তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ২৪

চার খণ্ড ভাঙা ফোনটা হাতে নিয়ে বসে আছে সায়রা। জোরা লাগানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। মোবাইলের উপরের কাঁচটা ভেঙে চুরমার। এইতো তিন মাস হলো ফোনটা কিনেছে। এখনো নতুন। কত পছন্দের ছিল তার। ফোন চালানো বৃথা চেষ্টা করল, হলো না। মন খারাপ করে বসে রইল সায়রা। কেউ জিজ্ঞাস করলে কি বলবে? কিভাবে ভেঙেছে? মুখভার করে গভীর চিন্তায় ডুবে রইল।

দিনের আলো মাড়িয়ে অন্ধকার এসে ঝেঁকে বসেছে। সন্ধ্যার আকাশ। চারিদিক আঁধার কালো, আমাবস্যার রাত! আকাশে নেই কোন তারকারাজি। গলির ব্যস্ত রাস্তা কৃত্রিম আলোয় আলোকিত। মিনিট দুএকের ব্যবধানে সুড়সুড় রিক্সা চলছে। নিকষ কালো অম্বরে বেখেয়ালি চেয়ে আছে সায়রা। আঁখিদ্বয় জলে ছলছল। ভাবনা কাটল কারো উপস্থিতিতে। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখল- আরসাল নিমিষ দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে আছে। আরসালকে দেখতেই তড়পান করে উঠল সায়রা। পিছন ফিরে দ্রুত পায়ে সামনের দিকে পা বাড়াতেই। গম্ভীর করে বলে উঠে আরসাল,

–” স্টপ সায়রা! আর একপা বাড়ালে খুব খারাপ হবে!”

এক পাও বাড়াল না সায়রা। ঠাই দাঁড়িয়ে থাকল। আরসাল মুখোমুখি হলো সায়রার। নত মাথায় দাঁড়িয়ে আছে সে।চোখ তার মাটিতে, আরসালের গভীর দৃষ্টি দেখছে সায়রাকে। কৃত্রিম আলোয় নিকষ কালো রাতেও স্পষ্ট মুখশ্রী ফুটে আছে সায়রার। মুখে দ্বিধাদ্বন্দ্বের বলিরেখা তার। চোখে এক সমুদ্র মায়া। কি লুকাচ্ছে মেয়েটা! কেন এত জটিলতা? এই লুকোচুরি খেলাই খেলছে কেন! চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে আরসালের। সায়রার শ্লথ স্বর ভেসে এলো,

— ” কিছু বলবেন আরসাল ভাই? রাত হচ্ছে আমাকে নিচে যেতে হবে।”

আরসাল ছোট এক নিশ্বাস ফেলল। চোখ সরিয়ে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

–” সমস্যা কি তোর? আমাকে ইগ্নোর করছিস কেন?”

নিরুত্তর সায়রা। সায়রার বাহু চেপে ধরল আরসাল। কাছে টেনে হুঙ্কার দিয়ে বলল,

–” মুখে তালা কেন? কথা কানে যাচ্ছেনা?”

সায়রার চোখ জলে টলটল। ছাড়া পাবার আপ্রাণ চেষ্টা। হাত ছুড়াছুঁড়ি করবে বারংবার। জোর ধমক দিলো আরসাল। শান্ত হলো সায়রা। মাথা নুয়ে নিশ্চুপ কেঁদে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। আরসাল চিৎকার করে বলল,

–” শান্ত আছি মানে এই না আমি তোর সব বেয়াদবি মেনে নিবো। সময় দিচ্ছি নিজেকে প্রস্তুত কর। খুব শীঘ্রই তোদের বাড়ি মা বাবা সম্বদ্ধ নিয়ে আসবে। আমি চাই ভালোয় ভালোয় হোক সব। কোনরকম বাড়াবাড়ি করবি না। আমি রেগে গেলে ফল কত ভয়ংকর হতে পারে নিশ্চয় জানিস?”

আরসালের উত্তরে চিৎকার করে উঠল সায়রা। প্রতিবাদী স্বরে,

–” নিজেকে কি ভাবেন আপনি! সবাই আপনার গোলাম! আপনি যা বলবেন তাই শুনতে হবে সবাইকে? কতবার বলবো আমার আপনাকে পছন্দ না। একদম পছন্দ না। ঘৃণা করি আপনাকে। আমি জাস্ট আপনার সাথে টাইমপাস করছিলাম। আপনি আমাকে অপমান করেছেন, তাই আমি প্রেমের নাটক করে কষ্ট দিকে আপনাকে তা সুদেআসলে ফিরাতে চেয়েছি। আপনি কেন বুঝেন না আমি আপনার প্রতি বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্টেড নাহ!”

ক্ষেপে গেল আরসাল। নিজের কাছে টেনে, হাত মুড়িয়ে নিজের সাথে চেপে ধরল। আরসালের ফোঁসফোঁস তপ্ত নিশ্বাস পড়ছে সায়রার মুখে। চোখ মুখ বুজে আছে সে। চোখের বাঁধ মাড়িয়ে গাল বেয়ে পড়ছে অশ্রুকণা। খুনের নেশা চেপেছে আরসালের। অন্যহাতে শক্ত ভাবে মুখ চেপে ধরল সায়রাকে। চোখ বুজেই আর্তনাদ করে উঠল সায়রা। শুনল না আরসাল! তাগড়াই গর্জন করে বলল আরসাল,

–” বেশি বাড় বেড়েছিস! শান্ত ভাবে সবটা হেন্ডেল করতে চেয়েছি। কিন্তু তুই করতে দিলি না। এখনি নিচে গিয়ে কাজি ডেকে বিয়ে করব তোকে। চল!”

ছিটকে ছাড়ল আরসাল। মোবাইল বের করে কাউকে ফোন লাগাল। সায়রার হাত টানতে টানতে নিচে নিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে হাত পা কাঁপছে সায়রার। কান্নাকাটি আহাজারি করছে সে। হাত ছাড়িয়ে নিজেকে মুক্ত করতে আপ্রাণ প্রচেষ্টা। থামাতে চাইল আরসালকে। পারল না। আরসাল আজ রাগে অন্ধ। সায়রার কান্নাকাটি আহাজারি কোনটাই কানে পৌঁছাচ্ছে না তার! ক্লান্ত হয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে। চিৎকার করে বলে,

–” মরে যাবো আরসাল ভাই! আমাকে কোন কিছু করতে বাধ্য করলে আমি নিজের জান নিয়ে নেবো!”

থেমে গেল আরসাল। পিছন ফুরে দেখল ডুকরে কাঁদছে সায়রা। চোখ গাল অশ্রুতে ভিজে। সায়রার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল আরসাল। আগের মত কান্না করতে করতে বলল সায়রা,

–” আপনি কেন বুঝেন না, আমি আপনাকে ভালোবাসি না। আপনাকে আমার সহ্য হয় না! বিরক্ত লাগে। প্রচণ্ড বিরক্ত! ”

এতটুকু বলেই সায়রা হাউমাউ কাঁদছে। আরসাল ঝুঁকল! গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে শান্ত ভাবে বলল,

–” বিরক্ত? তুই আমার উপর বিরক্ত?”

সায়রা চুপ। আরসাল আবার বলল,

–” আচ্ছা, সব বুঝলাম! কাঁদছিস কেন তুই? তোর চোখ তো অন্য কিছু বলছে। কোনটা মানব তোর চোখের ভাষা নাকি মুখের? ”

সায়রা এবারো চুপ। আরসাল জবাবের অপেক্ষায় থাকল বেশ কিছুক্ষণ। অবশেষে মুখ খুলল সায়রা। কান্নাভেজা আওয়াজে বিরবির করে বলল,

–” আমার আপনার থেকে মুক্তি চাই। আমাকে আমার মত থাকতে দিন আরসাল ভাই!”

গম্ভীর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল আরসাল। সায়রা মাথা নুয়ে কেঁদে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। আরসাল ফোঁস শ্বাস ছাড়ল। সায়রার সামনে একটা ব্যাগ রেখে তেজি স্বরে আওড়াল,

–” ফোন দিতে এসেছিলাম!”

কিছুক্ষণ থেমে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে বলল আরসাল,

— “আজকের পর আর কোন দিন তোকে বিরক্ত করব না সায়রা। তুই মুক্ত!”

তড়াক করে উঠে। বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেল আরসাল। থম মেরে আরসালের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল সায়রা শুধু। আজ নিজের হাতে সব শেষ করে দিলো সে!

.
সেদিনের পর আরসালকে আর দেখেনি সায়রা। আরসালের বারান্দার দরজাটাও বন্ধ। সায়রার খারাপ লাগলেও নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছে সায়রা। যা হচ্ছে ভালোই হচ্ছে। আরসাল ভুল বুঝে দূরে সরে যাক । এটাই তো সায়রা চায়! নিজেকে মিছেমিছি বুঝিয়ে নিয়েছে সে। সামনে ফাস্ট ইয়ার ফাইনাল। পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত সায়রা। ক্লাস, টিউশন, গ্রুপ স্টাডি পর পর শেষ করে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরছে সে। সন্ধ্যা নামতে এখনো অনেকটা সময়। শীতের প্রবণতা তখন আকাশ চুম্বী। চাদরে শক্ত করে হাত মুড়িয়ে , গুটিসুটি পায়ে গলির রাস্তায় হাঁটছে সায়রা। মদির দোকানের পাশে নাইট গার্ড চাচা বসে। গায়ে ছেঁড়া সোয়েটার। মাথায় পুরানো কান টুপিতে ঢাকা। শীতের এই রুক্ষতা থেকে বাঁচতে আগুন জ্বেলে উষ্ণতার ছোঁয়া নিচ্ছে তিনি। সায়রাকে দেখে উৎফুল্ল হেসে বললেন,

–” কই গেছিলা মা?”

–” ভার্সিটিতে চাচা”

–” শরীর গতর ভালানি মা”

–” জি চাচা ভালো, আপনি কেমন আছেন?

–” হ মা ভালা!”

নাইট গার্ড চাচার সাথে টুকটাক কথা সেরে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় সায়রা। হ্ঠাৎ চোখ আটকায় মোরের শেষ মাথায় চায়ের দোকানটার পাশে গাড়িটায়। আরসালের গাড়ি। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে, দ্রুত পা বাড়াতে যেয়েও থেমে যায় সায়রা। ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। আরসালের পাশের সিটে আরমিন। আরমিনের চোখ মুখ ফুলে আছে। বার বার চোখ মুছছে। সায়রাদের বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই তড়াক করে নেমে গেল আরমিন। বিষয়টা বেশ খটকা লাগল সায়রার। আরসাল ভাই আরমিন আপুকে রিজেক্ট করেনি তো আবার! ঘাবড়াল সায়রা। আরমিনের পিছু পিছু সায়রাও বাড়িতে গেল।

চলবে…….

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here