প্রিয়ঃ পর্ব ১
১.
আজ পাপিয়াকে বরপক্ষ দেখতে আসবে।পছন্দ হয়ে গেলে আজই এনগেজমেন্ট।বরপক্ষ চাইলে আকদও হবার সম্ভাবনা।
সকাল থেকেই পাপিয়ার চেহারা ঘষামাজা চলছে।পার্লার থেকে ফেসিয়াল করে এসেছে।পুরোটা বিকাল এসি’ ছেড়ে ঘুমিয়ে থেকেছে কারন ওতে চোখ দুটোয় একটু ফোলা ফোলা একটা ভাব আসবে।পাপিয়ার চোখের নিচটা একটু গর্তের ভেতর বসা বলে ওকে একটু গ্লুমি দেখায়।সেকারনেই চেহারার খুঁত ঢাকতে পাপিয়ার চেষ্টার অন্ত নেই।চেহারায় কাঁচা হলুদ লাগাবে বলে বসে আছে সে,এখনো গোসল করেনি ও।
পাপিয়া চেঁচিয়ে তার মা’কে ডাকল-“মাআআআ…..”!
পাপিয়ার মা সালেহা বেগম রান্না ঘরে মহাব্যস্ত।সন্ধ্যে বেলা বরপক্ষের জনাপনের লোক আসবে।
পাপিয়ার মা মোটামুটি বিশ জনের মত আয়োজন রেখেছেন।আজকের সমন্ধটা নিয়ে তিনি খুবই উত্তেজিত এবং আশাবাদী।বহু কষ্টে এই সমন্ধটা যোগাড় করেছেন তিনি।
পাপিয়ার ছোট বোন সামিয়ার বান্ধবী মিতুর মা এনেছেন এই সমন্ধটা।ছেলে ব্যবসা করে।ঢাকায় নিজেদের বাড়ী আছে।ব্যবসার কাজে মাঝেমধ্যে দেশের বাইরেও যেতে হয়।পাপিয়ার মায়ের খুব মনে ধরেছে সমন্ধটা।তিনি খুব চাচ্ছেন পাপিয়ার সমন্ধটা যেন এখানে হয়ে যায়।
বরপক্ষকে খুশি করতে তিনি খাবারের যে আয়োজন করেছেন তা বিয়ে বাড়ীর খাবারকেও হার মানাবে।চব্বিশ রকমের নাস্তা আর ফলের ব্যবস্থা তো আছেই,রাতের খাবারে রয়েছে খাসির কাচ্চি বিরিয়ানী,রোষ্ট,টিকিয়া,শামি কাবা,আলুবোখারার চাটনী,বোরহানী,সাথে ডেজার্টেও সফট ড্রিংকসের সাথে দই আর রাবড়ী।
রান্নাঘরে তিনি এমনিতেই ঘেমে নেয়ে উঠেছেন।এর মধ্যেই আবার মেয়ের চিৎকার।বাধ্য হয়ে তার পাশে কাজ করতে থাকা প্রিয়াকে বললেন-“প্রিয়া,যা তো মা,হলুদের বাটিটা তোর পাপিয়া আপুকে দিয়ে আয়।”
“প্রিয়া” পাপিয়ার চাচাতো বোন।প্রিয়ার বাবা-মা মারা যাবার পর থেকে প্রিয়া চাচার সংসারেই মানুষ।প্রিয়ার চাচা মিজানুর রহমান যথেষ্ট স্নেহ করেন প্রিয়াকে।তার দুই মেয়ে পাপিয়া আর সামিয়ার মতই প্রিয়াকেও নিজের মেয়ে বলেই মনে করেন।প্রিয়া নিজেও কাজে বেশ দক্ষ আর চটপটে।পাপিয়ার মা সব কাজে তাই প্রিয়ার উপরই বেশী ভরসা করেন।
প্রিয়া গোল গোল করে কোপ্তা বানিয়ে ডুবো তেলে ভাজছিল!
চাচীর কথা শুনে হাত ধুয়ে চুলার আঁচ কমিয়ে কাঁচা হলুদের বাটিটা নিয়ে বেরিয়ে গেল।যাবার আগে ওড়নাটা খুলে ভালোভাবে মাথা ঢেকে পড়ে নিল।প্রিয়ার এই আরেক বৈশিষ্ট্য।সে যথেষ্ট পর্দা মেনটেইন করার চেষ্টা করে।এতে সালেহা বেগম খুশিই হন।কারনএর আগের বার প্রিয়ার কারনে পাপিয়ার একটা ভালো বিয়ের সমন্ধ হাতছাড়া হয়ে গেছে।ছেলে খাবার খেয়ে বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে প্রিয়াকে দেখে ফেলে ভেতর বারান্দায়।ব্যস,ফিরে গিয়ে মা’র কানেকানে বলে দিল।মেয়ের ছোটো বোনকে পছন্দ হয়েছে।পাপিয়া বুঝে গেলেন,ওরা ‘প্রিয়া’র কথা বলছে”,কারন সামিয়া সেদিন বাসায় ছিলোনা!
তিনি ছেলেপক্ষকে সোজা মানা করে দিলেন,যে প্রিয়া এখনো ছোট তাই ওর বিয়ে দেবার কথা ভাবছেন না তারা।ছেলেরা কদিন খুব ঘুরাঘুরি করেছিল কিন্তু সালেহা বেগম কানে তোলেন নি।তাছাড়া প্রিয়া তার ডান হাত।ও চলে গেলে তার এতোবড় সংসার কে সামলাবে?
ড্রইং রুম গুছিয়ে প্রিয়া রান্নাঘরে চলে এল।চাচী আজ তাকে রান্নাঘরেই থাকতে বলেছেন।ড্রইংরুমের আশেপাশেও যেতে নিষেধ করেছেন।
সালেহা বেগম গোসল সেরে কড়কড়ে নতুন কাপড় পড়েছেন।সামিয়াও সুন্দর একটা থ্রী পিস পড়েছে।কেবল প্রিয়ারই কাপড় বদলানো হয়নি।সে পোলাও চড়িয়েছে মাত্র।এখন সামনে থাকতে হবে। এদিক সেদিক হলে চাচী তাকে আস্ত রাখবেননা।সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে অথচ মেহমানদের আসার কোন খবর নেই।প্রিয়ার কোমড় ব্যথা করছে।সে পোলাও দমে দিয়ে চাচীকে বলে প্রিয়া নিজের ঘরে চলে এল।ঘামে ভেজা কাপড় বদলে অযু করে নামায পড়ল।তারপর চুপ করে শুয়ে রইল।
প্রিয়ার নিজের ঘর বলতে আট ফিট বাই দশ ফিটের এই রুমটা।এটাকে রুম না বলে স্টোর রুম বললেই ঠিক হবে।একপাশে একটা ছোট খাট ফেলা হয়েছে আর এককোণে পুরোনো একটা আলমারী।তার পাশে রাজ্যের যত টিন ড্রাম,চালের বস্তা দিয়ে গুদাম বানিয়ে রাখা হয়েছে।প্রিয়ার তাতে দুঃখ নেই।শোবার মত একান্ত নিজের একটা জায়গা আর নামাজের পাটি বিছানোর জায়গাটুকুই ওর জন্য যথেষ্ট। এর বেশী আশাও করেনা সে।অন্তত এই রুমটাতে ওর প্রাইভেসী তো আছে।নিজের মত করে একটু দম নিতে পারে,এইই আলহামদুলিল্লাহ।
……♠……
নয়টার দিকে মেহমান হলো।প্রিয়া জানে এখন আর ডাক পড়বেনা ওর।খাবার লাগানোর সময় হলে একবার চাচী আসবে আর বলবে,”খাবার বেড়ে বুয়ার হাতে দিয়ে টেবিলে পাঠিয়ে দে”!
প্রিয়া নিশ্চিন্ত মনে একটা বই খুলে তাতে মন দিল।এইচ.এস.সি পাশ করার পর আর পড়াশোনা করা হয়নি বটে কিন্তু গল্পের বই পড়ার নেশা আজো ছাড়তে পারেনি প্রিয়া।
টুংটাং গ্লাস প্লেটের শব্দ আসছে।এমন সময় ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙার শব্দ এলো।তার সাথে সাথেই ছোট বাচ্চার তারস্বরে চিৎকার।বিছানায় শুয়ে শুয়ে সব শুনছে প্রিয়া।চোখটা প্রায় লেগে এসেছিলো।তখনি চাচী এসে দরজা টোকা দিলেন।
প্রিয়া লাফ দিয়ে উঠে দরজা খুলল।চাচী খাবার বেড়ে বুয়াকে দিয়ে পাঠাতে বললেন।চাচীকে বেশ বিরক্ত মনে হলো!একা একাই গজগজ করছেন।
প্রিয়া জিজ্ঞেস করল-“কি হয়েছে চাচী?”
-“আরে,এক বান্দর পিচ্চিরে নিয়ে আসছে,গ্লাস ভেঙে পানি টানি ফেলে একাকার!ওর দাদুও সামলাতে পারছেনা।বড্ড জেদী।”
-“ওর আম্মু কি করে, বাচ্চাটাকে নিয়ে সরে গেলেই তো হয়”!
-“আরে না,বাচ্চাটার নাকি মা নেই,দাদীর সাথে এসেছে।নে তাড়াতাড়ী খাবার গুলো পাঠিয়ে দে!সুন্দর করে সাজিয়ে দিস”!
বলে চাচী ব্যস্ত হয়ে চলে গেলেন!প্রিয়ার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল।আহা! এতটুকুন বাচ্চা!প্রিয়ার নিজের মা নেই,ও জানে মা না থাকার কি কষ্ট”!
.
বাচ্চাটা সম্ভবত কাউকে ঠিকমতো খেতে দিচ্ছেনা।চাচী বুয়ার কোলে দিয়ে ওকে বাইরে পাঠালেন।বুয়া এটা ওটা বলে তাকে ভুলানোর চেষ্টা করছে কিন্তু বাচ্চা এমনভাবে শরীর মোচড়াচ্ছে যে কোল থেকে পড়েই যাবে।প্রিয়া কান্নার শব্দ শুনে রান্নাঘর থেকে উঁকি দিল।আহারে! ছোট্ট মিষ্টি বাচ্চাটা, কেঁদে লাল হচ্ছে।ওর কান্না দেখে প্রিয়া আর থাকতে পারলোনা।দ্রুত এগিয়ে এসে কোলে নিলো।বাচ্চাটা চিৎকার করতে যাবার আগে এক ঝলক প্রিয়ার দিকে তাকাল।
প্রিয়া ওর দুগালে চুমু দিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে এলো। তারপর ওকে শূন্যে উঁচু করে ধরে চারপাশ ঘোরাল-“ইইয়েএএএ কি মজা দ্যাখো আমরা উড়ছি….!।বাচ্চাটা মজা পেয়ে চুপ হয়ে গেলো’।প্রিয়া হয়রান হয়ে থেমে গেলেই বলে-“আবাল তরো”!
প্রিয়া দুতিনবার করে বলল-“এবার রেষ্ট”!
বাচ্চা কাঁদো কাঁদো মুখ করতেই প্রিয়া দ্রুত বলল-“আরেকটা নতুন খেলা খেলবো….”!বাচ্চাটা ছোট ছোট দাঁত বের করে হাসি দিয়ে প্রিয়ার কোলে উঠে বসল।
..
সাজেদা হাই খেতে বসে উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন-আমাদের “প্রিয়”কোথায়?’কোনো শব্দ পাচ্ছিনা যে?”
সালেহা ব্যস্ত হয়ে বললেন-“একদম ভাববেন না আপা, আমাদের বুয়ার কোলে আছে,খেলছে”!
সাজেদা নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না।বারবার বাইরে তাকাচ্ছেন।বৌমা মারা যাবার পর থেকে তার একমাত্র ছেলে আর নাতনীর চিন্তা তাকে বুড়ো বানিয়ে দিচ্ছে।এর মধ্যে নাতনীটা প্রচন্ড জেদী হয়ে উঠছে।সাজেদা ছাড়া ওকে কেউ সামলাতে পারেনা।সাজেদার বয়স হয়েছে।বাচ্চা সামলাতে তিনি বেশ হিমশিম খান।সবাই বলে ছেলেকে আবার বিয়ে করিয়ে দাও।কিন্তু বললেই তো আর হয়ে যায়না।বৌমা মারা যাবার পর থেকে তার হাসিখুশি ছেলেটা কেমন চুপচাপ আর গম্ভীর মেজাজী হয়ে গেছে।এর মধ্যে বাচ্চাটা তো জেদী আছেই।কোন মেয়ে এসে তার নাতনিকে আপন করে নেবে আর তার ছেলের মুখে হাসি ফোটাবে?কোথায় পাবেন তিনি এমন মনের মত মেয়ে??
.
সাজেদা হাই ঠিকমতো খেতে পারলেন না।চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন।চারপাশে নাতনীকে খুঁজতে লাগলেন।ঘরভর্তি মানুষ সবাই ব্যস্ত নতুন বউ’র ছবি তোলা নিয়ে।সাজেদা বুয়া কে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন-“এই বুয়া,আমার নাতনী কই? তোমার কোলে না ছিল?”
-“না খালাম্মা,বাবু তো ঐ যে ঐ ঘরে,প্রিয়া আপার কাছে।”
সাজেদা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে এগিয়ে গেলেন।খিলখিল হাসির শব্দ শুনে তিনি কিছুটা ইতস্তত করে ঘরের কপাটটা ঠেলা দিলেন।ভেতরের দৃশ্য দেখে তাঁর মন জুড়িয়ে গেল।একটা মেয়ে তার নাতনীকে নিয়ে পুরো ঘর ঘুরে ঘুরে খেলছে, ওকে দোল দিচ্ছে, উঁচু করছে, নিচু করছে,মুখ দিয়ে শব্দ করে গাড়ী চালাচ্ছে আর তার জেদী নাতনী কুটকুট করে হেসে হুটোপুটি খাচ্ছে।সাজেদা নিজের অজান্তেই হেসে দিলেন!
তাকে দেখে মেয়েটা থেমে গেল।লজ্জা পেয়ে সালাম দিল।সাজেদা অবাক হয়ে ভাবলেন-“এই মেয়েটা কে? বাহ্,ভারী মিষ্টি তো দেখতে?”
সাথে সাথেই তার মনে একটা চিন্তা বিদ্যুতের মত খেলে গেল-“মেয়েটাকে আমার শারদের পাশে বেশ মানাবে!”
সাজেদা হাসি মুখে এগিয়ে গেলেন।নাতনীকে ডাকলেন-“এসো দাদু মনি”!
তিনি অবাক হয়ে দেখলেন তার নাতনী মেয়েটার কোল থেকে আসতে চাচ্ছেনা।মেয়েটার কোলে সেঁটে আছে।মেয়েটা মুচকি হেসে বলল-“কিছুক্ষণ থাক্,আন্টি।যাবার সময় বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠিয়ে দিবো”!
সাজেদা প্রিয়ার মাথায় একবার হাত বুলালেন”!
আর ততখনি তিনি মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন-“যেভাবেই হোক,এই মেয়েটার সাথেই তার শারদের বিয়ে দেবেন তিনি””!
চলবে……..