তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ১৬

(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

সেইরাতে সায়রা আরসালকে কোন উত্তর দেয়নি। ঘুমের ভণিতা করে আরসালের প্রণয় স্বীকারোক্তি ব্যাপারটাকে এড়িয়ে গেছে। মন মস্তিষ্ক কোনভাবেই শান্ত করতে পারেনি সে। সারা পথ গাড়ীর সিটে গা এলিয়ে চোখ বুজে থরথর কাঁপছিল। আরসাল অবশ্য বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সায়রা নিজেকে শক্ত করে রেখেছে। চোখ খুলবে না তো, খুলবেই না। তারপর বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই সায়রা চট করে চোখ খুলে একপ্রকার দৌড়ে পালায়। সেই যে আরসালের দৃষ্টির আড়াল হলো, আজ তিনদিন আরসালের সামনে আসেনি সায়রা। কয়েকবার ফোন করেছিল আরসাল। সায়রা ফোন তুলেনি।

নভেম্বরের শেষ সাপ্তাহ। শীত পড়তে শুরু করেছে। আজকাল সন্ধ্যা নামতেই চারিদিকে কুয়াশায় আঁধার নেমে আসে। ভোরে ঘাসের উপর বিন্দু বিন্দু শিশির কণা মুক্তার মত চকচক করে। সকাল থেকে মনটা বেশ ‘কু’ ডাকছে সায়রার। খুব শীঘ্রই ভয়ংকর কিছু ঘটতে চলেছে তার সাথে। ঠিক কি কারণে ঘটবে সেটাও মনে মনে খানিক আন্দাজ করতে পারছে সে।
আগামী শুক্রবার ভার্সিটির পিঠা উৎসব। ভার্সিটিকে নতুন রঙে, নতুন রূপে সাজানো হচ্ছে। রাখাল চন্দ্র ভবনের সামনে আনমনে আল্পনা আঁকছে সায়রা। বড় আম গাছটার পাতার আড়াল থেকে সকালের স্নিগ্ধ সোনালি রোদ সায়রার মুখশ্রীতে চুয়ে চুয়ে পড়ছে। রঙ দিয়ে হাত মুখ মাখামাখি তার। হিম শীতল হাওয়ায় অবাধ্য চুল গুলো বারবার মুখ ছুঁয়ে দিচ্ছে। পরনের লাল কামিজ। গায়ের সাদা ওড়নাটায়ও রঙে মেখে। একজোড়া পা দ্রুত গতিতে সায়রার দিকে এগিয়ে আসছে। পা জোড়া আল্পনার সামনে এসে ঠেকল। তা দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলো সায়রা। মাথা তুলে পিটপিট দৃষ্টি মেলতেই থমকে রইল সে। চোখে মুখে বিস্ময় আশ্চর্য ভিড় করল তার। এ সময়, আরসাল ভাই এখানে কেন? উনার তো এ সময় রহিতা আপুর সাথে থাকার কথা! তবে কি উনি সেখানে যায় নি?
কন্ঠে একরাশ বিস্ময় ঢেলে জিজ্ঞেস করল সায়রা,

–” আরসাল ভাই! আপনি এসময় এখানে?”

আরসাল কঠোর দৃষ্টিতে সায়রাকে দেখছে। চোখ মুখ রক্তিম। সায়রা শুকনো ঢোক গিলল। টিস্যু দিয়ে হাতে লেগে থাকা রঙটুকু মুছে আরসালের দিকে এগিয়ে এলো সায়রা। আরসালের দৃষ্টি আগের তুলনায় আরো তুখোড় হলো। সায়রার দিকে দু’কদম এগিয়ে আসল। গালে লেগে থাকা রঙটুকু মুছে দিতে দিতে গম্ভীর স্বরে বলল,

–” আমার এখন কোথায় থাকা উচিত সায়রা?”

সায়রা মিনমিনিয়ে জবাব দিলো,

–” রেস্টুরেন্টে। রহিতা আপু সাথে!”

আরসাল থামল। ভ্রু কুঁচকে সায়রার ভীতু মুখখানা দেখে নিলো। ভেতর থেকে তপ্ত নিশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। আগের মত গম্ভীর স্বরে আওড়াল,

–” রহিতা কেন? কথা তো ছিল তুই আসবি। সকাল থেকে আমি তোর অপেক্ষা করছিলাম সায়রা!”

সায়রা চুপ। আরসাল শক্ত করে সায়রার হাত চেপে ধরে, বিনাবাক্যে মাঠের মাঝ বরাবর দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগে। আশেপাশের সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। তা দেখে ভীষণ লজ্জিত সায়রা। চাপা স্বরে বলে উঠে,

–” কি করছেন আরসাল ভাই? সবাই দেখছে!”

সায়রার আওয়াজ বোধহয় আরসালের কর্ণকুহরে পৌঁছাল না। টেনে হিচড়ে সায়রাকে গাড়িতে উঠাল আরসাল। সায়রা ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। কিছু জিজ্ঞেস করার মত সাহস নেই তার।চড়া গতিতে গাড়ি চলছে। ভেতর ভেতর ভয়ে কাঠ সায়রা। কাঁদোকাঁদো অস্পষ্ট স্বরে বলল,

–” গাড়ির স্প্রিড কমান, আমার ভয় করছে আরসাল ভাই!”

গাড়ির স্প্রিড কমে এলো। সায়রার বুকে যেন প্রাণ ফিরল। আড়চোখে একবার আরসালকে দেখে নিলো সায়রা। এখনো রাগে ফোঁসফোঁস করছে। চোখ ভয়ংকর লাল। গাড়ি চলছে নিরুদ্দেশ। কোথায় যাচ্ছে তারা? জিজ্ঞেস করতে চাইল সায়রা কিন্তু আরসালের কঠোর মুখশ্রী দেখে থেমে গেল। আরসাল যা ভয়ংকর রেগে আছে, দেখা যাবে কিছু জিজ্ঞেস করলে হিতের বিপরীত ঘটবে। খানিক বাদে পাশ থেকে আরসালের রাশভারী আওয়াজ ভেসে এলো,

–” রহিতা না কি জানো মেয়েটার নাম? যাই হোক। মেয়েটার সাথে আমাকে কেন দেখা করতে বলছে তুই জানিস?”

সায়রা মাথা নুয়িয়ে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো,

–” হ্যাঁ জানি”

–” কি জানিস?”

— ” রহিতা আপুর সাথে আপনার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আপনার চাচা ফুপুদের সবার তাকে বেশ পছন্দ।”

–” আমার , আমার বাবা মার কাকে পছন্দ তা নিশ্চয় জানিস?”

সায়রা চুপ। আরসাল শান্ত স্বরে বলতে শুরু করল,

–” কাল সন্ধ্যায় যখন ম্যাসেজ করে রেস্টুরেন্টে দেখা করার কথা বলেছিস- খুশি হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম বিশেষ কোন কারণে হয়তো দেখা করতে বলছিস। তোর এই জঘন্য পরিকল্পনা সম্পর্কে আমার বিন্দু মাত্র ধারণা ছিলনা সায়রা। তাহলে আমি কখনো সেখানে যেতাম না! নেভার এভার।”

সায়রা আমতা আমতা করে বলল,

–” বাড়ির অন্য সবাই আপনার বিয়ে নিয়ে বড়মা বড়বাবাকে প্রেসার দিচ্ছিল। আপনিও কারো সাথে দেখা করতে রাজি হচ্ছিলেন না , তাই আমি ভাবলাম….

–” তুই ভাবলি আমাকে রেস্টুরেন্টে ডেকে সেই মেয়েটার সাথে ডেটে পাঠাবি তাই তো? স্টুপিড! ”

আরসাল দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল। সায়রা চুপ। আরসাল রাগে ফোঁসফোঁস করছে। আরসালের রাগের সাথে সাথে গাড়ির স্পিডও বাড়ছে। ভয়ে দরজার সাথে জড়সড়ভাবে বসে আছে সায়রা। নিশ্বাসের গতি বাড়ছে তার। সায়রা আরসালের দিকে অশ্রুভারাক্রান্ত দৃষ্টি মেলে তাকাল। আরসাল নীরব গম্ভীর। সায়রা জড় স্বরে বলল,

–” রহিতা আপু ভীষণ ভালোমেয়ে। আমাদের ভার্সিটির সুন্দরীদের তালিকায় প্রথম সারিতে তিনি। পড়াশোনায় তুখোড়। অন্যান্য এক্টিভিটিতেও বেশ পারদর্শী।”

–” তো?”

সায়রা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। আরসাল তার উত্তরের অপেক্ষায় নেই। সায়রা নিজে থেকেই ধীর আওয়াজ করল,

–” আপনি রহিতা আপুকে বিয়ে করে নিন আরসাল ভাই”

আরসালের প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো। এই মেয়ে কি কিছু বুঝে না? না কি সব কিছু বুঝেও না বুঝার ভণিতা করছে?
সেইরাতে স্পষ্ট ভাষায় নিজের অনুভূতির স্বীকারোক্তি করল আরসাল।আর আজ সায়রা এমন দেখাচ্ছে যে সে কিছুই জানে নাহ! আরসালের জন্য মেয়ে দেখছে,আবার তার গুনগানও গাইছে! কত বড় সাহস! বিয়েও করতে বলছে। আরসাল নিজের রাগকে যথাসাধ্য দমানোর চেষ্টা করল, বলল,

–” আমি অন্যকাউকে ভালোবাসি।”

সায়রা বিরক্ত হলো। মুখ থেকে ‘চ’ শব্দ বেরিয়ে এলো। চোখ মুখ খিঁচে অনবরত বলতে শুরু করল,

–” আরসাল ভাই ছেলে মানুষী করছেন কেন? সম্পর্ক হলো কাঁচের মত। যা একবার ভেঙে গেলে তা দ্বিতীয়বার জোড়া লাগানো সম্ভব না। জোড়া লাগালেও ভাঙার ছাপ রয়েই যায়।”

সায়রা আরো কিছু বলতে চাইল। কিন্তু তার পূর্বেই আরসালের শান্ত আওয়াজ,

–” গেট আউট”

আরসালের আওয়াজ কর্ণকুহরে পৌঁছালেও মাথায় খেলল না সায়রার। হতভম্ব স্বর করল,

–” হু”

–” আই স্যে গেট আউট”

আরসালের জোর গলার ভয়ংকর ধমকে ভয়ে কেঁপে উঠল সায়রা। হতভম্ব হয়ে গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে দাঁড়াল সে। সায়রা নামতেই ক্ষিপ্রগতিতে গাড়ি ছাড়ল আরসাল।এক পলকেই গাড়ি দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল। সায়রা কিংকত্র্তব্যবিমূঢ়, বিস্মিত ঠাই দাঁড়িয়ে রইল। এমন সময়ই আকাশ ভেঙে ঝুম বৃষ্টি নামল। মুহূর্তেই, বৃষ্টির পানিতে সায়রা ভিজে একাকার। কাক ভিজা ভিজেছে সে! আচ্ছা, অক্টোবরের বৃষ্টিকে অক্টোবর রেইন বলে, তাহলে নভেম্বরের বৃষ্টিকে কি বলে? নভেম্বর রেইন! গম্ভীর হয়ে ভাবল সায়রা!

ঝুম বৃষ্টি দেখে আরসাল গাড়ি ঘুরাল। তখন সায়রার কাঁচ লোহার সম্পর্কের কথা শুনে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল আরসালের। এখন মাথা খানিক শান্ত হয়েছে। এই বৃষ্টির মাঝে সায়রাকে রাস্তায় ছেড়ে এসে ভীষণ খারাপ লাগছে তার। বেশ অনুতপ্ত সে। যদিও সায়রাকে যেখানে নামিয়ে দিয়েছে সেখান থেকে বাড়ির দূরত্ব খুব একটা না। মাত্র পনের মিনিটের দূরত্ব। সেখানে ফিরে গিয়ে দেখল সায়রা নেই। ফোন দিলো সায়রাকে। অপর পাশ থেকে ফোন কেটে দিলো সায়রা। আরসাল তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–” অপরাধ করে আবার রাগ দেখানো হচ্ছে! স্টুপিড! ”

চলবে……

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here