আমি পদ্মজা – ৩৫
__________________
বাসন্তী গাঢ় করে ঠোঁটে লিপস্টিক দিচ্ছেন। প্রেমা,প্রান্ত বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছে। তারা দুজন বাসন্তীকে মেনে নিয়েছে। বাসন্তীর কথাবার্তা, চালচলন আলাদা। যা ছোট দুটি মনকে আনন্দ দেয়। আগ্রহভরে বাসন্তীর কথা শুনে তারা। লিপস্টিক লাগানো শেষ হলে বাসন্তী প্রেমাকে বলল, ‘তুমি লাগাইবা?’
প্রেমা হেসে মাথা নাড়ায়। বাসন্তীর আরো কাছে ঘেঁষে বসে। বাসন্তী প্রেমার ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক গাঢ় করে ঘষে দিল। এরপর প্রান্তকে বলল, ‘তুমিও লাগাইবা আব্বা?’
‘জি।’ বলল প্রান্ত। প্রেমাকে লিপস্টিকে সুন্দর লাগছে। তাই তারও ইচ্ছে হচ্ছে।
বাসন্তী প্রান্তর ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়ার জন্য উঁবু হোন। পূর্ণা বেশ অনেকক্ষণ ধরে এসব নাটক দেখছে। এই মহিলাকে সে একটুও সহ্য করতে পারে না। এক তো সৎ মা। বাপের আরেক বউ। তার উপর এই বয়সে এসে এতো সাজগোজ করে। প্রান্তকে লিপস্টিক দিচ্ছে দেখে তার গা পিত্তি জ্বলে উঠল। ঘর থেকে দপদপ করে পা ফেলে ছুটে আসে। প্রান্তকে টেনে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘হিজরা সাজার ইচ্ছে হচ্ছে কেন তোর? কতবার বলছি এই বজ্জাত মহিলার সাথে না ঘেঁষতে?’
বাসন্তী ভয় পান পূর্ণাকে। মেয়েটা খিটখিটে, বদমেজাজি। হেমলতা বলেছেন, সেদিনের দূর্ঘটনার পর থেকে পূর্ণা এমন হয়ে গেছে। হুটহাট রেগে যায়। কথা শুনে না। পদ্মজা যাওয়ার পর থেকে আরো বিগড়ে গেছে। এজন্য যথাসম্ভব পূর্ণাকে এড়িয়ে চলেন। তবুও এসে আক্রমণ করে বসে। গত দুই সপ্তাহে মেয়েটা অতিষ্ঠ করে তুলেছে জীবন। তিনি কাটা কাটা গলায় পূর্ণাকে বললেন, ‘এই ছিক্ষা পাইছো তুমি? গুরুজনদের সাথে এমনে কথা কও।’
‘আপনি চুপ থাকেন। খারাপ মহিলা। বুড়া হয়ে গেছে এখনও রঙ-ঢঙ করে।’
পূর্ণার কথা মাটিতে পড়ার আগে তীব্র থাপ্পড়ে সে মাটিতে উল্টে পড়ল। চোখের দৃষ্টি গরম করে ফিরে তাকায় সে, দেখার জন্য, কে মেরেছে তাকে! দেখল হেমলতাকে। হেমলতা অগ্নি চোখে তাকিয়ে আছেন। যেন চোখের দৃষ্টি দিয়ে পূর্ণাকে পুড়িয়ে ফেলবেন। পূর্ণার চোখ শিথিল হয়ে আসে। সে চোখ সরিয়ে নেয়। হেমলতা বললেন, “নিজেকে সংশোধন কর। এখনও সময় আছে।’
পূর্ণা নতজানু অবস্থায় বলল, ‘আমি এই মহিলাকে সহ্য করতে পারি না আম্মা।’
‘করতে হবে। উনার অধিকার আছে এই বাড়িতে।’
‘আমি খুন করব এই মহিলাকে।’ পূর্ণার রাগে শরীর কাঁপছে।
পূর্ণার অবস্থা দেখে হেমলতার দৃষ্টি গেল থমকে। পূর্ণা কেন এমন হলো? তিনি কী এক মেয়ের শূন্যতার শোক কাটাতে গিয়ে আরেক মেয়েকে সময় দিচ্ছেন না। বুঝিয়ে, শুনিয়ে পূর্ণাকে আবার আগের মতো করতে হবে। তিনি কণ্ঠ খাদে নামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এরপর পূর্ণা যা বলল তিনি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। পূর্ণা বাসন্তীকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বেশ্যার মেয়ে বেশ্যাই হয়। আর বেশ্যার সাথে এক বাড়িতে থাকতে ঘৃণা করে আমার।’
হেমলতা ছুটে যান বাইরে। বাঁশের কঞ্চি নিয়ে ফিরে আসেন। বাসন্তী দ্রুত আগলে ধরেন পূর্ণাকে। হেমলতাকে অনুরোধ করেন, ‘এত বড় ছেড়িডারে মাইরো না। ছোট মানুছ। বুঝে না।’
‘আপা, আপনি সরেন। ও খুব বেড়ে গেছে।’
বাসন্তীর স্পর্শ পূর্ণার ভালো লাগছে না। সে ঠেলে সরিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পূর্ণার পিঠে বারি মারলেন। পূর্ণা আর্তনাদ করে শুয়ে পড়ে। হেমলতা আবার মারার জন্য প্রস্তুত হোন, বাসন্তী পূর্ণাকে আগলে বসেন। অনুরোধ করেন, ‘যুবতি ছেড়িদের এমনে মারতে নাই। আর মাইরো না।’
প্রেমা,প্রান্ত ভয়ে গুটিয়ে গেছে। হেমলতার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। তিনি বাঁশের কঞ্চি ফেলে লাহাড়ি ঘরের দিকে যান। বারান্দায় বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মনে মনে মোর্শেদের উপর ভীষণভাবে ক্ষেপে যান। মোর্শেদ চিৎকার করে করে বাসন্তীর সম্পর্কে সব বলেছে বলেই তো পূর্ণা জেনেছে। আর তাই এখন পূর্ণা কারো অতীত নিয়ে আঘাত করার সুযোগ পাচ্ছে। মোড়ল বাড়ির ছোট সংসারটা কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে। হেমলতা আকাশের দিকে তাকিয়ে হা করে নিঃশ্বাস নেন। সব কষ্ট,যন্ত্রণা যদি উড়ে যেত। সব যদি আগের মতো হয়ে যেত। সব কঠিন মানুষেরাই কী জীবনের এক অংশে এসে এমন দূর্বল হয়ে পড়ে? কোনো দিশা খুঁজে পায় না?
__________________
আমির বিছানায় বসে উপন্যাসের বই পড়ছে। ছয়দিন পর পদ্মজার মেট্রিকের ফলাফল। এরপরই ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হবে। যদিও ফরিনা বেগম রাজি নন। কিন্তু আমির মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সে পদ্মজাকে রাজধানীতে নিবেই। পদ্মজার কথা মনে হতেই আমির বই রেখে গোসলখানার দরজার দিকে তাকাল। তার ঘরের সাথে আগে গোসলখানা ছিল না। পদ্মজার জন্য করা হয়েছে। সে বই রেখে সেদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। তখনি পদ্মজা চিৎকার করে উঠল। তাই দ্রুত দৌড়ে গেল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। পদ্মজা শাড়ি দিয়ে শরীর ঢেকে রেখেছে। কিছুটা কাঁপছে। আমির দ্রুত কাছে এসে বলল, ‘কী হয়েছে?’
‘ওখানে,ওখানে কে ছিল। আ…আমাকে দেখছিল।’
পদ্মজার ইঙ্গিত অনুসরণ করে আমির সেদিকে তাকাল। গোসলখানার ডান দেয়ালের একটা ইট সরানো। সকালে তো সরানো ছিল না! পদ্মজা কাঁদতে থাকল। কাপড় পাল্টাতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়ে দেয়ালে। আর তখনই দুটি চোখ দেখতে পায়। সে তাকাতেই চোখ দুটি দ্রুত সরে যায়। পদ্মজার পিল চমকে উঠে। আমির পদ্মজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘শুকনো কাপড় পরে আসো। কেঁদো না।’
কথা শেষ করেই সে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার তাড়া দেখে মনে হলো, অজ্ঞাত আগন্তুককে আমির চিনে। পদ্মজা দ্রুত কাপড় পরে নিল। এরপর আমিরকে খুঁজতে থাকল। আমির সোজা রিদওয়ানের ঘরের দিকে যায়। রিদওয়ান পানি পান করছিল। আমির গিয়ে রিদওয়ানের বুকের শার্ট খামচে ধরে। চিৎকার করে বলল, ‘তোকে সাবধান করেছিলাম। দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছিলাম।’
‘শার্ট ছাড়।’
‘ছাড়ব না। কী করবি? তুই আমার বউয়ের দিকে কু-নজর দিবি আর আমি ছেড়ে দেব?’
‘প্রমাণ আছে তোর কাছে?’
‘কুত্তার বাচ্চা,প্রমাণ লাগবে? আমি জানি না?’
‘আমির মুখ সামলা। গালাগালি করবি না।’
‘করব। কী করবি তুই?’
‘আবার বলছি,শার্ট ছাড়।’
আমির ঘুষি মারে রিদওয়ানের নাকে। রিদওয়ান টাল সামলাতে না পেরে পালঙ্কের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। চিৎকার, চেঁচামিচি শুনে বাড়ির সবাই রিদওয়ানের ঘরে ছুটে আসে।
চলবে….