#তোর_নামের_রোদ্দুর
পর্বঃ২১

লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা

পড়ন্ত বিকেল।শেষ বিকেলের স্তিমিত হয়ে আসা রোদ্দুরের আলোতে বাইক ছুটেছে।আর হেলমেটের মধ্যে থেকে চোরের মতো আমার নির্লজ্জ চোখজোড়া আয়নায় থাকা শুদ্ধের প্রতিবিম্ব দেখে চলেছে অনবরত।মাস্ক,সানগ্লাস,চেনা যাচ্ছে না ওনাকে একদম।কিন্তু তাকে জরিয়ে রাখা হাত যে হৃদস্পন্দন অনুভব করছে,তা বারবারই বলে চলেছে,শুদ্ধ শুধু সিয়ার।শুধুই তার শ্যামাপাখির।আর সেটা তুই ইনসিয়া।তুই!

-জিজ্ঞেস করলি না কোথায় যাচ্ছি?

চোখ সরিয়ে নিলাম আয়না থেকে।নিজেকে সামলে নিচদিক তাকিয়ে তার বুলিই আওড়ালাম।

-কোথায় যাচ্ছি?

-এমন কোথাও,যেখান থেকে বাসায় ফেরার রাস্তা খুজে না পাই,যেনো দুজন হারিয়ে যাই।

একপলক তার দিকে তাকিয়ে আশপাশটায় এতোক্ষনে চোখ বুলালাম আমি।মোটামুটি ফাকা রাস্তাতেই বাইকটা।মাঝে মধ্যে দু একটা বাস,ট্রাক আর বাইক চলছে।মনে হচ্ছে শহরের বাইরে চলে এসেছি আমরা।রাস্তার এপাশ ওপাশে বহুতল দালান কিছুই নেই।শুধুই গাছ।সত্যিই তো!কোথায় যাচ্ছি আমরা?প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে,তবুও প্রশ্নের সাথে সময়টাকে ভাসাতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছে না।আরেকটু খামচে শুদ্ধর জ্যাকেট ধরে নিচদিক তাকিয়ে তার অলক্ষ্যে হাসলাম শুধু।হয়তো তাতে লাজুকতা মিশ্রিত ছিলো।ভাগ্যিস হেলমেটটা ছিলো।তোর সে হাসি শুদ্ধ দেখলে তুই নিজেকে কি করে সামলাতি ইনসু?

.
চোখের সামনে বিস্তৃত ধানক্ষেত।যতোদুর চোখ যায়,শুধু সবুজ আর সবুজ।পশ্চিমদিকের সে সবুজ চাদরের প্রান্ত ছুয়ে ঢলতে শুরু করেছে লালাভ সূর্য।সে কিনারার শুধু কটা হেলানো নারিকেল গাছের অবয়ব দেখা যায়,বাকি গাছগুলো অন্ধকারে ছেয়ে এক হয়ে গেছে।আকাশে গোধুলির রঙিন আভা।রক্তিম সূর্যটার একদম কাছ দিয়েই যেনো একঝাক পাখি উড়ে গেলো মনে হলো।বাতাসটাও বেশ।ফাকা রাস্তা,দুপাশে ধানক্ষেত,বাধাহীনভাবে বয়ে চলে শরীর ছুয়ে দিয়ে যাচ্ছে।

জনকোলাহল একদমই নেই।শুধু পিছন দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ দু একটা গাড়ির হর্ন শোনা যায়।একপায়ে ভর করে ডানহাতে বামহাতের কনুই ধরে অস্তগামী সূর্যকে সবুজ চাদরে ঢুব দিতে দেখছি।কোনো বিশেষ ইন্দ্রিয় আমাকে জানান দিচ্ছে,পিছনে থাকা বাইকটায় সানগ্লাস,মাস্ক খুলে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে শুদ্ধ আমাকেই দেখছেন আর মুচকি হাসছেন।পিছন ফিরতেই আমার কল্পনার বাস্তব চিত্র ভেসে উঠলো।কিন্তু তা যে আরো বেশি মনমোহিনীকে মোহে ফেলে দেওয়ার মতো,সেটা জানলে পিছন ফিরতাম না আমি।শুদ্ধর চুলগুলো বাতাসে উড়ছে।সত্যিই উনি বাইকে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে,আমার দিকে তাকিয়ে।আর তার সেই হাসি!চোখ নামিয়ে নিলাম।উনি এগিয়ে এসে বললেন,

-হাটি আমরা?

মাথা নাড়িয়ে পা বাড়ালাম তার সাথে।দু পা হাটতেই মনে হলো হাটার অবস্থায় নেই আমি।থেমে গিয়ে অসহায়ভাবে পায়ের জুতোজোড়ার দিকে তাকালাম।আমি পাঁচ ফুট তিনের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও আমার চেয়ে শুদ্ধর হাইট অনেক বেশি।ঘাড় উচু করে দেখতে হয় তাকে।বিয়ের রাতেই উনি লিলিপুট বলেছিলেন আমাকে।ওনার সাথে বেরোবো বলে তাই উচু জুতা পরে এসেছিলাম।কিন্তু হাটতে কষ্ট হচ্ছে এখন।আচমকাই শুদ্ধ নিচে বসে যেতেই লাফিয়ে পিছিয়ে গেলাম।শুদ্ধ মাথা তুলে বললেন,

-এটাতে হাটতে কষ্ট হচ্ছে তোর আমি জানি।খোল ওটা।

যেহেতু মিস্টার বলেছেন,সেহেতু এটা করতেই হবে আমাকে।ত্যাড়ামো করলে না জানি কি করে বসে এখানে।তাই চুপচাপ জুতা খুলে হাতে নিলাম,তারপর আবারো হাটা লাগালাম।উঠে দাড়িয়ে শুদ্ধ পাশে হাটতে হাটতে বললেন,

-কিছু খাবি?ফুচকা?আইসক্রিম?

অবাক হইনি আজ।কোথাও কোথাও যেনো জানতাম উনি জানেন কি পছন্দ আমার।পরক্ষনেই মনে পরলো এ দুটো মেয়েদের কমন পছন্দের খাবার।কিছুটা বিরক্তি দেখিয়ে বললাম,

-না।

-ওকে।

উনি চুপচাপ হাটতে লাগলেন।রাগ হলো আমার।বললাম আর মেনে নিলো?

-এখানে কোথায় পাবেন আপনি ওগুলো?

আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,

-তুই চাইলেই পেয়ে যেতাম এখানেই কোথাও।

তার প্রতিটা কথায় প্রশান্তি অনুভব করছি আজ আমি।উড়তে থাকা চুলগুলো কানে গুজে সামনে তাকিয়ে দেখলাম,বেশ খানিকটা দুরেই কয়েকটা দোকান।মুখের হাসি নিমেষেই গায়েব।ও!তারমানে উনি জানতেন এদিক দোকান আছে।এখান থেকেই নিতেন উনি তারমানে।আর আমি মাথামোটা ভাবলাম,কথাটা এভাবে ছিলো,” সিয়া,তুই চাইলে সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার করে ফুচকা আইসক্রিম নিয়ে আসবো “।ধুরু!লোকটা অতিরিক্ত চালাক!

-কয়বার এসেছেন এদিক?

-বহুবার।

-কার সাথে?

-ফ্রেন্ডস্ দের সাথে।

ফ্রেন্ডস্?তারমানে অনেকগুলোর সাথে।মেয়ে বান্ধবীও ছিলো?কয়টা?কার কার সাথে ঘুরেছেন উনি?সুন্দরী মেয়েবান্ধবী?মেয়েগুলো কি খুব গায়েপরা ছিলো?কি ভাবে মিশতো ওরা শুদ্ধের সাথে?খুব ক্লোজ ছিলো?ওদের কি…

-মেয়েদের নিয়ে কখনই ক্যাম্পাসের বাইরে বেরোতাম না আমি।আর কথা বলতে শুধু ক্লাস আর বাদাম খাওয়া আড্ডায়।এর বেশি কিছু না।

ঠোটের কোনে হাসি ফুটলো এতোক্ষনে।ওয়েট!উনি এসব কেনো বললেন আমাকে?চোখ বড়বড় করে তাকালাম তার দিকে।উনি নিচের মাটিতে কিছু একটাতে একটা লাথি মেরে বললেন,

-ডোন্ট বি সো জেলাস!বলেছি তো,তোর জায়গাটা আলাদা।

ইশ্!এবার অস্বস্তি হচ্ছে।এই লোকটা সবটা টের পেয়ে যায় কিভাবে?আমি সত্যিই কি জেলাস হচ্ছিলাম?কেনো হচ্ছিলাম?কথা ঘোরাতে বললাম,

-ফ্রেন্ড বলতে আয়ান ভাইয়ার সাথে এসেছিলেন?

থেমে গেলেন উনি।মুহুর্তেই বদলে গেলো ওনার চেহারার ভাব।চোখ বন্ধ করে হাত মুঠো করে দুবার শ্বাস নিলেন শুদ্ধ।এমন করার কারন না বুঝে তার দিকেই তাকিয়ে আমি।উনি আবারো হাটতে হাটতে বললেন,

-হঠাৎ ওর কথা?

-ন্ না মানে,তাকে তো চিনি শুধু।তাই…

-আই হ্যাড হিউজ সার্কেল।

-হ্যাড?

শুদ্ধর ঠোটে তাচ্ছিল্য হাসি।চাপা কষ্ট নাড়া দিয়ে উঠেছে যেনো।কিন্তু আমি তো চাইনি কষ্ট দিতে ওনাকে।পাশ দিয়েই এক মামা কাধে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে যাচ্ছিলেন।থেমে গিয়ে চেচিয়ে উঠলাম,

-হাওয়াই মিঠাই খাবো!

শুদ্ধও দাড়িয়ে গিয়ে কপাল কুচকে জিজ্ঞাসা করলেন,

-হোয়াটস্ দ্যাট?

আঙুল দিয়ে দেখালাম ওনাকে।শুদ্ধ একটা কনফিউজড্ লুক দিয়ে বললেন,

-এটা খাওয়ার জিনিস?এইটা তো ভেবেছিলাম ঘর সাজানোর কিছু!

ওনার কথায় খিলখিলিয়ে জোরে হেসে দিলাম আমি।কিছুক্ষন তাকিয়ে দেখে মাথা চুলকে উনিও হাসলেন।ভালো লাগছিলো তার ওই হাসিটা।এগিয়ে গিয়ে পাঁচটা কিনে হাতে দিলেন।তারপর দাড়িয়ে গেলাম আবারো রাস্তার পাশটাতেই।

.
মাগরিবের আযান পরেছে বেশ অনেকক্ষন।রাত!তবুও ভয় করছে না।অন্ধকারে ভয় আমার।তবে চারপাশে আলোর অভাব নেই।পাশের এক ছোট ঝুপড়ির মতো স্টলের আবছা আলো,রাস্তায় চলা দু চারটে গাড়ির হেডলাইট,সন্ধ্যাতারা,আর দুরের কোনো ঘরবাড়ির ছোটছোট আলো।
চাঁদ ওঠেনি আজ।তবে পৃথিবীর সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর আলো জোনাকির আলোটা বাকি সবকিছুকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।হাওয়াই মিঠাই এর প্যাকেটগুলো বুকে জরিয়ে জোনাকির আলো খেলা দেখছি।শুদ্ধ পাশে দাড়িয়ে।অনেকটা সময় পর উনি বলে উঠলেন,

-তোর যীনাত আপুর পাঁচবছর আগের বার্থডের কথা মনে আছে?

পাশে তাকালাম।শুদ্ধ আমার দিক ফিরে।স্টলের হলদে আলোতে দেখা যাচ্ছে তার মুখ।এতোক্ষনে মনে হলো দেখার মতো আসল জিনিসটাই হয়তো উপেক্ষা করছি আমি।মস্তিষ্ক বলছে,পাশে তাকা।জোনাকির আলো,অন্ধকারে ডোবা ধানক্ষেত,উজ্জল সন্ধ্যাতারা,পৃথিবী সুন্দর ইনসু।কিন্তু মন বলছে,তোর দৃষ্টি তোর এই পৃথিবীতেই স্থির থাক।যেখানে শুদ্ধ নামক মানুষটার হাসিতে নিজেকে বিলীন করার ইচ্ছে জাগে।অন্য কোনোদিক তাকাস না তুই।তাকাস না!

শুদ্ধ ভ্রু উচিয়ে তার প্রশ্নের জবাব চাইলেন।ধ্যান ভাঙলো আমার।যীনাত আপু জন্মদিন পালন করে না কয়েকবছর হলো।ওর নাকি ভালো লাগে না আর।বড় হয়ে গেছে,লোকে কী বলবে,এসব বলে।তবুও আমরা কাজিনরা মিলে মোটামুটি সবারই বার্থডে সেলিব্রেট করেই থাকি।সেটাও খুব বিশেষ বিশেষ উপায়ে।সেই ট্রেন্ডে করে থাকবো হয়তো পাঁচবছর আগেও।কিছুদিন আগেরগুলো মনে আছে,পাঁচবছর আগেরগুলো কোথ্থেকে মনে রাখবো?

-মনে নেই?

মাথা নেড়ে না বুঝালাম।শুদ্ধ শব্দহীন হেসে বললেন,

-শেহনাজ মন্জিলের সেবারের জার্নি আমার জীবনকে ঝড়ের বেগে বদলে দিয়েছিলো জানিস?পড়াশোনার ব্যস্ততাকে একটু বুড়ো আঙুল দেখাতে আব্বু আম্মুর সাথে তিন বছর পর গিয়েছিলাম ওখানে।কিন্তু সেই সন্ধ্যেই যে আমার জীবনকে এভাবে উল্টেপাল্টে দেবে,ভাবতে পারিনি।

কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে তার দিকে আমি।শুদ্ধ দুহাত প্যান্টের পকেটে গুজে দাড়িয়ে সামনে তাকিয়ে বললেন,

-বরাবরই আদরের ছিলাম সবার।হুহ!আসাদুজ্জামান আজাদের একমাত্র ছেলে বলে কথা!শেহনাজ মন্জিলে যাতায়াত ছোটবেলা থেকে কমই ছিলো।আগের সময়গুলোর কথা বলতে পারবো না।কিন্তু সেবার যখন গিয়েছিলাম,কিছুতো আলাদা ছিলো।আঠারো উনিশের যুবা বয়স যাকে বলে।একটু এলোমেলো,উচ্ছল,মুডি,এইসব।মেয়েদের এভোয়েড করে পাশ কাটিয়ে আসাটা আমার ভালোলাগতো।বিশেষ করে যারা আমাকে পছন্দ করতো।ওদের পাত্তা না দিয়ে চলে আসায় পৈশাচিক আনন্দ পেতাম।হবি ছিলো আমার একপ্রকার।

সোজা কথায় বললেই হয় সব মেয়েদের ক্রাশ ছিলো,তবে পাত্তা দিতো না।এটিচিউড বয় ছিলো।ইহ!নিজে ওমন সেজে বেরোলে মেয়েদের কি দোষ!অবশ্য আমি তো ওমন না।কোনোদিন ওনার দিকে ভয়ে সেভাবে তাকাইই নি,আবার…আচ্ছা? উনি কি ঢপ দিচ্ছেন আমাকে?

-জানিস সিয়া,সেই আমিই সেদিন একজনের কাছে আটকে গিয়েছিলাম।প্রথমবারের মতো।তার হাসিতে।শেহনাজ মন্জিল যাওয়ার পথে জ্যাম পরে।বিরক্তি নিয়ে গাড়িতে বসে মোবাইল ঘাটছিলাম।কিছু একটা মনে করে জানালাটা তুলে দিতেই গাড়ির হর্ন ছাপিয়ে কারো কলকল হাসির আওয়াজ কানে আসলো আমার।চোখটা মোবাইলেই ছিলো,কিন্তু আওয়াজটা ঝংকার তুলে দিয়েছিলো সারা শরীরে।এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো,জীবনের শ্রেষ্ঠ স্বর শুনলাম আমি।
তাড়াতাড়ি বাইরে তাকালাম।চোখ আটকে গেলো রাস্তার পাশের এক রেস্ট্রুরেন্টে টেবিলের উপর বাবু হয়ে বসে থাকা একটা মেয়ের ওপর।অজান্তেই ঠোটের কোনে হাসি ফুটলো আমারো।লাল,কালোর মিশানো রঙের একটা গাউন,ঘাড়ের নিচে ছাড়া চুল।বয়সটা তেরো চৌদ্দর এদিক ওদিক।কাধে সাইড ব্যাগ টানতে টানতে টেবিলের চারপাশে বসে থাকা মানুষগুলোর সাথে কথা বলতে বলতে,হাসতে হাসতে পাশের জনের গায়ে পরছে।গায়ের রঙ,জামার রঙ,গলার আওয়াজ সবটা মিলিয়ে অস্ফুট স্বরে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো, ‌” শ্যামাপাখি! ”

পিছনে একজন ঝুকে দাড়িয়ে মেয়েটার গলা জরিয়ে আছে।চিনেছিলাম তাকে।ওটা যীনাত আপু।জানিস?প্রথমবার দেখে চিনতে একটু কষ্ট হয়েছিলো তোকে।পরমুহুর্তেই তিনবছর আগের তোকে মনে পরলো।অনেকটাই তফাৎ।তবে এই চঞ্চলতা তো শুধু ইনসিয়াকেই মানায়।এ শ্যামাপাখি ইনসিয়া।ইনসিয়া?যদি ওকে শ্যামাপাখি নাম দিতে পারি,তবে ইনসিয়া কেনো?ও শুধুই সিয়া।আমার কাছে ও সিয়া।আচ্ছা?কেমন হবে যদি ও হয় আমার সিয়া?শুদ্ধর সিয়া?

শ্বাস আটকে শুদ্ধর দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আমি।শুদ্ধ তার মতো করে বলে চলেছেন,

-তার আগেও তোকে দেখেছি।কম।আমার থেকে লুকোতে ব্যস্ত ইনসিয়াকে।কিন্তু সেদিন?কিছু তো ছিলো তোর হাসিতে।এলোমেলো লাগছিলো নিজেকে জানিস?গাড়ি ছেড়ে দিলো।গেলাম শেহনাজ মন্জিল।ইরাম তখন অনেকটাই ছোট।শুধু ওই বাসায় ছিলো।বাকিরা নাকি যীনাত আপুর বার্থডে সেলিব্রেট করতে গেছে।জানতাম না কেনো,তবে মনটা বড্ড উশখুশ করছিলো ওখানে বসে।ডোরবেল বাজতেই আমার ভেতরটাও নেচে উঠলো।যীনাত আপুসহ বাকি সবাই ভেতরে ঢুকলো।আমাকে দেখে সবাই কতো খুশি।আপুরা পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত বলে আসিনা এইসব নিয়ে পিন্চ করতে লাগলো,ভাইয়ারা গফ বানিয়েছি,বড় হয়ে গেছি এইসব বলছিলো,আর সবার মধ্য থেকে তুই?এককোনে চোরের মতো দাড়িয়ে আড়চোখে শুধু দেখছিলি আমাকে।বিশ্বাস কর সিয়া,প্রচন্ড রাগ হয়েছিলো।প্রচন্ড!

কাজিনদের আড্ডা,ঘোরা,ডাইনিং টেবিল,মুভি দেখা,টি পার্টি,সবকিছু,সবকিছুতেই এভাবেই তোর উপেক্ষার মধ্য দিয়ে কেটে গেলো দুটো দিন।যা সহ্য হচ্ছিলো না আমার।বিষাক্ত লাগছিলো শেহনাজ মন্জিলের প্রতিটা মু্হুর্ত।মনে আছে তোর সেদিনের কথা সিয়া?ছাদে?আমি দরজা আটকে সন্ধ্যায় ছাদে দাড়িয়ে ছিলাম।লাগানো দরজা দেখে কেউ একজন চেচিয়ে বলে উঠলো,

” তাপসী আপু,দরজা খোলো।আমি সন্ধ্যাতারা দেখবো।নইলে ইশান ভাইয়ার সাথে প্রেম করছো সেটা বলে দিয়ে আসবো নিচে। ”

আওয়াজটা চিনতাম আমি।মুচকি হেসে যেইনা দরজা খুলেছি,আমার সিয়া সোজা আমার হাতে এসে পরলো।জানিস?থমকে গিয়েছিলো আমার পৃথিবী।আতংকে ভরা ওই‌ চোখজোড়ায় ডুবে গিয়েছিলাম আমি।গলার রগগুলো দৃশ্যমান হয়েছিলো সেদিন তোর।অসম্ভব কম্পন ছিলো তোর সারা শরীর জুড়ে।হার্টবিট জোরে ছুটছিলো আমারও।তোর কাপতে থাকা ঠোট দেখে মুঠো করে নিয়েছিলাম ঘাড়ের সবগুলো চুল।মনে আছে তোর সিয়া?

কি করে ভুলবো সে সন্ধ্যা?হেয়ালি করে দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে নখ দেখছিলাম।ভেবেছিলাম প্রেমে ব্যস্ত তাপসী আপু দরজা দেরিতে খুলবে।কিন্তু আকসাৎ দরজা খুলে যাওয়াতে টাল সামলাতে না পেরে কারো হাতের বাধনে জরিয়ে গেলাম।কেউটা শুদ্ধ ছিলেন।অসম্ভব ভয় পাই যাকে আমি।এজন্যই কথা বলতাম না।কি কি অনুভুতি সে সময়টাতে মনে ঝড় তুলে গিয়েছিলো,তার ব্যাখা আজও অজানা আমার।ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে ঘরবন্দি করে নিয়েছিলাম নিজেকে।হাটু মুড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে বসে শরীরের কম্পন কাটাতে কতোটা সময় লেগেছিলো আমার,তারও হিসেব নেই।

-জানিস সিয়া?তুই ওভাবে চলে যাওয়ার পর অনেক বুঝিয়েছি নিজেকে।এটা হয় না,এটা ঠিক নয়।হয়তো বয়সের দোষ!ধরেও নিয়েছিলাম তাই।দুরে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি।লাভ হয়নি।শুধু জ্বলেছি।#তোর_নামের_রোদ্দুরে ।বিশ্বাস কর,কোনোদিনও এমন অনুভুতি কারো জন্য হয়নি আমার।তোর জন্যেই কেনো,তা আজও অজানা।জ্বলতে,পুড়তে থাকা মন তার প্রতিটা কথা ডায়রিতে এটে দিতে থাকে।নিজের মনের কাছে হেরে মানতে বাধ্য হলাম একসময়,তোকে ভালোবাসি।মনে মনে হলেও,তুই আমার।শুদ্ধের সিয়া।ভেবেছিলাম তুই যেভাবে পালিয়ে বেরোস,আমার অনুভুতিগুলো হয়তো কখনোই পুর্নতা পাবে না।কিন্তু দেখ,সৃষ্টিকর্তা তোকে আমার জীবনে এমনভাবে এনে দিয়েছে,যেমনটা আমার কল্পনারও বাইরে ছিলো।আমার করে।

জমে দাড়িয়ে আছি।শুদ্ধ এগিয়ে এসে দুগাল ধরে কপালে কপাল ঠেকালেন আমার।চোখ বন্ধ করে নিলাম।মৃদ্যু কাপছি আমি।কিছুক্ষন নিরবতা।অনেকটা দুরের স্টলে চামুচ নাড়ানোর ক্ষীন আওয়াজটা আসছে,আর ঝিঝিপোকার ডাক।রাস্তাটায় গাড়ি নেই কোনো।মনে হচ্ছে সময়টাই থেমে গেছে।যাক!এভাবেই থাকি না সারাজীবন।বাতাসে মুখে গলায় আছড়ে পরা চুলগুলো বিরক্ত লাগছে,তবুও হাত তুলে সরানোর জন্য এতোটুকো সময়নষ্টের ইচ্ছে করছে না।শুদ্ধ ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠলেন,

-ভালোবাসি সিয়া।খুব ভালোবাসি তোকে।নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।এতোটা ভালোবাসি যে তা কোনো কিছুর তুলনাতেও পরিমাপ করা সম্ভব না।কিন্তু তুই কবে বলবি‌ বলতো?ভালোবাসি।কবে বলবি এ কথাটা তুই?খুব বেশি দেরি করে দিয়ে না সিয়া।খুব বেশি দেরি করে দিস না!

#চলবে…

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here