তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ২১

দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে। নভেম্বর কেটে ডিসেম্বর। চারিদিক এখন শীতের প্রবণতায় জড়। রোজ সকালে ধোঁয়ার মত ঘন কুয়াশায় ডাকা থাকে চারিদিক। পাঁচটা বাজতে না বাজতেই সন্ধ্যা নেমে আসে। অন্ধকারে ডেকে যায় চারপাশ। বিকাল হতে না হতেই দোকানীরা ফুটপাতের পাশে পিঠার দোকান নিয়ে বসে। ভাপা পিঠার মিষ্টি ঘ্রাণে মো মো ফুটপাত। বৃদ্ধাদের গরম কাঁপড় পরে রাস্তার ধারে আগুন জ্বালিয়ে শীত কমাতে আপ্রাণ চেষ্টা। ভোরের শিশির ছুঁয়ে যায় দূর্বাঘাস। সময়ের সাথে আরসাল সায়রার সম্পর্কের গভীরতাও বেড়েছে। দুই বাড়ির মাঝেকার আড়ষ্টতা সংকোচ কাটছে ধীরেধীরে ।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সূর্যের তাপ কমে কুয়াশা নামছে। থমথমে মুখ নিয়ে তুর্জয়ের বাবা মায়ের সামনে বসে আছে আরমিন। সামনের টেবিলে চায়ের কাপ থেকে ঘন ঘন ধুঁয়া উড়ছে। আরমিনের গলা শুকিয়ে কাঠ। মাথা নুয়ে ওড়ানার কোণা শক্ত করে চেপে বসে আছে। তুর্জয়ের মা লতিফা ভীষণ সৌখিন মানুষ। চিন্তাভাবনাও ভীষণ ব্রাইট। যুগের সাথে পা মিলিয়ে চলতে জানেন তিনি। তার মতে, “ছেলেমেয়েরা তাদের মনের কথা বাবা মায়ের সাথে শেয়ার করবেনা তো কার সাথে শেয়ার করবে?” হাসি হাসি মুখ করে বললেন তিনি,

–” এখানে দেখাদেখি কি আছে। মেয়ে আমাদের ভারি পছন্দ। তুর্জয়ের পছন্দই আমাদের পছন্দ। আমরা আরো আগেই সম্বন্ধ নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু সায়রা বলল সামনে আরমিনের ফাইনাল এক্সাম তাই দেরী করা।”

দাদী বিচলিত স্বরে বললেন,

–” রিদ্ধির পায়ে একটু সমস্যা আছে জানেন নিশ্চিয়!”

লতিফা বেগম স্মিত হেসে জবাব দিলেন,

–” আমরা সায়রা থেকে সবটা শুনেছি। তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। এক্সিডেন্ট যেই কারো সাথে ঘটতে পারে। তা হাইলাইট করে কারো গুনগুলোকে কেন অদেখা করা?”

লতিফা বেগমের কথায় ভীষণ খুশি হলেন নুরজাহান বেগম। পাশ থেকে সিন্থিয়াও প্রশান্তির হাসি হাসলেন। মনে মনে এমনি একটা পরিবার আরমিনের জন্য খুঁজছিলেন তিনি। যে আরমিনের ক্ষুদ গুলোকে হাইলাইট না করে তার গুণ গুলো দেখবে। নুরজাহান বেগম হাসি মুখ করে বললেন,

–” তুর্জয় আরমিনকে পছন্দ করে সায়রা তা আগে থেকেই জানতো?”

–” হ্যাঁ, সায়রা থেকেই সবটা শুনেছি আমরা। সত্যি আপনাদের পারিবারিক শিক্ষার তারিফ করতে হবে। ছেলেমেয়েরা ভীষণ ভদ্র শান্ত। আ’ম ইম্পেসড। ভীষণ শান্ত বুঝদার মেয়ে সায়রা।”

গর্বে বুক ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল নুরজাহান বেগম। এসব প্রশংসার সকল কৃতিত্ব তার কড়া শাসনের। সিন্থিয়া তো সারাবছর অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সংসারের দিকে মন কই তার? সংসার তো তিনিই সামলায়। অতিশিক্ষিত চাকরীজিবী বউ ঘরে আনলে এই এক জ্বালা। শুধু রান্নাবান্না ঘর গোছানোই কি সংসার? এসব ভেবে তৃপ্তির হাসি হাসলেন নুরজাহান বেগম।

.

ক্লাস শেষে টিউশন পড়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়েছে সায়রার। গায়ে ভারী সিঁদুর লাল কাশ্মীরি শাল। বাহিরে প্রচণ্ড শীত পড়েছে। শালের ভেতর হাত ঘুটে শীতে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঢুকছে সায়রা। মনটা বেশ ফুরফুরে। আজ তুর্জয়ের বাড়ি থেকে আরমিনের জন্য সম্বন্ধ এসেছে। তার উপর টিউশন শেষে আরসালের সাথে বাড়ি ফিরেছে। এতে খুশি দ্বিগুণ হয়েছে। হাতের নীল কাঁচের চুড়ি গুলো বারবার দেখছে আর মিটমিট হাসছে সে। মানুষটা এমন অদ্ভুত কেন? কি জানি সব ছেড়ে সায়রার হাতের প্রতি তার এত নেশা কেন! যখনি দেখা হবে তখনি হাত সাজাবে কখনো ফুলের মালা বেঁধে আবার কখনো কাঁচের আর কুন্দনের চুড়ি দিয়ে। আরসালের দেওয়া চুড়ি আর হাত সাজানোর উপহারে আলমারীর বড় তাকটা ভরে গেছে সায়রার। সেইদিন মানা করায় যা রাগটাই না দেখল সায়রাকে! কি যে পাগলমো করে মানুষটা!
নিজের ঘরে ডুকেতেই বিছানায় আরমিনকে দেখতে পেল সায়রা। কাঁধ থেকে ঝুলন্ত ব্যাগটা টেবিলের উপর রাখল। গা থেকে শালটা ছাড়াতে ছাড়াতে হাসি হাসি মুখ করে আরমিনের উদ্দেশ্যে বলল সায়রা,

–” কি গো হবু নতুন বউ! বিয়ের কথা হতে না হতেই মুখ লজ্জায় লাল!”

অপর পাশ থেকে আরমিনের গম্ভীর আওয়াজ এলো,

–” তুর্জয় ভাই আমাকে ভালোবাসে তুই আগে থেকে জানতি সায়রা?”

–” জানতাম কি তুর্জয় ভাই সবার আগে আমার কাছেই তোমাকে ভালোবাসে তা স্বীকার করেছিল।”

–” আর তুই বাড়িতে বিয়ের প্রপোজাল পাঠাতে বললি, তাইতো ?”

সায়রার ভ্রু কুঁচকে এলো। আরমিনের কন্ঠে ক্রুদ্ধতার আবাস। ছোট থেকে এক সাথে বড় হয়েছে দুজন। আরমিন কখনো সায়রার সাথে এই টোনে কথা বলেনি। তবে হ্ঠাৎ আজ কেন? সায়রা কি কিছু ভুল করেছে? তুর্জয় ভাইয়ের বাড়ির লোক কি উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে আরমিন আপুকে। কিন্তু সেদিন তো সব ঠিকই ছিল। লতিফা আন্টি জানাল উনাদের আরমিন আপুকে ভীষণ পছন্দ! তবে আজ এমন কি হলো যার জন্য আরমিন আপু এত রেগে! বিস্মিত হয়ে ভাবল সায়রা।
সায়রা আরমিনের হাত ধরতেই, সায়রার হাত ছিটকে দেয় আরমিন। চিৎকার করে বলতে লাগে,

–” নিজেকে কি ভাবিস তুই? সবার জীবন তোর ইচ্ছেমত চলবে? তুই যা চাইবি তাই হবে? সবার লাইফ কন্ট্রোল করতে পারবি তুই? তুই কেন বাড়িতে তুর্জয়কে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে বলেছিস?”

সায়রা এবার কেঁদেই দিলো, বুঝানোর স্বরে আরমিনকে বলল,

–” বিশ্বাস করো আপু, আমি তুর্জয় ভাইকে আগেই বিয়ের প্রপোজাল পাঠাতে বলিনি। আমি বলেছিলাম প্রথমে যেন তোমাকে জানায়, তারপর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে। পরে যখন তুর্জয় ভাই রিজেক্টের ভয় করে জোর দিয়ে বলল, আগে পারিবারিক ভাবে সবটা হেন্ডেল করবে তারপর তোমাকে জানাবে। তাই আমিও আর মানা করিনি। তুর্জয় ভাই তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে আপু!”

সায়রার কথায় আরমিন প্রচণ্ড ক্ষেপে গেল। এগিয়ে এসে সায়রার কাঁধ ঝাঁকিয়ে চিৎকার স্বরে বলল,

–” আমি তুর্জয় ভাইকে ভালোবাসি না সায়রা! আমি অন্যকাউকে ভালোবাসি। প্রচণ্ড ভালোবাসি তাকে! শুনেছিস তুই?”

সায়রা প্রচণ্ড বিস্ময়ে পাথর হয়ে রইল। আরমিন সায়রাকে ছেড়ে ঘরের যা সামনে পাচ্ছে সব কিছু ভাঙচুর করছে। ক্রোধে আজ সে পাগল। বেশ শান্ত মেয়ে বলেই আরমিনকে চিনতো সায়রা। আজ তার এই অগ্নিরূপ থেকে পুরোপুরি আশ্চর্য সে। যে মেয়ে উঁচু স্বরে আজ অবধি কারো সাথে কথা বলেনি। সেই মেয়ে কিনা আজ এমন পাগলামো করছে? ঘরের জিনিস ভাঙচুর করছে। আরমিনের এমন রূপ দেখে জড়সড়ভাবে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে সায়রা। চোখ থেকে অনবরত জল পড়ছে তার। এই মুহূর্তে আরমিনকে প্রচণ্ড ভয় হচ্ছে সায়রার। বার বার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে কাকে ভালোবেসে এমন পাগলামো করছে আরমিন!
শান্ত মানুষ সাধারণত স্রোতহীন নদীর শান্ত জলের মতই নীরব থাকে। যখনি তাদের ভেতর সহ্য সীমানা অতিক্রম করে তখনি তারা অগ্নিগিরির জ্বলন্ত লাভার রূপ নেয়। আরমিন সেই শ্রেণীরই মানুষ। আজ তার সব সহ্য সীমানা অতিক্রম করেছে। জ্বলন্ত অগ্নিগিরির রূপ নিয়েছে সে।
এদিকে আরমিন চিৎকার করছে।

–” আমার কমতির সুযোগ নিয়ে ছোট থেকে সবাই যার যার সিদ্ধান্ত আমার উপর ঠেলে দিচ্ছে। আমি কি চাই, না চাই কেউ একটাবার ভেবে দেখেছে? মানুষ না আমি? রাস্তার জানোয়ার মনে হয় আমাকে? কারো কথা মানবো না। কারো কথা না। আমি ভালোবাসি তাকে। আমার তাকে চাই!”

পুরো ঘর এলোমেলো হয়ে আছে। আরমিন হাডবোর্ডের ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাড়িয়ে রাগে গরগর করছে। পেছনের ড্রেসিংটেবিলের আয়না নড়বড় করছে। মাসেক খানিক আগে ড্রেসিংটেবিলের আয়না ভেঙেছে। চার পাঁচদিন হলো নতুন আয়না লাগানো হয়েছে। পিয়াস লাগিয়েছে, ভালো করে লাগাতে পারিনি সে। মাহির আহমেদ বলেছে সার্ভিসিং এর লোক ডেকে ঠিক করে নিবে। ব্যস্ততায় আর ডাকা হয়নি। আয়নাটা নড়বড় করছে সামান্য ধাক্কা লাগলেই পড়ে যাবে। সায়রা তা লক্ষ করেছে। আরমিনকে সেখান থেকে দূরে সরাতে তার দিকে আসতেই আরমিন সায়রাকে জোরে ধাক্কা দেয়। তাল সামলাতে না পেড়ে দুজন দু দিকে পরে। আরমিনের মাথা বিছানায় লেগে কপাল কাটে। আর অন্যদিকে পেছনের আয়নার সাথে ধাক্কা লেগে সায়রা নিচে পরে। তার শরীরের ডান পাশটায় পড়ে আয়না। কাঁচ ভেঙ্গে শরীরে ঢুকেছে। চুড়ি ভেঙ্গে হাতে বিঁধেছে। শরীর থেকে গরগর করে রক্ত যাচ্ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে সায়রার, নিশ্বাস থেমে থেমে যাচ্ছে। আধবোজা ঘোলা চোখে দেখল সায়রা। আরমিনের কপাল কেটে অচেতন হয়ে ফ্লোরে পরে আছে । মনে পরে গেল ছোট বেলার সেই ইন্সিডেন্টের কথা। উঠে আরমিনের দিকে যেতে চাইল সায়রা। কিন্তু শরীরের শক্তি সাঁই দিলো না তার। ধপ করে আবারো কাঁচের উপর পড়ে গেল সে। চোখ বুজে এলো। তলিয়ে গেল গভীর অন্ধকারে।

বাড়ির সামনে শোরগোল আর এম্বুলেন্সের আওয়াজে রুম থেকে বেরিয়ে এলো আরসাল। সায়রাদের বাড়ির সামনে লোকজন জড় হতে দেখে কপাল কুঁচকে গেল। আজকাল দাদী ভীষণ অসুস্থ থাকে। উনার কিছু হয়নি তো আবার! ভাবল আরসাল। দ্রুত পায়ে নিচে গেল। বাড়ির সামনে যেয়ে ভিড় ঠেলে ভিতরে যেতেই আরসাল দেখল- স্টেচারে করে সায়রাকে এম্বুলেন্সে তুলছে। গায়ের সাদা কামিজটা রক্তেমাখা। সন্ধ্যায় পড়িয়ে দেওয়া নীল চুড়ি গুলো ভেঙে হাত থেকে গরগর রক্ত ঝরছে। আরসালের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। থমকে গেল সে। পাথর হয়ে গেল ঠাই দাঁড়িয়ে! অতি শোকে কি অনুভূতি জিনিসটা হারিয়ে ফেলল আরসাল!

 

চলবে…….

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here