অমানিশা❤️পর্ব-৮
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
দেয়ালের সময় নির্দেশক যন্ত্রটা ইংরেজি টুয়েলভ্ সংখ্যার ঘর অতিক্রম করলো কিছুক্ষণ আগে। এখন বারোটা দশ।
পায়ের ব্যান্ডেজটায় আলগা একটা গিঁট বেঁধে, কোল থেকে উঁচু বালিশের উপর তুলে দিয়ে ক্লান্ত শ্বাস ছাড়লো আরশাদ।
মেয়েটা একমূহুর্ত স্হির নেই। একবার এপাশে ফিরছে তো আরেকবার ওপাশে ফিরছে। এতদিন শুনেছে, মেয়েমানুষ শান্তশিষ্ট হয়ে ঘুমায়। অথচ এই মেয়ে অবিকল চড়ুই পাখির মতো করছে।
আরশাদের মা আনতারা ছেলের দিকে চেয়ে রয়েছেন অনেকক্ষণ যাবত। মুনতাহা দু’তিনবার লাথি মেরেছে ঘুমের ঘোরে। ছেলে কিচ্ছু বলেনি। আস্তেধীরে একমনে গজ পেঁচিয়ে দিচ্ছিলো। কি অনড় মনোযোগ! যেনো একটু চাপ দিলে, মেয়েটা একটু ব্যাথা পেলেই অনর্থ হয়ে যাবে।
মা কে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে মৃদু হাসলো আরশাদ। বললো,”কি দেখছো আম্মা?”
তিনি মুচকি হাসলেন। উওর দিলেননা। মুনতাহা আবার পাশ ফিরলো। হাতটা যেয়ে পড়লো উনার কোলের মধ্যে, হাতের উপর। আনতারা স্বস্নেহে আঁকড়ে ধরলেন। চুলোর জলন্ত আগুনের আঁচ প্রথমে হাতেই লেগেছিলো। সেখানটায় হাল্কা লাল। মায়া লাগে দেখলে। তিনি তাকিয়ে ছিলেন হাতের দিকে, আরশাদ ডাকলো,”আম্মা?”
এমনেই তার গলা প্রচন্ড ভারি। পরিষ্কার ভাবে ডাকলে যে কেউ চমকে উঠে। আনতারা তাকালেন। আরশাদ তার মুঠোয় ধরে রাখা হাতের দিকে ইশারা করে বললো,
—“তুমি শখ করে যেই আংটিটা বানিয়ে রেখেছিলো সেটা এই আঙুলে হবেনা?”
আনতারা চমকালেন আবার চমকালেন না। মাঝামাঝি ধরণের একটা হতভম্ব চাহনী স্পষ্ট হলো চোখে। বছরকয়েক আগে তিনি একটা সোনার আংটি বানিয়ে এনেছিলেন। অনেকটা শখ করেই। বলেছিলেন, ছেলের বিয়ের সময় পূত্রবধুকে পড়িয়ে দিবেন। কিন্তু তা আর হয়নি। আংটিটা এখনো বাক্সের ভেতর নতুন-ই পড়ে আছে।
আরশাদ আবার প্রশ্ন করলো,”হবে আম্মা? নাকি ছোট করে কাটিয়ে আনতে হবে? হাত তো চিকন।”
আনতারা হেসে ফেললেন এবার। সুপ্ত সম্মতিতে বারদুয়েক মুনতাহার অনামিকায় বৃদ্ধাঙ্গুল বুলিয়ে পরখ করে বললেন,
—“হয়ে যাবে। কিন্তু..”
আরশাদ ভ্রু উঁচালো। সাথেসাথেই বললো,
—“কিন্তু কি?”
হাসি নিভলো। আনতারা নিষ্প্রভ কন্ঠে বললেন,
—“কিভাবে বাবা?”
আরশাদ প্রশ্নাত্বক দৃষ্টিতে চাইলো। হতভম্ব কন্ঠে বললো,
—“কিভাবে মানে? তোমার ছেলে পছন্দ করেছে আম্মা। তোমার নিশ্চয়ই আপত্তি থাকার কথা না?”
আনতারা মাথা নাড়ালেন দ্রুত,
—“আরে না, আমার আপত্তি থাকবে কেনো? আমি ওর বাবার কথা বলছিলাম।”
আরশাদ উঠে দাড়ালো। বিছানায় রাখা ফোনটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বললো,
—“সেসব আমি দেখে নিবো আম্মা। আসি তাহলে। দাদু একা বাসায়। তুমি ওকে দেখে রেখো রাতে। শুভ রাত্রি।”
–
মুনতাহার ঘুম ভাঙলো দেরি করে। বাইরে রোদ উঠেছে। সাদা মেঝে ভর্তি করে আল্পনার মতো ছড়িয়ে আছে হলদে রশ্নি। পাখির কিচিরমিচির শব্দ। কাকের বিদঘুটে ডাক। তোড়জোড় করে সকাল হওয়ার জানান দিচ্ছে সময় সচেতন প্রকৃতি।
ভালোভাবে চোখ মেলতেই খানিকটা হকচকিয়ে গেলো সে। এক মহিলার বুকে মাথা গুঁজে রেখেছে। জাপটে ধরে রেখেছে। মহিলার হাত তার চুলের পিছে। কেমন যেনো লাগলো। একটা অচেনা মহিলা তার সাথে কেনো শুয়ে আছে? পিঠ থেকে দ্রুত হাত সরিয়ে নিয়ে বুক থেকে মাথা সরালো মুনতাহা। আনতারা জেগে গেলেন। খুব হাল্কা ঘুম তার। মুনতাহা তার চেহারা দেখতেই আরো একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কোনোকিছু বুঝতে না পেরে শূন্যকন্ঠে বললো,
—“আন্টি আপনি..” কথা শেষ না করেই এদিক ওদিক তাকালো সে। না, এটাতো তারই রুম। পায়ের দিকে চোখ গেলো। আলগা করে করা ব্যান্ডেজ খুলে কাছেই পড়ে আছে। সদ্য পোড়া বিভৎস্য পাজোড়া দেখে ভয় পেয়ে গেলো মুনতাহা। চাদর খামছে ধরলো দু’হাতে। মুখ দিয়ে অষ্ফুস্ট স্বরে বেরোলো,”আব্বু..”
আনতারা মায়াভরা চোখে তাকালেন। নিজ থেকেই মুনতাহার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে নরম কন্ঠে বললেন,
—“দেখোনা মা। ভয়ের কিছু নেই। ক’দিন পরই ঠি ক হয়ে যাবে।
মুনতাহা কাঁদো কাঁদো অসহায় স্বরে ডাকলো,
—“আব্বু কোথায়?”
আনতারা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মাহতাব সাহেবকে ডাক দিতেই হুড়মুড় করে ছুটে আসলেন তিনি। বাবাকে দেখে তবেই শান্তি হলো মেয়ের। অস্বস্তি কেটে গেলো। তার গোল গোল নরম চোখের চাহনী সহজেই বুঝতে পারলেন মাহতাব সাহেব। এগিয়ে আসতেই আনতারা সরে দাড়ালেন। মাহতাব সাহেব দু’গালে হাত রাখলেন। মাথায় ছোট্ট চুমু খেয়ে বললেন,
—“এইতো আব্বু আছি। পায়ে এখনো ব্যাথা হচ্ছে আম্মা?”
মুনতাহা একবার পায়ের দিকে তাকালো। সাথেসাথেই চোখ বুজে ফেললো বাচ্চাদের মত। পা দুটো জ্বলছে। ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই জ্বলছে। ভীষণ জ্বলছে। বাবার কাছে তার সহজ সীকারোক্তি,”পা খুব জ্বলছে আব্বু।”
মাহতাব সাহেবের ভেতরটা কেঁদে উঠলো। যন্ত্রনায় হৃদপিন্ডে সূল বিঁধলো কয়েক’শ। তাড়াহুড়ো করে ঠান্ডা পানিতে কাপড় ভিজিয়ে আনলেন তিনি। পায়ে মুছিয়ে দিলে জ্বালাপোড়া একটু হলেও কমবে।
–
তখন সন্ধ্যা।
মাহতাব সাহেব বসে ছিলেন মুনতাহার সাথে। মেয়ে তার বুকে মাথা রেখে চোখ বুজে রেখেছে। ঘুমাচ্ছেনা তবু চোখ বোজা। তিনি মাথায় হাত বুলাচ্ছেন অনবরত। আরশাদরা আসবে একটু পরে। আরশাদ জানিয়েছে সকালেই। অফিসে যাবার আগে একবার মেয়েটাকে দেখে গিয়েছিলো। তখনই বলেছে, সন্ধ্যার দিকে অফিস থেকে ফিরেই তার মাকে নিয়ে এসে আংটি পরিয়ে যাবে মুনকে। তার অসম্মতি নেই বরং যত দ্রুত সম্ভব ততোই ভালো। মুন জানেনা। বলবে বলবে করেও বলতে পারেননি। চোয়াল ভারি হয়ে আসে খালি। মেয়েদের কেনো বিয়ে দিতে হয়?
কলিংবেল বাজলো। মুনতাহা মাথা উঠিয়ে নিলো আস্তে করে।
আনতারা আরশাদ আর সাবিনা বেগমকে একসাথে ঘরে দেখেই খানিকটা গোলমেলে হয়ে গেলো মুনতাহা।
ভাবলো, অসুস্থ বলে তাকে দেখতে এসেছে হয়তো।
কিন্তু মাথাটা ঘুরে উঠলো তখনই যখন কিছুক্ষণ পরে আরশাদের মা সামনে বসে বাক্স থেকে আংটি বের করে বললেন,”দাও মা, হাত দাও।”
মুনতাহা কিছু বুঝে উঠতে পারলোনা। হাতদুটো জড়োসড়ো করে গুটিয়ে নিলো দ্রুত। কেমন কেনো লাগলো। জ্ঞাতশূন্য চোখে বাবার দিকে চাইলো সে। আরশাদ আস্তে করে বললো,”আংকেল? বলেননি ওকে?”
মাহতাব সাহেব ঝুঁকে গেলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন,
—“মুন আম্মু হাত বাড়িয়ে দে। দেখ, তুই বড়ো হয়েছিসনা? আব্বুর কথাতো মানে তাইনা? শোন মা, আব্বু আর ক’দিন থাকবে বল?”
এতটুকু শুনতেই থরথর করে কেঁদে দিলো মুনতাহা। চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে গেলো। চেহারা রক্তলাল হয়ে গেলো মূহুর্তেই। মুখের চোয়াল অসম্ভব ভারি হয়ে উঠলো। দু’হাতে বাবার পেট জড়িয়ে ধরে ভীত কন্ঠে বললো সে,
—“আব্বু, এসব কেনো বলছো?” তারপর একটু থেমে সজোরে হেঁচকি তুলে বললো,”তুমি আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে?”
মাহতাব সাহেব দু’হাতে মাথা টা বুকের সাথে চেপে রেখেই ধরা গলায় বললেন,
—“আহা! আম্মা কাঁদেনা। উনারা শুধু আংটি পরিয়ে যাবেন। বিয়ে পরে মা। তুই হাত বাড়িয়ে দে। আব্বুর কথা শুনবিনা?”
মুনতাহা চোখভর্তি পানি নিয়ে গুটিগুটি করে একবার আরশাদের দিকে তাকালো। হাতদুটো তখনো শক্ত করে গুটিয়ে রেখেছে।
আরশাদ পাশ থেকে ধীরকন্ঠে বললো,”আংকেল থাক আজকে, আপনি বুঝিয়ে বলেন পরে। বাচ্চা মানুষ, অসুস্থ এমনিই। কান্নাকাটি করলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
মাহতাব সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আদুরে কন্ঠে বললেন,”আম্মা, এমন করেনা মা। আমি বলছিনা হাত বাড়াতে? ভয় কেনো? আব্বু বলছিনা? হাত দাও মা। উনি বড় না? অসম্মান হচ্ছে কিন্তু।”
মুনতাহা চোখ নিচে নামিয়ে নিলো। হাত বাড়িয়ে দিলো ধীরগতিতে। আনতারা মুচকি হেসে আংটি পরালেন তার অনামিকা আঙ্গুলে।
~চলবে~