#রুপকথার_খোঁজে
#অন্তিম_পর্ব
আকরামের ঠোঁটে মৃদু হাসি। গম্ভীর আকরামকে আজ খুজে পেলো না রুহামা। বরং এক অমায়িক মানুষকে নজরে পড়লো। এমন স্বামীর কল্পনাই তো করেছিলো সে। হঠাৎ ঘরের দরজায় টোকা পড়লো। রুহামা নিজেকে সামলে নিলো। আকরাম গাম্ভীর্যকে আবার বরণ করলো, জিজ্ঞেস করলো
“কে?”
“ভাই, পুলিশ এসেছে। তোমার সাথে কথা বলতে চায়”
আদিবার কথাটি শোনার সাথে সাথেই ধক করে উঠে রুহামার ভেতরটা। সাঈদ কি তবে পুলিশ পাঠালো? দুপুরে আকরাম রাগের মাথায় সাঈদকে মেরেছিলো সেটার শোধ তুলতেই কি এই ব্যাবস্থা করেছে সাঈদ? রুহামা মুখ পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো। এক নিগাঢ় কৃষ্ণ ভয় তাকে ভেতর থেকে দূর্বল করে তুললো। আকরাম মিনিট দুয়েক চুপ করে থাকলো তারপর বললো,
“উনাদের বসতে বল আমি আসছি”
আদিবা চলে গেলো। রুহামার বিবর্ণ মুখের দিকে একপলক চেয়ে উঠে দাঁড়ালো আকরাম। মাথায় চিন্তা ঘুরপাক করছে না বললে ভুল হবে, কিন্তু ঘরের মধ্যে বসে থাকলে তো সমাস্যার সমাধান হবে না। সাঈদ যদি কোনো বলদামি করে তার সমাধান ও আকরামের কাছে আছে। বসার ঘরে মিরপুর থানার অসি বসে আছেন। আকরামকে দেখে সে উঠে দাঁড়ালো। মৃদু হেসে বললো,
“স্যার, ভালো আছেন?”
“জ্বী, তুমি কেমন আছো ইকবাল?”
“আলহামদুলিল্লাহ। স্যার একটা কাজে আপনার নিকট এসেছি”
“বলে ফেলো?”
“সাঈদুর রহমানের ব্যাপারে কিছু জানতে চাইতাম। আপনি হয়তো তাকে চিনেন, মিরপুর তফসিল অফিসে সাবরেজিস্টার হিসেবে কাজ করেন”
সাঈদুর রহমান নামটি শোনামাত্র রুহামার ভয় বেড়ে যায়, তবে কি সাঈদ ই পুলিশ পাঠিয়েছে? অসি ইকবাল আকরামের বেশ পরিচিত। তাই সে ঘাবড়ালো না, বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বললো,
“হ্যা, চিনি। কেনো কি হয়েছে?”
“আসলে তার নামে ভূমিদস্যুতার কেস রয়েছে। আমরা এতোকাল এই ব্যাপারে বেশ কটা রিপোর্ট পেয়েছি। আজ আমরা প্রমাণ ও পেয়েছি হাতে নাতে। সে বেশ কিছু টাকা খেয়ে এই কাজগুলো করে। বেশ কিছু জমি একই সাথে তিন-চারজনের সাথে বিক্রয় করা হয়েছে। খুব বড় একটা দল এর পেছনে আছে। সাঈদ তাদের ই সাহায্য করেছে। জাল দলিল এবং এই ভণ্ডামির কারণে আমরা তাকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু সাঈদুর রহমান আপাতত হসপিটালে ভর্তি বিধায় তাকে গ্রেফতার করতে পারছি না। তবে আমাদের নজর বন্দি সে। এই ব্যাপারেই আপনার কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছি”
রুহামা তার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সকল কথাগুলো শুনলো। সাঈদের মতো জঘন্য মানুষের জন্য তার মনে স্বল্প পরিমাণ সমবেদনা কাজ করছে না। যে মানুষ কোনো নারীর অসম্মান করতে পারে, সেই মানুষ যেকোনো খারাপ কাজ করতে পারে বলে রুহামার ধারণা। সাঈদের চরিত্রের এরুপ বর্ণনা শুনে সুমাইয়া বেগমের মন বসে গেলো। সততা সবার আগে যদি একটা ছেলে সৎ ই না হয় তবে তাকে মেয়ে সপে দেওয়া সবচেয়ে বড় ভুল। আকরাম দীর্ঘসময় কথা বললো ইকবালের সাথে। ঘন্টা খানিক পর ইকবাল উঠে দাঁড়ালো। বিনয়ী কন্ঠে বললো,
“স্যার, ধন্যবাদ। ইনশাআল্লাহ আপনি যেনো কোনো ঝামেলার ভেতর না পড়েন সেই দায়িত্ব আমার”
আকরাম মৃদু হেসে তাকে বিদায় দিলো। ইকবাল যাবার পর সুমাইয়া বেগম প্রশ্ন ছুড়লেন,
“তুমি কি এই কারণে বিয়েটা ভাঙ্গতে চাচ্ছিলে?”
“না, কারণ এটা নয়। এই ঘটনা তো আজ জানতে পারলাম আমি। আমি ভাঙ্গতে চেয়েছিলাম সাঈদের চরিত্র খারাপ তাই। তাকে আমি অন্য মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেছি। দৃশ্যটি দৃষ্টিকটু। কথাটা তখন কিভাবে বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। যাক গে, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। তুমি এখন নিশ্চিন্তে বিয়ে ভাঙ্গতে পারো। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলবে, তার ছেলে অসৎ”
কাঠ কাঠ উত্তর দিলো আকরাম। তারপর নিজ ঘরে প্রবেশ করলো। রুহামা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আকরাম তাকে বললো,
“আরেক কাপ চা দিতে পারবে?”
“হু, নিয়ে আনছি”
রুহামা রান্নাঘরে চলে গেলো। আকরাম নিজ ঘরে গিয়ে রুদ্ধশ্বাস ফেললো। যতই হোক সে মানুষ, মানুষের ভয় হয়। তার ও ভয় হয়েছিলো। ভেবেছিলো সাঈদ তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেছে। ভয়টা থানায় যাওয়া কিংবা নিজের সাদা চাকরি জীবনে কালো দাগ পড়ার নয়। ব্যাপারটা তার বউ এর মান সম্মানের সাথেও জড়িত। সাঈদকে সে মেরেছে রাগের বসে, রাগটা কেনো হয়েছে? এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করলেই এক কথায় দু কথায় রুহামার কথা উঠলো। তখন হয়তো মিডিয়া সেটা নিয়ে একটা খবর চাপাতো, মিরপুর তফসিল অফিসের রেজিস্টার স্ত্রীর প্রাক্তনকে মারার কারণে জেলে আটক। দুপুরে গরম মাথায় এসব কিছুই আসে নি, তখন শুধু সাঈদকে মারতে ইচ্ছে করেছিলো। এখন বুঝতে পারছে কোথা থেকে কি হবার সম্ভাবনা ছিলো। ভাগ্যিস আল্লাহ তা’আলা সাঈদের ভণ্ডামি ফাঁস করে দিয়েছেন। নয়তো অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো আকরামকে। আকরাম বারান্দার দাঁড়ালো। আজ শীত তুলনামূলক বেশি পড়েছে। চাটা পেলে ভালো হতো। ঠিক তখন ই রুহামা এক কাপ চা হাতে উপস্থিত হয়। নরম গলায় বলে,
“আপনার চা”
“ধন্যবাদ”
রুহামার ঠান্ডা লাগছে বিধায় সে ঘরে যাবার জন্য পা বাড়ায়। তখন আকরাম বলে উঠে,
“কিছুক্ষণ দাঁড়াবে এখানে?”
“জ্বী?”
আকরামের নরম গলার নিবেদনে থমকে যায় রুহামা। এই দুমাসে কখনো এমনভাবে অনুরোধ করে নি আকরাম। কিছুটা অবাক হলো সে। রুহামার উত্তর না পেয়ে আকরাম বললো,
“সমস্যা নেই, তুমি যাও”
“আমি শালটা নিয়ে আসছি, ঠান্ডা তো”
“হু”
রুহামা একটা মোটা শাল ভালো করে পেঁচিয়ে দাঁড়ালো আকরামের পাশে। আজ আকাশে পূর্ণচন্দ্রমা, ঝিরিঝিরি শীতল বাতাস ছুয়ে যাচ্ছে রুহামার মুখশ্রী। সাপের ন্যায় চুলগুলো অবাধ্য হয়ে উড়ছে। মাঝে মাঝে আঁছড়ে পরছে মুখের উপর। কালো আকাশের মেঘের ফাঁকে শীতলের চাঁদের আলো গলে পড়ছে তাদের বারান্দায়। আজ রাতে জ্যোৎস্নাবিলাশের জন্য উপযুক্ত। রুহামার ইচ্ছে ছিলো বিয়ের পর বরের সাথে জ্যোৎস্নাবিলাস করবে। কিন্তু সেই ইচ্ছেটা ইচ্ছেই রয়ে গেলো। কখনো সাহস করে আকরামকে বলা হয় নি। হয়তো বললেই বলতো, ‘তুমি এতো ছেলেমানুষ কেনো রুহামা?’
রুহামা অপলক দৃষ্টিতে চন্দ্রমাকে দেখছে, হঠাৎ আকরাম বলে উঠে,
“জানো রুহামা, আমার কখনো বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলো না। মা কে সবসময় বলতাম, বাচ্চা মেয়ে আমার অপছন্দ। পারলে আমার সমবয়সী কাউকে খুজো। সেটার কারন ছিলো। আমার এক বন্ধু তার থেকে ছোট একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলো। তাদের মাঝে হাজারো অমত। একটা সময় তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। সময় পাল্টাচ্ছে, আমি বড্ড সেকেলে মানুষটা। এখনের জেনারেশনকে বুঝে উঠতে পারি না। তাদের পছন্দ, অপছন্দ সবকিছু কেমন এলোমেলো ঠেকে আমার কাছে। ফলে আমারো পরিণতি আমার বন্ধুর মতোই হবে। আমি বিচ্ছেদ খুব ভয় পাই। বিনা ছুরিঘাতে হত্যার মতো লাগে আমার কাছে। কিন্তু মা পছন্দ করলেন তোমাকে। নয় বছরের ছোট একটা মেয়েকে। যখন তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম, না চাইতেও মন দিয়ে বসলাম। আসলে এই ভালোবাসা, ভালোলাগা ব্যাপারগুলো তো নতুন আমার কাছে। তোমার সেই লাজুক চাহনী, মৃদু হাসি, এতো স্নিগ্ধ লেগেছিলো। কিন্তু এই অনুভূতির সাথে গাঢ় ভয় ও আমাকে তাড়া করেছিলো। তোমার কি আমার মতো বুড়োকে ভালো লাগবে? আমি সুন্দর করে কথা বলতে পারি না। খ্যাটখ্যাট করি প্রচুর। আরোও ভয় পেলাম যখন তোমার আড়ষ্টতা আমার নজরে পড়লো। ভেবেই নিলাম তুমি আমাকে পছন্দ করো না। কিন্তু সেদিন যখন তুমি বিনা জড়তায় আমাকে সাঈদের কথাগুলো বললে, কেনো জানে মনে হলো তুমি আমাকে একটু হলেও মনে জায়গা দিয়েছো। আজ যখন সাঈদ তোমার নামে খারাপ কথা বলছিলো আমার একটু ভালো লাগছিলো না। বরং রাগ হয়েছিলো। আমি সেই সময়ে বুঝতে পেরেছি। শুধু তোমাকে ভালো লাগে না, অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে। মনের ভেতরে কথাগুলো জমিয়ে রাখতে পারলাম না। বলে দিলাম। আমার মতো মানুষকে ভালোবাসতে তোমার আপত্তি থাকতেই পারে। বলে দিতে পারো। আমি জোর করার মানুষ নই”
“আচ্ছা, আকরাম আমার বয়স হলে কি আপনার এই ভালোবাসাটা কমে যাবে?”
রুহামার প্রশ্নে মৃদু হাসে আকরাম। তারপর বলে,
“এজন্যই তোমার সাথে কথা বলতে চাই না। এতো বোকা কেনো তুমি? ভালোবাসা কি সেভাবে হয় নাকি? তাহলে তো সবাই বুড়ো হলেই তার পার্টনারকে ছেড়ে দিতো। ভালোবাসা তো মন থেকে হয়।”
“তাহলে আপনার কেনো মনে হলো, আপনি আমার থেকে বড় হওয়ার জন্য আমি আপনাকে ভালোবাসবো না। আপনাকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি জানেন, আপনার সততাকে আমার ভালোলাগে। সকালে আপনার শান্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে থাকি। কল্পনা করি আপনার সাথে জ্যোৎস্নাবিলাসের। কিন্তু ঐ খ্যাটখ্যাটে স্বভাবের দরুন বলা হয় না। এই দু মাসে আপনার জন্যই আপনার পরিবারকে ভালোবেসেছি। আমার আপনাকে খুব ভালোলাগে আকরাম। শুধু আগাতে পারি নি, ভেবেছি আপনার হয়তো আপনার সর্বগুন সম্পন্ন মেয়ে পছন্দ। আমার মাঝে তো শুধুই ভুল। আশাকরি আমার উত্তরটা পেয়েছেন”
আকরাম আবারো মৃদু হাসলো। কি অমায়িক হাসি, তার চোখও যেনো হাসছে। রুহামার বাবা বলেছিলো, ‘যাদের চোখ হাসে, তারা স্বচ্ছমনের মানুষ’। কথাটা মিলে গেছে। আকরাম বা হাতটা বাড়িয়ে মৃদু কন্ঠে বললো,
“আজ পূর্ণচন্দ্রিমা, জ্যোৎস্নাবিলাস করবে? হুমায়ুন স্যারের বই এ পড়েছিলাম। প্রিয়তমার সাথে জ্যোৎস্নাবিলাস নাকি খুব সুখময়। করবে আমার সাথে জ্যোৎস্নাবিলাস?”
রুহামা অজান্তে লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। সে ভেবেছিলো তার রুপকথার খোঁজ হয়তো অপূর্ণই থাকবে। একটা সময় সাঈদের মাঝে রুপকথা খুজতো, ভবিষ্যতের সুখের হাতছানি খুজতো। কিন্তু সে সব কাঁচের মতো ভেঙ্গে গিয়েছিলো। তারপর আকরাম তার জীবনে আসে। কিন্তু লোকটির গম্ভীরতা তাকে এলোমেলো করে দিয়েছিলো। ভেবেছিলো, রুপকথা খোঁজার পথই হারিয়ে ফেলেছে রুহামা। অবশেষে আজ সকল দ্বিধার অন্ত হলো, আকারামের মাঝেই খুজে পেলো তার রাজকুমারকে। রুহামার রুপকথার খোঁজ অবশেষে পূর্ণ হলো। রুহামা আলতো ঘাতে আকড়ে ধরলো আকরামের হাত। চাপা স্বরে বললো,
“করবো, আজ রাতটি শুধু আমাদের”
।।সমাপ্ত।।