#অপেক্ষা
#পার্ট_০৪
#আফরিন_ইনায়াত_কায়া
.
.
রেওয়াজ একজন ধর্ষনকারী।শুধু ধর্ষন না মেয়েদেকে ধর্ষন করে নির্মমভাবে তাকে নির্যাতন করে।শরীরের অংগপ্রতঙ্গ কেটে ফেলে।
গেল বছর অক্টোবর মাসে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রী রাফিয়াকে রক্তাক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় ভার্সিটির পেছনের পুকুর পাড়ে।রেওয়াজ ওকে ধর্ষন করে নির্মমভাবে নির্যাতন করে সেখানে ফেলে রেখে যায়।পরের দিন সকালে তাকে নিয়ে যায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।সেখানে মুমুর্ষূ অবস্থায় তাকে ভর্তি করানো হয়৷প্রায় ৩ দিন সময় লেগেছিল মেয়েটির জ্ঞান ফিরতে।জ্ঞান ফিরে চোখের সামনে রেওয়াজকে দেখে চেচিয়ে উঠে সে।পাগলের মত ছটফট করতে থাকে। পরে পুলিশ ওর স্টেটমেন্ট নিলে সেখানে লেখা ছিল রেওয়াজ তাকে প্রেম প্রস্তাব দিয়েছিল।কিন্তু সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার কারনে রেওয়াজ অপমানের শোধ নিতে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষন করে আর নৃশংস নির্যাতন করে তাকে ফেলে রেখে যায়। রেওয়াজ মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যায় যাতে কেউ তার উপর সন্দেহ না করে।সে ভেবেছিল হয়তো আঘাতের কারনে মেয়েটি সব ভুলে যাবে। কিন্তু তা হয় নি।মেয়েটিকে এর পর পুলিশ সুরক্ষায় রাখা হয়েছিল।মেয়েটির বাবা মা রেওয়াজের নামে কেস করেছিল।দীর্ঘ এক মাস পর মেয়েটিকে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ দেওয়া হয়। মেয়েটি পুলিশের কাছে তার জবান বন্দী দিয়েছিল যেখানে লিখা ছিল
-রেওয়াজ ওর এক মেয়ে ফ্রেন্ডকে দিয়ে রাফিয়াকে হল থেকে ডেকে নিয়ে যায়। যে মেয়েটি রাফিয়াকে হল থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল সে রাফিয়াকে ফোন করে ভার্সিটির পেছনের পুকুরপাড়ে ডেকেছিল।বলেছিল সে সন্ধ্যা বাতাসে হাটতে বেরিয়েছিল।হঠাত করে নাকি পা পিছলে পুকুড় পড়ে গিয়ে কোমড়ে ব্যাথা পায়। তারপক্ষে একা একা হলে ফেরা সম্ভব না। তাই সাহায্যের জন্যে ফোন করে রাফিয়াকে ডেকেছিল।রাফিয়াও বান্ধবীর বিপদ শুনে কোন কিছু না বুঝে চলে যায় পুকুড় পাড়ে।সেখানে গিয়ে বুঝতে পারে সে কতটা বড় ভুল করেছে।
রেওয়াজ দিপার গলায় ছুড়ি লাগিয়ে দিপাকে দিয়ে ফোন করায়। রাফিয়াকে দেখা মাত্রই সে দিপাকে এক কোনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে রাফিয়াকে নিয়ে চলে যায়।দিপা উঠে দাড়ানোর আগেই রেওয়াজ রাফিয়াকে নিয়ে চলে যায়।
.
.
রাফিয়া আর দিপা দুজনেরই স্টেটমেন্ট একই ছিল।তারা দুজনেই রেওয়াজের কাছে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ রেওয়াজকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল।কিন্তু রেওয়াজ ভার্সিটির বিভিন্ন সংস্থার সক্রিয় আর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিল।বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতিশিক্ষার্থীদের তালিকায় ওর নাম ছিল।তাই ওর অনুনয়ে ওকে আইনের কাছে হস্তান্তর করা হয় নি। শুধুমাত্র ভার্সিটি থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল সেই সাথে এটাও বলা হয়েছে যে রেওয়াজ কখনো কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলেও তাকাতে পারবে না।কোন মেয়ের ধারে কাছেও তাকে দেখা গেলে তার বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে।যদিও রেওয়াজ অনেক চেস্টাই করেছিল নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার কিন্তু সব প্রমান এটাই নির্দেশ করছিল যে ও দোষী।ফলাফল আজ সে বিতাড়িত।
এতটুকু বলেই চোখের চশমাটা খুলে সামনের টেবিলে রাখলেন আমজাদ খান।রেওয়াজ ট্রাজেডির পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। প্রথমে মুখ খুলতে না চাইলেও পরে আমার জোরাজুরিতে কথা বের করতে বাধ্য হন নি।আমি এক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।উনি একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বললেন
-আশা করি এখন আর তোমাকে বোঝাতে হবে না যে রেওয়াজ কতটা ক্ষতিকর ছেলে। ওর থেকে যত দূরে থাকবা ততটাই ভালো।
উনার কথা শুনে আমি হাসতে শুরু করলাম।আমাকে হাসতে দেখে তিনি প্রথমে বেশ অবাক হলেন।পরে রেগে গিয়ে বললেন
-এই মেয়ে হাসছ কেন?তোমার ভালোর জন্যে বললাম আর তুমি হেসে উড়িয়ে দিচ্ছ?
আমি হাসি থামিয়ে বললাম
-হাসবো না তো কি করব বলুন স্যার? এমন থার্ড ক্লাস ভিত্তিহীন গল্পকে আপনারা জবানবন্দি হিসেবে নিয়ে একজনকে কাঠগড়ায় দাড় করিয়েছেন।
-মানে কি বলতে চাইছ তুমি?
-স্যার তার ফ্রেন্ডকে রেওয়াজ তুলে নিয়ে গেল আর সে এসে চুপচাপ হলে এসে কাথামুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে এল!আরে স্যার বাংলা সিনেমায়ও তো এর চেয়ে বেশি লজিক থাকে।
লাইব্রেরীয়ান অনেকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন
-চোখের সামনে হঠাত এমন একটা ঘটনা দেখে সে হয়তো ভয় পেয়ে গিয়েছিল তাই কাউকে বলেনি।
উনার কথার জবাবে আমি মুখ পাথরের মত কঠিন করে বললাম
-তার মানে স্যার আপনার সামনে আপনার মেয়েকে ছেলেরা তুলে নিয়ে গেলে তার রেপ করা হবে জেনেও হঠাত এমন ঘটনা দেখে আপনি ভয় পেয়ে যাবেন আর পুলিশে খবর না দিয়ে বাসায় এসে কম্বলের তলে ভয়ে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া হাত পা গরম করবেন।তাই না?গুড আইডিয়া স্যার। কংগ্রাচুলেশন।
কথাটা বলেই উনার জবাবের অপেক্ষা না করেই আমি চলে এলাম সেখান থেকে।
.
.
সময় মানুষকে কত কিছুই না দেখায়!ভেবেছিলাম মাত্র ৪ টে মাস তারপরেই অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটবে।শুরু হবে এক নতুন জীবন।কিন্তু এখন চার মাসের অপেক্ষাকে ৪০০ বছরের প্রতীক্ষা মনে হচ্ছে।যেন এক অনন্ত কাল যেটা কখনো শেষ হবে না।একটা অজানা ধাধা যার উত্তর আমি জানি না।
নাহ এভাবে বসে থাকলে হবে না। কিছু একটা করতেই হবে। এভাবে রেওয়াজকে শাস্তি পেতে দেওয়া যাবে না আমি জানি রেওয়াজ ওরক কিছু করে নি।আমার মন জানে রেওয়াজ নির্দোষ।আমাকে একা পেয়েও যে ছেলে আমার দিকে ঠিকভাবে চোখ তুলে পর্যন্ত তাকায় নি সে কিনা একটা মেয়েকে রেপ করবে তাকে নির্যাতন করবে এটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। রেওয়াজ কে ফাসানো হয়েছে।কে করেছে কেন করেছে আমি জানি না।তবে আমি এর গোড়ায় পৌছেই ছাড়ব। এইভাবে চুপ করে থাকলে একদিন পুরো সমাজেরই ন্যায়ের উপর থেকে ভরসা উঠে যাবে।
.
.
প্রায় দুই সপ্তাহ হয়ে গেছে।আমি রেওয়াজের কোন খোজ নেই নি।ও কেমন আছে কোথায় আছে কিছুই জানিনা।সেদিনের পর থেকে আমি আর রেওয়াজের ব্যাপারে কিছু খোজ ও করিনি।সবাই ভাবছে আমি হয়তো রেওয়াজের কথা ভুলে গেছি।ভার্সিটি থেকে বের হয়ে বাসার পথে পা বাড়িয়েছি।পেছনের এই রাস্তা হল বেয়ে মেইন রোডে গিয়ে উঠে।আমি হল পার হয়ে মাত্র গেট পেরোবো ঠিক তখনি পেছন থেকে কেউ একজন আমার হাত টেনে ধরল।পেছন ফিরে তাকাতেই আমার চোখ বড়বড় হয়ে গেল। আবিদ ভাইয়া শক্ত করে আমার দুহাত চেপে ধরে আছে।আমি ছাড়ানোর চেস্টা করছি কিন্তু পারছি না।আবিদ ভাইয়া আমাকে টানে হেচড়ে পাশের ছোট জংগলে নিয়ে যাওয়ার চেস্টা করছে।আমি টানাটানি করতেই পাশ ফিরিয়ে আমাকে কষে একটা থাপ্পড় দিল।ঠোটের কোনা ফেটে টুপটুপ করে রক্ত ঝরছে।আমি চেচাচ্ছি কিন্তু আশেপাশে কেউ নাই।হঠাত করে গালে থাপ্পড় দেওয়ার মত জোরে একটা শব্দ হল।আবিদ ভাইয়া আমার হাত ছেড়ে গাল চেপে ধরে দাড়ালেন।আমি চোখ তুলে দেখি একটা মেয়ে স্যান্ডেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে।আবিদ ভাইয়া মেয়েটাকে দেখে রাগে গড়গড় করে বলে উঠলেন
-তোর এত বড় সাহস তুই আমার গায়ে হাত তুললি?তোকে তো আমি…..
আবিদ ভাইয়া কিছু করার আগেই মেয়েটা এক কদম পিছিয়ে গিয়ে বলল
-খবর দার একপাও আগাবি না একা মেয়ে দেখলেই জিভে জল আসে তাই না?তুই যাবি এখান থেকে নাকি স্যান্ডেল দিয়ে পিটিয়ে লাল করে দেব?যা..
আবিদ ভাইয়া কি মনে করে গেটের দিকে চলে গেলেন। পেছন ফিরে বললেন
-দেখে নিব তোকে আমি।
মেয়েটা গলা উচিয়ে বলল
– আরে যাহ যাহ।
মেয়েটা আমার দিকে তাকাতেই আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।বুক ফাটিয়ে কাদতে কাদতে বললাম
-আপু আপনি না থাকলে আমার কি যে হতো আজকে।অই শয়তানটা আমাকে…..
মেয়েটা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
-আরে কাদে না।ও চলে গেছে এখন আর ভয় নেই।যা মার খেয়েছে তাতে শিক্ষা হয়ে গেছে।আর বিরক্ত করবে না। নাম কি তোমার?
আমি ফোপাতে ফোপাতে জবাব দিলাম
-কায়া।
-বাহ ভারী মিষ্টি নামতো।আমি রাফিয়া।চল তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
বলেই রাফিয়া পেছনের দিকে হাটতে লাগল।আমার মুখে ফুটে উঠল সূক্ষ্ম হাসির রেখা।……
চলবে