#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
পর্ব_৩৩
©জারিন তামান্না

বেলা ৩ টায় বিয়ে পড়ানোর কথা।এখন বাজে বেলা ৩:৪৭ মিনিট। অথচ বিয়ের বর, কনে দুজনেই গায়েব। বিয়ে বাড়িতে রীতিমত চাপা গুঞ্জন চলছে বর বউ দুজনেরই একসাথে গায়েব হওয়ায়। আমজাদ আলী, ইশতিয়াক আলম, রুকু,দিহান,নিশাত, নাজিয়া অনবরত কল করে যাচ্ছে তাদের নাম্বারে। সিফাতের ফোনে রিং হলেও তা রিসিভ হচ্ছে না আর পলকের ফোন সুইচড অফ বলছে। চিন্তায় সবাই অস্থির হয়ে উঠেছে। কিন্তু, কে কোথায় আছে সেটা জানার কোন উপায় নেই। বিথি তিয়ানকে খুঁজছে, কিন্তু তাকেও পাওয়া যাচ্ছে না। সে আবার কিছু ভুলভাল করলো কিনা সেটাও বুঝতে পারছে না সে। তারও মাথা গরম সব মিলিয়ে। নোরাকে কোলে নিয়ে সারা ঘরময় পায়চারী করছে সে।

বিকেল ৪:৩০ মিনিট।

বাড়ির সদর দরজায় এসে দাঁড়ালো চারজন মানুষ। সিফাত,পলক তিয়ান আর অন্তরা। বড্ড কাহিল লাগছে অন্তরাকে। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা সে। পলক তাকে ধরে রেখেছে একপাশ থেকে। এত বছর পর অন্তরাকে দেখে পলকের পরিবার আত্মীয়স্বজন সবার অবস্থা বিস্ময়ে হতবিহ্বল। আমজাদ আলী ঠিক কি বলবেন জানা নেই তার। আজকের এমন একটা দিনে অন্তরা আবার এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। সবথেকে বেশি অবাক হলেন পলক, সিফাত আর তিয়ানকে অন্তরার সাথে দেখে। ব্যাপারটা ঠিক কি সেটা বুঝে ওঠার আগেই সিফাত আমজাদ আলীকে উদ্দেশ্য করে বললো,
_বাবা, আগে ঘরে চলুন প্লিজ। পরে বলছি সব।
_মৃণ্ময়ী, আপুকে নিয়ে আসুন।
_জ্বী। বলেই অন্তরাকে নিয়ে গেল নীচের একটা গেস্টরুমে।
আর তাদের পিছু পিছু গেল পলকের পুরো পরিবার,চাচা চাচী আর মামা-মামী। সিফাত তার পরিবারের কাউকে ঘরে যেতে নিষেধ করায়,তারা সবাই বাইরেই অপেক্ষায় রইলো।

____________________________________

_তুমি এখানে কি করছো অন্তরা? গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন আমজাদ আলী।
_আপাকে আমি নিয়ে এসেছি বাবা। অন্তরার পাশে বসে পলক বললো।
_তুমি নিয়ে এসেছো সেটা তো সবাই দেখেছি আমরা, কিন্তু ও এখানে কেন? আর তুমিই বা কোথায় গিয়েছিলে? আজ তোমার বিয়ে ভুলে গেছো সেটা? শেষ কথাগুলো বেশ ধমকের স্বরে বললেন আমজাদ আলী।তার এহেন প্রতিক্রিয়ায় কেঁপে উঠলো পলক,অন্তরা আর শাহনাজ বানু।অন্তরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।
_বাবা,প্লিজ আপনি হাইপার হবেন না। ডক্টর আপনাকে স্ট্রেসড নিতে নিষেধ করেছে। -সিফাত বললো।
_তুমি বুঝতেছো না বাবা…এই মেয়েটা এখানে কেন এসেছে সেটা জানতে হবে আমাকে। ওর জন্য কম কিছু সহ্য করতে হয়নাই আমাদের। পলকের জীবনটাও শেষ করে দিতে গিয়েছিলাম আমি। আমার ছেলেটা আলাদা হয়ে গেল ওর জন্য। আজ পলকের বিয়ে ছিল আর সে বাড়ি থেকে উধাও। তাও এই মেয়েটার জন্য। তাও তুমি আমাকে শান্ত থাকতে বলতেছো? বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন আমজাদ আলী।
_বাড়িতে কিন্তু আমিও ছিলাম না বাবা! আপনি একা মৃন্ময়ীকে দোষারোপ করতে পারেন না। আপনি বসুন এখানে আমি আপনাকে বলছি সব। বসুন আপনি।-বলেই তাকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল সিফাত।

সিফাতের কথায় চেয়ারে গিয়ে বসলেন তিনি।তারপর সিফাত বলতে শুরু করলো।
_আপু লাস্ট ১’৫ মাস ধরেই মৃন্ময়ীর কন্টাক্টে ছিলেন।আপনি যখন হাসপিটালে এডিমিট ছিলেন তখনই প্রথম মৃন্ময়ীর সাথে দেখা হয় উনার। চেকআপে গিয়েছিলেন উনি।তারপর যখন মৃন্ময়ী সবটা জানলো তারপর থেকেই তারা যোগাযোগে ছিল। আর আমি উনার ব্যাপারে জানতে পারি লাস্ট ১৭ দিন যাবৎ। তারপর থেকেই উনি আমার গুলশানের ফ্ল্যাটে ছিলেন। আজ উনার প্রচন্ডরকম পেইন হওয়ায় ইমার্জেন্সিতে উনাকে হসপিটালে এডিমিট করা হয়। সেখানেই গিয়েছিলেন মৃন্ময়ী। আর উনার সাথে গিয়েছিলাম আমি আর তিয়ানও।কারণ, উনার পেইন হওয়ার খবরটা আমরা দুজনেই পেয়েছিলাম নিজেদের ফোনকলে।ডক্টর বলেছেন উনার এখন পর্যাপ্ত যত্ন আর মেন্টাল সাপোর্ট প্রয়োজন। আর এসবের জন্য উনার নিজের পরিবারের চাইতে থেকে ভালো আর কি হতে পারে! এই জন্যই আজ উনাকে এখানে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেই আমরা।
_আমি ওকে আমার বাড়িতে জায়গা দিবো না সিফাত। আমার জন্য ও মৃত!
_ভুল তো সবাই করে বাবা! আর ভুল শোধরানোর একটু সুযোগ সবারই প্রাপ্য। -সিফাত বললো।
_ও যেটা করেছে সেটা কোন ভুল ছিল না সিফাত। বিশ্বাসঘাতকতা ছিল। কম হেনস্তা হতে হয়নি আমাদের ওর জন্য!
_কিন্তু,এর পেছনে কারণ তো তুমিই ছিলে, বাবা। তোমার জেদের কারণে আপা বাধ্য হয়েছিল বাড়ি ছেড়ে পালাতে।আপা যখন বলেছিল সে নিলয় ভাইকে ভালোবাসে তাহলে কেন মেনে নাওনি তুমি সেটা? কম তো আকুতি মিনতি করেনি সে তোমার কাছে। তোমার সবচেয়ে কাছের প্রিয় মেয়েও তো আপাই ছিল সবসময়। সব আবদার মেনেছো তার। তাহলে শুধুমাত্র নিলয় ভাইয়ার কোন পরিবার নেই বলে কেন মেনে নাওনি তাকে তুমি? এতক্ষণ চুপচাপ সিফাত আর আমজাদ আলীর কথোপকথন শুনছিল পলক সহ ঘরে উপস্থিত সকলেই। কিন্তু আমজাদ আলীর এহেন কথায় আর চুপ থাকতে পারেনি পলক। একপ্রকার চেঁচিয়েই বললো কথাগুলি।
_ তুমি যেটা জানো না সেটা নিয়ে কথা বলো না পলক! গম্ভীর গলায় বললেন আমজাদ আলী।
_আচ্ছা,,বেশ! নাই জানলাম আমি কিছু। ওটা নিয়েও কিছু নাই বললাম আমি। তুমি শুধু এটুকু বলো আপা যখন তোমার কাছে এসেছিল,,ক্ষমা চেয়েছিল কেন ফিরিয়ে দিয়েছিলে তুমি? এটা জেনেও কেন ফিরিয়ে দিয়েছিলে যে আপার গর্ভে নিলয় ভাইয়ার সন্তান আর ভাইয়া.. বেশ উত্তেজিত স্বরেকথা বলছিল আজ পলক। কিন্তু শেষের এটুকু বলতেই ঝরঝর করে কেঁদে দিল পলক।অন্তরাও এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। ঘরে উপস্থিত সবাই হতবাক। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না তারা। তবুও কেবল আমজাদ আলী ঘরে উপস্থিত থাকায় চুপ করে আছে সবাই। কিন্তু শাহনাজ বানু এবার আর চুপ থাকতে পারলেন না। ভয়ার্তক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,নিলয়.. কি সাজি??
পলক কাঁদছে। কান্নার দমকে কিছুই বলতে পারছে না। তাই সিফাতই বললো,
_৪ মাস আগে একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে নিলয় ভাইয়া। যেহেতু নিলয় ভাইয়ার কোন পরিবার ছিল না,,আপুকে নিয়ে তিনি আলাদা বাসা ভাড়া করে থাকতেন। তাই এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরে ওখানে একা থাকাও বেশ কঠিন হয়ে উঠেছিল আপুর জন্য। বাধ্যহয়ে আপু বাবার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। বলেছিলেন তাকে সব কিন্তু বাবা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। একটুকু বলা শেষ করেই ছোট একটা শ্বাস ফেললো সিফাত।এত সব শুনে সবাই বিস্ময়ে হতবিহ্বল। শাহনাজ বানু অন্তরার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে কেঁদে যাচ্ছেন। তার স্বামীর রাগ জেদ সম্পর্কে তিনি অবগত। ৩৩ বছরের সংসারে আজও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি তিনি নিজের স্বামীকে। কিন্তু,তাই বলে এতটা নিষ্ঠুর তিনি হবেন নিজের সন্তানের প্রতি এটা তিনিও মানতে পারছেন না।
_বাবা, তুমি সত্যিই করেছো এমন? হতবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলো পলাশ।
_হ্যাঁ,,করেছি। যে মেয়ে আমার ২৪ বছরের আদর স্নেহ পায়ে ঠেলে এভাবে আমাকে সবার কাছে অপদস্থ করে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারে তার জন্য এটাই ঠিক আছে।
_এতটা নিষ্ঠুর কেউ ক্যাম্নে হইতে পারে আব্বা? গমগমে স্বরে বললো নিশাত।
_সেসবের কৈফিয়ত আমি তোমাদের দেবো না নিশাত। ছোট তুমি! ছোটর মতই থাকো।
_আমি ছোট…বাকিটুকু বলার আগেই ওর হাত চেপে ধরে থামিয়ে দিল তিয়ান। কথার মাঝে বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে নিশাত ওর দিকে তাকাতেই চোখের ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বললো সে। নিশাতও বাধ্য মেয়ের মত চুপ করে তার কথায়।
_বাবা,,মানুষ ভুল করে।কিন্তু ভুলের পরে একটা সুযোগ কিন্তু সবারই প্রাপ্য সেটা শোধরানোর জন্য। বড় আপু যে ভুল করেছিল সেটার কারণ কিন্তু একভাবে আপনিই ছিলেন। শান্তস্বরে বললো সিফাত।
_আমি ওকে আমার বাসায় জায়গা দিবো না সিফাত। তুমি দয়া করে এই নিয়ে আর কিছু বলতে এসো না।
_এটাই তোমার শেষ সিদ্ধান্ত বাবা?গম্ভীর স্বরে বললো পলক।
_হ্যাঁ। এখন যাও,,বিয়ের জন্য প্রস্তুত হও।সবাই অপেক্ষা করছে বাইরে।
_কাউকে অপেক্ষা করতে হবে না। চলে যেতে বলো তাদের।
_মানে?
_তুমি যদি আপাকে মেনে না নাও,তাহলে আমিও করবো না এই বিয়ে। আপাকে নিয়ে চলে যাবো তোমার বাড়ি ছেড়ে।
_এইই সাজি! না।কি.. কি..ইই বলতেছিস তুই এগুলা? এমনিতেই আমার কারণে বাবাকে একবার এতকিছু ফেইস করতে হইছে এখন আবার তোর জন্যও যদি.. আতঙ্কিত স্বরে বললো অন্তরা।
_তুই চুপ থাক আপা। মানুষের জেদ তাকে কতটা নিষ্ঠুর করে দিতে পারে আমিও দেখবো আজকে। পলকের কন্ঠে রাগ জেদ স্পষ্ট।
_পলক!! কি আজেবাজে কথা বলতেছো তুমি? বিয়ে কোন ছেলেখেলা নাকি ? যাও তৈরী হও।- ধমকে উঠলে আমজাদ আলী।
_ছেলেখেলা না হলে এত বছর পরেও কেন মেনে নিতে পারছো না তুমি আপাকে? নিলয় ভাইয়ার সাথেও তো বিয়ে হইছিল ওর। তার সন্তানের মা হবে ক’দিন পরে। তাহলে তুমি কেন মানোনি এই বিয়ে?
_ এমন অকৃতজ্ঞ মেয়েকে আমি কখনোই মানবো না।
_তাহলে আমিও করবো না এই বিয়ে।
_সিফাতের পুরো পরিবার বাইরে অপেক্ষা করছে পলক। তামাশা করবা না কোন তুমি আজকে। -কঠিন গলায় বললেন আমজাদ আলী।
_মৃন্ময়ী না চাইলে আমিও করবো না এই বিয়ে। বাকিটা আপনার উপর,বাবা। আপনি কি করবেন তার উপর নির্ভর করবে সবটা।
_সিফাত…দেখো বাবা! তুমি এর মাঝে এসো না। এটা আমাদের পারিবারিক ব্যাপার,তুমি..
_আমি কি তবে এই পরিবারের বাইরে বাবা? এতদিনে কি এই পরিবারের সাথে কোন সম্পর্ক তৈরী হয়নি আমার?

সিফাতের এহেন কথা শুনে চুপ হয়ে গেলেন আমাজাদ আলী। তাকে চুপ থাকতে দেখে সিফাত এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো তার সামনে। সিফাতকে এভাবে দেখে চকালেন তিনি। সিফাতকে বাঁধা দেওয়ার আগেই বড্ড শান্ত সহজ স্বরে সিফাত বললো,
_মৃন্ময়ীর কাছে শুনেছি আপু আপনার খুব কাছের ছিল। তার সব আবদার আপনি অনায়াসে মেনেছেন, প্রশ্রয় দিয়েছেন সবসময়। অথচ, সেই মেয়েটাই যখন আপনাকে ভরসা করে নিজের মনের কথাটা বললো আপনি নিজের জেদের কারণে সেটা নাকোচ করলেন। তাই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কাজটা করতেও সে বাধ্য হয়েছিল।শুনেছি,বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে কোন সন্তান সুখী হয় না কখনো। আপুও পারেনি পুরোপুরি সুখী হতে। নিলয় ভাইয়াকে সে হারিয়েছে।একলা হয়ে গেছে। কিন্তু, সেও তো মা হতে চলেছে। নিজের সন্তানের জন্য একটা পরিবারের আশ্রয় পেতেই সে বাধ্য হয়ে আপনার দোরগোড়ায় ফিরে গিয়েছিল। আর আপনি আপনার রাগ জেদের কারণে এই অবস্থাতেও ফিরিয়ে দিয়েছেন তাকে। বাবা মা কি এতটাও নিষ্ঠুর হয় কখনো, বাবা? আপনি প্লিজ আরেকটা সুযোগ দিন আপুকে। তার এই অনাগত সন্তানটাকে একটা নিরাপদ আশ্রয় দিন।একটা পরিবার দিন। এটা পাওয়াটাও বাচ্চাটার অধিকার,বাবা। এই অধিকার ক্ষুণ্ণ করবেন না প্লিজ।

আমজাদ আলীর চোখ টলমল করছে। হাজার হলেও তিনিও একজন বাবা। বাবা মা সন্তাকে তাদের সবটা উজার করে দিয়ে ভালোবাসেন। স্নেহ মমতা দিয়ে বড় করেন।তাই সন্তানের থেকে পাওয়া সামান্য আঘাতও তাদের প্রচুর কষ্ট দেয়। অন্তরা তার সবচেয়ে প্রিয় মেয়ে ছিল।আর সেই মেয়েটাকে নিষেধ করার পরেও তার অবাধ্য হয়ে তাকে কষ্ট দিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। এই কষ্টটাই তিনি সহ্য করতে পারেননি।তার রাগে জেদে এমন একটা অবস্থাতেও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি অন্তরাকে। কিন্তু এখন সিফাতের কথায় তিনি নিজের রাগ জেদের কারণে ঘটা ঘটনাগুলোর জন্যই অনুতপ্ত। কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু,,তিনি বাইরে সেসবের কিছুই প্রকাশ করলেন না। কঠিন গলায় বললেন,
_পলাশের মা! পলককে বিয়ের জন্য তৈরী হতে বলো। আর বাকিরাও যার যার কাজে যাও। বিয়ে বাড়িতে অনেক মেহমান।তাদের দেখো। তারপর সিফাতকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
_বাবা তুমিও যাও। তৈরী হয়ে নাও। দুপুরে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। এখন প্রায় বিকাল শেষ। আর দেরি করো না। বলেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর, দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার আগে পলককে বললেন,
_এই ভাবে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার দরকার নেই পলক। বিয়ে হচ্ছে,,শশুড় বাড়ি যাও। তুমি গেলে বাড়তি একজনের জায়গা এমনিতেই হয়ে যাবে। -বলেই তিনি বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

ঘরে উপস্থিত সকলের মনেই খুশির ঝলক। সরাসরি কিছু না বললেও যে তিনি অন্তরাকে থাকতে দিতে রাজি হয়েছেন সেটা সবাই বুঝে গেল। নিশাত পলাশ নারাজ পলকের উপর। সব জেনেও তাদের কিছু না জানানোর জন্য।।তারপর একটু আগে কেমন নিয়ে করবেনা বলে জেদ ধরেছিল? সিফাত না থাকলে বোধয় খারাপ কিছু একটা সত্যিই ঘটে যেত আজ।

পলক কাঁদছে। খুশিতে কাঁদছে সে। কাঁদতে কাঁদতেই সিফাতের দিকে চাইলো সে। মুচকি হেসে সব ঠিক আছে বলে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করলো সে পলককে। পলকও চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে কৃতজ্ঞতা জানালো তাকে। এই মানুষটাকেই সে চায়। খুব করে চায়। বাকি সারাটা জীবনের জন্য…প্রতিটা মূহুর্তের জন্য চায়। এই মানুষটাকে কষ্ট দেওয়া বা ঠকানো অসম্ভব তার জন্য। তাই এতদিন সাহস করে না বলা কথাটাও বিয়ের আগেই সে বলে দিতে চায় সিফাতকে। নিজের অতীতের সবটা বলেই সিফাতের হাত ধরে নতুন জীবনে পা রাখতে চায় সে। এখন একটা সুযোগ চাই শুধু তাকে সবটা বলার।

____________________________________

বর্তমান,

আয়নায় মুখ দেখার পর মিষ্টিমুখ করানো হয়েছে নতুন বর বউকে। এবারেও একজনের খাওয়া মিষ্টিটা আর একই গ্লাসের পানি খাওয়ানো হয়েছে তাদের দুজনকে।এতে নাকি স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা বাড়ে।
সব আচার অনুষ্ঠান শেষে ফার্ম হাউজের গার্ডেনে আয়োজন করা পার্টিতেও সামিল হলো সবাই। সেখানে নতুন বর বউকে অভিনন্দন আর শুভেচ্ছা জানালো সবাই।বিথি তো মহাখুশি। তার মনের ভয়টাও কেটে গেছে।তিয়ান, পলক আর সিফাত প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ জায়গাটা পেয়েছে।তিয়ান তাকে বলেছে সবটা।পলকের সাথে,সিফাতের সাথে এ কদিন যা যা কথা হয়েছে তার সবটাই খুলে বলেছে। প্রথমে তিয়ানের উপর ভীষণ রকম রাগ হয়েছিল বিথির। কিন্তু,,সেও তো জানে তিয়ান কেমন আর পলককে সে কতটা ভালোবেসেছিল।আর আজও ভালোবাসে। তাছাড়া,,পলকের বোঝানার পর সে খুশি মনে সবটা মেনে নিয়েছে।নিজের কাজের জন্যও অনুতপ্ত সে। সে নিজেই বলেছে সিফাতই বেস্ট পলকের জন্য। আর তিয়ানের এই উপলব্ধিটাই বিথির সব রাগ উড়িয়ে নিয়ে গেছে নিমিষেই। তার এখন স্বস্তি লাগছে খুব। সম্পর্কগুলোও ভালো আছে। বরং আগের থেকেও বেশি স্ট্রং হয়ে গেছে।

একে একে যখন সবাই নতুন বিবাহিত জুটিকে অভিনন্দন জানাতে ব্যস্ত তখন স্টেজে উঠে এলো তিয়ানও। পলক কিছুই বলতে পারেনি সিফাতকে। বলার সুযোগই পায়নি বলা চলে। তার মনে কিছুটা খচখচে ভাব থাকলেও এত কিছুর মাঝে সেটাকে আর পাত্তা দেয়নি সে।সিফাতকে সে কষ্ট দিতে চায় না।আর কিছু কথা অন্তরালে থাকাই ভালো। তাই সবটা এখন ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে সে।

তিয়ানকে দেখেই আলতো হাসলো সিফাত। বললো,
_Hey, Tiyan. কি অবস্থা?

সিফাতের এহেন প্রশ্নে একবার পলকের দিকে চাইলো সে। তারপর সিফাতের দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে বললো,
_ভালোবাসি তো! তাই পলক যেটাতে খুশি সেটায় আমিও । বলেই এগিয়ে গিয়ে হাগ করলো সিফাতকে। তিয়ানের এমন কথায় খুব স্বস্তি পেল সিফাত। সত্যিই সে পলককে ভালোবাসে খুব। আর ভালোবাসে বলেই পলকের চাওয়াটাকে মন থেকে সম্মান করতে পেরেছে। মেনে নিয়েছে বাস্তবতাটাকে। তার মৃন্ময়ী ভাগ্যবতী বটে! বিথি আর তিয়ানের মত বন্ধু আছে তার জীবনে।যারা সর্বাবস্থায় তার ভালো চায়। সন্তুষ্টচিত্তে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকেও হাগ করলো সিফাত। সিফাত কে ছেড়ে পলকের কাছে এগিয়ে গেল তিয়ান। আলতো হেসে বললো,
_Congratulations Shamkonna.
_Thanks Tiyan. মৃদু হেসে বললো পলক। তারপর,পলকে দেখিয়ে সিফাতকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো সে একবার পলককে হাগ করতে পারে কিনা! সিফাত খুশি মনে চোখের ইশারায় তাকে অনুমতি দিল। অনুমতি পেয়েই আলতো করে জড়িয়ে ধরলো সে পলককে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
_তোমার জন্য সিফাত ভাইয়ার থেকে পার্ফেক্ট আর কেউ হতো না পলক। কখনো কষ্ট দিও না তাকে।তুমি খুব খুব খুব সুখী হবে ইন শাহ আল্লাহ। বলেই পলককে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। মৃদু হেসে স্টেজ থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তার হাত টেনে ধরলো পলক। তিয়ান তার দিকে ফিরে চাইতেই খুব আদুরে স্বরে বললো পলক,
_তুমিও থাকবে তো আমার পাশে,,সারাজীবন?
_Always dear. বলেই আলতো করে তার গাল ছুঁয়ে দিল তিয়ান। পাশে দাঁড়িয়ে এই সবটাই দেখলো সিফাত। মনে মনে বললো,আলহামদুলিল্লাহ!

____________________________________

রাত ৯:৪৪ মিনিট।

পলককে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সিফাতদের ঢাকার বাড়িটাতে। কেঁদেকেটে একাকার অবস্থা পলকের। বিদায়ের সময় খুব কেঁদেছে সে।সিফাত বুঝিয়েছিল তাকে। এত কান্না কাটির কিছু নেই।এই পরিবারটা আজীবন তারই থাকবে।শুধু ঘর বদল হচ্ছে।নতুন একটা পরিবার পাচ্ছে সে। কিন্তু,পলক মানেনি। রুকুও সিফাতকে ধমকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। বলেছে,তুই বুঝবিনা এই কষ্টটা। তারপর থেকে সিফাত কিছুই বলেনি আর।

আজ সারাদিনও কম কাঁদেনি মেয়েটা। বিয়েতে মেক আপ করবে না করবে না বলেও হালকা পাতলা মেক আপ তাকে করতেই হয়েছে। কারণ কেঁদেকেটে চেহারার হাল বেহাল করে ফেলেছিল সে। সিফাত এতক্ষণ কিছু না বললেও এবারে একরকম ফুঁসে উঠলো সে। চাপা রাগের স্বরে বললো,
_তোমাকে তো আমি বিয়ে করে নিয়ে যাচ্ছি মৃন্ময়ী। কিডন্যাপ করে নয়। এভাবে কান্না করছো কেন? এত কষ্ট কেন দিচ্ছো আমাকে?
সিফাতের এহেন ধাঁচের কথা শুনে চকিতেই কান্না থেমে গেল পলকের। ফ্যালফ্যাল করে কতক্ষণ সিফাতের দিকে চেয়ে থেকে হতবাক স্বরে প্রশ্ন করলো তাকে।
_আমার বিয়ে হয়েছে,,পরিবার আমি ছেঁড়ে এসেছি, কষ্ট হচ্ছে আমার..তাই কান্নাও আমি করছি ; এতে আপনি কষ্ট পাচ্ছেন কেন?
_কষ্ট পাচ্ছি কারণ আপনি আর আমি তো আলাদা নই এখন থেকে ! আমার অর্ধেক অস্তিত্বই তো এখন আপনার হয়ে গেছে। কেবলই আপনার। সিফাতের কন্ঠে অদ্ভুত ঘোর।আর চোখ জোড়ায় অপ্রতুল ভালোবাসা স্পষ্ট।
ওই চোখ জোড়ার দিকে কিছুসময় চেয়ে রইলো পলক। কান্না থামার পর ফুপাচ্ছিল পলক। এখন সেটাও থেমে গেছে তার। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না সে ওই গভীর দৃষ্টি পানে। দৃষ্টি সরিয়ে নিল সে।বাইরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো কেবল আপনমনেই।

____________________________________

আলম ম্যানশনের সুবিশাল গেট পেরিয়ে ঢুকলো সিফাত আর পলকের বিয়ের গাড়িটা। রাত এখন ১১:২০মিনিট। বেশ রাত হয়ে গেছে আসতে আসতে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর কখনো আসা হয়নি পলকের এ বাড়িতে। বিয়ের কার্ড দিতে বরপক্ষকে দাওয়াত করার সময় আমজাদ আলী,পলাশ,নিশাত, পলকের চাচা এসেছিলেন এই।বাড়িতে। নিশাত তাকে বলেছিল সিফতদের বাড়িটা বিশাল। রাতের অন্ধকারে বাইরের লন খুব একটা দেখা না গেলেও ঝলমলে আলোক সজ্জায় সজ্জিত বাড়িটা দেখে এর আয়তন বেশ আন্দাজ করা যাচ্ছে। পলক খুব একটা না বুঝলেও দেখলো যতটা দেখে যায়।

বাসার সদর দরজায় এসে গাড়ি থামার পর সিফাত নিজে পলকের হাত ধরে নামিয়েছে গাড়ি থেকে। নামানোর সময় বলেছে, আপনার একান্ত আপন নীড়ে আপনাকে স্বাগতম, মৃন্ময়ী!

খুব ধুমধাম করে বরণ করা হয়েছে পলককে। মিসেস.রেহনুমা, রেহানা, রুকু,রিহান আবিদ, দিহান, ইয়ানা, আলম ম্যানশনের কয়েকজন সার্ভেন্ট সবাই ছিল পলককে বরণ করার জন্য। কেবল সারা ও ইশতিয়াক আলম বাদে। গাড়ি থেকে নেমেই তারা যার যার মতো নিজের ঘরে চলে গেছে। বেশ রাত হয়ে যাওয়ায় বরণ শেষে টুকটাক আচার অনুষ্ঠান পালন করতে করতেই রাত ১২:৩০ টা বেজে গেছে। তারপর পলককে সোজা পাঠানো হলো সিফাতের ঘরে। রুকু আর ইয়ানা মিলে তাকে নিয়ে রেখে এলো সিফাতের ঘরে।তাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো তারাও। একা ঘরে সিফাতের অপেক্ষায় রয়ে গেল পলক। আজ তার আর সিফাতের জীবনের সবচেয়ে গূরুত্বপূর্ণ রাত। আজ থেকে তাদের নতুন জীবনের সূচনা। তিন কবুল বলার সাথে সাথেই তো এক হয়ে গেছিল তারা।তবুও আজ থেকে সেই নতুন মানুষের সাথে নতুন এক পথ চলার যাত্রা শুরু হবে এই রাত থেকেই। একঘরে…এক ছাদের তলায় তৈরী হবে তাদের ছোট্ট এক সংসার।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here