#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
পর্ব_২৪
©জারিন তামান্না
৪ দিন পর,
কলেজ ক্যাম্পাসের পুকুরঘাটে বসে আছে তিয়ান। সময়টা রোদ দুপুর শেষের বিকেলবেলা। বিষন্ন মনে কি যেন ভাবছে সে। এদিকে তাকে খুঁজতে খুঁজতে পুকুর ঘাটের দিকে এসেছে পলক আর বিথি। পলক আসতে চায়নি কিন্তু বিথিও নাছোড়বান্দা। পলককে সে কিছুতেই হারতে দিবে না তিয়ানের কাছে। তাই ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছে ওকে।
পুকুরের কাছে এসে দেখলো তিয়ান একা বসে আছে। আশেপাশে কেউ নেই। কলেজ ছুটি হওয়ায় মোটামুটি খালি হয়ে এসছে ক্যাম্পাস। তাই দেখে বিথি বললো,
_যা দিয়া আয় ওইটা। সব লেনদেনের হিসাব ক্লোজ কইরা ফেল এখনই।
_আমি একা যাবো না রে বিথু। তুই চল সাথে।
_আমি যাবো ক্যান? তোর ঋণ তুই শোধ করবি। আর আমারে দেখলে তিনু ঠিক বুইঝা ফেলবে কাজটা আমি করে দিছি। তাই তুই একাই যাবি।
_প্লিজ দোস্ত চল। তোরই বেস্টু ও। আর তুই আমার বেস্টু। সো তুই গেলে ও কিছুই ভাববে না এসব। প্লিজ প্লিজ প্লিজ..চল না রে দোস্ত। করুণ মুখে পলকের করা এই অনুরোধ বিথি ফেলতে পারলো না। খানিক ভেবে বললো,
_আচ্ছা চল। বিথির কথায় স্বস্তি পেল পলক। তারপর, দুজনে একসাথে গিয়ে দাঁড়ালো তিয়ানের পেছনে।
কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছিল তিয়ান। তা দেখে বিথি এগিয়ে গিয়ে তিয়ানের পিঠ চাপড়ে দিয়ে তার পাশে বসতে বসতে বললো,
_কি রে ব্যাটা? একা একা বইসা আছোস ক্যান এইনে?
পাশ ফিরে বিথিকে একনজর দেখলো তিয়ান। কিন্তু কোন জবাব দিল না তার কথার। বিথি বেশ অবাক হলো তিয়ানের এই কাজে।তবে সাথে এটাও বুঝলো যে তিয়ানের মন খারাপ কোন কারণে। পেছন ফিরে পলককে দেখলো একবার বিথি। তিয়ানের পেছনে দু কদম দূরে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার সামনে কিছু জিজ্ঞেস করবে কি করবে না ভাবতে ভাবতেই জিজ্ঞেস করে ফেললো সে। তিয়ানের গালে হাত দিয়ে মুখটা নিজের দিকে ফেরালো বিথি। তারপর চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো যে কি হয়েছে। তিয়ান কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো বিথির চোখের দিকে। তার চোখে তিয়ানের জন্য চিন্তা খেলা করছে। সেই সাথে কি হয়েছে সেটার জিজ্ঞাসা। তিয়ান এবারেও কিছু বললো না। শুধু হাতের মুঠো খুলে একটা ব্রেসলেট এগিয়ে দিলো বিথির দিকে। ব্রেসলেটটা দেখেই চিনলো বিথি। এটা সিন্থিয়ার হাতে দেখেছে সে বিগত ৭ মাস ধরে। তিয়ান দিয়েছিল তাদের রিলেশনের শুরুতে। তিয়ানের গার্লফ্রেন্ড অহরহ চেঞ্জ হলেও সিন্থিয়ার প্রতি বেশ সিরিয়াস ছিল তিয়ান।বিথিকে বলেছিল সব ঠিক থাকলে ওর সাথেই সেটেল হতে চায় সে।সিন্থিয়া স্মার্ট,সুন্দরী আর ভালো স্টুডেন্টও। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে।কিছুটা উগ্র টাইপের। তিয়ানের প্রতি ওর শুরু থেকেই নজর ছিল।তাই একটা সময় বন্ধুত্বের নাম করে সম্পর্ক শুরু করলেও সিন্থিয়ার তিয়ানকে নিয়ে করা পাগলামি,শো অফ গুলোর কারণে একসময় তা রিলেশনশিপে গড়ায়। তিয়ান উগ্র না হলেও বেশ ফ্রি স্টাইলের লাইফ লিড করে সে। সিন্থিয়াও তার কোন কাজে বাঁধা দেয় না। ঠিক এই কারণেই সিন্থিয়ার প্রতি বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। বিথির সিন্থিয়াকে বিশেষ একটা পছন্দ না হলেও তিয়ানের কারণে কিছু বলেও না।সিন্থিয়ার কিছু কিছু কথা বা কাজে তিয়ানের আপত্তি তাদের ঝগড়ার কারণ হতো। কিন্তু,সিন্থিয়া বা তিয়ান নিজেদের মাঝে কথা বলে সেটা মিটিয়েও নিতো।শেষ দু দিন আগেও বেশ ঝগড়া হয়েছিল তাদের সেটা জানে বিথি।কিন্তু,ব্রেসলেটটা কেন তিয়ানের কাছে সেটা বিথি বুঝলো না। তাই জিজ্ঞেস করলো, এইটা তো…
_She broke up.
_What?হতভম্ব স্বরে বললো বিথি।
_হ্যাঁ। আজ ব্রেসলেট ফিরিয়ে দিয়ে আমার সাথে সম্পর্কটা শেষ করে গেছে।
_কিন্তু ক্যান? হঠাৎ কি হইছে এমন যে ও..
_ Because now she loves someone else.
_ও বললো আর তুই মাইনা নিলি? এত সব পাগলামি কইরা তোর সাথে সম্পর্কে জড়াইলো আর এখন বলে অন্য কাউকে ভালোবাসে? ফাইজলামি পাইছে? বেশ রাগ রাগ স্বরে বললো বিথি।
_ব্যাপারটা আজকের না রে বিথু। লাস্ট ২ মাস ধরেই ও কেমন যেন চেঞ্জ হয়ে গেছিল। এই নিয়ে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেসও করছি ওরে বাট ক্লিয়ার করে কিছু বলে নাই। বেশি কিছু বললেই রাগারাগি করতো। ঝগড়া হইতো আমাদের। আর গত পরশু হিডেন বার্গ (ছদ্মনাম) গেছিলাম বলছিলাম না তোরে?
_হ্যাঁ,,ওই তো নিউ রেস্টুরেন্টটা..
_হু,,ওখানে গেছিলাম বাফু ওদের নিয়ে। সেও গেছিল তার নিউ বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে। তাদের রোমান্টিক মোমেন্ট শেয়ার করতে ব্যস্ত ছিল। আমি দেখেও কিছু বলি নাই তখন। বাইরে সিনক্রিয়েট করে কি হতো বল? তাই পরে যখন এটা নিয়ে জিজ্ঞেস করছি সে স্বীকার করেনি। ঝগড়া হইছিল।অনেক। বাট এবার সে কলও করে নাই একবারও। আর আজকে এসে বলছে আমার জন্য কোন ফিলিংস নাই তার। যা ছিল সব তার ইনফ্যাচুয়েশনস। আমি অনেক করে বলছি,বুঝাইছি বাট জোর করতে ইচ্ছা করলো না। ছেড়ে দিলাম। বলেই তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে হাসলো সে। বিথির কাছে সে হাসি স্পষ্ট জানান দিচ্ছিল কতটা কষ্ট পেয়েছে তিয়ান। ক্লাস টু থেকে একে অপরের বন্ধু তারা।বাড়িও কাছাকাছি হওয়ায় প্রায় একসাথেই বড় হওয়া দুজনের। খুব ভালো করেই চেনে জানে তিয়ানকে। বুঝে। কিছুটা চাপা স্বভাবের ছেলেটা। বাবা মা কে কাছে পায়নি খুব একটা। বিথির পরিবারের সাথেই উঠা বসা। আর বাকিটা সময় একলা থাকা। নয় তো বন্ধুদের নিয়ে সময় কাটায়। নিজের কষ্টগুলোকে কেবল বিথির সাথেই শেয়ার করে সে। তাই আজও কোন ভণিতা ছাড়াই বলে দিল সে সবকিছু। তিয়ানের অবস্থা দেখে কিছু বলতে পারলো না। শুধু শক্ত করে তার হাতটা ধরলো। তিয়ানও বিথির কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলো চুপচাপ। দূরে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখলো পলক। শুনলোও সবটা। কিন্তু কাছে গেল না তাদের। ফিরেও গেল না ওখান থেকে। এদিকে তিয়ানের সাথে কথা বলতে বলতে বিথিরও খেয়াল ছিল না পলক যে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে আর তারা ঠিক কি কাজের জন্য এখানে এসেছিল। কিছুটা সময় পরে বিথির ফোন বেজে উঠলে নিরবতায় ছেদ পড়লো তাদের। ফোন বের করে দেখলো বিথির কাজিন কল করেছে। আজ তার জন্মদিন। বিথি কখন আসবে পার্টিতে সেটা জিজ্ঞেস করতেই কল করেছে।
_হ্যালো…হ্যাঁ,,দোলন, শোন বোন…আমি খুব স্যরি। বাট আমি আসতে পারবো না আজকে। তুই প্লিজ মাইন্ড করিস না।
_ফাইজলামি করিস তুই? আসবি না ক্যান তুই..তোর জন্যই তো এই বেলায় পার্টির প্রিপারেশন হইছে। এখন তুই বলতেছিস আসবিনা। ক্যান আসবি না শুনি?
_আ……আমি একটু অন্য কাজে বিজি আছি রে। এই জন্যই আসতে পারবো না। তুই প্লিজ রাগ করিস না সোনা বোন আমার।
_তিয়ানের সাথে আছিস তুই,নাহ?
_হু।
_তাইলে আর কি! এখন তো দুনিয়া উল্টায়া গেলেও ওরে ছাইড়া নড়বা না তুমি। এ্যাইই…তুই সত্যি কইরা বল তো ওর সাথে তোর শুধুই বন্ধুত্ব নাকি…
_ওইই…লিমিটে থাক। কি সব বলতেছিস। তুই জানিস সব। ভুলভাল বকিস না জেনে শুনে।রাখ এখন। আর যা পার্টি কর। হ্যাপি বার্থডে এগেইন।
_ওই ওই ওইইই…ওয়েট। স্যরি বোন আমার। আর বলবো না এভাবে। তাও তুই আয় প্লিজ।আধা ঘন্টার জন্য হইলেও আয়।তোরে ছাড়া পার্টি জমে নাকি!! তিয়ানকে বল ও বুঝবে.. প্লিইইইইজজজ
_আরেএএ বললাম তো না।
বিথির এমন কথোপকথন শুনে তিয়ান ইশারায় বললো যেতে। বিথিও না করলো। কিন্তু তিয়ানের কথায় শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো সে যাবে। দোলন তখনো ফোনে কানেক্টেড। ওকে বললো, সে আসছে। ফোন রাখতেই আরেকটা কল এলো। কথা বলতে বলতেই তিয়ানের থেকে বিদায় নিল সে। উঠে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরতেই পলকের উপর নজর গেল তার। সাথে সাথে মনে পড়ে গেল সে কি জন্য এসেছিল এখানে। ইশারায় তিয়ানকে দেখিয়ে পলককে বললো কাজটা শেষ করতে। বলেই একপ্রকার দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল ওখান থেকে।পলক তাকে কি যেন বলতে গিয়ে… আ..উচ্চারণ করায় পিছন ফিরে তাকালো তিয়ান। দেখতে পেল পলক দাঁড়িয়ে আছে। বিথিকে কিছু বলার আগেই চলে গেছে সে। ঘুরে দাঁড়াতেই তিয়ানের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল তার। বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল সে। তিয়ানও বেশ অপ্রস্তত হয়ে গেছে। মনে মনে ভাবলো,পলক এখানে? কখন এসেছে? সে কি শুনেছে সব!এসব ভাবতে ভাবতেই তাকে জিজ্ঞেস করে ফেললো তিয়ান,
_তুমি এখানে? কখন এসেছো?
_বিথির সাথে।না মানে বিথি আমার সাথে এসেছিল।কিন্তু..
_অহ। বলেই করে সামনে ফিরে তাকালো সে। বুঝলো যে পলকও সবটাই শুনেছে তাহলে।ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বললো,
_এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? বিথু তো চলে গেছে। তুমিও বাড়ি ফিরে যাও।
_হ্যাঁ.. যাবো কিন্তু..
_কিন্তু কি? কোন দরকার ছিল তোমার?
_হ্যাঁ…ওই.. বেশ লজ্জা লাগছে পলকের। মুখ ফুঁটে বলতে পারছে না কি জন্য এসেছিল সে এখানে। বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তিয়ান পলকের দিকে। কিন্তু সে কিছু বলছে না। ইতস্তত করছে বেশ। তা দেখে তিয়ানও আর কিছু বললো না। সামনে ফিরে কানে হেডফোন গুঁজে বসে রইলো ওখানেই।
খানিক বাদে পলক গিয়ে দাঁড়ালো ওর পাশে। এক হাতে আস্তে করে বাড়িয়ে দিল সিগারেটের প্যাকেটটা। আচমকা চোখের সামনে সিগারেটের প্যাকেট দেখে চমকালো তিয়ান। পাশ ফিরে চাইতেই দেখলো পলক দাঁড়িয়ে আছে। অবাক নয়নে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো পলকের দিকে। পলক উশখুশ করছে। মনে মনে ভাবছে, তিয়ান কেন নিচ্ছে না প্যাকেটটা। নিলেই তো সে যেতে পারে।এখানে এভাবে থাকতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে তার। লজ্জাও লাগছে খানিক। তিয়ানকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে না পেরে একসময় পলক নিজেই বললো, কি হলো..নাও ধরো এটা। পলকের কথায় খানিক শুকনো হাসলো তিয়ান। তারপর হাত বাড়িয়ে নিল প্যাকেটটা। তিয়ান ওটা নিতেই পলক চটপটে গলায় বললো, আমি কারও ঋণ রাখি না,তোমারটাও পরিশোধ করে দিলাম। আসছি এবার। বলেই যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ঝট করে তার এক হাত টেনে ধরলো তিয়ান। পলক অবাক হয়ে পাশে তাকাতেই দেখলো তিয়ান আগের মতই বসে আছে। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই তিয়ান বললো,
_কই যাবা এখন?
_কই যাবো মানে??বাসায় যাবো। ক্লাস তো শেষ সেই কখন।
_একটু বসো এখানে।
_মা…আ…মানে? ঘাবড়ানো গলায় প্রশ্ন করলো পলক।
তিয়ান সেটার জবাব না দিয়ে শান্ত কন্ঠে আবার বললো, বসো। তিয়ানের কন্ঠে কিছু একটা ছিল যেটা পলকের অজান্তেই তাকে বাধ্য করলো তিয়ানের কথা মানতে। আস্তে করে তিয়ানের থেকে একটু দূরে তার পাশেই বসলো সে। পাশে পলকের উপস্থিতি টের পেতেই ওর হাতটাও ছেড়ে দিল তিয়ান। তারপর সিগারেটের প্যাকটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,
_ভালো সময় ভালো জিনিস দিলে। এটার খুব দরকার ছিল এখন। থ্যাংক্স।
পলক কিছু বললো না।চুপচাপ বসে রইলো তিয়ানের পাশে। তারপর তিয়ান প্রশ্ন করলো, তুমি শুনেছো সবটাই,তাই না?
_হ্য…হ্যাঁ। আসলে..
_এটা তুমি নিজে কিনেছো? সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বললো তিয়ান।
পলক কি বলবে বুঝতে পারলো না। সত্যি বলবে? নাকি মিথ্যা বলবে বিথির কথামত। তারপর কি যেন একটা ভেবে সত্যিটাই বলে দিল।
_না…বিথু ম্যানেজ করে দিয়েছে।
_কাজটা কি ঠিক হলো?
_ভুলেরও কিছু হয়নি। তোমার ঋণ পরিশোধ করার ছিল,সেটা আমি কিভাবে ম্যানেজ করেছি সেটা তোমার দেখার বিষয় তো নয়। মিনমিনে গলায় বললো পলক। তিয়ান হাসলো পলকের কথায়। তারপর বললো,
_হ্যাঁ,,সেটা ঠিক বলেছো। তবে,এই মূহুর্তে এটা পেয়ে বেশ উপকার হলো। বলতে বলতেই একটা সিগারেট নিয়ে মুখে দিল সে। আগুন জ্বালাতে যাবে তার আগেই পলক সেটা দেখে একপ্রকার চেঁচিয়ে উঠলো। বললো,
_এইইই…..কি করতেছো এটা? আচমকা পলকের এহেন চিৎকারে থতমত খেয়ে গেল তিয়ান। হতভম্ব চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পলকের দিকে তাকাতেই সে বললো,
_আরেএএএ বাবা…ক্যাম্পাসে বসে সিগারেট খাবে কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এখানে এসব পুরোপুরি নিষিদ্ধ, জানো না তুমি?
পলকের এহেন কথায় হতভম্ব নয়নে কতক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকা হেসে দিল তিয়ান।তিয়ানকে ওভাবে হাসতে দেখে সরু চোখে তাকালো পলক। মনে মনে বললো, কি ব্যাপার এভাবে হাসতিছে ক্যান ছেলেটা? ছেঁকা খেয়ে পাগল হয়ে গেল নাকি? কিন্তু মুখে বললো,
_এখন রেখে দাও। বাসায় গিয়ে খেও।
_উঠো।হাসি থামিয়ে বললো তিয়ান।
_উঠবো মানে?
_উঠবা মানে উঠবা। দাঁড়াবা। তারপর হাঁটবা।বাসায় যাবো আমরা।
_আমরা? বোকার মত প্রশ্ন করলো পলক।
_তো কি? তোমার কি রাতে ক্যাম্পাসে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে আছে?
ফ্যালফ্যাল চোখে তিয়ানের দিকে তাকিয়ে ডা’য়ে বা’য়ে মাথা নাড়িয়ে না করলো পলক।তিয়ানও এতক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পলক ওখানেই বসে আছে। তা দেখে তিয়ান বললো,
_উঠো তাহলে। তোমাকে আগায় দিয়ে যাই । সন্ধ্যা নামতে বেশি সময় নেই। একা যাওয়া ঠিক হবে না।
পলক অবাক হলো বেশ। যদিও সেদিনও সে দেখেছে তিয়ানের দায়িত্ববোধ বেশ ভালোই। তবুও আজ এমন তার একটা অবস্থাতেও পলকের কথা ভাবতে দেখে সত্যিই অবাক হলো সে। মুগ্ধও হলো কিছুটা। আপন মনেই হাসলো সে। তারপর উঠে দাঁড়ালো সেও। সে উঠে দাঁড়াতেই দুজনে একসাথে হাঁটতে হাঁটতেই বেরিয়ে এলো ক্যাম্পাস থেকে। ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে পলককে জিজ্ঞেস করলো,আমার সাথে রিক্সায় যেতে কোন সমস্যা আছে তোমার?
তিয়ানের এহেন প্রশ্নে বেশ অপ্রস্তত হয়ে গেল পলক। বাবা, ভাই ছাড়া কখনো কোন কাজিন ভাইয়ের সাথেও রিক্সায় উঠেনি সে। সেখানে অন্য কোন ছেলের সাথে কিভাবে সে.. এসব ভেবে বেশ ইতস্তত করছিল পলক। মুখে কিছু বলতে পারছে না। তাকে এভাবে ইতস্তত করতে দেখে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললো তিয়ান,
_ওকে ফাইন। বাসেই যাবো আমরা। বলেই সামনের বাসটপের দিকে পা বাড়ালো তিয়ান। বাসে উঠে মাঝখানের সিটগুলোয় বসলো তারা। পলককে জানলার কাছে দিল।যেন কেউ চলাচল করলে তার সাথে ছোঁয়া না লাগে ওর। পলক বেশ স্বস্তি পেল এতে। বাসে জার্নি করার অভ্যাস একেবারেই নেই তিয়ানের।এম্নিতে কলেজে, টিউশানিতে নিজের সাইকেল নিয়েই যাতায়াত করে সে। দূরে কোথাও গেলে নিজেরদের গাড়ি নিয়ে যায়। নয় তো রিক্সা বা বুক করা সি এন জি। কিন্তু, পলককে নিয়ে এ সময় সি এন জি তে যাওয়াটা ঠিক হবে না বলে মনে হওয়ায় বাসেই যেতে হলো তাকে। তাই প্রথমবার বাসে উঠায় বেশ অস্বস্তিবোধ করতে লাগলো সে। তা খেয়াল করলো পলক। সে বুঝলো ব্যাপারটা। বিথির কাছে শুনেছে তিয়ান সম্পর্কে। কিন্তু তারও বা কি করার। এ সময় তিয়ান তাকে একা ছাড়বে না আর একা বাসে ট্রাভেল করাও রিক্স তার জন্য। তাই চুপচাপ মেনে নিলো ব্যাপারটা।
বাসে যেতে যেতে তেমন কোন কথা হলো না দুজনের। জানলার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসা আলোর সাথে সন্ধ্যা নামা দেখছে পলক। বাইরে তাকিয়েই একসময় পলক বললো,
_ভালোবাসাটাকে কখনো দূর্বলতার খাতায় জায়গা দিতে নেই। হৃদয় যখন হৃদয় টানে না সেখানে ভালোবাসা বলে কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকে না আর। বাহ্যিক সাক্ষ্য প্রমাণ কখনো ভালোবাসার প্রমাণ দিতে পারে না। অনুভব আর বিশ্বাসটাই সব!
তিয়ান ফোনে কিসব যেন ঘাটাঘাটি করছিল। আচমকা পলকের এহেন কথায় থমকে গেল সে। পাশ ফিরে চাইলো পলকের দিকে। পলক বাইরের দিকেই তাকিয়ে আছে। মৃদুমন্দ বাতাস এসে লাগছে তার চোখে মুখে।আর তাকে পাশ কাটিয়ে কিছুটা বাতাস এসে ছুঁয়ে দিল তিয়ানকেও। তিয়ান কিছু বললো না পলকের কথার বিপরীতে। মুগ্ধ নয়নে কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলো পলকের দিকে। তারপর, মুখ ফিরিয়ে নিল সামনের দিকে।নিরবতায় কাটিয়ে দিল বাকিটা পথ।
_________________________________
বাস থেকে নেমে পলকের বাসার গলি পর্যন্ত এগিয়ে দিল তাকে তিয়ান। আজকেও ভাড়াটা তিয়ান দিয়েছে। পলক গাল ফুলিয়ে ছিল এই নিয়ে। কথা বলেনি আর একটাও। তাই গলির মুখে ঢুকেও যখন কোন কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিল পলক তখন পেছন থেকে তিয়ান কিছুটা জোর আওয়াজে বললো,
_হেল্প করিনি..বন্ধু ভেবে দিয়েছি ওটা….ঋণ বা দান হিসেবে নয়। ফেইসটা স্বাভাবিক করো মিস. বাঁশপাতা। ভরসন্ধ্যায় এমন গালফোলা বাঁশপাতা দেখলে ভয় পাবে তো মানুষ। বলেই সকৌতুক হাসলো তিয়ান।
কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে সবটাই শুনলো পলক। বন্ধু ভেবে দিয়েছি-কথাটা ভালো লেগেছে তার।রাগটা তখনই গায়েব হয়ে গেছিল তার,তাই শেষ কথাটায় সেও ফিক করে হেসে দিল। হাসি মুখেই বললো,
_বন্ধুকে ধন্যবাদ দিতে নেই। তাই তোমাকেও দিলাম না। সাবধানে বাড়ি ফিরে যেও। আসছি। আল্লাহ হাফেজ।
_yeah….u too.Bye.
এরপর ফিরে গেল দুজনে দুজনের রাস্তায়। সাথে নিয়ে গেল কোন রকম আয়োজন, প্রয়োজন কিংবা দীর্ঘদিনের পরিচয় ছাড়াই সদ্য তৈরী হওয়া একটা নির্মল বন্ধুতের সম্পর্ক নিয়ে।
চলবে…