#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
পর্ব_২২
©জারিন তামান্না
শান্তিনগর, রাত ৯ :১৭ মিনিট।
অনবরত বাসার কলিংবেল বাজিয়ে যাচ্ছে কেউ।পলক সবেমাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছে।হাসপাতাল থেকে ফিরেছে ঘন্টাখানেক আগে। পলকের ঘরটা বাসার শেষ মাথায় হওয়ায় করিডোর পেরিয়ে সদর দরজা পর্যন্ত যেতে বেশ কিছুটা সময় লেগে গেল তার। কিন্তু এর মাঝেই অনবরত বেল বাজিয়ে চলেছে কেউ। না পেরে শেষের পথটুকু একপ্রকার দৌঁড়ে গিয়েই দরজা খুলে দিল সে। দরজা খুলতেই মূহুর্তেই থমকে গেল পলক। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। যদিও বা সে জানতোই এমন কিছু ঘটবে তবে এত দ্রুত সেটা সত্যি হবে ভাবতে পারেনি সে। তাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি বললো,
_কি রে…তিন বছরে কি চেহারা ভুলে গেছিস আমার যে চিনতে না পেরে বাসায় ঢুকতেও দিচ্ছিস না?
পলকের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে সামনে পলাশ দাঁড়িয়ে আছে।আর তার কোলে দু’বছরের ছোট্ট প্রাপ্তি। বাবার কোলে থেকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখছে সে পলককে।পলকের এহেন অবস্থা দেখে সেও কিছু বুঝতে পারছে না। আরও কিছুটা সময় দরজা ধরেই দাঁড়িয়ে রইলো পলক। তা দেখে ক্লান্ত পলাশ বললো,
_তোরে কি এখন এন আই ডি দেখাতে হবে রে সাজি? তারপরে ঢুকতে দিবি বাসায়? দাঁড়ায়া থাইকা তো পা ব্যাথা হয়ে গেল। এবারে পলকও নড়েচড়ে উঠলো।তারপর এক ছুটে গিয়ে ভাইয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ধরেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো সে। আচমকা বোনের এমন প্রতিক্রিয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না পলাশ। কিছুটা সময় নিয়ে সামলে নিলো নিজেকে। তারপর মুচকি হেসে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
_এই পাগলী মেয়ে! এভাবে কাঁদতেছিস কেন?এই তো আমি চলে আসছি।আর কখনো কোথাও যাবো না। এখন দয়া করে ঘরে ঢুকতে দে বোন। বাচ্চাটাকে নিয়ে এতদূর জার্নি করে আসছি। টায়ার্ড লাগতেছে খুব। একটু ফ্রেস হইতে দে। প্লিজ বোন আমার!
পলাশের কথা যেন কানেই গেল না পলকের। সে নিজের মত কেঁদে যাচ্ছে। তার এমন কান্না দেখে একসময় আধো আধো বুলিতে ছোট্ট প্রাপ্তি বললো,
_বাব্বা…পুপ্পি কাঁদে..পুপ্পি কাঁদে।
আচমকা প্রাপ্তির মুখে পুপ্পি ডাক শুনে কান্নায় ব্রেক পড়লো পলকের। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে প্রাপ্তির দিকে। এইটুকু মেয়েটাও তাকে চিনে। ফ উচ্চারণ করতে না পারায় পুপ্পি বলছে। প্রাপ্তিও তাকিয়ে আছে পলকের দিকে। ফুফু ভাতিজির এমন অবস্থা দেখে এবারে প্রাপ্তিকে পলকের কোলে দিলো পলাশ। বললো,
_চেনে তোরে। আর বাকি সবাইরেও।তোদের ছবি দেখেই বড় হইছে। এখন তোরা ফুফু ভাতিজি নিজেদের ইমোশনাল মোমেন্ট শেয়ার কর, আমি বরং ভিতরে যাই। বলেই নিজের সাথে আনা ৩ টা ব্যাগ নিয়ে গটগট করে ভিতরে চলে গেল সে।
এদিকে ভাতিজিকে নিজের কোলে পেয়ে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারলো না পলক। কাঁদতে কাঁদতেই উরাধুরা চুমুতে ভরিয়ে দিল প্রাপ্তির ছোট্ট মুখখানি। বুকে চেপে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, আমার আম্মাটাহ! বেশ শান্তশিষ্ট মেয়ে প্রাপ্তি। তাই সেও চুপচাপ মুখ গুঁজে রইলো ফুপুর বুকে।
এরমাঝেই ভেতর থেকে ভাইয়ের ডাক শোনা গেল।
_এইইই সাজি!কি করছিস আমার রুমটাকে? এখন কই থাকবো আমি?
ভাইয়ের এহেন কথায় ফিক করে হেসে দিল পলক। মনে মনে ভাবলো নিশাতের আস্তানা গেল এবারে! তারপর ফটাফট দরজা বন্ধ করে প্রাপ্তিকে কোলে নিয়ে দ্রুত পায়ে ভেতর ঘরের দিকে ছুটলো সে।
নিশাতের ঘরে ঢুকে দেখলো ভাই তার কোমড়ে হাত দিয়ে পুরো ঘরটা পর্যবেক্ষণ করছে। তাকে এভাবে দেখে পেছন থেকে পলক বললো,
_নিশু থাকে এখন এ ঘরে। তুমি আজ রাতটা থাকো এখানেই। কাল নিশু এলেই ওর সব জিনিস আমার ঘরে শিফট করে নিবো।
_আচ্ছা, ঠিক আছে। ব্যাপার নাহ কোন। তুই এক কাজ কর,প্রাপ্তিকে ফ্রেস করিয়ে কিছু খাইয়ে দে আগে। বেচারি সেই দুপুরে কি না কি খেয়েছিল…ওর মায়ের যা স্বভাব,খেলে খাওয়াবে নইলে না খায়িয়েই রাখবে সারাদিন। বলেই হতাশার একটা শ্বাস ফেললো পলাশ। শেফার কথা উঠতেই পলকের খেয়াল হলো শেফা আসেনি তাদের সাথে। চকিতেই ভাইকে প্রশ্ন করলো,
_ভাবী আসেনি?
_ওর সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে এসেছি রে,আর কোন অশান্তি হোক এমনটা চাই না আমি।শুকনো হেসে বললো পলাশ।
_মানে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো পলক।
_তোকে পরে সব বুঝিয়ে বলছি।যেটা বললাম কর আগে। আর আমাকেও খেতে দে কিছু। সকালের পর খাওয়া হয়নি আর। আমি ফ্রেস হয়ে আসছি। খেয়ে হাসপাতালে যাবো বাবার কাছে।
_আচ্ছা।
_হু! হ্যাঁ রে..মা আর নিশু কই?
_ওরা দুজনেই হাসপাতালে।বাবার কাছে আছে।গত দুদিন আমি ছিলাম,আজ মা জোর করে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। এই তো ঘন্টা দেড় আগেই এসেছি আমিও।
_আচ্ছা,ঠিক আছে। তুই যা এখন। তাড়াতাড়ি কর।
_হুম।তুমি ফ্রেস হয়ে নাও। বলেই প্রাপ্তিকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল পলক।
____________________________________
আমজাদ আলীর কেবিনে ঢুকতেই মা আর বাবাকে একসাথে দেখতে পেল পলাশ। বিছানায় শুয়ে আছে আমজাদ আলী।আর তার পাশেই বিছানার এককোণে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছেন শাহনাজ বানু।৩ বছর পর স্বচক্ষে বাবা মাকে একসাথে দেখলো পলাশ। আনন্দের জলরাশিতে চোখ চিকচিক করছে তার। আলগোস্তে দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। কাছে গিয়ে দেখলো আমজাদ আলী ঘুমিয়ে গেছেন।আর শাহনাজ বানু চোখ বুজে আছে। ঘুমাচ্ছে বলে মনে হলো না পলাশের।কেবিনের কোথাও নিশাতকে দেখতে পেলো না সে।গেছে বোধয় কোথাও।আলতো করে মায়ের কাঁধে হাত রেখে ডাকলো তাকে। চেনা পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে চমকে দ্রুত চোখ খুলে তাকালেন শাহনাজ বানু। এত বছর পর কাছ থেকে ছেলেকে দেখতে পেয়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না তিনিও। ছেলে ধরেই কেঁদে দিলেন।মাথায়, শরীরে, মুখে হাত বুলিয়ে আদর করলেন ছেলেকে। পলাশ তার প্রথম সন্তান। ছোট থেকেই মা ভক্ত ছেলে। অনার্সে পড়ার সময় রাজশাহী যেতে হয়েছিল তাকে। শুরুর দিকে ছুটি পেলেই ছুটে আসতো মায়ের কাছে। বলতো,তাকে ছাড়া ভালো লাগে না। বোনদের মিস করে। শাহনাজ বানু প্রথম প্রথম হাসতেন ছেলের এমন কথা আর কাজে। বুঝাতেন ওখানে থাকার জন্য। ধীরে ধীরে সেও শিখে গেছিল দূরে থাকা। তারপর অনার্স শেষ করেই ঢাকায় চাকরি নিল। বাবার পছন্দ হিসেবে শেফাকে বিয়ে করলো। আর সেই শেফার কারণেই ৩ বছর মায়ের থেকে তার পরিবার থেকে আলাদা থাকতে হলো তাকে।
মা ছেলে যখন নিজেদের আবেগ অনুভূতি ভাগাভাগিতে ব্যস্ত, ঠিক সে মূহুর্তে নিশাতও ঢুকলো কেবিনে।তার হাতে ছোট খাটো একটা ফ্লাক্স । কফি আনতে গিয়েছিল সে। রাত জাগলে কফি খাওয়ার অভ্যাস তার। কেবিন ঢুকে মাকে কারও বুকে মাথা রেখে কাঁদতে দেখে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল সে। পেছন থেকে লোকটিকে দেখে বুঝা যাচ্ছে না সে কে! তাই এক পা দু পা করে সামনে এগিয়ে গিয়ে আস্তে করে ডাকলো, মা?
নিশাতের গলা পেয়ে শাহনাজ বানুকে ছেড়ে পেছন ফিরে তাকালো পলাশ। বোনকে দেখে মুচকি হাসলো। তিন বছরে বেশ খানিকটা বড় হয়ে গেছে তার পিচ্চি বোনটা। তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, কি রে…কেমন আছিস ছুটকি?
পলাশকে আচমকা এভাবে এখানে দেখে চূড়ান্তভাবে বিস্মিত হলো নিশাত। কারণ সে জানতো না যে পলাশ আসবে এখানে। আমজাদ আলী তাকে ফিরে আসতে বলেছেন এ কথাটা জানানো হয়নি তাকে। হতভম্ব চোখে ফ্যালফ্যাল করে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো সে ভাইয়ের দিকে। এতবছর পর আচমকা ভাইকে দেখে কি প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিৎ বুঝে উঠতে পারছে না সে। হাতে ফ্লাস্ক নিয়ে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। তাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মা ছেলে দুজনেই হেসে দিল একসাথে। তারপর, মাকে ছেড়ে বোনের দিকে এগিয়ে গেল পলাশ। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কাছে টেনে নিল তাকে। আদর করে দিয়ে বললো, অনেকটা বড় হয়ে গেছিস রে তুই ছুটকি। বেশ লম্বাও হয়েছিস দেখছি। সাজির চাইতে তো তোকেই বড় লাগে রে। বলেই হাসলো সে। নিশাত কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। ভালো মন্দ কিছু জিজ্ঞেদ না করে বোকার মত প্রশ্ন করলো ভাইকে, কফি খাবা ভাইয়া?
মেয়ের মুখে প্রথম কথা এটা শুনে শাহনাজ বানু কপাল চাপড়ে বললেন,
_ব্যাক্কল ছেড়ি,এতবছর পর ভাইরে পাইছিস.. কই ভালো মন্দ খোঁজ খবর নিবি একটু…তা না কইরা জিজ্ঞেস করতেছিস কফি খাবে নাকি? বলি হুশ জ্ঞান কি আছে তোর কিছু?
মায়ের এমন বকুনিতে না হেসে পারলো না পলাশ।এই মূহুর্তে বোনের মানসিক অবস্থাটা ঠিক বুঝতে পারছে সে।তাই হেসে হেসে বললো, দে এক কাপ,খাই। টায়ার্ড লাগছে বেশ। কফি খেয়ে চাঙ্গা হই একটু। নিশাত মুখে কিছু বললো না। চুপচাপ মাথা কাত করে সায় দিল ভাইয়ের কথায়। তারপর টি টেবিলের উপর রাখা মগে কফি ঢেলে এগিয়ে দিল ভাইয়ের দিকে।
কফি খেতে খেতে আমজাদ আলীর ব্যাপারে কথা বললো মা আর বোনের সাথে।ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়ানোর ফলে সে রাতে আর দেখা হলো পলাশের সাথে দেখা হলো না আমজাদ আলীর। রাতে সেখানেই থাকতে চেয়েছিল পলাশ। কিন্তু, ক্লান্ত বলে জোর করে তাকে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন শাহনাজ বানু। অগ্যতা তাকেও ফিরে আসতে হলো বাসায়।
__________________________________
প্রাপ্তিকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে পলক। আজ রাতটা তাকে নিজের কাছেই রাখবে সে। বেশ ক্লান্ত লাগছে তারও। তাই প্রাপ্তির পাশেই বিছানায় গা এলিয়ে দিল পলক। ঘুমে চোখ দুটো সবে লেগে এসেছিল আচমকা ফোনের ম্যাসেজ টোনে ঘুম ছুটে গেল তার। বিছানা হাতড়ে ফোনটা হাতে নিয়ে অন করতেই দেখলো সিফাতের ম্যাসেজ। ম্যাসেজে ছোট্ট করে লেখা-” ফ্রি হয়ে কল করবেন আমাকে। অপেক্ষায় থাকবো। ”
ম্যাসেজ পেয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে সময় চেক করলো পলক। রাত ১১:৪৫ বাজে। ম্যাসেজ যখন এখন করেছে তারমানে সেও নিশ্চয় ফ্রি আছে! চট করেই ফোনের ডেটা অন করলো। হোয়াটস অ্যাপে গিয়ে অডিও কল করলো। দুবার রিং হতেই কল কেটে দিল সিফাত। মন খারাপ হয়ে গেল পলকের। ‘ব্যস্তই যখন আছে তাহলে আমার ফ্রি হয়ে কল করার অপেক্ষা কে করতে বলেছিল উনাকে? ‘মনে মনে বললো পলক। কিন্তু মিনিট দুই গড়াতেই সিফাতের কল এলো। ভিডিও কল। সিফাতের কল পেয়েই খুশি হয়ে গেল পলক। রুমে ড্রিম লাইট জ্বলছিল। দ্রুত পায়ে বিছানা থেকে নেমে লাইট অন করে স্টাডি টেবিলে গিয়ে ফোন সেট করে রিসিভ করলো কলটা। রিসিভ করতেই ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো সিফাতের মুখখানি। কতদিন পরে দেখছে সে মানুষটাকে! ১১ দিন আগে শেষ দেখেছিল এই মুখটা। ওখানে যাওয়ার পরে ফোনে কথা হয়েছিল একবার। সে ঠিকভাবে পৌঁছেছে এটা জানাতেই কল করেছিল। পলক বলে দিয়েছিল পৌঁছে যেন জানায় তাকে। তারপরে ট্রেনিং এ বিজি হয়ে গেছিল, দু দেশের রাত দিনের সময়ের পার্থক্যে সেভাবে সময় মিলিয়ে কলও করা হয়নি সিফাতের। কিন্তু,আজ রুকুর সাথে কথা হয়েছিল তার। রুকু কল করে জানিয়েছে তাকে পলকের বাবার কথা। বিগত ৩ দিনে যা যা হয়েছে সবটাই জানিয়েছে তাকে। পলককে কল করে যেন একবার খোঁজ নেয় সিফাত সেটাও বলেছে রুকু। তাই বাংলাদেশে রাত হওয়া সত্ত্বেও দুপুরের লাঞ্চ ব্রেক পেয়েই ম্যাসেজ করেছে পলককে।যদি কথা বলার সুযোগ হয় এখন! পলক চুপচাপ কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো ফোনের স্ক্রিনে। সিফাতকে দেখছে সে। সিফাতও দেখছে তাকে।ক্যাপ্টেনের সাদা ইউনিফর্মে বরাবরই বেশ সুদর্শন লাগে তাকে। তবে সিফাতের মুখখানি বেশ মলিন লাগছে আজ,কিন্তু কেন?মনে প্রশ্ন জাগলেও সেটা জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না পলকের।
একধ্যানে কতক্ষণ চেয়ে রইলো পলকের দিকে।চোখের নিচে জমা কালি সাক্ষী দিচ্ছে তার কদিনের ঘুমহীন রাতের। ক্লান্তিতে বড্ড নিষ্প্রাণ লাগছে মুখখানি। চুলগুলো কুঁকড়ে এলোমেলো হয়ে আছে। গোসল করে আঁচড়ায়নি বোধয়।একপাশে সিঁথি করে সামনে দুভাগ করে এনে রেখেছে। অন্য রকম লাগছে এ জন্য তাকে আজ। তবে আজকেও ওড়না পড়তে ভুলে গেছে মেয়েটা। এটা ভেবে আপন মনেই মুচকি হেসে উঠলো সিফাত। তার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে ভ্রু কুচকে গেল পলকের। মনে আবার প্রশ্ন জাগলো,”এভাবে হাসছে কেন মানুষটা?”
পলকের ওমন কুঞ্চিত মুখ দেখে এবারে নিরবতা ভেঙে ভীষণরকম শান্ত স্বরে নিজেই বললো,
_কেমন আছো মৃন্ময়ী?
মৃন্ময়ী ডাকটা শুনেই অদ্ভুতরকমের একটা শান্তি লাগলো পলকের। বিগত একমাসে বেশ ভালোরকমে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এই ডাকনামে। এত বছরের পুরোনো সাজি,পলক এই ডাকনামগুলোর পরেও মৃন্ময়ী নামটা তার কেনো এত বেশি ভালো লাগে নিজেই বুঝে পায় না এটা সে।শুধুমাত্র এই মানুষটা ডাকে বলেই?কখনো কখনো নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে কিন্তু ঠিকঠাক কোন উত্তর মেলে না। এক ছটাক স্বস্তির হাসি মুখে নিয়েই জবাব দিল সে।
_জ্বী ভালো,আপ..এটুকু বলতেই বলতে পলকের খেয়াল হলো সিফাত তাকে তুমি করে বলেছে।চকিতেই বড় বড় চোখ করে, তাকালো ফোনের স্ক্রিনে।সিফাতের চোখ মুখ বড্ড শান্ত দেখাচ্ছে। কিছুটা ভয় পেল পলক।সিফাতের এহেন ভাবসাব স্পষ্ট জানান দিচ্ছে, সে রেগে আছে পলকের উপর।কিন্তু,কেন? কি করেছে সে?
_ঠিক আছি আমি।পলকের প্রশ্নটা পুরো বলা না হলেও উত্তর দিল সিফাত। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
_বাবা কেমন আছেন এখন?
বাবা! সিফাতের মুখে আমজাদ আলীকে বাবা বলে সম্বোধন করা শুনে কিছুটা হকচকিয়ে গেল পলক। সেকেন্ড কয়েক সময় নিয়ে ধাতস্ত করলো নিজেকে। সে বুঝলো,আমজাদ আলীর কথা জেনে গেছে সিফাত। ও বাড়ির কেউ বলেছে হয় তো। সবটা বুঝতে পেরে ধীরে সুস্থে জবাব দিল সে।
_হ্যাঁ,,,আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছে এখন। আজ সকালে আই. সি. ইউ থেকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। দুই এক দিনের মাঝে ডিসচার্জও করে দেবে হয় তো।
_বেশ। মা আর ছোট আপু কোথায়?
_ওরা তো হাসপাতালে, আজ রাতটা ওখানেই থাকবে।
_অহ। তিয়ান কি রোজ আসে দেখা করতে?
সিফাতের মুখে তিয়ানের কথা শুনে কিছুটা চুপসে গেল পলক। তারমানে সিফাত আগাগোড়া সবটাই জানে। আচ্ছা,উনি কি রাগ করেছেন এই নিয়ে? মনে মনে প্রশ্ন করলো পলক নিজেকেই। কিন্তু সিফাতকে এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। কিছুটা ইতস্তত করেই বললো,
_হ্য..এ..হ্যাঁ। রোজ অফিসে যাওয়ার আগে আর ফেরার পথে দেখা করে যায়।
_হুম। বেশ গম্ভীর স্বরে বললো সিফাত। তারপর, কিছুটা সময় দুজনেই চুপ করে রইলো। সিফাত পলককে দেখছে।পলক কিছুটা মাথা নিচু করে চোখ নামিয়ে রেখেছে। হঠাৎ পলকের পেছনে বিছানার দিকে নজর গেল সিফাতের। যেখানে প্রাপ্তি ঘুমিয়ে আছে। কিছু বুঝতে না পেরে চট করেই প্রশ্ন করলো,
_বাসায় তুমি একা?
_হ্যাঁ..কেন?.
_বিছানায় কে ওটা?
পিছন ফিরে চাইলো একবার পলক। ঘুমন্ত প্রাপ্তিতে দেখে মুচকি হাসলো। তারপর ক্যামেরার দিকে ফিরে মৃদু হেসেই বললো।
_ওটা প্রাপ্তি।পলাশ ভাইয়ার মেয়ে। ঘুমিয়ে আছে।
পলাশের মেয়ে শুনে বেশ চমকে গেল সিফাত। সাথে সাথে প্রশ্ন করলো, ভাইয়া এসেছেন?
_হ্যাঁ।খুশি মনে জবাব দিল পলক।
_কবে? বাবা জানেন?
_হ্যাঁ। বাবাই আসতে বলেছে ভাইয়াকে। আজ কেবিনে শিফট করার পরে মাকে বলেছিল যেন ভাইয়াকে ফিরে আসতে বলে।বাবার কথা শুনে রাতের ফ্লাইটেই চলে এসেছে সে।
_তোমার ভাবীও এসেছে? বেশ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো সিফাত। কারণ যতটা সে জেনেছে শেফার সম্পর্কে তাতে শেফাকে তার একটুও পছন্দ নয় । তাই তার উপস্থিতি নিয়েও সে অখুশি।
_না। সে আসতে চায়নি। তাই জন্য ভাইয়া প্রাপ্তিকে নিয়ে একাই এসেছে।
_ভালো হয়েছে।
_হ্যাঁ?!চমকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো পলক।কিন্তু সিফাত সেটার বিপরীতে কিছু বললো না। কথার প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললো,
_দেখি…ফোনটা ধরো ওদিকে।দেখাও তো ওকে। পলক খুশি মনে ফোনটা নিয়ে গিয়ে ঘুমন্ত প্রাপ্তির মুখোমুখি ধরলো। বাচ্চার প্রতি সিফাতের বেশ ভালো রকম দূর্বলতা তৈরী হয়েছে ইয়ানার জন্মের পরে।বাচ্চা বেশ পছন্দ তার।তাই সেই মূহুর্তে প্রাপ্তিকে দেখেও সিফাতের মনে হলো, কোন ছোট্ট পরী ঘুমিয়ে আছে। এতটাই নিষ্পাপ লাগছিল ওকে। তার মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে এলো, মাশাল্লাহ!
তারপর পলককে উদ্দেশ্য করে বললো,
_অনেকটা তোমার মতই দেখতে হয়েছে।
সিফাতের কথা শুনে হাসলো সে। তারপর বললো, ভাইয়ার মত দেখতে হয়েছে। আর সবাই বলে ভাই-বোনদের মধ্যে ভাইয়া আর আমার চেহারায় নাকি মিল বেশি।
_হ্যাঁ,,সেটা অবশ্য ঠিক। ছবিতে যখন দেখেছিলাম আমারও সেটাই মনে হয়েছিল। তবে,আমার এখন আরেকটা ছোট্ট আম্মা হয়ে গেল,কি বলো? বলেই হাসলো সিফাত।পলক মুগ্ধ হয়ে দেখলো সে হাসি। নির্মল..প্রাণোবন্ত এক হাসি। মনে মনে বললো,এত সুন্দর মন কেন মানুষটার? প্রাপ্তিকেও ইয়ানার মত একই স্নেহের জায়গা দিয়ে ফেললো মূহুর্তেই! নিশু ঠিকই বলেছিল,আমার সব না পাওয়া…কষ্টের বিপরীতে সুদ আসলে এই মানুষটাকে পেয়েছি আমি। আলহামদুলিল্লাহ। -বলে আপন মনেই হাসলো সে। তাকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে সিফাত জিজ্ঞেস করলো, রাতে খেয়েছো?
_না।
_কেন? রাত তো অনেক হয়েছে।
_আসলে সময় পায়নি। হাসপাতাল থেকে এসে গোসল করেছি। আর তার পর পরই ভাইয়া এলো। বাকিটা সময় প্রাপ্তিকে নিয়েই কেটে গেছে। এই তো আপনি ম্যাসেজ করার কিছুক্ষণ আগেই ঘুম পাড়িয়ে শুইয়েছি ওকে।
_ক’দিনেই বড্ড শুকিয়ে গেছো মৃন্ময়ী। নিজের না হোক অন্তত আমার মৃন্ময়ীর একটু খেয়াল রাখলেও তো পারো।
‘আমার মৃন্ময়ী ‘ কথাটা শুনে আবারও লজ্জা পেয়ে গেল পলক। সেটার আভাস ফুঁটে উঠলো তার চোখ মুখেও। সিফাতও স্পষ্ট দেখতে পেল সেটা। পলক এভাবে দেখতেও বেশ লাগে তার। এত কিছু ঘটে গেছে অথচ তাকে একবারও জানায়নি বলে বেশ রাগ হয়েছিল তার পলকের উপর। কিন্তু,পলকের ক্লান্ত মলিন মুখটা দেখামাত্র সেই রাগের দেয়ালে চির ধরেছিল তার। আর এখন এভাবে দেখে সব রাগ, মন খারাপ নিমিষেই কোথায় যেন উবে গেল তার। কদিনের ধকলে পদ্মপাতার জলের মত টলটলে মুখখানিতে ক্লান্তির ছাপ বসে গেছে অনেকটাই। বড্ড মলিন লাগছে। তবুও যেন তার মৃন্ময়ীর সৌন্দর্যকে এক বিন্দুও টলাতে পারেনি এ ক্লান্তি।এতেও অন্য রকম সুন্দর লাগছে তাকে। এই জন্যই বোধয় লোকে বলে, নিজের ভালোবাসার মানুষকে তার সব রূপেই সুন্দর লাগে নিজের কাছে। আর এই মূহুর্তে তার লজ্জামাখা মুখখানি দেখে মনে হলো, প্রচন্ড ঝড়ের শেষে মেঘলা আকাশের বুকে উঁকি দেওয়া ঝলমলে এক ফালি সূর্যকিরণ এসে জুড়ে বসেছে ভেজা মাটির গায়ে। আজ নতুন করে আরও একদফা প্রেমে পড়লো সে তার মৃন্ময়ীর। মুচকি হেসে মনে মনে বললো, মাশাল্লাহ! এরপর পলককে বললো,
_এবার তো দয়া করে খেয়ে নিন, মৃন্ময়ী।
_হু,,খাবো। আপনি খেয়েছেন?
_না। সকালে ব্রেকফাস্ট করেছিলাম। এখন লাঞ্চ ব্রেক ছিল। সেই ফাঁকে কথা বলে নিলাম আপনার সাথে।
_সেটা তো খেতে খেতেও কথা বলতে পারতেন। নয় তো পরেও কল করতে পারতেন।আপনি কল কেটে দেওয়ায় আমি ভেবেছিলাম ব্যস্ত আছেন আপনি।
_নাহ, ফ্রি হয়েই ম্যাসেজ করেছিলাম। রেস্টুরেন্টে মানুষ ছিল অনেক।সে জন্যই কল কেটে দিয়েছিলাম তখন ।আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল খুব।তাই ট্যারেসে এসে কল দিলাম এভাবে। লাঞ্চ আওয়ারও শেষ প্রায়। যেতে হবে এবারে।
সিফাতের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল পলকের। মানুষটা তার সাথে কথা বলবে বলে লাঞ্চ ব্রেকটা মিস করলো!খাওয়া হলো না তার।তাই মন খারাপের সুরেই বললো,
_কাজটা মোটেও ঠিক করেননি আপনি।সারাদিন এত পরিশ্রম করেন।তারপর খাওয়া দাওয়াটা ঠিক মত না করলে তো শরীর খারাপ করবে।
পলকের এভাবে বলায় হেসে দিল সিফাত। মেয়েটা তার হচ্ছে একটু একটু করে। তার জন্য চিন্তা করছে।খেয়াল রাখছে। এসবের মাঝেই খানিক দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল তার মাথায়। আচমকা মন খারাপের ভান করে আফসোসের সুরে বললো সে,
_বুঝলেন মৃন্ময়ী! বিয়েটা না করে এসে বেশ ভুল হয়ে গেছে।
_কেন? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো পলক।
তা শুনে এবারে বেশ রসিকতার সুরেই সিফাত বললো,
_এই যে দেখুন, শুধু আংটি পড়ানোতেই এমন বউ বউ ভাব চলে এসেছে আপনার মাঝে,,এভাবে চিন্তা করছেন আমার জন্য। তো কবুল বলে বিয়ে করে রেখে এলে তো পুরোপুরিভাবে বউ হয়ে যেতেন। তখন না জানি কত চিন্তা করতেন আমার। দিন রাত কত খোঁজ খবর নিতেন। কিন্তু…হায়! সে ভাগ্য আর আমার হলো কই!
সিফাতের এহেন কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল পলক। বোকার মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সিফাতের দিকে। পলকের এহেন চেহারা দেখে ফিক করে হেসে দিল সিফাত। আর তার এই হাসি দেখে পুরোপুরি বোকা বনে গেল পলক।
হাসি হাসি মুখেই এবারে সিফাত বললো,রিল্যাক্স! আই ওয়াজ কিডিং। বলেই আবারও হাসলো সে। সিফাতের কথায় এবারে পরিষ্কার বুঝতে পারলো পলক,ব্যাপারটা আদতে কি ছিল। নিজের এহেন বোকামিতে বেশ লজ্জা পেয়ে গেল সে। লাজুক হেসেই বললো, ধ্যাত !
এমন সময় বাসার বেল বেজে উঠলো। ঘড়িতে সময় দেখলো ১২:২৭। এমন সময় পলাশ ছাড়া আর কারও আসার কথা না। তাই সিফাতকে বললো, ভাইয়া এসেছে বোধয়। আমি দরজাটা খুলে দিয়েই আসছি। পলকের এহেন কথায় বাঁধ সাধলো সিফাত। বললো,
_আমারও এখন যেতে হবে মৃন্ময়ী। লাঞ্চ আওয়ার শেষ। নিজের খেয়াল রেখবেন । আর বাকি সবারও।
_জ্বী।আপনিও খেয়াল রাখবেন নিজের।
_ইন শাহ আল্লাহ। আর হ্যাঁ,,যাওয়ার আগে নিজেকে আয়নায় দেখে যাবেন একবার।
_কেন? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো পলক।
_সে আপনি দেখলেই বুঝবেন। বলেই মুখ টিপে হাসলো সে।তারপর বললো,রাখছি এখন। আল্লাহ হাফেজ।
পলক কিছুই বুঝলো না সিফাতের কথা। কিন্তু, কথাও বড়ালো না আর। বিদায় জানালো তাকে।আল্লাহ হাফেজ বলেই কল কেটে দিল সে। তারপর বিছানা থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দেখলো নিজেকে।আর সাথে সাথেই চক্ষুচড়ক গাছ হলো তার। আজকেও সে ওড়না ছাড়াই..!প্রাপ্তিতে খাওয়াতে গিয়ে জামায় খাবার পড়ে গেছিল তার। তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে চেঞ্জ করে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল সবেই। আর তখনই তো….!এসব মনে হতেই,লজ্জায় চোখ বুজে ফেললো সে।তবে আজ এই নিয়ে কেন কিছু বললো না মানুষটা তাকে? লজ্জায় ফেলবে না বলে? এটুকু ভাবতেই আরেকটু লজ্জা পেয়ে গেল সে।
ওদিকে পলাশ অনবরত বেল বাজাচ্ছে।তাই নিজের ভাবনার চরকা থামিয়ে হাতের কাছে থাকা ওড়নাটা চট করে তুলে নিল সে। ওটা গায়ে জড়াতে জড়াতেই রুম থেকে বেরিয়ে পা বাড়ালো সদর দরজার দিকে।
চলবে…