#শিশির_কণা
শামসুল ইসলাম
(পর্বঃ-১২)

-” আসতে যেহেতু চাচ্ছেন, তাহলে আসুন!”
-” আচ্ছা এখুনি আসছি!
শিশির মিনিট দশেকের ভিতরে বাসায় চলে আসলেন।
এসে রুমে প্রবেশ করে সালাম প্রদান করলেন, আমি জবাব দিলাম।
শিশির হাত বাড়িয়ে-
-” এই নাও তোমার প্রিয় আইসক্রিম।”
-” ধন্যবাদ আমার প্রিয় আইসক্রিম দেওয়ার জন্য।”
-” ধন্যবাদের পরিবর্তে যাঝাকাল্লাহ খাইরান বলবে, তাহলে সওয়াব হবে। এটার অর্থ আল্লাহ তোমাকে উত্তম কল্যান দান করুক।”
-” যাঝাকাল্লাহ খইর।”

আমি মনেহচ্ছে কালো মানুষটির প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি, গত কালও তাঁর প্রতি অরাজি ছিলাম। আজ মোটামুটি ভালোই লাগছে। শিশিরের কথায় জাদুর পরশ আছে, সহজে আমাকে জয় করে নিয়েছে। অনেক সচেতন মনে হচ্ছে আমার প্রতি সে।
শিশিরকে বললাম-
-” আপনার রান্নার তারীফ না করে পারছি না, অসম্ভব সুন্দর রান্না। কিন্তু আমি পারিনা রান্নাবাড়া করতে, আম্মু কখনো করতে দেননি রান্নার কাজকাম।”
-” তো কি হয়েছে! আমি পারি শিখিয়ে দিবো ইনশাআল্লাহ্‌।”
-” একটা কথা বলি?”
-” অবশ্যই বলো?”
-” আপনি এতো কষ্টকরে নাস্তা তৈরি করে না খেয়ে দোকানে চলে গেলেন যে!!
-” তোমার সাথে খাবো তাই চলে গেছি। আর স্ত্রীর সাথে খাওয়া সুন্নাত সেটাই মুখ্য ছিলো।”
-” আমাকে ডাকেননি কেন?”
-” ঘুমাচ্ছিলে তাই ডাকা হয়নি।”

-“আগামীকাল তো মামারা নিতে আসবেন আমাকে, সাথে কি জাবেন?”
-” তুমি চাইলে যাব, না চাইলে না।”
-” আচ্ছা যদি এবার যেয়ে আর ফিরে না আসি?”
-” না আসলে জোরজবরদস্তি করার কিছু নেই, তোমার পরিপুর্ন অধিকার আছে, ইচ্ছে হলে সংসার করবে না হলে নই।”
টুকটাক গল্পগুজবের মধ্যদিয়ে নানুভাই হাজির হলেন আমাদের মাঝে।

শিশির সালাম দিয়ে বেডে বসার জন্য অনুরোধ করলেন, নানুভাই বললেন-
-” কি ব্যাপার! নতুন বউ রেখে কি দোকানে মন বসেনি?”
-” হাহাহা কি যে বলেন না নানু! আপনার বোন তো একা থাকতে চাইনা আমাকে ছাড়া। গতকাল বিয়ে হয়েছে অথচ মনেহচ্ছে দুই বছরের পুরনো বউ আমার।”
-” হাহাহা কইলাম না! আমার বোইন জম্মের ভালো মেয়ে। দেখ তোমার কত্তো ভালোবাসে, আর দো’আ করি একগাদা ছেলেপিলে হোক তুমাগের।”

নানুভাইর কথায় অনেক লজ্জা পেলাম, এদিকে শিশির হোহো করে হাসছে।
শিশিরের হাসিটা অসম্ভব সুন্দর লাগছে, মনেহচ্ছে তাকিয়েই থাকি তাঁর দিকে।
শিশির বিষয়টা লক্ষকরে আমার দিকে চোখটিপ দেই, আমি আর লজ্জাই বাঁচিনা।মুখ ঘুরিয়ে মিটিমিটি হাসলাম।
নানুভাই বললেন-
-” তুরা গল্পটল্প কর, তুগার নতুন বিয়ে হয়েছে এই সময় বেশিবেশি গল্প কত্তি হয়।”
শিশির বললো-
-” নানুভাই আপনি তাহলে বিয়ের পর কেমন গল্পগুজব করেছেন, তা আমাদের বলে যান আমরা সেভাবে গল্পগুজব করি।”
-” তালি শুনবি সে কতা! তুগার নানির যখন বিয়ে করে আনলাম, তখন তাঁর বয়েস নয়দশ বচ্চর। বাসর রাত্তিরিই সে আমার কাছে শুতি চাইনি, বলিল- ‘ বুড়ো বিটার কাছে শুতি পারবোনা। তখন আমার মা মেলা কতা কইয়ে বুজিয়েসুজিয়ে আমার কাছে দিয়ে যাই। আর সেদিনির পতথেকে আমরা আর কনদিন আলাদা হয়নি, এই কতো বচ্চর পর গতরাত একাএকা শুতি হলো তুগার জন্যি। না জানি বউ আমার গতরাত্তিরি ঘুমাইলো কিনা।”

শিশির আবার হোহোরকরে ভুবনজয়ী হাসি দিয়ে-
-” নানুভাই তারজন্য কি ভোরবেলা উঠেই নানির মুখখানা দেখতে গেছিলেন ঐই বাসায়?”
-” কি আর কবো ভাই, সত্যি কতা কইছিস। সারারাত্তিরি আমার ঘুম হয়নি তোর নানির জন্যি। না জানি তোর নানি ঘুমিয়েছে কি না এসব চিন্তাকরে সকালে ঘুম থেকে উঠেই তুগার নানির সাথে দেখা কত্তি গিইলাম।”
হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো, খেয়াল করে দেখি আম্মুর নাম্বার থেকে।
রিসিভ করে সালাম দেওয়ার সাথেসাথে আম্মু বললেন-
-” কিরে মা! আমাকে ভুলে গেলি? বলেছিলাম শিশির খুব ভালো ছেলে, সাথে তাঁর পরিবারের সদস্যরাও অমায়িক মানুষ, কখনো অসুখী হবিনা মা। আল্লাহপাক তোদের সুখি রাখুক দোয়াকরি।”
আম্মুর কথা কেন জানি ভালোলাগছে আজ, গত কালও বিষের মতো লেগেছে আমার কাছে। কিন্তু আজ শিশিরের কথা ভালোই লাগছে।
এভাবে অনেকক্ষণ কথা হলো আম্মুর সাথে।

★★★
বাসায় সবাই ব্যস্ত, সাথে আমিও। আজ আমাকে নিতে আসবেন মামারা। রান্নাবাড়ার কাজে হাঁফ ধরে যাচ্ছে, শিশির ফজরের সালাত আদায় করে এসেই যতোটুক সম্ভব কাজ! করে দিয়েছেন। আমার শাশুড়ি অসুস্থ এইজন্য তিনি কাজকাম ঠিকমত করতে পারেননা, আজ এক আত্মীয়কে বলেছেন রান্নাবাড়ার কাজে সাহায্য করার জন্য।
শিশির বলেছিলেন -” আমি কাজ করছি তুমি শুধু বসেবসে দেখো, তাছাড়া তোমার পরিবার এসে এমন কর্মরত অবস্থায় দেখলে বদনাম রটবে।”
আমি বদনামের তোয়াক্কা না করে মাজাই ওর্না বেঁধে কাজে লেগে যাই, আজ কেন জানি কাজ করতে খুব ভালো লাগছে। মনেহচ্ছে এসংসার আমার, আমিই মোড়ল এ বাড়ির।
শাশুড়ি আমার এমন কাজকর্ম দেখে বারবার নিষেধ করছেন, আর বলছেন- ” মা তুই নতুন বউ এবাড়ির, তোর মামারা কাজ করা অবস্থায় দেখলে আমাদের বদনাম করবে।বরং তুই তোর নানুভাইয়ের সাথে গল্পগুজব কর।”
আমি এসব কথা অগ্রাহ্য করে আপনমনে কর্মে মহাব্যস্ত।
নাগাত দুপুরের দিকে মেহমানগন চলে আসলেন, সাথে মণিও এসেছে। শিশির সবাইকে সালাম মুসাফার মাধ্যমে গ্রহন করলেন।
নাস্তাপানি পরিসমাপ্তির পর মণি আমার সাথে রুমে আসলো, দুইবোন অনেক গল্পগুজব করছি, মনেহচ্ছে কতকাল দেখা হয়না আমাদের।
গল্পগুজবের মধ্যে শিশির রুমে প্রবেশ করলেন সালামের দিয়ে, রুমে এসে বললেন-
-” তোমার সমস্ত কাপড়চোপড় ভালোভাবে গুছিয়ে নিও, ভুলে রেখে যেওনা।”
শিশির কথাটি অনেক মনখারাপ করে বললেন। মণি বিষয়টা লক্ষকরে বললো-
-” কি ব্যাপার ভাইয়া, আপু কি একবারে চলে যাবে যে আপনি সবকিছু গুছিয়ে নিতে বলেছেন?”
এক চিলতে শুকনো হাসি দিয়ে বললেন-
-” হাহাহা না বিষয়টা হচ্ছে সামনে কণার পরিক্ষা, তাই পরিক্ষার আগে আর আসার দরকার নেই, পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটিয়ে লাভ নেই।”
-” তাহলে ঠিকআছে।”
আমি বুজতে পারলাম, শিশির কথাটি কি ইঙ্গিত করে বলেছেন, কারন এ তিনদিনে তাঁর চাহনি পর্যন্ত আমি আয়ত্ত করে ফেলেছি।
আমি অনেক দ্বিধান্বিত, কি করবো সেসব নিয়ে। কিছু সময়ে শিশিরকে ভালোলাগে আবার আমার একাকীত্বে খারাপ লাগে। সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারছি না কি করা উচিৎ আমার।
অনেকক্ষণ টুকিটাকি আমাদের সাথে গল্পগুজব করলেন শিশির, আমি গভীরভাবে খেয়াল করলাম, এক পলকের জন্যও সে মণির দিকে তাকালেন না। আমার মনে পড়ে যাই, গত কয়েকবছর আগে আমার এক মামাতো বোনের বিয়ে হয়, সেই ভাইয়া আমার দিকে কেমন বেহায়া দৃষ্টিতে তাকাতেন সাথে মাঝেমধ্যে ইয়ার্কির ছলে মন্দ কথা বলতেন। কিন্তু শিশির একবারের জন্যও মণির দিকে তাকাইনি, যে কয়বার তাকিয়েছেন তা আমার দিকেই। এই বিষয়টা আমার অসম্ভব ভালো লেগেছে।
বাইরে থেকে কে যেন ডাকলেন, শিশির সালাম দিয়ে বাইরে বের হয়ে গেলেন।
মণি বললো-
-” আপু তোমার কপালটা সত্যিই অনেক ভালো, এতো সুন্দর মনের মানুষকে কখনোই কষ্ট দিওনা, তার কথাবার্তা বাহ্যিক আচরণ অসম্ভব সুন্দর।”
কেন জানি কান্না পাচ্ছে আমার, মনেহচ্ছে সত্যিই শিশিরকে পেয়ে আমি ভাগ্যবতী হয়েগেছি।
মনেমনে নিজেকে খুব অযোগ্য মনেহচ্ছে আজ দুইদিন চারিদিকে শিশিরের সুনামে, বারবার মনের ঘরে উকি দিচ্ছে একটি কথায় তা হচ্ছে আমি তো আসলেই শিশিরের যোগ্যতম স্ত্রী নই! এসব দুশ্চিন্তায় দগ্ধ আমি।
আজ খুব ভালোলাগছে, মামারা কখনোই ঠিকমতো সালাত পড়েনা আর আজ শিশিরের সাথে জোহরের সালাত জামায়াতে আদায় করে আসলেন।আমিও রীতিমত নিয়মিত সালাত আদায়কারী হয়েগেছি, শিশিরের সাথে গত তিনদিন থেকে বুঝেছি জীবন কতোটা সুন্দর ও ধর্ম পালনের মাঝে কতোটা তৃপ্তিকর।
দুপুরবেলা সব মেহমানদারির মাধ্যমে খানাপিনা পরিসমাপ্তি হলো। সময় প্রায় আসরে গড়িয়ে এলে সবাই সালাত পড়তে গেলো।
কাপড়চোপড় সব ব্যাগভর্তি করা সারা, সালাত আদায় করে বড়োমামা জানালেন এখুনি বের হতে হবে, তাছাড়া রাত হয়ে যাবে।
আমাকে বিয়ের দিনইদ কালো বোরখা হিজাব দিয়েছিল, মণি আমাকে সব গুছিয়ে পরিয়ে দিলো। আজ আর পরতে কোনো অস্বস্তি লাগছে না, বরং বেশ ভালো স্বস্তিকর অনুভব করছি।
শিশির রুমে এসে বললেন-
-” কণা?”
-” জ্বি বলুন!
-” আমার পাঞ্জাবীগুলো কোথায়?”
-” সব ব্যাগে ভরেছি।”

গভীরভাবে একপলক আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসিদিয়ে বললেন-
-” একটু বারান্দায় আসতো?”
মনেহচ্ছে আমরা অনেকদিন বিয়ে করা স্বামী স্ত্রী। তাঁকে অনুসরণ করলাম।
-” কিছু বলবেন?”
-” হ্যাঁ, রুমে মণি আছে তাঁর সামনে তো আর বলা যাইনা, তাই তোমাকে এখানে ডাকছি।”
-” আচ্ছা বলুন?”
-” আমার কাপড়চোপড় এতো নিচ্ছ কেন? আমি আগামীকাল ইনশাআল্লাহ্‌ চলে আসবো। তোমার সাথে থাকতে থাকতে তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। তুমি তো আমাকে স্বামী হিসাবে মেনে নিতে পারছোনা, কারন আমি কালো বেটে একটা মানুষ, অন্যান্য পুরুষের মতো সুন্দর নই। তাই চাইনে কষ্ট পেতে, কারন তুমি বলেছো আমাকে তালাক দিবে সময় সুযোগ বুঝে। তুমি স্বাধীনভাবে চলাচল করবে তোমার সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আমি।”
কথাগুলো বলেই চলে গেলেন তিনি। কথাগুলো আমার কলিজাই আঘাত হানে, চোখদিয়ে কয়েক ফোটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়লো। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে তাঁকে ছাড়া থাকতে, আমিতো চাইনা আর তাঁকে ছাড়া থাকতে।
তবুও তার কাপড়চোপড় আমি ব্যাগে ভরে নিলাম। শাশুড়ি আম্মু কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বললেন-
-” মারে এই মাকে ভুলে যাসনে, মনযোগী হয়ে পড়াশোনা করবি।পরিক্ষার পর একবারে আমি যেয়ে তোকে আনব ইনশাআল্লাহ্‌।”
আমি আবেগে বলে দিলাম-
-” আম্মু আমার যেতে ইচ্ছা করছেনা”
-” পাগলী মেয়ের কাণ্ড দেখ! না গেলে হয় নাকি! যা পরিক্ষা শেষকরে দ্রুততম চলে আসিস।”
আমরা বিদায় নিয়ে সবাই আমার নানুবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করলাম।

★★★
শিশিরকে দেখে পাড়াগাঁয়ের লোকজন কানাঘুষা শুরু করে, অনেকে বললেন-
-” এতো সুন্দর মেয়েটার কেমন কালো একটা বেখাপ্পা ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছে।”
কথাগুলো আমরা পৌঁছানোর পরপরই মানুষজন দেখে বলাবলি করতে লাগলেন। তাঁদের কথায় আমার মনখারাপ হয়ে গেলো।
আম্মু তাঁদের ঝাড়ি দিয়ে বললেন-
-” আমি আমার ভাইবোনের সিদ্ধান্তে এমন ছেলেকে আমার কণার সাথে বিয়ে করিয়েছি তাতে আপনাদের কি? আমারটা আমার কাছে ভালো হলেই হবে, আপনাদের তা নিয়ে মাথাব্যথার দরকার নেই।”
সবাই আম্মুর মুখে এমন কথাশুনে যারযার বাড়ি চলে গেলেন।
কথাগুলো শিশিরও শুনতে পেয়েছেন, কিন্তু সেই কথায় তিনি কান দেননি।
রাতটা অতিবাহিত হলো, চার মামার বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার দাওয়াত। আর পাড়াপড়শি দাওয়াত করেছেন আমাদের। সবাই অনেক ভালোবাসেন আমাদের, একারণে আমার এতোটা কদর করেন তাঁরা।
সকালে উঠেই শিশির আম্মুকে বললেন-” আজ চলে যেতে চান। কিন্তু আম্মু বললেন-” আজ যাওয়া যাবেনা।”তাই তিনি থেকে গেলেন।
শিশির আজ তিনদিনে বাড়ির সমস্ত আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শিকে নিজের চরম ভক্ত করে নিয়েছেন, তাঁর কথাবার্তা চালচলন আচারব্যবহারের মাধ্যমে, সাথে আমার কথা কি বলবো?
আমিতো রীতিমত শিশিরের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি, একপলক তাঁকে না দেখে থাকতে পারছিনা। সারাক্ষণ তার সঙ্গ পেতে মনচাই।
দুপুরের খাওয়ার পর শিশির বললেন-
-” আমার কাপড়চোপড়গুলো গুছিয়ে দাও, আমি বাসায় যাবো আম্মু কষ্ট পাচ্ছে একাএকা অনেক। এদিকে ছোটভাইটা সকালে বের হয় রাতে বাসাই ফিরে, আম্মুর একাএকা সময় কাটেনা।”
শিশিরের বাড়ি যাওয়ার কথাশুনে আমার ভিতরে হুহু করে কেঁদে উঠলো, তবুও মুখে শুকনা হাসি দিয়ে বললাম- ” আরেকটি দিন থেকে যান?”
-” না, থেকে কি হবে? মায়া বেড়ে যাচ্ছে অনেক! এমনিতে যে মায়া বেড়ে গেছে সেটা ভুলে থাকবো কিভাবে আল্লাহপাক ভালো জানেন।”
শিশিরের কথায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে মনেহচ্ছে এখনি বলি-” শিশির তোমাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি, যেয়োনা আমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারবোনা তোমাকে ছাড়া।”
কিন্তু কথায় আছেনা! “মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফুটেনা” সেই অবস্থা হয়েছে আমার।
আমি অনিচ্ছাবশত তাঁর কাপড়চোপড় একটা ব্যাগে ভরে দিলাম, সবার কাছে বিদায় নিয়ে রওনা করলো। আমি মণি আর শিলা তিনজন এগিয়ে দিতে আসলাম, শিশির বারবার বলছেন-” আর আসতে হবেনা, তোমরা ফিরে যাও।” তবুও আমি নাছোড়বন্ধার মতই তাঁর পিছু নিলাম।
মনেহচ্ছে এখুনি তাঁর সাথে ঝিনাইদহ চলে যাই, কিন্তু উপায়ন্তর নেই।
শিশির এবার বললেন-
-” অনেক পথ এসেছ, আর আসতে হবেনা। এবার সবাই বাড়িতে ফিরে যাবে ব্যাচ!”
মণি আর শিলাকে বললাম-
-“তোরা একটু দুরে গিয়ে দাড়া, আমার কিছু পার্সোনাল কথা আছে তাঁর সাথে।”
দুরে দাড়ানোর পর শিশির আমার কাছে এসে বললেন-
-” কি ব্যাপার! ওদের দুরে পাঠালে কেন? কিছু কি বলতে চাও?”
আমি চুপকরে তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, মনেহচ্ছে এখুনি আমার চোখদিয়ে অশ্রুর ফোয়ারা গড়াবে। তোমাকে ভালোবাসি শিশির কথাটি বলতে যেয়েও বলতে পারলামনা। শুধুই বললাম-
-” নিজের প্রতি খেয়াল রাখবেন, আম্মুর প্রতিও। অনেক মিস করি সবাইকে, করবো ভবিষ্যতেও।”
শিশির মুখটা বিমূঢ় করে বললেন-
-“আমাকেও করবে মিস?”
কোনো কথা বলার দুঃসাহস হলোনা, চুপ করে থাকলাম।
শিশির বললেন-
-” ঠিকআছে ভালো থাকবে, আরেকটি কথা?”
আমি উৎসুক হয়ে-
-” জ্বি বলুন?”
-” একটা সখ ছিলো জীবনে, কখনোই প্রকাশ করার সুযোগ আসিনি যদি অনুমতি দিতে তাহলে সেটা পুরন করতাম।”
আমি মনেমনে বললাম-‘ একটা কেন, তোমার সমস্তরকম সখ পুরন করতে সদা প্রস্তুত।’
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম-‘ জ্বি বলুন? ” কারন তাঁর দিকে তাকাতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
শিশির বললেন-
-” জীবনে কখনোই প্রেম করিনি, সব প্রেম আমার স্ত্রীর জন্য জমিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু ভাগ্য অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। তো যাইহোক, ইচ্ছে ছিলো আমার স্ত্রীকে প্রেয়সী নামে ডাকবো, জীবনে প্রথম ভালবাসা প্রকাশ করবো – ‘প্রেয়সী আমি তোমাকে ভালবাসি’ শব্দটি উচ্চারণ করে। কিন্তু তা হলোনা, তার আগেই সব শেষ হবার উপক্রম। হয়তো জীবনে আর কখনো নাও দেখা হতে পারে আমার, কারন তুমি আমাকে তালাক দিতে ইচ্ছুক। সেইজন্য এই শেষ বিদায়ে আমার ইচ্ছাটা পুরনের সুযোগ দিতে, তাহলে পুরন করতাম!”

আমার খুব কান্নাপাচ্ছে, হ্রদয় আমার ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে! হাজার চেষ্টা করেও কোনো শব্দ উচ্চারন করতে পারছিনা।
তবুও অনেক কষ্টে বললাম-
-” আপনার সমস্তরকম ইচ্ছা পুরন করুন?”
-” যাঝাকিল্লাহ খইর, সমস্তরকম নেই, মাত্র একটা, তা হচ্ছে “ প্রেয়সী I LOVE U” ভালো থাকবে সারাজীবন।”
কথাটি বলেই ভোঁভোঁ করে হাটা ধরলেন।

আমি বলতে যাবো ” I LOVE U 2″ তার পুর্বেই তিনি চলে গেলেন। একটিবারের জন্য পিছনে তাকাইনি তিনি, আমি নির্বাক দৃষ্টিতে তাঁর পথের দিকে চেয়ে রইলাম।

মণি কাছে এসে অনেক ডাকাডাকি করলো, আমি কিছুই খেয়াল করিনি, আমার সমস্ত মনযোগ শিশিরের দিকে।
মণি আমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো-
-” বাব্বাহ্! কয়দিনে এতো প্রেম? আবার মটেই বিয়ে করছিলে না।”
আমি মণির কথায় সংবৎ ফিরে পেলাম, পরক্ষণে বললাম-” চল?”
মণি বললো-
-” চলোপু, অনেক পথ চলে এসেছি! বাড়ি ফিরতে হবে।”
আমি মণিকে আরেকটু দাঁড়াতে বলে, ততক্ষণ দাড়িয়ে থাকলাম, যতোক্ষন তাঁকে দেখা যাই।
যখন অদৃশ্য হয়ে গেলো সে, আমি বাড়ির দিকে হাটা শুরু করলাম। সারাপথ মাথানিচু করে গোপনে চোখের জল ফেলেছি, বাড়িতে এসেই ঘরে প্রবেশ করলাম।
বিছানাই শুয়ে বালিশে মুখ লুকিয়ে কান্না শুরু করে দিলাম, আর ভালোলাগছে না শিশিরকে ছাড়া। মণি আম্মু সবাই জিজ্ঞেস করে কান্নার কারন কি!
আমি নিশ্চুপ কান্না করেই যাচ্ছি, মণি অনেক জোরাজুরি করার পর আমি নির্লজ্জের মতো বললাম-
-” শিশিরকে আমি ভালোবাসি, তাঁকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারবোনা।”
-” হাহাহা, তো কাঁদার কি হলো? স্বামীকে ভালোবাসার অধিকার তো একমাত্র তোমারি?”
-” না তা নই, বিষয়টা তুই বু্ঝবি না। আমাদের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে।”
-” কি ভুল! সেটা না বললে বুঝাবো কেমন করে?”

বিস্তারিত খুলে বললাম, মণি সাথেসাথে আমার ফোন নিয়ে শিশিরকে ফোন করলো।
মণি বললো-
-” ভাইয়া! আপনার তারছেড়া বউটুক আপনার জন্য বিরহে চিল্লাচিল্লি করে কান্নাকাটি করছে।”
আরো কি কি কথা হলো জানিনা, কিছুক্ষণ পর আমাকে ফোন দিয়ে বললো-
-” নাও তোমার হুজুরের সাথে কথা বলো?”
ফোনটা নিয়েই বললাম-
-” আপনি কেমন বর হ্যাঁ! যে তার বউর মনের খবর বোঝেননা, আমিও তো বলতে চাইছিলাম I LOVE U 2 তার পুর্বেই আপনি চলে গেলেন কেন?”
আমার এসব কথাশুনে মণি বললো-
-” খাইছেরে! মাত্র সপ্তাহ পার না হতেই এতো ভালোবাসা, না জানি সারাজীবন কি করবে তাঁরা।”
আমি বোকার মতো মানুষ না দেখেই বকবক করে ফোনে শিশিরকে বলে দিলাম এসব। পরে খেয়াল করে দেখি আম্মু মুখ চেপে হাসি দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
আমি লজ্জাই মরে যাচ্ছি।
ফোন কানেই আছে, শিশির বললেন-
-” তাহলে কি আমার প্রেয়সী আমাকে ভালোবাসে?”
-” জ্বি জ্বি আমি ভালোবাসি আমার বরের, বুঝেননা কেন! আর কতবার বলবো?”
-” থাক বলতে হবে না! বুঝে গেছি। আমি কি আমার প্রেয়সীকে রেখে ঝিনাইদহ চলে যাবো?”
কি বলবো বুঝতে পারছি না, লজ্জাই মরে যাচ্ছি! কি বেহায়ার মতো তুলকালাম কাণ্ড করলাম।
লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে বললাম-
-” জ্বি নাহ্! মাগরিবের আযানের পুর্বে আমার বরকে আমার সামনে দেখতে চাই।”
-” সমস্যা নেই, তুমি না চাইলেও আমি মাগরিবের পুর্বেই তোমার কাছে ফিরে আসতাম।”
-” মানে হচ্ছে, তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। তাই ছেড়ে যেতে মন চাইনি, যার কারনে ইচ্ছা করে কাপড়ের ব্যাগটি রেখে এসেছি, যাতে কাপড়ের ওছিলায় তোমার কাছে ফিরে আসতে পারি।”

আমি সাথেসাথে তাকিয়ে দেখি সত্যিই কাপড়ের ব্যাগ বাক্সের ওপর রয়েছে।
আমার সব কষ্ট নিমিষে উবে যাই, তৎক্ষণাৎ বললাম-
-” ওরে শইতান হুজুর! তাহলে মানুষের সামনে আমাকে বেকুব বানালেন কেন?”
-” আমার কি দোষ! আমি তো তোমার মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটি শুনার জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে ছিলাম।”
-” এখন শুনতে পেয়েছেন?”
-” হ্যাঁ, আমার প্রেয়সী আমাকে ভালোবেসেছে।”
-” ঐই দুষ্টু! তাহলে এখনো আমার সামনে না এসে দাড়িয়ে ফোনে কথা বলছেন কেন? এগিয়ে নিয়ে নিতে আসবো?”
-” হাহাহা না না! আমি এখনি হাজির হচ্ছি মহারানী। টেনশন নিওনা, সাথে নানুভাই আছেন। তোমাকে ইচ্ছা করে কষ্ট দিইনি, সব নানুভাইয়ের পরিকল্পনা ছিলো।”
-” মানে!
-” সব এসে রাতে বলবো ইনশাআল্লাহ্‌।”…………(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here