#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
পর্ব_২৩
©জারিন তামান্না
নিজের কেবিনে শুয়ে আছেন আমজাদ আলী। তার বেডের পাশে রাখা চেয়ারে বসে আছে পলাশ। তার কোলে ছোট্ট প্রাপ্তি। তাদের পেছনে একে অপরকে ধরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে পলক, নিশাত আর শাহনাজ বানু। নিরবে কাঁদছে তারা। কিন্তু আমজাদ আলী মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে রেখেছেন। কথাও বলছেন না পলাশের সাথে। এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে থাকতেই পলাশ বললো,
_কেমন আছো বাবা?
পলাশের মুখে এত বছর পরে বাবা ডাক শুনে হুহু করে উঠলো আমদাজ আলীর বুকের ভেতরটা। চোখ বুজতেই টপটপিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো তার চোখের কোণ বেয়ে। তবুও,তিনি মুখ ফিরিয়ে চাইলেন না পলাশের দিকে। বললেনও না কিছুই। তা দেখে পলাশই আবার বললো,
_এভাবেই যদি মুখ ফিরায়াই রাখবা,তাহলে আমাকে ফিরা আসতে কেন বলছিলা?
________
_আচ্ছা, ঠিক আছে। আমার উপর তুমি রাগ করে আছো মানলাম,কিন্তু আমার মেয়েটার কি দোষ বাবা? তার কি অধিকার নাই নিজের দাদাকে কাছে পাওয়ার?
এটুকু বলতে বলতেই কোলে বসা প্রাপ্তি তার ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়েই শুয়ে থাকা আমদাজ আলীকে ছোঁয়ার চেষ্টা করতে করতে তাকে ডাকলো।
_ দা..দ্দু…দা..দ্দু
প্রাপ্তির মুখের নিজের জন্য দাদু সম্বোধন শুনে আর মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারলেন না তিনি। প্রাপ্তির দিকে তাকিয়েই হুহু করে কেঁদে দিলেন তিনি। উঠে বসার চেষ্টা করতেই প্রাপ্তিকে বিছানায় বসিয়ে দ্রুত গিয়ে তাকে ধরলো পলাশ। আস্তে আস্তে ধরে উঠে বসতে সাহায্য করলো। পেছনে বালিশ দিয়ে হেলান দিয়ে বসতেই তিনি দু’ হাত বাড়িয়ে দিলেন প্রাপ্তির দিকে। ছোট্ট প্রাপ্তিও আর দেরি করলো না। দুই এক কদমের হামাগড়ি দিয়ে ছুটে গেলো তার দাদার কোলে। প্রাপ্তিকে কোলে নিয়ে আনন্দে তার কান্নার বেগও বেড়ে গেল। তাকে এভাবে কাঁদতে দেখেও কেবিনে উপস্থিত কেউই কিছুই বললো না। কারণ এই কান্না যে তার এত বছরের জমাট বাঁধা কষ্টের গলিতরূপ সেটা সেখানে উপস্থিত প্রতিটা মানুষ খুব ভালো করেই জানে। তারাও কাঁদছে নিঃশব্দে। আমদাজ আলী নাতনিকে কোলে নিয়ে নিজের মত আদর করে যাচ্ছেন। তা দেখে একসময় পলাশ বললো,
_বাহ! এই জন্যই লোকে বলে,গাছের চেয়ে পরগাছার কদর বেশি। এখানে যে তার এত্ত বড় ছেলে দাঁড়িয়ে আছে তা তো চোখেই পড়ছে না, নাতনিকে যে পেলো তা সেটা কার জন্য পেয়েছে সেটাও ভুলে গেছে। হুহ!
পলাশের এহেন কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতেই হেসে দিল পলক, নিশাত আর শাহনাজ বানু।কাঁদতে কাঁদতেই আমদাজ আলী পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পলাশের এক হাত টেনে মুঠোয় জড়িয়ে কাঁদলেন কিছুক্ষণ। পলাশ এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। মাথায়, গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করলো তাকে। আমজাদ আলী কিছুটা শান্ত হয়ে এলে তার পাশে গিয়ে বসলো সে। তারপর প্রাপ্তিকে দেখিয়ে বললো,
_জানো বাবা, ও যখন কিছুই বুঝতো না তখন থেকেই মোবাইলে তোমাদের সবার ছবি দেখিয়েছি আমি ওকে। তোমাদের সবাইকে চিনিয়েছি। জন্মের পর থেকে পরিবার বলতে সে তোমাদেরকেই চিনেছে। আর জানো তো বেশিরভাগ সময় ও তোমার ছবি নিয়েই বেশি নাড়াচাড়া করতো। তোমাকে বেশি পছন্দ করে। রক্তের টান বোধয় একেই বলে। বাবা মা বলার আগে দাদু ডাক শিখছে। আর এবার তোমার নাতিকে তোমার কোলে তুলে দিলাম। এখন ওকে তুমি আদর করবা নাকি দূরে ঠেলে দিবা আমার মতো সেটা তোমার ব্যাপার। এই আমি হাত তুলে নিলাম। এবার যা করার,যেভাবে করার তুমি করো। আমি আর ওসবের মধ্যে নেই।
_আমাকে তুই মাফ করে দিস বাবা। আমার রাগ, জেদ আর ভুলের জন্যই এতগুলা বছর তোকে তোর পরিবার থেকে আলাদা থাকতে হইছে। আমার নাতনিটা তার পরিবার থাকা সত্ত্বে একা একা বড় হইছে। তুমি মাফ করে দিস তোর এই বুড়ো বাবাটাকে। মাফ করে দিস। পলাশের কথা শেষ হতেই আচমকা তার একটা হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন আমজাদ আলী।
_তুমি কোন ভুল করো নাই বাবা। তুমি তোমার জায়গায় ঠিক ছিলে। আমিই বরং নিরুপায় ছিলাম। তাই তোমার অবাধ্য হতে হইছিল। তুমি মাফ করে দিও আমাকে। আমি কথা দিতেছি আর কারও জন্য কখনো তোমাদের থেকে আলাদা হবো না। আবার সবাই একসাথে ভালো থাকবো। ঠিক যেমন ছিলাম আগে। কিন্তু তার আগে তুমি কান্না থামাও। নয় তো শরীর খারাপ করবে আবার। আর দ্রুত সুস্থ হও তো। আমার মেয়েটা তার দাদুর সাথে খেলবে, ঘুরবে বলে সেই দুই বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে। ওর অপেক্ষা আর বাড়ায়ো না। সুস্থ হয়ে যাও তাড়াতাড়ি।
_হ্যাঁ রে বাবা। এই তো আমার দিদিভাই এসে গেছে।এবার আমি এম্নিতেই ভালো হয়ে যাবো। তুই আমাকে বাসায় নিয়ে চল। আমি বাসায় ফিরে খেলবো আমার দিদিভাইয়ের সাথে।
_হ্যাঁ,,নিবো তো বাবা। এই তো আমি গিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলবো এখন। যত দ্রুত সম্ভব তোমাকে ডিসচার্জ করার ব্যবস্থা করবো আমি। তুমি চিন্তা করো না।
ছেলের কথা শুনে স্বস্তির হাসি হাসলেন আমজাদ আলী। তারপর নাতনিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। ওদিকে একসাথে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখলো কেবিনে উপস্থিত বাকি চারটা মানুষ। তাদের সকলের চোখেই আজ বাঁধভাঙা সুখজল!
__________________________________
একটা রেস্টুরেন্টের টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে পলক আর তিয়ান। গতকাল রাতে তিয়ানকে কল করেছিল পলক। আজকে দেখা করার কথা বলেছে।তাই দুপুরে স্কুল শেষে এখানে এসেছে তারা। তিয়ান দু’টো কফি অর্ডার করলো দুজনের জন্য। ওয়েটার অর্ডার নিয়ে ওখান থেকে যেতেই একটা খাম এগিয়ে দিল পলক তিয়ানের দিকে। খামটা দেখে তিয়ান জিজ্ঞেস করলো,
_কি এটা?
_নিজেই খুলে দেখো। পলকের কথায় হাত বাড়িয়ে খামটা নিল তিয়ান। খাম খুলতেই বেশ কিছু ক্যাশ টাকা দেখতে পেল তাতে। সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করলো আবার,
_পলক এগুলো..?
_বাবাকে এডমিট করার সময় ৩০ হাজার টাকা লেগেছিল। তখন তো সেটা তুমিই পেমেন্ট করেছিলে নিজের কার্ড দিয়ে।
এ কদিন হাসপাতালের ঝামেলায় টাকাটা ব্যাক করা হয়নি তোমাকে। তাই আজ..
_কিন্তু এটা তো এখন না দিলেও…
_আমি কারও ঋণ রাখিনা তিয়ান। যথাসাধ্য চেষ্টা করি ঠিকভাবে সেটা পরিশোধ করার। আর এটা তুমি খুব ভালো করেই জানো।
_হ্যাঁএএ…সেটা কি আর ভুলবার বিষয়! যে মেয়ে একশ টাকার ঋণটাও যে কোন মূল্যে ফেরত দিতে বাদ রাখে না সেকি আর এতগুলো টাকার ঋণী হয়ে থাকবে নাকি!!
তিয়ানের এ কথায় মুচকি হাসলো পলক।তিয়ানের কথায় কিসের ইংগিত ছিল সেটা ঠিকই বুঝেছে পলক।পলককে হাসতে দেখে হাসলো তিয়ানও। আর সেই সাথে, আরও একবার কলেজ লাইফের স্মৃতিপটে পা রাখলো দুজনেই।কথায় কথায় উল্টেপাল্টে দেখা হলো ক্লাসমেটের পরিচয় থেকে বন্ধুত্বের পথে পা রাখার স্মৃতিটা।
৭ বছর আগে..
এই ধরো,তোমার টাকাটা। -বলেই তিয়ানের দিকে একটা একশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিল পলক।
দোতলার করিডোরে দাঁড়িয়ে নিজের গার্লফ্রেন্ড সিন্থিয়া আর আশেপাশের দুই একজন বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল তিয়ান। ঠিক তখনই আগের দিন রিক্সাওয়ালাকে দেওয়া ভাড়ার একশ টাকাটা ফেরত দেবার উদ্দেশ্যেই সবার সামনেই তাকে কথাটা বললো পলক। আচমকা এভাবে এসে টাকা দেওয়াতে উপস্থিত সবাই অবাক হলো।শুধু তিয়ান বাদে। সিন্থিয়া তখন তিয়ানের কাঁধে এক হাত ঠেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। পলকের এহেন কাজ আর কথায় বিস্মিত কন্ঠে তিয়ানকে জিজ্ঞেস করলো,
_What’s the matter darling?ও তোমায় কিসের টাকা দিচ্ছে এভাবে?
সিন্থিয়ার এহেন প্রশ্নে আশেপাশে থাকা ছেলেমেয়েরাও উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে তিয়ানের মুখের দিকে। সে কি বলবে সেটার শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তারা। কিন্তু,এভাবে সবার সামনে সামান্য একশ টাকা ফেরত দেওয়ার কাজটা ইগোতে লাগলো তিয়ানের।অপমান বোধ করলো সে।ধনী পরিবারের ছেলে সে। হুটহাট বন্ধুদের ট্রিট দেওয়া, এখানে সেখানে নিয়ে গিয়ে পার্টি করা,টাকা দিয়ে হেল্প করা এসব তার নিত্যদিনের কাজ। তার কাছে,টাকা হচ্ছে হাতের ময়লা।তাই টাকা হিসেব করে চলার অভ্যাস বা স্বভাব তার নেই বললেই চলে।আর বাবা মা দুজনেই যখন বিশাল ব্যবসায়ী তখন সেই অর্জিত টাকা বেসামালভাবে খরচের জন্যও কখনো দু বার ভাবতে হয়নি তাকে। সেখানে সামান্য একশ টাকা ফেরত দিতে আসার ব্যাপারটা তার জন্য সত্যিই অপমানজনক। তবে সেও বা কম কিসের! পাল্টা জবাবে নিজের এটিটিউড দেখিয়ে বললো,
_Don’t know babe. তারপর পলকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এটা কিসের টাকা পলক?
তিয়ানের কথায় অবাক হয়ে গেল পলক। এই তো গতকাল দুপুরের কথা।রিক্সাওয়ার ভাড়া দিয়ে দিল ছেলেটা। আর এক বেলার মধ্যেই ভুলে গেল সেটা? এই নাকি ব্যাচের জিনিয়াস বয়!যার মেমোরি এত্ত ড্যাম! মনে মনে বললো পলক কথাগুলো। আর মুখে বললো,
_তুমি গতকাল আমার রিক্সার ভাড়া দিয়েছিলে,ওটার টাকা। নাও ধরো।
_তুমি ওর রিক্সার ভাড়া দিয়ে দিয়েছো তিনু ডার্লিং! But why?এই মেয়ের কাছে কি টাকা ছিল না নাকি যে ওর জন্য ভাড়াটা তোমাকে দিতে হবে? পলকের কথা শুনে পাশ থেকে তিয়ানের উদ্দেশ্যে বললো সিন্থিয়া।
সিন্থিয়ার পলককে” এই মেয়ে “বলাটা ঠিক পছন্দ হলো না তিয়ানের। তাই খানিকটা পরোক্ষভাবেই সিন্থিয়াকে সতর্ক করে দিয়ে বললো,
_ওর একটা নাম আছে বেব। পলক! মানুষকে তার নিজস্ব নামে সম্বোধন করা উচিৎ । তোমার নাম থাকতেও কেউ তোমাকে এই মেয়ে বললে সেটা নিশ্চয় ভালো লাগার মত কিছু হবে না,তাই না? মুখে কপট হাসি টেনে বললো তিয়ান।
তিয়ান কেমন ধাঁচের ছেলে তা ক্লাসের সবাই মোটামুটি জানে। তাই তিয়ানের কথাগুলোও ঠিকঠাক কাজ করলো সিন্থিয়ার ওপর। তিয়ান ঠিক কি বলেছে তাকে সেটাও সে বুঝেছে।অপমানবোধ করলো সে।আর রাগটা জমলো পলকের ওপর। কিন্তু তিয়ানের নজরে ভালো সাজার জন্য খানিকটা মিনমিনিয়েই বললো,
_Yeah…I’m.sorry.
_Good. তিয়ান বললো। তারপর, পলককে উদ্দেশ্য করে বললো,
_ওটা তুমিই রাখো। লাগবে না আমার।
_হ্যাঁ, এসব ছোটখাটো হেল্প তিয়ান এমনিতেই করে সবাইকে।টাকাটা বরং তুমিই রাখো। পরেরবার ভাড়া দিতে কাজে লাগবে। বলেই মুখ টিপে হাসলো সিন্থিয়া।
কথাটা যে সে পলককে অপমান করে বলেছে সেটা সেখানে উপস্থিত সবাই বুঝলো। আর এতে পলকের যতটা না রাগ হলো তার থেকেও বেশি লাগলো তিয়ানের। নিজের লাইফের ব্যাপারগুলোয় অন্য কারো হস্তক্ষেপ মোটেও পছন্দ নয় তার। সে টাকা নিবে না তো নিবেনা। এটা সম্পূর্ণ তার আর পলকের মধ্যকার ব্যাপার। আর এতে ৩য় ব্যক্তি হিসেবে সিন্থিয়ার এভাবে কথা বলাটাও সে কিছুতেই সহ্য করতে পারলো না। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার।এর জন্য সিন্থিয়াকে কঠিন কিছু কথা শোনানোর সিদ্ধান্ত নিল সে।তাই পাশ ফিরে সিন্থিয়াকে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই তার পেছন থেকে পলক বললো,
_আমি কারও ঋণ রাখিনা তিয়ান।নিজের সাধ্যের মধ্যে যে কোন মূল্যে সেটা পরিশোধ করার চেষ্টা করি। তুমি গতকাল আমাকে হেল্প করেছো তার জন্য ধন্যবাদ তোমাকে। কিন্তু,ভাড়া দেওয়ার কোন প্রয়োজন কিন্তু ছিল না। আমি বারণ করেছিলাম তোমাকে। তুমি শোননি। আমিও তখন বলিনি আর কিছু। কিন্তু,তাই বলে আমার সাধ্য থাকা সত্ত্বেও তোমার ঋণ বয়ে বেড়াবো এমন শিক্ষা আর স্বভাব কোনটাই আমার নেই। বলেই তিয়ানের হাতটা নিয়ে তার মুঠোয় গুঁজে দিল টাকাটা। তারপর এগিয়ে গিয়ে সিন্থিয়ার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। আর বললো,
_আর হ্যাঁ,,সিন্থিয়া..তোমাকে একটা কথা বলি, মন দিয়ে শোনো। আমার বাবা একটা স্কুলের শিক্ষক। মধ্যবিত্ত পরিবার আমাদের। কিন্তু,আমাদের চার ভাইবোনকে নিজের সাধ্যের মধ্যে সাবলিলভাবে মানুষ করার, আমাদের দায় দায়িত্ব নেবার ক্ষমতা তিনি রাখেন এখনো। তাই, প্রয়োজনে কারো সাহায্য নিলেও দান নেওয়ার মত অবস্থা আমাদের হয়নি এখনো। বুঝা গেল? আশা করি ঋণ আর দানের মধ্যে ঠিক কি তফাৎ সেটা এবারে বুঝতে পেরেছো তুমি।আর কখনো এই নিয়ে কোন কনফিউশন হবে না তোমার। বলেই পেছন ফিরে ক্লাসরুমের দিকে হাঁটা দিল পলক।
এতক্ষণ রীতিমত হা হয়ে পলকের কথাগুলো শুনছিল তিয়ান আর ওখানে উপস্থিত সবাই।তিয়ান পুরো শকড! এটা যে পলক ছিল সেটা বিশ্বাস হচ্ছে না তার। এতদিন দূর থেকে হলেও দেখেছে সে পলককে। গতকালও পলককে দেখার পর আর বিথির কাছে ওর সম্পর্কে শুনে মনে হয়েছিল খুবই শান্ত, নরম আর অবলা নারী টাইপ ক্যাটাগরির মেয়ে পলক।।কিন্তু আজ তো দেখছে পুরো এসিড এই মেয়ে! নিজের কথায় যোগ্য জবাব দিয়ে সিন্থিয়ার করা অপমানকে কেমন ঝসলে দিল মূহুর্তেই।এমনকি তিয়ানকেও বাদ রাখেনি। তার এটিটিউডের ডট ডট ডট অবস্থা করে ছেড়েছে একদম। কিন্তু এত সহজে তো হার মানার পাত্রও তিয়ান নয়। তাই চকিতেই পলকের কথার ঝাঁজ সামলে নিয়ে ফিরে গেল নিজ এটিটিউডে। পলককে চলে যেতে দেখে পেছন থেকে ডকলো তাকে।
_ওই বাঁশপাতা..নিরামিষ। ওয়েট।
তিয়ানের এমন ডাকে ফট করে থেমে গেল পলক। ওখানে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই তিয়ান এগিয়ে গেল তার দিকে।তার মুখোমুখি দাঁড়াতেই তার হাত টেনে নিয়ে হাতের মুঠোয় গুঁজে দিল সেই একশ টাকার নোটটা। পলক অবাক! মুখে কিছু বলতেই যাচ্ছিল তার আগেই তিয়ান বললো,
_তিয়ান এভাবে টাকা নিতে অভ্যস্ত নয়। হেল্প করেছি বললে না?তবে, সেটার বিনিময়ে কিছু দাবিও তো করিনি,তাই না? কিন্তু তুমি তো আবার কারও ঋণ রাখো না। নিজের সাধ্যের মধ্যে যে কোন উপায়ে ঋণ পরিশোধ করে দাও। তাহলে আমার ঋণটাও পরিশোধ করো।তবে টাকা দিয়ে নয় অন্যভাবে।
পলক এবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে বিস্মিত। হতবাক নয়নে তাকিয়ে আছে তিয়ানের দিকে। তার হাত তখনো তিয়ানের হাতের মুঠোয়।সেই অবস্থাতেই হতবাক কন্ঠে সে জিজ্ঞেস করলো,
_অন্যভাবে মানে?
_অন্যভাবে মানে অন্যভাবে।ক্যাশ আমি নেবো না। তুমি বরং অন্য কিছু দিয়ে এই একশ টাকার ঋণটা পরিশোধ করো।
_আরেএএ..তুমি আমাকে ক্যাশ দিয়ে হেল্প করছো তো আমিও তো ক্যাশ দিয়েই সেটা রিটার্ন করবো।এখানে অন্যকিছু কিভাবে আসে?
_হ্যাঁ,,আসে তো। সহজ হিসাব !দেখো পলক..তুমি আমার থেকে ডিরেক্টরলি কোন টাকা নাওনি,,চাওনিও আমার থেকে।আমি নিজেই দিয়েছি। কিন্তু,পরে সেটা ফেরত চায়নি। দাবিও করিনি ওটা। এখন সেটা তোমার কাছে ঋণ হয়ে গেছে এবং সেটা তুমি পরিশোধ করতে চাইছো।কিন্তু,আমি তো সেটা নিতে চাইছি না। তাই এখন একান্তই যদি তোমার সেটা পরিশোধ করার হয় তবে এই টাকার সম পরিমাণ কোন কিছু তুমি আমাকে দিতে পারো। But, I won’t take any cash from you. Do u get it?
পলক হতভম্ব। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তিয়ানের দিকে। ওখানে উপস্থিত বাকিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছে। একদম ফ্রিতে ম্যাটেনি শো দেখতে পাওয়ার মত। ব্যাচের মোস্ট জিনিয়াস বয়ের আর ব্যাচের মোস্ট নিরামিষ মেয়েটার মধ্যে হওয়া এমন তর্ক বিতর্কের ঘটনাটা বেশ মজা দিচ্ছে তাদের।
এসবের মাঝেই সেখানে এসে হাজির হলো বিথি। সে এম্নিতেও লেট লতিফ।তাই বেশিরভাগ সময় কলেজে ক্লাস শুরু হওয়ার পর পর নয় তো একদম আগে আগে আগমন ঘটে তার। আজও তাই হলো।ক্লাসের ঘন্টা পড়ার মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। তখনই বিথি এসে দেখলো সিনেম্যাটিক সিন চলছে সেখানে রীতিমত। যার হিরো হিরোইন হিসেবে একজনের হাতের মুঠোয় অন্যজনের হাত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিয়ান আর পলক। তাদের পেছনে ভিলেনের মত ক্রুদ্ধ চেহারা করে দাঁড়িয়ে আছে সিন্থিয়া।আর বাকি ছেলে মেয়েরা নিষ্ঠার সাথে দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। কেবল ডিরেক্টর আর ক্যামেরাম্যানের অভাব। তবে আসল কাহিনী কি সেটা বুঝতে না পেরে তিয়ান আর পলকের কাছাকাছি গিয়ে কোমড়ে দু হাত রেখে দাঁড়ালো সে। তারপর তার টমবয় ভয়েসে সন্দিহান স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
_কি রেএএ…কি চলে এইনে? তোরা এম্নে হাত ধরাধরি কইরা খাঁড়ায় আছিস ক্যান? কেস কি মামা??
বিথির কথায় পুরো ব্যাক্কল হয়ে গেল পলক। তারপর তিয়ানের হাতের মুঠোয় থাকা তার হাতটা দেখলো একবার।সাথে সাথেই এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিল তা। পলক বেশ অপ্রস্তত হয়ে পড়েছে পুরো ব্যাপারটায়। কিন্তু তিয়ান একদম স্বাভাবিক। খানিক গলা ঝেড়ে বললো,
_তোর বাঁশপাতা নিরামিষ বান্ধুবী আমার ঋণ পরিশোধ করতে চাইতেছে। বাট তুই তো জানিস আমি ক্যাশ নেই না। তাই বলছি অন্যভাবে সেটা পরিশোধ করতে।
_কিসেএএর ঋণ? একটা ম্যাথ সলভ কইরা দেওয়ায় টাকা দেওয়া লাগবে তোরে? অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো বিথি।
_আরেএএ ধুর! ম্যাথ সলভ করার জন্য টাকা দিবে কেন? ওইটা তো…
_তোরে আমি পরে সব বুঝায় বলতেছি বিথু। ক্লাসে চল এখন। বিথির হাত ধরে তাকে কাছে টেনে বললো পলক।
_হ্যাঁ…কিন্তু ও ক্যাশ নিবে না তো নিবেটা কি?
_সেটা আমি ক্যাম্নে বলবো। ওইটা তুই তোর ফ্রেন্ড রে জিজ্ঞেস করে নিস। আমি গেলাম। বলেই ক্লাসের দিকে পা বাড়ালো পলক।
_আমি দুজনের ব্যাপারের মাঝে অন্য কারও হস্তক্ষেপ পছন্দ করি না, মিস.বাঁশপাতা। তাছাড়া ঋণ পরিশোধ করার কথা তোমার। যা জানার, যা জিজ্ঞেস করার সেটা তুমি আমাকে কররা। সেটার মাঝে বিথুকে কেন টানছো?
তিয়ানের এহেন খোঁচামারা কথায় থমকে গেল পলক। পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলো,
_বেশ। তুমিই বলো তাহলে কি চাই তোমার?
পলকের এহেন কথায় কিছুক্ষণ ভাবলো তিয়ান। তারপর বললো,
_উউউউমমম, এক কাজ করো তাহলে।তুমি বরং এক প্যাকেট বেনসন এনে দিও আমাকে। তোমার ঋণ শোধ হয়ে যাবে। বলেই বাঁকা হাসলো তিয়ান।
_কিইইইইহহহ……? সিগারেট!হতভম্ব স্বরে বললো পলক।
_অয় ব্যাটা,,মাথা খারাপ হইয়া গেছে তোর? ও মেয়ে হইয়া যাইবো সিগারেট কিনতে? কিসব উল্টাপাল্টা ডিমান্ড করতেছিস তুই!
_এটা তো আমার দেখার বিষয় না বিথু। তোর বান্ধুবী জিজ্ঞেস করছে আমি কি চাই।আমিও বললাম। এখন সেটা সে আমাকে দিবে কি দিবে না নাকি না দিয়ে ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াবে সেটা ওর ব্যাপার। আমি তো কোন জোরজবরদস্তি করি নাই। ঝরঝরে গলায় বললো তিয়ান।
এরই মধ্যে ক্লাসের ওয়ার্নিং বেল পড়ে গেল। আর সাথে সাথেই সবাই নড়েচড়ে উঠলো। যার যার মত পা বাড়ালো ক্লাসরুমের দিকে। বাঁকা হাসতে হাসতে তিয়ানও পাশ কাটিয়ে গেল পলকের। যাওয়ার আগে আবার পলকের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে গেল,
_তিয়ান কোন কিছুর বিনিময়ে হেল্প করে না,তাই তার ঋণ শোধ করতে চাওয়াটাও সহজ বিষয় না।But still when u wanna do this..then,Best of luck. Miss. Bashpata. বলেই বাঁকা হাসতে হাসতেই ক্লাস রুমে ঢুকে গেল সে।
পলক হতভম্ব হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। বিথিও তাজ্জব পুরো। ভাবছে তিয়ান এটা কি করলো? কেন করলো? এসব ভাবতে ভাবতেই সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো স্যার আসছে ক্লাসের দিকেই। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল সে পলকের দিকে। পলকের কোন নড়চড় না দেখে একপ্রকার টেনে ধাক্কিয়েই নিয়ে গেল তাকে ক্লাসরুমের ভিতরে।
চলবে….