তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ৭
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
শ্রাবণের অগোছালো বাতাসে জানালার সাদা পর্দাগুলো এলোমেলো উড়ছে। দূর আকাশ কালো মেঘে সেজে আছে। এই বুঝি! ঝরঝর করে শ্রাবণধারা নামছে। ঘর ভর্তি লোকজন অথচ পিনপতন নীরবতা। বিয়েবাড়ির উৎসব মুখর পরিবেশটা কেমন জানো নিস্তেজ শোকসভায় পরিণত হয়েছে। সকাল সাতটা। ঘন্টা খানেক আগেই আহনাফ সাহেব, স্ত্রী মুনতাহা বেগম, ছোট ভাই জাহিদ ও তার স্ত্রীর সঙ্গে পৌঁছেছেন। ভোরে বন্ধু মাহির আহমেদের ফোন পেয়ে ক্ষান্ত থাকতে পারেননি তিনি, ছুটে এসেছেন সায়রাকে দেখতে। মাহির আহমেদ ফোনে জানিয়েছেন জরুরী তলব আছে। তাই দেরী না করে স্ত্রীকে নিয়ে ভোরেই রওনা হয়েছে। জাহিদ সাহেবের স্ত্রী জুলেখা ভীষণ কৌতূহল প্রবল মানুষ। জরুরী তলবের খবর শুনে তিনি শান্ত থাকতে পারেননি, স্বামীকে বুঝিয়ে শুনিয়ে। খবর শুনতে বড় ভাই আর জায়ের সাথে ঠিক চলে এসেছে।
সবার চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ। আহনাফ সাহেব চেয়ারে মাথা চেপে বসে আছেন। সামান্য দূরত্বে বিছানার সামনাসামনি চেয়ারটায় আরসাল বসে। আরসাল সায়রা মুখোমুখি।
বিছানায় মায়ের সাথে জড়সড়ভাবে ঠাই বসে আছে সায়রা। মুখশ্রী ভয়ে চুপসে গেছে। গত রাতে প্রচণ্ড জ্বর ছিল তার। যার রেশ এখনো কিছুটা রয়ে গেছে। গায়ে ভারী চাদর মুড়ানো, ঠাণ্ডার প্রলেপ থেকে বাঁচতে হাত পা চাদরে গুছিয়ে রেখেছে।
মাথা উঁচু করে পুরো ঘরে একবার চোখ বুলাল সায়রা। সবার মুখ গম্ভীর। আরসালের দিকে তাকাতে দেখল, ক্রুদ্ধ সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। সায়রা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নুয়িয়ে নিলো। অশ্রুস্নাত ভীতু আঁখি জোড়ায় টলমল চাহনি। মনে অভিশঙ্কা, তবে কি সত্যি শুনে সবাই তাকে চরিত্রহীনা ভাবছে? শাস্তি দিবে তাকে? কি শাস্তি দিবে!
সে যেই শাস্তি দেখ, সায়রা সব মাথা পেতে নিবে। তবুও কেউ যেন তাকে ঘৃণা না করে। আর যাই হোক ঘৃণা নিয়ে বাঁচা যায় না। মনের অধীরতা তীব্র শঙ্কা নিয়ে সায়রা মুখ খুলল। ভীতু স্বরে নত গলায় বলল,
–“আমি জানি আমি যা করেছি, তা ক্ষমার অযোগ্য! তবুও আমি সবার কাছে ক্ষমা চাইবো। বার বার হাজারবার ক্ষমা চাইবো। আপনাদের যেই কোন শাস্তি আমি মাথা পেতে নিবো। তবুও কেউ আরসাল ভাইয়ের উপর এই সম্পর্কটা চাপিয়ে দিবেন না। আমার ভুলের শাস্তি আমাকে দিন, আরসাল ভাইকে না।”
জুলেখা বেগম রাগে ফোঁস করে উঠলেন। রাগে কটকট চাহনি সায়রার দিকে নিক্ষেপ করলেন। দাঁতে দাঁত চেপে ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন,
–“ভাইজান, আমি আগেই বলেছিলাম এই মেয়ে সুবিধার না। নিশ্চিত আমাদের ছেলেকে ফাঁসিয়েছে। দেখলেন! দেখলেন তো আমার কথা ঠিক মিলে গেল। এই মেয়েকে দেখতে যতটা সহজ সরল মনে হয়, ততটা সরল এই মেয়ে নয়। ভীষণ চতুর। দেখলেন, তো কি করে আমাদের ছেলেকে ফাঁসাল? যেই দেখেছে বড়লোক বাপের একমাত্র ছেলে। অঢেল টাকাপয়সার মালিক। সুদর্শন। ওমনি লোভে পড়ে গেল। তুখোড় বুদ্ধি খাটিয়ে জঘন্য আরোপ লাগিয়ে ফাঁসিয়ে নিলো আমাদের ছেলেকে। এই মেয়ের জন্য শুধু শুধু আমাদের ছেলের সম্মান নষ্ট হলো। সবার সামনে ছোট হলো। বিনা অপরাধে সাজা পেল। কত বড় বদমাইশ চারিত্রহীন মেয়ে! দেখেছ ভাবী?”
আহনাফ সাহেব ক্ষিপ্ত স্বরে বিরক্তি সহিত ধমক দিলেন,
–“আহ জুলেখা! চুপ করবে তুমি!”
–“অপরাধ নিবেন না বড় ভাইজান, এই মেয়ের চেহারায় যাবেন না, ভীষণ চালাক মেয়ে! না হয় এমন ভাবে কাউকে ফাঁসায়? চরিত্রহীনা মেয়ে কোথাকার!”
লজ্জা অপমানে সায়রার চোখ থেকে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। মুখ বুজে, নত মাথায় জুলেখা বেগমের সব আরোপ শুনছে। বুক চিঁড়ে হাহাকার চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঘন ঘন নিশ্বাস ভারী হচ্ছে সায়রার। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এমনটা তো হওয়ারই ছিল। যে ছেলেমানুষী সে করেছে তার ফলস্বরূপ কোনো একজনকে তো চরিত্রহীনার ট্যাগ লাগারই ছিল। বিনাদোষে আরসাল কেন সেই ট্যাগ নিবে? দোষ যেহেতু সায়রার, সেই সব অপমান সায়রাই সহ্য করবে!
জুলেখার কথায় আরসাল রাগে ফোঁসফোঁস করছে। সিন্থিয়া বেগম জুলেখার প্রতিবাদে কিছু বলতে গেলে, সায়রা হাত চেপে থামিয়ে দেয়। নিচু গলায় থেমে আসা স্বরে,
— “মা তুমিই বলেছিলে কর্মের ফল সবাইকে পেতে হয়, এখন আমার সাথে যা হচ্ছে তা আমার কর্মের ফল। অপরাধ যেহেতু আমার! উনাদের আমার উপর রাগ জেদ প্রকাশ করার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। ”
সিন্থিয়া বেগম আহত দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ সাহেব ক্ষুণ্ণ নয়নে সায়রার মুখপানে চেয়ে ভাঙা স্বরে বললেন,
–“তুই তো আমার মেয়ের মত সায়রা! তোর থেকে এমন কিছু আশা করিনি ।বড় বাবার সাথে এতো বড় মিথ্যা বলতে পারলি? ”
সায়রা ঠিক এই ভয়টাই পেয়েছিল। এতবছর ভিতরে ভিতরে আহনাফ সাহেব মুনতাহা বেগমের নজরে ছোট হওয়ার ভয়ে প্রতিক্ষণ ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। মনে অজানা শঙ্কিত ভয়টাকে সত্যি হতে দেখে, অস্থির হয়ে পড়ে সায়রা। চোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রুধারা। ডুকরে কেঁদে উঠে। আঁখিদ্বয় অনুতাপের অশ্রুতে জর্জরিত। আহনাফ সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে জোর গলায় আওড়াল,
–“বেশ! সম্পর্কটা যেহেতু একটা ভুলে বোঝাবোঝির বসে হয়েছে। এই সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার কোন মানে হয়না। ভুল বোঝাবোঝি নিয়ে আর যাই হোক, সংসার হয় না। এতে আরসাল সায়রা দুজনই চিরকাল কষ্ট ভোগ করবে! আমার কথায় আরসাল সায়রার এংগেজমেন্ট হয়েছে। অনইচ্ছাকৃত সম্পর্কটা দুজনের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
খানিক থেমে বড় এক নিশ্বাস ফেলে আবার বললেন,
— “তো! এই সম্পর্কটাকে ভেঙে ফেলাই উত্তম।”
বাবার সিদ্ধান্তে আরসাল মাথা তুলে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে একবার বাবার দিকে আরেকবার সায়রার দিকে তাকাল। সায়রার মুখপানে তাকিয়ে মন বোজার চেষ্টা করল। সায়রা নিশ্চুপ। সম্পর্ক ভাঙা নিয়ে চেহারায় ছিটাফোঁটা কষ্ট নেই তার। যেন এমন ঘোষণার অপেক্ষাতে সে এতকাল বসে ছিল। এতে আরসালের কেন জানো রাগ হলো। প্রচণ্ড রাগ!
আহনাফ সাহেবের ঘোষণায় সায়রার গলায় আটকে থাকা নিশ্বাস ফোঁস করে বেরিয়ে এলো। এবার হয়তো আরসালের জীবন নষ্ট করার অনুতাপ থেকে মুক্তি পাবে সে। সামান্য হলেও অনুতাপের আগুন শান্ত হবে তার।
আহনাফ সাহেব আবারো মুখ খুললেন,
–“আজকের পর এই নিয়ে কেউ সায়রাকে কোনপ্রকার দোষারোপ করবে না। তখন বয়স কম, অবুঝ ছিল! ছেলেমানুষির বসে ভুল করেছে। এ নিয়ে কেউ তাকে কথা শুনাবে না। বিশেষ করে জুলেখা তুমি! এব্যাপারে কোন প্রকার আলোচনা যেন এই ঘরের বাহিরে না যায়। এখানে সব মাটিচাপা দেওয়া হোক!”
আহনাফ সাহেবের কথায় ঘর ভর্তি বাকি সবাই সাই দিলো। মাহির আহমেদ বন্ধুর এই মহত্ত্ব দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি ভাবেননি বিষয়টা আহনাফ সাহেব পজেটিভলি নিবেন। যদি জানতেন তবে অনেক আগেই সত্য জানাতেন। এভাবে লুকিয়ে বাপ-ছেলের সম্পর্ক নষ্ট হতে দিতো না! মনে মনে ভীষণ আহত অনুতপ্ত হলেন তিনি।
সায়রা টেনেটুনে বাম হাতের অনামিকা আঙ্গুল থেকে এংগেজমেন্ট রিংটা খুলে ফেলল। মায়ের বকুনির ভয়ে, এই চারবছরে একবারের জন্যেও আংটি্টা খুলেনি সায়রা। তাই ভীষণ শক্ত ভাবে আংটিটা আঙুলের সাথে এঁটে গেছে। খোলার সময় আঙুলে নখের গাঢ় আঁচড় পড়ে, লাল হয়ে যায়। আরসালের চোয়াল শক্ত! ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে শুধু সায়রাকে দেখছে।
সায়রা নতজানু হয়ে আংটিটা আরসালের সামনের টেবিলে রাখল! তখনো আরসালের ক্রুদ্ধ চাহনি সায়রার দিকে। চারবছর আগের মত আজও আরসাল চুপ। এখানে সার্কাজম চলছে! তার জীবন নিয়ে নাটক হচ্ছে, নাটক!
পিঠে মায়ের হাতের স্পর্শ পেতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায় আরসাল। টেবিলের উপর থেকে এংগেজমেন্ট রিংটা তুলে একবার সায়রার দিকে ভস্ম করা দৃষ্টিতে তাকায়, তারপর মুঠো শক্ত করে হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়! যাওয়ার আগে, সামনের টেবিলে পা দিয়ে সজোরে এক আঘাত করে গেল। টেবিল ছিটকে দূরে সরে যায়। আরসালের এহেন কাণ্ডে সবাই হতভম্ব! সবচেয়ে বেশি অবাক সায়রা নিজে। আরসালের এমন প্রতিক্রিয়ার কারণ তার বোধগম্য হলো না!
চলবে……..