প্রিয়ঃ_আপডেট পর্ব ১৭
সপ্তদশ পর্বঃ
মোর্শেদা রুবিঃ
১৭. ———————
প্রিয়াকে ফোনের সংবাদটা জানিয়েই শারদ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।ওর সাথে গেলো ইমরান চৌধুরী এবং পাপিয়ার বর আরমান।হাসপাতালে পৌঁছুতেই ইরার স্বামীর সাথে দেখা হলো।তিনি প্রায় ছুটে এলেন।শারদ তার হাত আঁকড়ে ধরে বললো-“কিভাবে কি হলো।ত্বাকী কেমন আছে এখন?”
ত্বাকীর বাবা কান্নাভেজা কন্ঠে বললেন-
-“এখনো জ্ঞান ফেরেনি।ডাক্তার বলছেন পায়ে একটা অপারেশন লাগবে।তারা লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাবার আশঙ্কা করছেন।এক্সরে করা হয়েছে।পায়ের অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক নয়।”
-“একটু দেখা করা যাবে?”
-“আমার সাথে আসুন!”
শারদ দলবল সহ ওটি লাগোয়া ওয়েটিং রুমের সামনে গেলো।সেখানে প্রিয়’র নানু,ইরা ও অন্যান্যরা দাঁড়িয়ে আছেন।ইরা শারদকে আসতে দেখেই কেঁদে ফেললো।প্রিয়’র নানু দু হাতে মুখ ঢেকে বসে আছেন।শারদ ইরার দিকে একবার তাকিয়েই ভেতরে ঢুকে গেলো।বাকিদের বাইরেই আটকে দেয়া হলো।
শারদ একাই ভেতরে গেলো।ত্বাকীকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে।মাথায় কিছুটা আঘাত পেয়েছে তবে পায়ের আঘাতটা খুব বেশী।রাতের মধ্যেই অপারেশন করতে হবে নতুবা পা হারাতে হতে পারে!
শারদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে আসলো।প্রিয়’র নানু উঠে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো-” কিভাবে কি হয়ে গেলো, বুঝতে পারলাম না বাবা।ও সন্ধ্যের পর পরই বাইক নিয়ে বেরিয়েছিলো।বললো,জরুরী একটা কাজ আছে।সেটা সেরেই চলে আসবে।ওর মা বললো যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসে।ওর ফিরতে দেরী দেখে আমরা সমানে ফোন দিচ্ছিলাম কিন্তু মোবাইল বন্ধ আসছিলো।রাত দশটার দিকে এই হাসপাতাল থেকে ফোনে জানানো হলো ত্বাকীর এ অবস্থা।খবর পেয়ে আমরা সবাই হুড়মুড় করে এখানে ছুটে এসেছি।তোমাদেরকে আর ফোন দেবার সময় পাইনি!”
-“না না সেটা ঠিক আছে।আসলে কি বলবো…এটা ভাগ্যে ছিলো!আল্লাহ ওকে সুস্থ করুন!”বলে শারদ সরে এলো সেখান থেকে।
ত্বাকীর বাবা জামিল সাহেব ওদের সাথেই দাঁড়িয়ে আছেন।শারদ বুঝতে পারছিলো না কি করবে।সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাবছিলো।ওর বাড়ী ফিরে যাওয়া দরকার,সেখানে গেষ্টদের বিদায় দিতে হবে আবার এখানে রাত এগারোটায় ত্বাকীর অপারেশন, এখানেও তো কারো থাকা উচিত।না থাকলে ব্যপারটা কেমন দেখায়।কি করবে কোনটা করবে শারদ ভেবে পাচ্ছিলো না।
এমন সময় প্রিয়া ফোন করলো।শারদ ফোনটা নিয়ে একপাশে সরে গেলো।প্রিয়ার সাথে কথা শেষ করে আসার পর ইমরান এগিয়ে গেলেন।
তিনি নিজেই হঠাৎ বললেন যে,তিনি বাড়ীর পরিস্থিতি সামাল দিতে সেখানে চলে যেতে চান।মেহমানদের পুরো ব্যপারটা বুঝিয়ে বলে তাদের বিদায় দিয়ে আসবেন।তাতে একদিক অন্তত রক্ষা হবে।
সব শুনে শারদ রাজী হলো।ইমরানকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় দিয়ে নিজে রয়ে গেলো।ওর সাথে ওর খালাত ভাই আরমানও রয়ে গেলো।
*
প্রিয়’র ঝিমুনী আসছিলো।সাধারণত ও এতো রাত জাগে না।রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে দশটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েও কিন্তু আজ অনেক রাত হয়ে গেছে। এতোটা রাত জাগার অভ্যাস নেই ওর।মা ওর রুমে দু’বার এসে গেছে কিন্তু ভালো করে কোনো কথা বলেনি।দিয়া আর হিয়াও যেন পালিয়ে বেড়াচ্ছে।স্থির হয়ে ওর সামনে বসছেনা।বাইরে হৈ চৈ একদমই কমে গেছে বরং নিরবতাটা একটু বেশীই মনে হচ্ছে।প্রিয়া সামান্য উঁকি দিয়ে মাকে খুঁজলো।বাইরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।পাশেই দাদুর রুম।প্রিয়া ঘোমটা ভালো করে টেনে দ্রুত সাজেদার রুমে চলে এলো।দাদুকে জিজ্ঞেস করতে হবে বরপক্ষের এতো দেরীর কারন কি!
অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করা সম্ভব নয়।একমাত্র দাদুকেই একথা জিজ্ঞেস করা যেতে পারে!
সাজেদা ঘনঘন আঁচলে চোখ মুছছিলেন।প্রিয়া স্থবিরের মতো এককোণে বসে আছে।আরো দুচারজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে।
একজন মহিলা বলছেন-“ইমরান ভাই যা বললেন তাতে তো মনে হলো,ছেলের পা মারাত্মক রকমের ইনজিওরড।দেখো অপারেশনের পর ডাক্তাররা কি বলে।আমিতো বলি তোমার মেয়ের ভাগ্য ভালো যে,বিয়েটা হবার আগেই অঘটনটা ঘটেছে।নইলে ছেলের ভাগ্যে যা’ই ঘটতো তার সব মেয়েকে বরণ করে নিতে হতো।আল্লাহ বড় বাঁচা বাঁচাইসে।”
সঙ্গের মহিলাটি মন্তব্য করলেন-“বাদ দাও,এরকম দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে।এখন মেয়েকে কি জেনেশুনে পঙ্গু ছেলের কাছে দিবে নাকি।তোমার মেয়ে কম কিসে!এখন থাক্,দুদিন বাদে জানিয়ে দিও যে তোমরা এখন মেয়ে বিয়ে দেবেনা।ব্যস,কথা শেষ।”
প্রথম মহিলাটি সমবেদনার সুরে চুকচুক করে উঠলেন-“আহ্ হা রে,ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা কি সহজ কথা।বাইক নাকি সাত আট ফুট দুরে ছিটকে পড়েছিলো।আরেকটা চলন্ত বাইক আবার ছেলের পায়ের উপর দিয়ে গেছে।মাথায় লাগলেতো স্পট ডেথ হয়ে যেতো!বাঁচলেও দেখো কি অবস্থা হয়।ইমরান ভাইয়ের মুখে যা শুনলাম তাতে তো মনে হলো ছেলে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে কিনা সন্দেহ!”
আচমকা চুড়ির ঝঙ্কারে সবাই ফিরে তাকিয়ে চমকে গেলো।প্রিয় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পেছনে।কথার তোড়ে কেউ লক্ষ্যই করেনি যে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।মেয়েকে দেখে প্রিয়া দ্রুত উঠে এসে প্রিয়কে জড়িয়ে ধরলো!
-“আম্মু,তুমি এখানে?এসো ভেতরে এসো!”
প্রিয় মায়ের দিকে তাকালো!
-“কার এক্সিডেন্ট হয়েছে আম্মু?”
প্রিয়া খানিক ইতস্তত করে বললো-
-“ইয়ে,মানে ত্বাকী জামিলের।মানে যার সাথে আজ তোমার বিয়ে হবার কথা ছিলো।”
প্রিয়’র মনে হলো ওর বুকের ভেতর বাতাসের আনাগোনা থেমে গেছে।সাথে সাথেই ত্বাকীর দুষ্ট হাসিমাখা প্রানোচ্ছল চেহারাটা ভেসে উঠলো প্রিয়’র মুখের সামনে।একটু আগেই ত্বাকীর সাথে সম্ভাব্য আলাপের স্বপ্ন গাঁথছিলো বসে বসে।মনের যাবতীয় জোর খাটিয়েও সে ত্বাকীকে মন থেকে তাড়াতে পারছিলো না।মনকে যতই চোখ রাঙাচ্ছিলো এই বলে যে,সে কিন্তু এখনও পরপুরুষ।ওর কথা ভাবা বন্ধ কর্।মন ততই বেহায়ার মতো বলছিলো,আর কিছুক্ষণ পরেই সে তোমার জীবনের সবচে কাছের মানুষটি হয়ে যাবে।প্রিয় নিজের অজান্তেই ত্বাকীকে নিজের মনোরাজ্যের অধিপতির আসনটা দিয়ে দিয়েছিলো।
মাথাটা সামান্য ঝিমঝিম করে উঠতেই সে মা’কে আঁকড়ে ধরলো।প্রিয়া ওকে ধরে বিছানায় নিয়ে বসালো।মহিলাদের দলটি বলে উঠলো,’টেনশন নিয়োনা মা।তোমার কোনো ক্ষতি হয়নি।এরকম কত কারনে বিয়ের আসরেই ভেঙ্গে যায়।আর এটা তো একটা একসিডেন্ট।সবাই জানে একসিডেন্টে ছেলে মারাত্মক আহত হয়েছে।এখানে তোমার তো কোনো দোষ নেই।মনকে শক্ত করো মা।সে তোমার ভাগ্যে ছিলো না বলেই বিয়েটা হয়নি।নইলে ওর এই দুর্ঘটনার বোঝা তোমাকেই সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হতো।নামাজ কালাম পড়ো তো তাই আল্লাহ তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে!”
প্রিয় ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মহিলাটির মুখের দিকে।কোনো কথাই যেন ওর মাথায় ঢুকছিলো না।কেবলি মনে হচ্ছিলো,সব মহিলাই কি এতো নিষ্ঠুর আর স্বার্থপরের মতো কথা বলতে পারে?
সাজেদা প্রিয়াকে ডেকে বললেন ঘরটা খালি করে প্রিয়’র পোষাক বদলে ওকে শুইয়ে দিতে।কারন কথাগুলো শুনতে তার নিজেরো ভালো লাগছিলো না।
প্রিয়া মহিলাদেরকে ড্রইংরুমে এনে বসালো।
অতিথিদের অনেকেই চলে গেলেও এনারা এখনও যাননি! হয়তো বিয়েবাড়ীর শেষ দৃশ্যটা দেখে যেতে চান।কিছু মহিলার কৌতুহলের কাছে স্বামীদের সকল দাবী অগ্রাহ্য হয়ে যায়।তাদের অনড় অবস্থানের কারনে তাদের স্বামীরা বাইরে শুকনোমুখে পায়চারী করতে লাগলেন।
প্রিয়া কাঁপা স্বরে মেয়েকে অনুরোধ করলো,বিয়ের পোষাকটা বদলে নিতে।প্রিয় স্বাভাবিক ভাবেই উঠে বাথরুম গিয়ে জামাটা বদলে এলো।
প্রিয়া ওর হাত ধরে বললেন-
-“একটা প্লেটে কিছু খাবার নিয়ে আসি মা!তুমি কিছু খেয়ে নাও।অনেকক্ষণ থেকে তুমি না খেয়ে আছো!”
প্রিয় মাথা নেড়ে বললো-“একদম খিদে নেই আমার।আম্মু,আমি বাবার সাথে একটু কথা বলবো।”
-“কি কথা বলবে মা? ত্বাকীর এখন অপারেশন শুরু হবে।উনার সাথে কথা হয়েছে আমার!”
-“তবুও….আমি একটু কথা বলতে চাই মা!”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিয়া ফোনটা এগিয়ে দিলো প্রিয়’র দিকে।
শারদ বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়েছিলো।ওর পাশেই দেয়ালে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ত্বাকীর বাবা।এমন সময় শারদের ফোন বেজে উঠলে সে সচকিত হয়ে একপাশে সরে এলো!
-“আস্সালামুআলাইকুম!”
-“ওয়াআলাইকুমুস্সালাম বাবা।ইরা আন্টির ছেলে এখন কেমন আছেন?ওনার কি জ্ঞান ফিরেছে?”
শারদ হকচকিয়ে গেলো প্রিয়’র জড়তাহীন কন্ঠ শুনে।সে বললো-
-“ওর জ্ঞান একবার ফিরেছিলো।তবে অনেক রক্ত যাওয়ায় সে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে।আম্মু,তুমি বিশ্রাম নাও।এদিকের খবর নিয়ে টেনশন করো না।আমি এখানেই আছি!”
-“টেনশন করার কোনোই কারন নেই, তাই না বাবা ?”
শারদ থমকে গেলো।
প্রিয় বলে চললো-
-“ওনার ভাগ্যের সাথে আমি জড়াইনি বলে আমি টেনশন থেকে বেঁচে গেছি।অল্প কিছু সময়ের ব্যবধান আমাকে ওনার দুর্ভাগ্য থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।কিন্তু আমার নিজেকে বড় স্বার্থপর লাগছে বাবা।আমি ওনার জন্য একটু দুআ করতে চাই।ওনাকে একবার দেখতে চাই।তুমি কি আমাকে অনুমতি দেবে?”
শারদ হতভম্ব কন্ঠে বললো-“মামনি, তুমি নিজেই একদিন আমাকে বলেছিলে, আল্লাহর হুকুমের বিপরীতে পিতামাতার হুকুম তুচ্ছ।আজকে যদি আমি তোমাকে দেখা করার অনুমতি দেইও তবু তুমি তার সাথে দেখা করার বৈধতা পাওনা।তাহলে অনুমতি চাইছো কেন?”
-“বাবা,আমি জানি,আল্লাহর আইনে আমার তাকে দেখার অনুমতি নেই আর সেকারনেই আমি তোমার কাছ থেকে অনুমতি চাচ্ছি, তুমি আমাকে তার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দাও,বাবা।প্লিজ বাবা।প্লিজ।”
শারদের চোখগুলো ধীরে ধীরে বিস্ফোরিত হয়ে এলো।প্রিয়’র কথার মর্মার্থ এবার তার তার বুঝে আসছে।তিনি কি জবাব দেবেন তা ভেবে পেলেন না।
এদিকে প্রিয়া আর সাজেদা দুজনেই প্রিয়’র কথা শুনে পাথর বনে গেছেন।
কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হয়ে শারদ ধরা গলায় বললো
–“ওকে কিছুটা সুস্থ হতে দাও,তারপর আমরা এ ব্যপারে কথা বলি?”
-“বাবা,তুমি আমাকে স্বার্থপর হতে বলছো!তিনি সুস্থ হলে তারপর তুমি সিদ্ধান্ত নেবে!আমি যে ওনার বিপদেই ওর পাশে থাকতে চেয়েছিলাম!ওর সুখ দুখের সাথী হতে চেয়েছিলাম!আমার ভাগ্যে যে বিপদ আছে তাকে আমি কোনোভাবেই এড়াতে পারবোনা বাবা।আমাদের সবার জীবন তাকদীরের হাতে বাঁধা! আমি জানি,আমার এই চাওয়া বাস্তব বিচারে পাগলামী, কোনোভাবেই আমি এটা করতে বাধ্য নই! না আইনতঃ না ধর্মতঃ! কিন্তু এটা আমার একান্ত চাওয়া বাবা।
দেবে বাবা,আমাকে ওনার কাছে যেতে?”
প্রিয়’র কন্ঠে এবার কান্নার আভাস।
শারদ দ্রুত বললো-
-“তোমার আম্মুকে ফোনটা দাও!”
ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে প্রিয় ফোনটা মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সেখান থেকে সরে গেলো।কেন যেন তার বুক ঠেলে কান্না আসছে।চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।কোনো কারন নেই অথচ এতো কান্না কেন পাচ্ছে সে নিজেও জানেনা।
ত্বাকীকে পোস্ট অপারেটিভে রাখা হয়েছে।শারদ এতক্ষণ যতখানি ভারমুক্ত ছিলো এখন তার দশগুণ চিন্তায় সে ঘেমে নেয়ে উঠলো।মনে মনে বারবার আল্লাহর কাছে পানাহ চাইলো।নিজের পরিবর্তিত মানসিকতায় নিজেই অবাক হয়ে গেলো শারদ।ফোন রাখার পর থেকে ত্বাকীর জন্য যত দুআ করেছে এর একটু আগেও এতোবার দুআ করে গলা শুকায়নি।
জামিল সাহেবকে ডেকে কথাগুলো বলার পর বুকের ধুকপুকানী আরো বেড়ে গিয়েছিলো শারদের।
আসলেই মানুষ বড় স্বার্থপর!ভাবলো শারদ।
সারারাত শারদ হাসপাতালেই থাকলো।সকালে প্রিয়াকে ফোন করে জানালো একটু পরেই ত্বাকীকে বেডে দেয়া হবে।
ত্বাকীকে বেডে দেয়া হলেও সবাইকে সতর্ক করা হলো পেশেন্টকে যেন বিরক্ত না করা হয়।
শারদ আর ত্বাকীর বাবা জামিল সাহেব দুজনে একসাথে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলেন।প্রায় আধাঘন্টা তার সাথথে কথা বললেন।ডাক্তারের অনুমতি পেতে বেশ বেগ পেতে হলো।তবু তিনি চব্বিশ ঘন্টার আগে অনুমতি দিতে পারবেন না বলে জানালেন।
অবশেষে বিকেলের দিকে অনুমতি মিললো।ত্বাকীর জ্ঞান আগেই ফিরেছে তবে সে খুব চুপচাপ হয়েছিলো।এমন সময় ইরা এসে ছেলের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেন।কিন্তু ত্বাকী বারবার দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলো দেখে ইরা আর থাকতে পারলো না।
ঝুঁকে ওর কানে কানে কিছু বলতেই তাক্বীর চোখজোড়া চঞ্চল হয়ে উঠলো।মাথা নেড়ে বাধা দিয়ে উত্তেজনায় উঠে বসতে চাইলো।
-“আরে…এসব কি! না না,ও কেন এমন করবে!ওকে মানা করো! ”
ইরা ছেলের হাত চেপে ধরে বললো-“মানা করিস না বাপ!মেয়েটা তোর সাথে দেখা করার জন্য সেই সকাল থেকে এসে বসে আছে।তোর জ্ঞান ফেরার পর থেকে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে।দুপুরেও কিছু খায়নি।তুই আর অমত করিস না বাবা।মেয়েটাকে আসার অনুমতি দে।ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি,তিনি অনুমতি দিয়েছেন।
ত্বাকী চোখ বন্ধ করে ফেললো-“পাগল মেয়েটা কি বললো না বললো আর তোমরাও মেনে নিলে।পরে কি সে আসতে পারতো না?আজকেই কেন আসতে হবে!”
-“জানিনা।ওর বাবা মা আর আমি কি কম বুঝিয়েছি মনে করিস!কিন্তু মেয়েটার আকুতির কাছে আমাদের হার মানতে হলো!”
এমন সময় শারদকে আসতে দেখে ইরা সরে দাঁড়ালো।শারদ এসে ত্বাকীর হাত ধরলো।
ত্বাকীকে আধশোয়া করে বসানো হয়েছে। বাম পা টা উরুর কাছ থেকে ব্যান্ডেজ করা।সেটা সামান্য তুলে উঁচু করে বেঁধে রাখা হয়েছে।ত্বাকীর কোলের মধ্যে একটা রেজিষ্টার খাতা।
দু চোখ বন্ধ করে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের নামটা সই করে দিলো সে।
চারপাঁচজনের উপস্থিতিতে ত্বাকীর সই হলে পাঁচজনের ছোট দলটি পাশের খালি কেবিনে অপেক্ষারত মহিলাদের আসরে গিয়ে পর্দার এপাশ থেকে খাতাটা এগিয়ে দিলো।
প্রিয় খাতাটা হাতে নিয়ে দেখলো উপরে লেখা নামটি জ্বলজ্বল করছে।
সে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে নির্দ্বিধায় নিজের নামটি নিচে সই করে দিলো।
আশেপাশের কয়েকজন নার্সও এসে দাঁড়িয়েছে মুনাজাতে শামিল হতে।শারদ আর জামিল সাহেব নিজে গিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে মিষ্টি দিয়ে হাত মেলালেন।ডাক্তার হেসে বললেন-“আমার প্রফেশনাল লাইফে এটা একটা স্মরনীয় ঘটনা হয়ে থাকলো!”
বোরকা পড়ে বসে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিলো প্রিয়।এবার ওকে হাত ধরে ত্বাকীর কেবিনে নিয়ে এলো ইরা।কেবিনের পর্দা তুলে দাঁড়িয়ে পড়লো প্রিয়।
ত্বাকী মাথাটা দেয়ালে হেলান দিয়ে ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো দরোজার দিকে।
প্রিয়কে দেখে ত্বাকী সোজা হয়ে বসলো।ইরা বাইরে দাঁড়িয়েই দরোজাটা টেনে দিয়ে চলে গেলো।
প্রিয় দুরে দাঁড়িয়েই নিরবে ত্বাকীকে দেখতে লাগলো।ত্বাকী কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে গমগমে কন্ঠে সালাম দিলো!
-“আস্সালামুআলাইকুম!”
প্রিয় নেকাব সরিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে এগিয়ে গেলো ভেতরের দিকে।মৃদু শব্দে বললো-
-“সকাল থেকে বোরকা পড়ে আছি।খুব গরম লাগছে।বোরকাটা খুলে বসি?”
ত্বাকী চোখের ইশারায় দেয়াল দেখিয়ে বললো-
-“এসি’জ অন!তবে বোরকা চাইলে খুলতে পারো!”
প্রিয় হিজাব সরিয়ে বোরকাটা খুলে সেটা স্ট্যান্ড হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে দিলো।একটা লাল টুকটুকে শাড়ীতে ওকে নতুন বৌ এর মতো লাগছিলো।চুলগুলো চমৎকার খোঁপার শাসনে বন্দী।একগুচ্ছে বেলী ফুলের মালা আবৃত করে আছে সেটাকে।
ত্বাকী বিভোর হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।বললো-
-“আমাকে এভাবে কষ্ট না দিলে বুঝি চলছিলো না!তাই না?”
চলবে…….