তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ৫

 

আজ রিদ্ধির হলুদ। ভোর থেকে বাড়িতে তোড়জোড় শুরু ।রিদ্ধি সায়রার নানা বাড়ির লোকজন আরো তিনদিন আগে চলে এসেছে। দুই ভাইয়ের একমাত্র বোন রিদ্ধি। রিদ্ধির নিজের কোন বোন নেই।সেই কমতিটাও সায়রাই পূরণ করছে। সবকিছু একা হাতে সামলাতে হচ্ছে সায়রার।ডালা থেকে কুলা ,ছেলেদের বাড়িতে পাঠানো তত্ত্ব সাজসজ্জা থেকে শুরু করে স্টেজে কনের সামনে রাখা খাবার গুলো তাকে সাজাতে হচ্ছে।তার উপর বোনেদের আবদার তো আছেই! কোন শাড়ির সাথে কোন কানের দুল পরবে? চুল কি খোলা রাখবে নাকি খোপা বাঁধবে? লাল সাদা শাড়ির সাথে কোন ফুল মানাবে! হাজারো আবদার।কাজের ফাঁকেফাঁকে সায়রা এদিকটাও দেখছে।রিদ্ধিদের বাড়ি শহুরে পরিবেশ থেকে খানিক দূরে।এখানকার পরিবেশ অনেকটা উপশহরের ন্যায়! যাকে বলে গ্রাম শহরের মাঝামাঝি! বাড়ীর সামনে বিরাট পুকুরপাড় ,পুকুরপাড়ের পাশে খোলা বিস্তৃত বিশাল মাঠ।সেখানে রিদ্ধির বিয়ের অনুষ্ঠানের যত আয়োজন । বিশাল আয়োজন! বিশাল আয়োজন হবে নাই বা কেন? চেয়ারম্যানের একমাত্র কন্যার বিয়ে বলে কথা! সাড়া গ্রাম জুড়ে হৈ হৈ রৈরৈ আমেজ ।
এসব তত্ত্ব সাজসজ্জা দেখে বাড়ির সবাই সায়রার প্রশংসায় পঞ্চমুখ! ছোট মামীর সায়রাকে বড্ড মনে ধরেছে।এক সময় তো আফসোসের স্বরে বলেই ফেলল,”ইশ মোস্তাফিজ যদি সায়রার ছোট না হয়ে বড় হতো ,সায়রাকে মোস্তাফিজের বউ করে আনতাম! আফসোস! ”
মামি এহেন আফসোসে সারা ঘর জুড়ে হাসির রোল পড়ল।সবাই সায়রার এতো এতো প্রশংসা করছে, অথচ তার নিজের মা, সিন্থিয়া বেগম ফোনে প্রশংসা বাক্যে শুধু এতোটুকু বললেন,”যতটা অকর্মা তোকে ভেবেছি ততটা অকর্মাও তুই না ”
তা শুনে অভিমানে ঠোঁট ফুলালো সায়রা ,মা তার প্রশংসা করলো নাকি খোঁচা মারল?

.
হলুদ ছোঁয়া পর্ব শেষ হয়েছে সেই অনেকক্ষণ।এখন নাচ গান চলবে।ডি.জে এসেছে সারারাত গান বাজবে।ঐদিকে সায়ন সহ তার কিছু বন্ধুরা আসছে।সায়নের বন্ধুদের জন্য রিদ্ধির বড় ভাই রেদোয়ান, আলাদা স্পেশাল খাবারদাবারের আয়োজন করেছে। অধীর আগ্রহ নিয়ে সায়নের অপেক্ষা করছে রিদ্ধি।হাতে সায়নের নামে মেহেদি লাগিয়েছে ,তার পছন্দমত হলুদ কনে সেজেছে।তাকে দেখাতে হবে না? রিদ্ধিকে দেখে কি বলবে সায়ন? তা ভেবে লজ্জায় লাল নীল হচ্ছে রিদ্ধি। সায়রাও কম নয় ,সুযোগের ঠিক ব্যবহার করছে।এটা ওটা বলে আরো লজ্জায় ফেলছে রিদ্ধিকে !
খানিক বাদে পাখির দলবল “বর এসেছে ,বর এসেছে ” হৈ চৈ করে ঘরে ঢুকল।সায়রা আরমিন যেন এই অপেক্ষাতে- ই ছিল ,তারাও তাদের দলবল নিয়ে হুড়হুড় করে নিচে নামল!

.
আরসাল বিরক্তি ভারী মুখ করে দাঁড়িয়ে।সায়নের মুখে ইয়া বড় , বিশ্বজয়ের হাসি।সায়নের এই হাসি দেখে আরসালের আরো বেশি মেজাজ খারাপ হচ্ছে! রাত পোহালে কাল সকালে এদের বিয়ে,আদিখ্যেতা দেখিয়ে এই নিশিরাতে এখানে আসতে হবে কেন? বউ বিয়ে করে তার বাড়িই যাবে , অন্য কোথাও তো নয়! এক রাতের জন্য কি সহ্য হচ্ছেনা ? এই নিশিরাতে এখানে আসতে হবে কেন? যত সব আদিখ্যেতা! আসার পক্ষে একদম মত ছিল না আরসালের,সায়নের পীড়াপীড়িতে আসতে হয়েছে।সায়ন আরসালের কাঁধে হাত রেখে আহ্লাদী স্বরে বলে উঠে,

–“রাগ করছিস কেনো দোস্ত! দু,এক ঘন্টার ব্যাপার- ই তো! ”

আরসাল উত্তর দিলো না।ক্ষিপ্ত নয়নে সায়নের দিকে তাকাল।এমন সময় হৈচৈ আওয়াজ কানে বাজল। চোখ ফিরিয়ে সামনে তাকাতে। একদল মেয়ে দেখতে পেলো ,অকস্মাৎ,আরসালের দৃষ্টি আটকাল কারো উপর।কপালে ভেসে থাকা বিরক্তির ছাপ গুলো মুহূর্তে- মিলিয়ে গেল।গা জুড়ে এক স্নিগ্ধ হাওয়া বয়ে গেল।বুকটা ঠকঠক কাঁপছে।সামনে শুভ্রতায় মোড়ানো শুভ্রপরী দাঁড়িয়ে! তার সারা অঙ্গ যেন বসন্তে নয়া ফুলের মত দুলছে।লতানো খোলা চুল গুলা হাওয়ায় হেলে দুলে উড়ছে ।রক্ত রাঙা লাল ঠোঁট জোড়ায় প্রমত্ত হাসি।পড়নে লাল সাদা লেহেঙ্গা! যেন কোন ঘন বর্ষনে স্নিগ্ধ গোলাপ! সাদা স্কার্ট টা দু হাতে উঁচু করে তার দিকেই যেন পা বাড়িয়েছে ।কয়েক সেকেন্ডের জন্য আরসাল থেমে গেল।পুরোপুরি নিস্তেজ নিমিষ দাঁড়িয়ে রইল।আশেপাশের চারিদিক যেন থমকে গেছে।শুধু সামনে থাকা স্নিগ্ধ গোলাপটা তার দিকে বেড়ে আসছে।তিরতির করে আরসালের বুক কাঁপছে ,বুকের কোথাও তীব্র এক যন্ত্রণা! অপ্রকাশিত অজানা!

দলবল নিয়ে সায়নের দিকে আসছে সায়রা। আরসালকে নিজের দিকে গভীর নয়নে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে,ভয় পেয়ে যায় ।মনে পড়ে যায় আরসালের বলা সেই দিনের কথা “তোর সাথে কথা বলা তো দূর ,তোর চেহারাও দেখতে চাইনা! ”
সায়রা তাড়াতাড়ি ওড়নার কোণ টেনে দ্রুত হাতে মুখ ঢেকে ফেলল।বিষয়টা আরসালের চোখে বাঁধল ,বিরক্তি সহিত আবারো কপাল কুঁচকে নিলো ।যেন ব্যাপারটা তার বিন্দুমাত্র পছন্দ হয় নি।

সায়নের পথ আটকে ধরেছে সায়রা আরমিন।সাথে দলবল তো আছে- ই।তাদের আবদার একটাই,

–“আগে আমাদের লেনদেন মিটাও , তারপর বউয়ের সাথে দেখা করতে দিবো ”

সায়রার এহেন কথায় সায়ন ঠোঁট উল্টে বলে,

–“আজ কিসের লেনদেন! বিয়ে তো কাল ,কাল সব লেনদেন মিটিয়ে দেব । একবার বউটার সাথে দেখা করতে দে! ”

সায়রা নাকচ করল।সায়ন ইমোশনাল ব্লাকমেইল শুরু করল ,

–“তুই না আমার বোন সায়রা? ভাইয়ের সাথেও এমনটা করতে পারবি ? ”

সায়রার সোজাসাপ্টা জবাব ,

–“পারবো কি? অলরেডি করছি! এই দুই দিন তুমি আমার ভাই না ,দুলাভাই! আর আমি তোমার আদরের শালিকা ।আমাদের একটা শালিকাগত অধিকার আছে না?
আগে আমাদের পাওনা মিটাও, তবেই বউয়ের সাথে দেখা করতে দিবো! ”

সায়নের কোন কথায় সায়রারা শুনল না।নিজেদের পাওনা নিয়েই রাস্তা ছাড়ল।চকচকে হাজার টাকার বান্ডিল ধরিয়ে দিয়েছে সায়ন ।তা দেখে কনে বাড়ির সবার হৈ চৈ শুরু! ভেতরে ঢুকার সময় তুর্জয় থামল।তা দেখে আরায়ালও ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল।তুর্জয় সায়রার মুখোমুখি হয়ে হাস্যউজ্জ্বল মুখ তুলে বলল,

–“তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে সায়রা,স্বপ্নে দেখা শুভ্রপরীদের মত! ”

সায়রার ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এলো ,তুর্জয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে ফিরল। দেখল, তুর্জয়ের দৃষ্টি সায়রার দিকে না! তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা লাজুকলতা আরমিনের দিকে। আরমিনও লজ্জায় লাল হচ্ছে।চোখে মুখে লজ্জার রক্তিম আভা ছেয়ে।সায়রা ফিক করে হেসে দিলো ,তুর্জয়ের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,

–“কাহি পে নিগাহে কাহি পে নিশানা? বাহ তুর্জয় ভাই বাহ! ”

তুর্জয় মাথা নুয়ে হেসে ফেলল ,সেই সাথে সায়রাও! তাদের এতো বেশি কাছাকাছি ,হাসাহাসি! কেউ একজনের চোখে বাঁধল ।খুব করে বাঁধল। ভীষণ রাগ হচ্ছে তার।অগ্নিচোখে দুজনকে অপলক দেখে যাচ্ছে।চোখ দিয়ে যদি কাউকে ভস্ম করা যেত? তবে এতোক্ষণে নিশ্চিত এই দুজন ভস্ম হয়ে ,হাওয়ায় মিলিয়ে যেত।

.
সশব্দে ডি.জের গান বাজছে। ছোট বড় সবাই ড্যান্স ফ্লোরে যে যার যার মত নাচছে।সায়রা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল ,রিদ্ধির পীড়াপীড়িতে তাকেও যেতে হলো।একপ্রকার জোর করে রিদ্ধি সায়রা কে ড্যান্স ফ্লোরে নিয়ে গেল ।তুর্জয়,সায়ন রিদ্ধি সায়রা পাখি পিয়াস একত্রে- ই নাচছিল।মাঝেমাঝে তুর্জয় সায়রা হাসাহাসিও করছে।দূর থেকে আরসাল সবটা দেখছে।কোনকিছু তার দৃষ্টির অগোচর হচ্ছে না। হৈ হুল্লর আরসালের পছন্দ না।তার উপর রিদ্ধির ইঁচড়েপাকা চাচাতো বোনদের গিলে খাওয়া নজর তো আছেই ।পশ্চিমা দেশের আধুনিকা আজকালকের বাচ্চাদের একটু বেশি আধুনিক বানিয়ে দিয়েছে ।বাচ্চা মেয়েদের এডাল্ট চাহনির ধাঁচে গা ঘিনঘিন করে উঠে ।

আরসাল ড্যান্স ফ্লোর থেকে খানিক দূরে বসেছিল।এখান থেকে ড্যান্স ফ্লোর স্পষ্ট! সায়রাকে দেখা যাচ্ছে। যা আরসালের মেজাজ খারাপ করছে।একের পর এক সিগারেট খাচ্ছে।অন্ধকারে বিষাক্ত ধোঁয়া গুলো হাওয়ায় মিলছে শুধু। বারবার প্রশ্ন জাগছে ,তুর্জয়র সাথে সায়রার কি এমন গভীর সম্পর্ক! কেন এতো হাসাহাসি? তুর্জয়ের সাথে সায়রা কেন হাসবে? কেন ঘুরবে? হোক সায়রা তার অপছন্দ, না মানা হবু বউ! সায়রা অন্য কোন ছেলের সাথে হাসবে কেন? ঘুরবে কেন? অন্য কারো সাথে হাসতে পারবে না।ঘুরতে পারবে না সায়রা।আর তুর্জয়ের সাথে তো একদমই না! তার প্রিয় ,অপ্রিয় ,মানা ,না মানা যা আছে! তা শুধু তারই থাকবে।কেউকে সেই জিনিসের দিকে চোখ তুলে তাকাতে দেবে না।কাউকে না!

এমন সময় সামনে থেকে দুই মহিলার কথোপকথন কানে এলো আরসালের।প্রথম মহিলা সায়রাকে দেখিয়ে বলছে,

–“ঐ সাদা লেহেঙ্গা পরা মাইয়াডা ,সিন্থিয়ার বড় মাইয়া সায়রা না! ”

–“হ ,বড় হইয়া গেছে , দেখতে হুনতেও কি সুন্দর হইছে।একদম পরী গো লাহান ।”

–“হ ঠিক! সায়নের লগের পোলাডা কেডা? সায়রার বয়ফেরেন্ড নিহি! ”

–“মনে হয়, আজকাল যা জমানা! কিন্তু যাই ক পোলাডা কিন্তু সুন্দর ।দুইজনরে হেভি মানাইছে! ”

এই কথোপকথন আরসালের মনের জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালার জন্য যথেষ্ট ছিল।চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় আরসাল।ভীষণ ক্ষিপ্ত সে।চোয়াল শক্ত ।রাগে দাঁত কটকট করছে।বড় বড় পা ফেলে ড্যান্স ফ্লোরে সায়রার দিকে এগিয়ে যায়।ড্যান্স ফ্লোর তখন কৃত্রিম আবছা আলোয় অন্ধকার ।খপ করে কেউ সায়রার হাত চেপে ধরে, সায়রা কেঁপে উঠে।ঘাড় ফিরে পেছন তাকাতে কারো শক্ত বুকে ধাক্কা খায়।মাথা উঁচু করতেই ভয়ে কেঁপে উঠে।আঁতকে দূরে সরে যেতে নিলে শেষ রক্ষা হলো না।সামনে থাকা ব্যক্তি আরো শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে ।টেনে হিঁচড়ে ভিড় থেকে বের করে শুনশান আউট হাউসের দিকে নিয়ে যেতে লাগে।সায়রার হাজার আকুতি মিনতিতে আরসালের হৃদয় বিন্দুমাত্র গললো না!

চলবে….

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন ।প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here