তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ১৭

 

বাড়ি ফিরে রেগে ফোঁসফোঁস শ্বাস ফেলছে সায়রা। সারা শরীর ভিজে একাকার। আরসালের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে তার। যদি আধো পথেই নামানোর ছিল, তবে ভার্সিটি থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসলো কেন? সায়রা তো বলেনি! এসব ভাবনার মাঝেই ফোনটা আবার বেজে উঠল। সায়রা রিসিভ না করে কেটে দিলো। তারপর সুইচঅফ। এই রগচটা বদমেজাজি লোকটার সাথে কথা বলবে না সে। একদম কথা বলবেনা!

পরদিন থেকে দুজনের মধ্যে অদৃশ্য এক যুদ্ধ শুরু হলো। একজন আরেকজনকে এড়িয়ে চলার যুদ্ধ। সেইদিনের পর সায়রাকে আর ফোন দেয়নি আরসাল। না নিজের থেকে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কখনো মুখোমুখি হলে সায়রাকে বরাবরের মত এড়িয়ে গেছে। এতে সায়রা বেপরোয়া ভাব দেখিয়ে চললেও ভেতরে ভেতরে সেও কষ্ট পাচ্ছে।

আজ ছুটির দিন। সকাল থেকে মন খারাপ সায়রার। ফজরের নামায আদায় করে বিছানায় নিস্তেজ হয়ে পরে আছে সে। চোখের পাতায় কিছুতেই ঘুম নামছে না। গত রাতেও ভালো ঘুম হয়নি তার। মন বড্ড অশান্ত, অস্থির। গতকাল যখন থেকে শুনেছে আজ রহিতাদের বাড়ি থেকে আরসালদের বাড়িতে বিয়ের কথাবার্তা বলতে লোকজন আসছে। সম্ভব হলে আজই আংটি বদল হবে, সেই থেকেই মন অশান্ত সায়রার। লাখ বুঝিয়েও নিজেকে শান্ত করতে পারছেনা সে। অথচ সে নিজেই চেয়েছিল রহিতার সাথে আরসালের বিয়েটা হোক। এখন যখন সবটা সুন্দর ভাবে হচ্ছে তার কেন এমন অস্বস্তি লাগছে? কেন এই ঈর্ষান্বিত যন্ত্রণা? নিজেকে নিজে বারবার প্রশ্ন করে যাচ্ছে সায়রা। প্রত্যুত্তরে মন থেকে কোন আওয়াজ এলো। মনটাও বুঝি মস্তিষ্কের মতই বিভ্রান্ত। সারা সকাল বিছানায় শুয়েই কাটল। সকাল পেরিয়ে দুপুরে যেয়ে থামল। মায়ের ডাকাডাকিতে বিছানা ছেড়ে উঠল সায়রা। শরীর নিশ্চল, ভারী হয়ে আছে। হাত পা চলছে না তার। নিজের ঝিম ধরা হাত পা নিয়ে সায়রা কোনরকম গোসল সেরে নামায আদায় করে চুল শুকাতে বারান্দায় চলে যায়। নরম তপ্ত রোদে চুল শুকাচ্ছিল সে। চোখ বুজে বসে আছে তার। সারাদিন পর নরম রোদের ছোঁয়া ভীষণ ভালো লাগছে। পাখির ডাকে চিন্তন ভাঙল তার।

–” দেখো আপু, আরসাল ভাইদের বাড়ির সামনে কত গুলা গাড়ি। রহিতা আপুরা কত বড়লোক। আর রহিতা আপুকে দেখো কি সুন্দর। কি সিল্কি চুল! রোদে ঝলঝল করছে। একদম নায়িকাদের মত লাগছে! তাই না আপু!”

পাখির কথায় বিরক্ত হলো সায়রা। রহিতা বা তাদের গাড়ি দেখার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই তার। তেতো মুখ করে বলল,

–” টাকা থাকলে সৌন্দর্যও কেনা যায়। এতে এত হায় হুতাশের কিছু নেই পাখি।”

কপাল কুঁচকে ঘরে চলে গেল সায়রা। দুপুরে আর খাওয়া হলো না তার। বিকালে বারান্দায় শুকনা কাপড় তুলতে গিয়ে দেখল- আরসালের বারান্দায় আরসাল আর রহিতা। সায়রা থেমে গেল, ধীর গতিতে কাপড় তুলছে। আড়চোখে আরসালের বারান্দার দিকে তাকাল সে। আরসালের পরনে ডার্ক ব্লু পাঞ্জাবি। ‘স্টুডেন্ট অফ দ্যা ইয়ারে’ মুভির রাঁধা গানে সিদ্ধার্থ মালহোত্রা যেই পাঞ্জাবিটা পরেছিল অনেকটা সেই রকম। চুল গুলা সুন্দর করে সেট করা। ঠোঁটে চমৎকার হাসি। অদ্ভুত সুন্দর চোখজোড়া দূর আকাশে স্থির। পাশেই রহিতা হেসে হেসে কথা বলছে। কি সুন্দর সেজেছে সে! গায়ে ভারী কারুকাজের পিংক নেটের শাড়ী। তার সিল্কি চুল গুলো দিনের শেষভাগের কোমল রোদে চিকচিক করছে। পাখি ঠিক বলেছে, রহিতা দেখতে কোন নায়িকা বা মডেল থেকে কম নয়। দুজনকে এক সাথে কি সুন্দর মানিয়েছে! দুজন এত সাজগোজ করেছে নিশ্চয় আজ তাদের আংটি বদল! আরসাল কি রাজি? রাজি না হবার তো কোন কারণ নেই। রহিতা দেখতে কত সুন্দর, ভদ্র নম্র। কত সুন্দর চুল তার। কই সায়রার তো এত সুন্দর চুল নেই। না সে রহিতার মত এত স্মার্ট! আরসাল রহিতাকে ছেড়ে তাকে পছন্দ করবে কেন?
সায়রা তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ল। মাথা উঁচু করে টলটল দৃষ্টিতে একবার আরসালের দিকে তাকাল। আরসাল আগে থেকেই তার দিকে তাকিয়ে ছিল। দুজনের চোখাচোখি হলো। সায়রার মলিন মুখ। দুজন দুজনের দিকে অপলক তাকিয়ে। এই দৃষ্টিতে লুকিয়ে আছে অজস্র না বলা কথা। আরসালের দিকে আরো কিছুক্ষণ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে, দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সায়রা। ঘরে এসে বিছানায় সটান শুয়ে পড়ল। চোখ বেয়ে আনমনে নোনাজল পড়ছে। এত যন্ত্রণা হচ্ছে কেন! মনে হচ্ছে এখনি বুঝি নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। অসহ্য যন্ত্রণা! নিজের প্রতি প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে তার। রাগে হাত কচলাচ্ছে সে। নিজের শরীরে খামচে ঘা করে ফেলছে। হাত চিঁড়ে রক্ত পড়ছে। সেই দিকে কোন খেয়াল নেই সায়রার। ভেতরের যন্ত্রণাকে চেপে রাখতে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে সে। সারা ঘর জুড়ে ফোঁপানোর আওয়াজ।
সন্ধ্যা নেমেছে। ঘরের টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনতে পিয়াসকে নিয়ে বাহিরে বেরিয়েছিলেন সিন্থিয়া। মাত্রই বাড়ি ফিরেছে। বিকালে বের হওয়ার আগে টেবিলের উপর সায়রার জন্য খাবার রেখে গিয়েছিলেন তিনি। সায়রা খায়নি। সেই খাবার টেবিলের উপর তেমনি ভাবে ঢাকা যেমন ভাবে রেখে গেছে। সকাল থেকে কেমন জানো নেতিয়ে আছে সায়রা। খাওয়া দাওয়া করছে না, কারো সাথে কথা বলছে না। ভীষণ চিন্তিত হলেন তিনি। হ্ঠাৎ মেয়েটার হলো কি? চিন্তায় রাশভারী মুখ নিয়ে সায়রার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। অন্ধকার ঘর। সন্ধ্যা বাতি জ্বালানো হয়নি। ভেতর থেকে ঘন ঘন ফোঁপানোর আওয়াজ ভেসে আসছে। সিন্থিয়ার বুক কেঁপে উঠল। কাঁদছে কেন সায়রা? হঠাৎ কি হলো তার? দ্রুত পায়ে ভিতরে গেলেন তিনি । ঘরের বাতি জ্বালাতেই। আঁতকে উঠলেন- পুরো ঘর অগোছালো, বিছানার চাদর মাটি ছুঁই ছুঁই। বিছানার মাঝ বরাবর উপুড় হয়ে শুয়ে, কাঁদছে সায়রা। সিন্থিয়া মেয়ের কাছে ছুটে গেল। বুকে জড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,

–” কি হয়েছে সায়রা? শরীর অসুস্থ লাগছে?”

সায়রা উত্তর দিলো না। মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ফোঁপানো কান্না বুক চিঁড়া চিৎকার হয়ে বেরিয়ে এলো। মায়ের বুকে মাথা রেখে অনবরত কাঁদছে সায়রা। সিন্থিয়া মেয়ের চুলে আদুরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আস্তে আস্তে কান্নার আওয়াজ কমে আসে। সায়রা চোখ মুখ শক্ত ভাবে চেপে ধরে আছে। সিন্থিয়া পূর্বের ন্যায় চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে,

–” কি হয়েছে তোর? মাথা ব্যথা? মাথায় কি খুব যন্ত্রণা হচ্ছে! ডক্টর ডাকবো!”

সায়রার ধরে আসা কন্ঠের ফিসফিস আওয়াজ ভেসে এলো,

–” প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে মা। প্রচণ্ড! এই যন্ত্রণা ডক্টর সারাতে পারবেনা। আমার শান্তি চাই। আমাকে একটু একা থাকতে দেও। প্লিজ!”

সিন্থিয়া বেগম চলে গেলেন। খানিক বাদে খাবার প্লেট হাতে নিয়ে ফিরে এলেন। সায়রা খাবেনা বলে নাকচ করল। শুনলেন না তিনি। নিজের হাতে জোর করে খায়িয়ে দিলেন। মেডিসিন দিয়ে। মাথা চিপে দিতে লাগলেন। আস্তে আস্তে সায়রার চোখের পাতায় নিদ্রা ভর করল। ধীরেধীরে ঘুম রাজ্যের অতলে ডুবে যেতে লাগল সে।

রাত দুইটা ত্রিশ। ফোনটা বেজে উঠল সায়রার। বিছানা হাতিয়ে ফোন বের করল। ঘুম ঘুম চোখে রিসিভ করে কানে ধরতেই অপর পাশ থেকে শীতল আওয়াজ ভেসে এলো,

–” তোদের ছাদে আয়! এক্ষুনি!”

চোখ থেকে ঘুম পালাল সায়রার। ধপ করে উঠে বসল। অপর পাশের মানুষটার আওয়াজে বুকটা ধুকধুক করছে। নিশ্বাস থেমে আসছে বার বার। বিকালে রহিতার সাথে আংটি বদল করে এখন তার আছে কি চাই? অভিমান হলো সায়রার। চোখ ভরে এলো তার। দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করল সায়রা। মনকে দৃঢ় করল। যেই ‘ আসতে পারবো না’ বলতে যাবে অমনি ফোনটা কেটে গেল। সায়রাও আর ফোন করল না। বিছানায় শুয়ে পড়ল আবার। দু চোখে ঘুম নেই। মন বিচলিত।
রাত তিনটা চল্লিশে ফোনটা আবারো বেজে উঠল। রিসিভ না করে, কেটে দিলো সায়রা। আরো কয়েকবার বাজার পর মেসেজ এলো,

–” ঝামেলা না চাইলে, ভালোয় ভালোয় ছাদে আয়।”

ভয়ে গলা শুকাচ্ছে সায়রার। দুটানায় পড়েছে সে। আরসালকে দিয়ে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই, দেখা যাবে সত্যি সত্যি কোন ঝামেলা শুরু করেছে। এসব ভাবনা চিন্তার মাঝেই আবারো মেসেজ এলো,

” অপেক্ষা করছি!”

চলবে……..

ভুল ত্রুটি ক্ষমাত দৃষ্টিতে দেখবেন। প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here