প্রিয়ঃ_আপডেট পর্ব ১২
দ্বাদশ পর্বঃ
মোর্শেদা খাতুন।

১২. ***************
সাজেদা হাতের ব্যাগ সোফার এককোণে রাখলেন।তারপর জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেলেন।
শারদ চুপচাপ একজায়গায় দদাঁড়িয়ে মোবাইল দেখছে।
তিনি শারদকে তাগিদ দিলেন-“কিরে!দাঁড়িয়ে আছিস কেন?যা,শুতে যা!রাত বাড়ছে না!”

ঝড়ের বেগে চিন্তা চলছে শারদের মাথার ভেতর।মা’কে কি বললে তিনি কি উত্তর দিবেন শারদ সেসব ভাবছে।এমন কিছু বলতে হবে যেন মা বিনাবাক্য ব্যয়ে চুপচাপ মেনে নেয়।
কারন,সন্ধ্যারাতের ঐ কান্ডটার পর নিজেই নিজের কাছে ছোট হয়ে আছে।আর আজ যদি প্রিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে না নেয় তো ওর রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে।মনটা এমনিতেই অপরাধ বোধে কুঁকড়ে আছে।নাহ…..প্রিয়াকে ছেড়ে তো এ ঘর থেকে সে যাবেইনা,একদম না।

প্রিয়া কাপড় চেন্জ করতে বাথরুমে ঢুকে গেলে শারদ বলল-“মা,তুমি ঐ ঘরে যাও,আমি এখানেই থাকবো!”
-“কেন?”
-“কেন আবার? বাবার নাক ডাকার শব্দে আমি একফোঁটা ঘুমাতে পারবোনা,আর আমি কেন বাবার সাথে ঘুমুবো?”

সাজেদা এবার বলে উঠলেন-“প্রিয়াকে সহ্য হবে তোর? তখন তো এতোগুলো লোকের সামনে যাচ্ছেতাই ব্যবহারটা করলি।এটা কি ওর পাওনা ছিলো?কি না করে ও প্রিয়র জন্য।তোর এই চন্ডাল রাগের জন্যই নীরা……!”

সাজেদাকে থামিয়ে দিলো শারদ-
-“মা….প্লিজ,প্যারা দিও না তো!স্বীকার করছি,উত্তেজনার বশে আমার ভুল হয়ে গেছে!তাই বলে……!”শারদ থেমে গেল।
মা আর কিছু না বলে উঠে চলে যাবার জন্য জুতা খুঁজলেন।শারদ তার ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বলল-“নাও,তোমার ব্যাগ”!

মা বেরিয়ে যেতেই দ্রুত দরজা আটকালো শারদ।
ফোঁস করে চেপে রাখা দম ছাড়ল,’উহ্,মা একেবারে রেগে আছেন।তার আদরের বৌমাকে কষ্ট পেতে দেখে তিনিও কষ্ট পেয়েছেন।সত্যি,সন্ধ্যের ব্যপারটা বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।’কপালটা দুআঙ্গুলে চেপে ধরে ভাবল শারদ।
গেট খোলার শব্দে ফিরে তাকিয়ে দেখলো শাড়ী বদলে স্যালোয়ার কামিজ পড়েছে প্রিয়া।মাথায় ওড়নাটা প্যাঁচানো।কি ব্যপার?নামাজ পড়বে নাকি?ভাবল সে।
.
আস্তে করে জিজ্ঞেস করল-“নামাজ পড়বে?”
প্রিয়া সহজ স্বাভাবিক সুরে উত্তর দিলো-“জ্বী,ঈশা পড়া হয়নি!”
-“ওও…..!ইয়ে….!”
প্রিয়া জায়নামাজ বিছিয়ে তাকাল-“কিছু বলবেন?”
-“না,ঠিক আছে,তুমি…নামাজ পড়ো”!

প্রিয়া নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে গেল।শারদ ধীরে সুস্থে কাপড় বদলালো।বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো।তারপর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।
সময় গুলো যেন পাথরের মত বুকের উপর চেপে আছে।প্রিয়া কি খুব বেশী রাগ করেছে ওর উপর?কতটুকু রেগে আছে বোঝা তো যাচ্ছেনা।প্রিয়াকে কখনো রাগতে দেখেনি সে।

মনে পড়তেই ঘরের পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল। দেখলো প্রিয়া নামাজ শেষ করে হিজাব খুলছে।আধাভেজা চুলগুলো পিঠের ওপর ছড়িয়ে দিয়েছে।মুখ নামিয়ে প্রিয়র জামাকাপড়গুলো ভাজ করছে একমনে।

শারদ ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবল।তারপর দুহাত ট্রাউজারের পকেটে চালান করে দিয়ে বারান্দায় খানিক হাঁটল।নিজের চুলগুলো দুহাত দিয়ে ব্যাকব্রাশ করল বার কয়েক।কিভাবে বললে ওর মনের ভার লাঘব হবে ভাবছে শারদ।ভাবতে ভাবতেই ঘরে ঢুকে দেখলো প্রিয়া চুপ করে শুয়ে আছে।

শারদ একেবারে প্রিয়ার কাছে এসে বসল।প্রিয়া চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে কিন্তু শারদ জানে ও ঘুমায়নি।আস্তে করে নিজের ডান হাতটা প্রিয়ার গালে রাখল।

প্রিয়া চোখ খুলে তাকিয়ে ত্রস্তে উঠে বসল।
শারদ ওর হাতটা টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কাতর স্বরে বলল-“আ’ম স্যরি,এক্সট্রিমলি স্যরি…মানে আমি…আমি খুবই দুঃখিত।আমাকে মাফ করে দাও!তখন কিভাবে কি হয়ে গেলো যে বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম ঘটনা ঘটে গেছে!”

প্রিয়া হাসবার চেষ্টা করল-“ঠিকআছে,বাদ দিন ওসব কথা”।
-“তোমার নিশ্চয়ই খুব খারাপ লেগেছে।আসলে আমি….আমি খুব খারাপ!তোমাকে কষ্ট দেবার ইন্টেনশান ছিলোনা আমার।কি ভাবে যে কি হলো,আমি টেম্পার ঠিক রাখতে পারিনি”!
-“বললাম তো,বাদ দিন”!
শারদ বলল-“তুমি এখনো রেগে আছো,প্লিজ ফরগিভ মি”! বলে নিজের দুকান ধরল।
প্রিয়া এবার ছোট্ট করে হেসে বলল-“সিনেমা করতে হবেনা,কান ছাড়ুন!”

শারদ কান ছেড়ে প্রিয়ার হাত ধরলো–“একটা অনুরোধ করবো, রাখবে?”
প্রিয়া তাকিয়ে রইল,শারদ ওর হাত ধরে টানল-“চলোনা….,একটু বারান্দায় বসি!”
প্রিয়া ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল-“চলুন!”

শারদ উঠে বসে হাসল-“চলো তাহলে”!
প্রিয়া চুলগুলো খোপা বাঁধতে গেলে শারদ বাধা দিল-“থাকনা,ভালই তো দেখাচ্ছে!”

বারান্দায় একটা লম্বা সোফা পাতা রয়েছে।দুজন সেখানে বসল।
শারদ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল-“তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে!”
-“হমম…..ঘুম পাচ্ছে তো,সন্ধ্যার ধকলটা আমাকে একেবারে কাহিল করে দিয়েছে।মাথাটা এখনো ঝিমঝিম করছে!”

প্রিয়া ডান হাত চুলে বোলালো।শারদ পরম মমতায় ওকে কাছে টেনে নিলো! ওর মাথাটা টেনে নিজের উরুর ওপর রেখে বলল-“তুমি পা লম্বা করে শোও…আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি!”
-“আরে ধ্যাৎ,এসব দরকার নেই।প্রিয়া হেসে সরে গেল।
শারদ থেমে থেমে বলতে লাগল-“আমার এই রাগের কারনে জীবনে অনেক সাফার করেছি,অনেক মূল্যবান সময় জীবন থেকে হারিয়েছি।সব হারিয়ে তোমাকে পেয়েছি,তোমাকে হারাতে চাই না!”

প্রিয়া এবার ওর হাত ধরে বলল-“আপনি এটা ভুলে যান তো।অযথা এসব ভেবে নিজেকে ভারাক্রান্ত করার দরকার নেই।আসলে আপনার ব্যবহারে আমি যতটা না ব্যথা পেয়েছি তারচে বেশী কষ্ট পেয়েছি যে,আপনি আমাকে ভুল বুঝলেন!”

-“ভুল বুঝিনি,আমার সেই পুরোনো রোগটাই ঝামেলা বাঁধিয়েছে।রাগলে কিছু মনে থাকেনা।”
তারপর প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল-“আমার রাগটা কমাতে সাহায্য করবে?”

প্রিয়া হাসল-“কি করলে রাগ কমে তা তো জানি না তবে আপনি যদি দ্বীনি জীবন যাপন শুরু করেন তাহলে কেবল রাগই না অনেক কিছুর উপরই আপনার নিয়ন্ত্রন তৈরী হবে।”!
-“তাই? কিভাবে?”
-“রাগটা আসলে আসে এক ধরনের অহংকার থেকে।আমরা আমাদের নিজেদের কতকিছুই তো জানিনা।নিজেকে আগে জানতে হবে তারপর শোধরাতে হবে।আমাদের চোখে অন্যের ছোট ছোট ভুল বড় হয়ে দেখা দেয় কিন্তু নিজের বড় বড় ভুলও আমাদের নজর এড়িয়ে যায়।”
-“কথাটা খুব ঠিক ।আমরা প্রায় সবাই এই রোগের রুগী।আমার রাগটা না হঠাৎ চড়ে যায়।”

-“এ প্রসঙ্গে একটা হাদিস বলি!একবার এক লোক রাসুল সাঃ এর কাছে এসে বললেন,হে আল্লাহর রাসুল সাঃ, আমাকে কিছু ঊপদেশ দিন।তখন রাসুল সাঃ বললেন-“তুমি রাগ করো না।লোকটি বললো-“আর?
রাসুল সাঃ আবার বললেন-“তুমি রাগ করবে না।এভাবে লোকটির বারবারের প্রশ্নের জবাবে রাসুল তাকে এই উপদেশটাই দিচ্ছিলেন।রাগটা আসলে ঈমানদারের জন্য হারামের মতো।আপনি রাগ না করার প্রাকটিস করুন।ধীরে ধীরে রাগ কন্ট্রোলে চলে আসবে।সব কিছুতো একদিনে হয়না!”

শারদ ওর গালে হাত রেখে বলল-“ইনশাআল্লাহ,চেষ্টা করবো।আচ্ছা,তখন খুব বেশী লেগেছিলো, না?
প্রিয়া কপট রাগ দেখিয়ে বলল-“না,লাগেনি….ডাকাত একটা!”
শারদ প্রিয়াকে কাছে টেনে বসালো-“কোথায় লেগেছে দেখি?”
-“ছাড়ুন তো…প্রিয় জেগে যাবে!”
-“জাগলে জাগবে!”
প্রিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে শারদের কাঁধে মাথা রাখল।
শারদ ওর চুলে মুখ ডুবিয়ে বলল-“আজ প্রমিজ করলাম।জীবনে আর কোনোদিন তোমার গায়ে হাত তুলবোনা।
প্রিয়া কিছু বললো না।শারদ ওর চুলে হাত বুলিয়ে বললো-“আচ্ছা, বাই দা ওয়ে..ইসলাম কি স্বামীকে অনুমতি দেয় এভাবে স্ত্রীকে প্রহার করার?”
-“উঁহুঁ….একদম না।”
-“তাই? আর স্ত্রী অবাধ্য হলে?”
-“অবাধ্য হলে তাকে কন্ট্রোল করতে চারটা পদ্ধতি এপ্লাই করতে হবে। প্রথমে তার মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করে তার মনের কাছাকাছি যেতে হবে,তাকে পছন্দের জিনিস কিনে দেয়া বা বেড়াতে নিয়ে যাওয়া…এসব।এর পরেও না মানলে তাকে উপদেশ দিতে হবে,বোঝাতে হবে।তারপরেও না মানলে বিছানা আলাদা করে দিতে হবে,এটা এক ধরনের শক ট্রিটমেন্ট। তারপরেও না মানলে মৃদু আঘাত।আলেমগন বলেন,গায়ে মিসওয়াকের একটা ছোট্ট আঘাত।তবে মুখে মারতে রাসুল সাঃ স্পষ্ট করে নিষেধ করেছেন।কারন এতে তার সৌন্দর্য্য নষ্ট হবার আশঙ্কা আছে।এ নিয়ে খুব সুন্দর কিছু হাদিস আছে।এক হাদিসে তো তিনি বলেছেন-“তোমরা কেমন করে তাদের(স্ত্রী)দের আঘাত করো কষ্ট দাও,আবার রাতের বেলা তাদের সাথেই তোমরা শয়ন করো?”
-“কি সুন্দর কথা যে উনি বলেছেন।শুনে মনটা কেমন হয়ে গেলো।আর আমি হতভাগা তোমার মুখে…..!”
-“আপনি তো তওবা করেছেন!”
-“আমি আবারো তওবা করলাম।”শারদের কন্ঠে স্পষ্ট আক্ষেপ।
-“চলুন, এবারশুতে যাই!”
-“চলো!”

পরদিন দুপুরের আগেই বাড়ী ফিরল ওরা।শারদ বাড়ী ফিরে অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল,দুদিন একটু গ্যাপ যাওয়ায় কাজ জমেছে বেশ কিছু।নিজের রুমে বসে একমনে কাজ করছে সে।প্রিয়া কখন ওর সামনে চা রেখে গেছে খেয়ালই করেনি।
এমন সময় ফোন বাজল।মাজেদা খালা ফোন করেছেন।
ফোন রেখে সাজেদা বললেন-” আগামী কাল ওদের বৌভাত, সেখানে যাবার কথা বলল”!
-“কখন? ”
-“বৌভাত তো রাতে,আমাদরকে সকালেই যেতে বলেছে।”
-“তুমি বাবাকে নিয়ে সকালে যেতে পারো,আমি প্রিয়াকে নিয়ে পড়ে যাবো”!কাজ করতে করতেই শারদ বললো।

কথার মাঝখানেই ডোরবেল বাজল।সাজেদা যেয়ে দরজা খুলে দেখলেন,নীরার মা আর নীরার ছোট বোন দাঁড়িয়ে আছে।
শারদ ড্রইংরূমে এসে ওদের দেখে কিছুটা হকচকিয়ে গেল।সাজেদা ওদের বসতে বলে নিজেও বসলেন!

শারদ ও একটা সোফায় বসল।এর মধ্যেই প্রিয়কে কোলে নিয়ে প্রিয়া ঢুকল।সবাইকে সালাম দিলো।
ইরা শান্ত অথচ কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রিয়ার দিকে।
শারদ তা লক্ষ্য করে উঠতে যাচ্ছিল।তখনি ইরা বলে উঠলো-
-“কি,পালাচ্ছেন কেন?”
-“পালাচ্ছি মানে?”
-“উঠে চলে যাচ্ছেন?”
-“না,আমার একটু কাজ আছে।তোমার ভাবীর সাথে কথা বলো।ওর সাথে তো তোমার পরিচয়ই হয়নি!”
-“পরিচিত হওয়ার আর কি আছে।আমি নীরার বোন ইরা।নাকি নীরার নামটা আজকাল ভুলে যাওয়া হয়েছে?’
-“কি বলতে চাইছো,তুমি আসলে ?”
শারদ শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল।শারদের মনে হলো ইরা আজকে অফেন্সিভ কথাবার্তা বলবে।ওকে থামানোর সহজ উপায় হচ্ছে পাল্টা আক্রমন করা।অফেন্সই হবে এখানে ভালো ডিফেন্স।শারদ সেরকম ভেবেই মানসিক প্রস্তুতি নিলো।
এমতাবস্থায় প্রিয়া বলল-“আপনারা বসুন,আমি আসছি।”
বলে ও চলে যেতে উদ্যত হলে নীরার ছোট বোন ইরা বলে উঠল-“যাবেন কেন,আপনার স্বামীর কথাগুলো শুনবেন না?তিনি নাকি আমার বোন মারা গেলে কোনোদিন বিয়েই করবেন না।এখন তো দেখছি দিব্যি গৃহস্বামী সেজে বসেছেন!”

শারদ প্রিয়ার দিকে তাকাল।প্রিয়া তাকিয়ে আছে নীরার ছোট বোনের দিকে। ঠিক তখনি প্রিয় কেঁদে উঠল।

চলবে…….!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here