?’
পদ্মজা নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবল। এরপর বলল, ‘আলগ ঘরে যাব। আপনি ঘরে যান। নয়তো আম্মা আমাকে খুঁজবে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসব। এরপর সব বলব।’
‘আরে, কী করবে বলবে তো।’
‘আপনি যান না।’
পদ্মজা ঠেলে আমিরকে অন্দরমহলের দিকে পাঠাল। আমির অসহায় মুখ করে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমিও থাকি?’
‘আপনি ঘরে গিয়ে বসবেন আর আমি চলে আসব।’
পদ্মজার অনুরোধ ফেলা যাচ্ছে না। আমির না চাইতেও অন্দরমহলে চলে গেল। পদ্মজা এক নিঃশ্বাসে দৌড়ে অন্দরমহলের ডান পাশে চলে আসে। সঙ্গে,সঙ্গে রানির মুখোমুখি হয়। রানি ও পদ্মজা একসাথে কেঁপে উঠল। দুজন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। রানিই আগে কথা বলল, ‘রাইতের বেলা এমনে ছুটতাছো কেন?’
পদ্মজার মাথা থেকে ঘুমটা পরে গেছে সেই কখন। দৌড়ে আসাতে চুলের খোঁপাও খুলে গেছে। গাছ-গাছালির বাতাসে তিরতির করে চুল উড়ছে। তবুও সে ঘামছে। আমতাআমতা করে বলল, ‘আ…আমি তো হাঁটতে বের হয়েছি। জোনাকি দেখলাম এদিকে। তাই নিতে এসেছি।’
‘ওহ। কই জোনাকি। নাই তো।’
‘একটু আগেই ছিল।’
‘এহন তো নাই। রাইতের বেলা একলা থাকবা কেন। আসো ঘরে যাই।’
‘তুমি কোথায় গিয়েছিলে রানি আপা? সন্ধ্যার আযানের আগে তোমার ঘরে গেলাম। পেলাম না। এদিক দিয়ে কোথাও ছিলে? কিন্তু এদিকে তো ঝোপঝাড়,জঙ্গল।’
পদ্মজার প্রশ্নে রানির মুখ রক্তিম হয়ে উঠল। কেমন অস্বাভাবিক হয়ে উঠে মুখ। সে অপ্রস্তুত হয়ে হাসল। কী বলবে খুঁজছে যে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। পদ্মজা অপেক্ষা করছে,রানি কী বলে শোনার জন্য। পদ্মজা ডাকল, ‘আপা?’
‘আরে আমি ঔষধ খুঁজতে আসছিলাম।’
‘কী ঔষধ?’
‘তুমি চিনবা না। আসো বাড়িত যাই। মেলা রাইত হইয়া গেছে।’
রানি পদ্মজাকে রেখে এগোতে থাকল। এটাকে পালিয়ে যাওয়া বলে। পদ্মজা আর থেকে কী করবে! সেও রানির পিছু পিছু অন্দরমহলে চলে আসে। ঘরে ঢুকতেই আমির হামলা করে, ‘এবার কাহিনি কী বলো তো।’
‘বিশ্বাস করবেন?’
‘তোমার কথা বিশ্বাস করব না, এ হয়?’
‘রানি আপা প্রায় জঙ্গলের ভেতর যায়। আমি জানালা থেকে দেখি। উনি এমন ভাবে যান যেন চুরি করতে যাচ্ছেন।’
আমির শুনে অবাক হলো। সে চাপা স্বরে প্রশ্ন করল,’সত্যি! প্রায়ই যায়?’
‘আমি সত্যি বলছি।’
আমির চিন্তিত হয়ে কিছু ভাবে। কপালের চামড়া কুঁচকে গেছে। গভীর ভাবনায় বিভোর সে। পদ্মজা বলল, ‘আমি আজ অনুসরণ করে জঙ্গল অবধি গিয়েছিলাম। মদন ভাইয়ার জন্য ভেতরে ঢুকতে পারিনি। এরপর আপনি এলেন। পরে আবার যেতে চেয়েছি। কিন্তু ততক্ষণে রানি আপা চলে এসেছে। সরাসরি প্রশ্নও করেছি, কেন জঙ্গলে গিয়েছিল। বলল, ঔষধ আনতে। মানে কোনো ঔষধি পাতা। কিন্ত আমার বিশ্বাস হয়নি। প্রায়ই কেন কেউ ঔষধি পাতা আনতে যাবে? আবার ভোরে আর রাতে।”
পদ্মজা এক দমে কথা গুলো বলল। আমির বলল, ‘আব্বাকে বলতে হবে।’
‘আগে শুনুন?’
‘বলো?’
‘এখন কাউকে বলবেন না।’
‘বলা উচিত। ব্যাপারটা জটিল মনে হচ্ছে।’
‘আমরা আগে বের করি কী হয়েছে? কী করতে যায়। এরপর নিজেরা সমাধান করতে পারলে করব। নয়তো বড়দের বলব। যদিও আমরা নিশ্চিত না কোনো সমস্যা আছে।’
‘অবশ্যই সমস্যা আছে। তুমি জানো, ওদিকে কোনো মহিলা ভুলেও যায় না। যেতে চায় না ভয়ে। সেখানে রানি যায়। বড় কোনো কারণ আছে।’
‘আমরা বের করি সেটা?’
‘কীভাবে?’
‘আমার মনে হচ্ছে আবার যাবে। কাল-পরশুর মধ্যে। আমরা পিছুপিছু যাব।’
‘খারাপ বলোনি।’
‘কাউকে বলবেন না এখন, অনুরোধ।’
আমির হাসল। পদ্মজার কোমর পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,’বলব না।’
‘আপনি কারণে-অকারণে ছোঁয়ার বাহানা খুঁজেন।’
‘এতে পাপ তো নেই।’
‘খাওয়ার সময় হয়েছে। চলুন। ঠিক সময়ে না গেলে আম্মা চিল্লাবেন।’
‘আম্মারা চিল্লায়ই। তোমাকে খয়েরি রঙে বেশি সুন্দর লাগে।’
‘আমি তো খয়েরি শাড়ি পরিনি।’
‘পুরো কথা বলতে দাও।’
‘আচ্ছা,বলুন।’
‘আর, কালো রঙে আবেদনময়ী লাগে। আকর্ষণীয়।’ আমির ফিসফিসিয়ে কথাটা বলল। পদ্মজার কানে,ঘাড়ে আমিরের নিঃশ্বাস ছিটকে পড়ে। সে ঘুরে আমিরের দিকে তাকায়। আবার চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘আপনি সবসময় আকর্ষণীয়।’
আমির হইহই করে উঠল,’সত্যি? কত,কত দিন পর একটু প্রশংসা করলে। আল্লাহ!’
পদ্মজা মৃদু আওয়াজ করে হাসল। বলল, ‘প্রশংসা শুনতে খুব ভালোবাসেন?’
‘অবশ্যই। তবে বউয়ের প্রশংসা করতে আরো বেশি ভালবাসি।’ আমির আরো শক্ত করে পদ্মজার কোমর আঁকড়ে ধরে। পদ্মজা আমিরের দুই হাতে ধরে বলল, ‘আপনি সবসময় এতো শক্ত করে কেন ধরুন? গায়ের জোর দেখান?’
‘কেন? ভালো লাগে না?’
‘মোটেও না। আদর করে ধরবেন।’
আমির হাতের বাঁধন কোমল করে দিয়ে বলল,’লজ্জার ছিটেফোঁটাও গিলে ফেলছো দেখছি।’
‘বিয়ের এতদিন পরও কোন মানুষটা লজ্জা পায় আমাকে দেখাবেন। আমি অতো ভং ধরতে পারব না।’
‘কী ঝাঁঝ কথায়।’
‘এবার ছাড়ুন।’
‘ইচ্ছে হচ্ছে না।’
‘আবার শক্ত করে ধরেছেন।’
‘যদি দৌড়ে পালাও?’
‘পালিয়ে আর যাব কতটুকু?’
আমির পদ্মজাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে এক হাতে কোমর চেপে ধরল। তখনই লতিফা হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে। পদ্মজা,আমির দুজন দুদিকে ছিটকে যায়। আমির ধমকে উঠল,’লুতু,কতবার বলছি না বলে ঘরে ঢুকবি না। আমাদের তো নতুন বিয়ে হয়েছে নাকি?’
পদ্মজা খেয়াল করে আমির কথাগুলো রাগে বলার চেষ্টা করলেও রাগের মতো হয়নি। পদ্মজার হাসি পেল। লতিফার মুখের অবস্থা দরজার চিপায় পড়ার মতো। সে আমিরকে ভীষণ ভয় পায়। কাচুমাচু হয়ে বলল,’খালাম্মা খাইতে যাইতে কইছে।’
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here