#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_২০

এক রাশ রাগ ক্ষোভ নিয়ে মারুফার অভিমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেহেরিশ।মনে মাঝে সুপ্ত রাগটা ক্রমশ দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে।নিজের রাগ নিবারণ করতে এক হাতের সাথে অন্যহাত সমান তালে কচলে যাচ্ছে।মারুফা তার দিকে তাকিয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে।মারুফা কি তাকে নিয়ে লুডু খেলা শুরু করেছে নাকি,নাকি তার আবেগ অনুভূতি নিয়ে।নিজের কাছে আজ নিজেই প্রশ্নবাণ সেহেরিশ।
আফীফের সাথে সেদিনের কথা গুলো সব মারুফাকে জানিয়ে দেয় সেহেরিশ।আফীফ যে তাকে চিনতে পেরেও নাটক করছে এবং স্ত্রী হিসেবে তাকে চাইছে সবটা জানতে পেরে মারুফার মুখের রঙ পালটে যায়।তারপর থেকেই শুরু হয় আফীফের সম্পর্কের গুনগান।

– এমন হাত কচলাচ্ছিস কেন?
– না কিছু না ফুফি।তোমার কথাটা আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
– আমি খারাপ কিছু বলি নি সেহেরিশ,আফীফ পাত্র হিসেবে সু-পাত্র।তোর সাথেও বেশ মানানসই।
– তুমি তো বলেছিলে আফীফ থেকে আমি যেন একশ হাত দূরে থাকি। আমিও তাকে দূরে দূরেই রাখছি তবে এখন এসব কথা কেন?
– হ্যা আমি তখন ঠিক বলেছিলাম।দেখ যে ছেলেটা তোকে না পেয়েও এত বছর মনের মাঝে লালান করেছে তার মত যোগ্য জীবনসঙ্গী তুই আর পাবি কি না আমার সন্দেহ।

সেহেরিশ ‘ফস’ করে শ্বাস ছাড়লো।সব কিছু গোলমাল লাগছে তার।এতদিন আফীফকে নিয়ে মনের মাঝে তিলার্ধেল অনুভূতি হলেও মারুফার কথায় তা সঙ্গে সঙ্গে গায়েব হয়ে গেছে।বর্তমানে আফীফকে দেখলেও তার সারা অঙ্গে আগুন লেগে যায়।সেদিন রাতে আফীফকে মনের রাগ মেটাতে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে সেহেরিশ।তারপর থেকে আফীফ চুপচাপ হয়ে গেছে সেহেরিশকে দেখলেও না দেখার ভান করে দূরে দূরে থাকে।রাগের মাথায় বলা কথা গুলো বর্তমানে সেহেরিশকে পীড়াদায়ক যন্ত্রণায় ভোগাচ্ছে।

সেহেরিশকে চুপ থাকতে দেখে চোখ ছোট করে তাকায় মারুফা।নিঃশব্দে শ্বাস ছেড়ে সেহেরিশের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
– যদি তুই আফীফকে পেতে দাবি করিস তবে তুই পরিবার এবং আফীফ দুটোকেই পাবি।তবে তোর মা-বাবা আমি তখন অনেক দূরে থাকবো চাইলেও দেখার তৃষ্ণা মেটাতে পারবি না।তোর পাপা মামনিকে চাইলেও জড়িয়ে ধরতে পারবিনা।আর আফীফকে ছাড়লে স্বাধীন জীবন পাবি।সেখানে তোর বিয়ে দেবো চাইলে সহজেই আমাদের কাছে আসতে পারবি। যাই হোক আমার মনে হয়না আফীফ তোকে অর্জন করা ছাড়া এই বাড়ি থেকে মুক্তি দেবে।বাকিটা তোর ইচ্ছা।

মারুফা চলে যায় কিন্তু সেহেরিশের মাথায় দিয়ে যায় চিন্তার বোঝা।

সকাল ভোর ভোর তুন্দ্র এবং কেইন ক্রিসমাসের উদ্দেশ্য ঢাকায় রওনা হয়।সেহেরিশ যেতে চাইলো খুরশীদ আনওয়ার অপরিচিত শহরে মেয়েকে একা ছাড়েন নি।তাই মারুফা যাওয়ার পর সেহেরিশ রুমেই চুপচাপ বসে ছিল।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলো আফীফের কাছে ক্ষমা চাইবে যত যাই হোক বাজে ভাবে রিয়েক্ট করা তার মোটেও উচিত হয় নি।বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে সেহেরিশ ছাদের উদ্দেশ্য পা বাড়ায়।

ছাদে কফি মগ হাতে জিউসের সঙ্গে কথা বলছে আফীফ।সেদিনের পর আফীফের মন ভালো নেই।সেহেরিশের অবহেলা তাকে বার বার মুষড়ে দিচ্ছে।

– তুমি তাকিয়াকে সব বলে দিয়েছো অথচ আমায় জানালে না।
– সরি জিউ আসলে সেদিন এমন একটা অবস্থায় ছিলাম হুট করেই সত্যটা প্রকাশ পায়।তবে যা বুঝেছি তাকিয়ার মনে অতীতের কান্ডে আমার প্রতি বিদ্বেষ ছাড়া কিছুই নেই।আমার প্রতি তার সম্মানটুকু নেই।আর ভালোবাসা তা তো দূরের কথা।যানো সেদিন আমার সাথে কতটা বাজে বিহেভ করেছে।এই আফীফ দেওয়ানের সাথে কেউ গলা উচু করে কথা বলে না তার তাকিয়া…
– আহ চিল ব্রো।তাকিয়া সহজে কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেনা হয়তো রাগ সামলাতে না পেরে এমনটা করেছে।তুমি দেখবে তাকিয়া ক্ষমা চাইবে।
– দে…

আফীফ থামলো সেহেরিশকে তার সামনে দেখে দ্রুত ফোন কেটে পকেটে পুরে নিলো।কফির মগটা হাতে নিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো অন্যদিকে।সেরিশকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– কিছু বলবেন আপনি?
– আমি দুঃখিত।আপনার সাথে সেদিন বড্ড বাজে ব্যবহার করে ফেলেছিলাম।
– ইট’স ওকে।

আফীফ সেহেরিশ দুজনেই চুপচাপ কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলো।আফীফ সেহেরিশকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কফি মগে চুমুক দিয়ে মোবাইলের স্কিনের দিকে তাকিয়ে আছে।
– আপনি কী আমায় ক্ষমা করতে পারেন নি মি.আফীফ?
– আমি আপনার কথায় বিন্দু পরিমানেও কষ্ট পাই নি ক্ষমা কেন করবো?
– তবে আমায় ‘আপনি’ বলে সম্মোধন করছেন কেন?

আফীফ ঘুরে তাকায়।সেহেরিশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার মুখে ফু দেয়।তৎক্ষনাৎ সেহেরিশের মাঝে অনামিক অনুভূতির ঢেউ খেলে যায়।আফীফের শুভ্র উজ্জ্বল মুখের ঘোরে সেহেরিশকে যেন বার বার কাছে টানছে।

– আমি ‘তুমি’ বলে সম্মোধন করলে যদি আপনি খুশি হন তবে তুমি বলেই ডাকবো।
সেহেরিশের ঘোর ভাঙ্গে। মাথা নাড়িয়ে আফীফকে ‘তুমি’ বলার অনুমতি দেয়।আফীফ কফির মগে আরেকটি চুমুক দিয়ে মগটি সেহেরিশের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
– নিন চুমুক দিন।
– আ..আমি?
– তো এখানে কেউ আছে নাকি আর?
– আপনার মুখের কফি।
– তো? আমি কি থুথু ছিটিয়ে দিলাম নাকি?
সেহেরিশ প্রত্যুত্তর করলো না কফির মগটা হাতে নিয়ে চুমুক বসায়।আফীফ তার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসে।ছাদের রেলিংয়ের পাশে রাখা টবে গাঁদা ফুলের গাছে থেকে একটি ফুল ছিড়ে সেহেরিশের কানে গুজে দেয়।সেহেরিশ চমকে তাকালে আফীফ তপ্ত শ্বাস ছাড়ে।

– তোমার নাম ফুলপরী রেখে আমি ভুল করিনি।ইচ্ছে করছে হাজার রকমের ফুলের মাঝে তোমাকে বসিয়ে রাখি।তোমার চুল গুলো এত ছোট কেন?চুল বড় করলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যায়?
– এটা ফ্যাশন আপনি বুঝবেন না।
সেহেরিশের কথায় রুষ্ট হয় আফীফ।চোখ ছোট করে প্যান্টের পকেটে হাত রেখে সেহেরিশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে বলে,
– যে ফ্যাশনে তোমার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের খামতি রাখে তবে সে ফ্যাশন তোমার দরকার নেই।

সেহেরিশ অবাক হয়।কফির মগে আরেকটি চুমুক দিয়ে আড় চোখে তাকায় আফীফের দিকে।
– আজ থেকে ফুফু আম্মার কাছে নিয়মিত তেল লাগাবে।তোমার থেকেও আমাদের মৌ’য়ের চুল অনেক বড় আর তোমাকে দেখলে আমার রাগ লাগে।
সেহেরিশ মাথা ঘুরিয়ে নেয়।বিড়বিড় করে আফীফকে হাজারটা গালি দিয়ে নিজেকে স্থির করে।
– আমাকে ভালোবাসলে কি তোমার জাত চলে যাবে সেহেরিশ?

হঠাৎ আফীফের অনাড়ম্বর কথায় চমকে যায় সেহেরিশ।এই কথার প্রত্যুত্তর কি দিতে হবে তা সেহেরিশ জানে না।তাই কোন প্রত্যুত্তর না করে দ্রুত নিচে নেমে যায়। আফীফ তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শুরু দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।

_____

আড়ালে যত্ন ভালোবাসায় কেটে গেলো আরো কয়েকটি দিন।আফীফ আর সেহেরিশের সম্পর্ক এখন মোটামুটি আগের মতো স্থির।আফীফের খুনশুটি,হুট-হাট রেগে যাওয়া সেহেরিশের অভ্যাসে পরিনত হয়েছে।তুন্দ্র এবং কেইন তার উৎসব শেষে আবারো গ্রামে ফিরে এসেছে।তবে খুরশীদ আনওয়ারের সাথে আবারো বদানুবাদে লেগে গেছে সেহেরিশ,তুন্দ্র এবং কেইন।থার্টি-ফাস্ট নাইট উপলক্ষ্য গ্রামে কোন অনুষ্ঠান না হওয়ায় শহরে যাওয়ার জন্য আবদার করে তারা।কিন্তু খুরশীদ এবং ফাহমিদা কিছুতেই রাজি হয় নি।কেইন এবং তুন্দ্রের রিকুয়েষ্টে আফীফ অবশেষে রাজি হয় বাড়িতে থার্টি-ফাস্ট নাইট উৎযাপন করতে।

দেওয়ান মঞ্জিলে আজ আলোক সজ্জায় সজ্জিত।ছাদের উপর নিয়ন বাতি দিয়ে সম্পূর্ণ ছাদ সাজানো।কেইন টুংটাং গিটারের শব্দ তুলছে।সেহেরিশ লং গাউন পরে তৈরি হয়ে এসে কেইনের পাশে বসে যায়।তুন্দ্র,আফীফ,মুনিফ বারবিকিউ করবে বলে সব কিছু রেডি করছে।মৌ,সামী, আমান তারা বাজি ফাটাতে ব্যস্ত।

বারবিকিউ রেডি করে তুন্দ্র, মুনিফ,আফীফ সবাই সবার জায়গায় বসে যায়।আফীফ নিজের স্থান ছেড়ে সুযোগ বুঝে চেয়ার টেনে সেহেরিশের মুখোমুখি বসে।
হিমেল হাওয়া চারিদিক,আলোতে জ্বলমলে পরিবেশ, গিটারের টুংটাং শব্দে মূখরিত পরিবেশ।সেহেরিশ গায়ের চাদরটা কিঞ্চিৎ টেনে আড় চোখে আফীফের দিকে তাকায়।গায়ের আসমানী রঙের শাট,হাতা ফোল্ড করে তুন্দ্রের সাথে হাত নাড়িয়ে কথা বলছে আফীফ তার সাথে ঠোঁটে লেগে আছে মুচকি হাসি।সেহেরিশ এক পলক দেখেই যেন তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়।দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

– সত্যিত! এই ছেলের হাসি দেখা মানা।একবার দেখেই আমার দৃষ্টি বিভ্রান্ত হয়েছে।আমার নিষ্পাপ মনটাকে অন্যদিকে টানছে।দূর,নিজেকে শক্ত কর সেহেরিশ নিজেকে শক্ত কর।

সেহেরিশ না চাইতেও আফীফের দিকে আরেকবার তাকালো।তখনি দুজনের চোখাচোখি হতেই সেহেরিশ দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।আফীফ ঠোঁট কামড়ে হেসে ভ্রু কুচকে সেহেরিশের দিকে তাকায়।

– অমৃত ভাই অমৃত।আজকের বারবিকিউটা যা হবে না।বলে বুঝাতে পারবো না।
তুন্দ্রের কথায় সবাই তার দিকে দৃষ্টি রাখে।মুনিফ আফীফের পিঠে চাপড় মেরে বলে,
– হতেই হবে আমাদের আফীফ রাজা হাত লাগিয়েছে বলে কথা।
– আজকের খাওয়ার শেষে তোমাদের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
– সারপ্রাইজ?
সেহেরিশ প্রশ্ন ছুড়ে দিলো তুন্দ্রের দিকে।কিন্তু তার কথায় প্রত্যুত্তর করলো না তুন্দ্র।বরং কেইনের দিকে তাকিয়ে ইশারায় হাসে।হঠাৎ একটি বাজি ফাটার শব্দে সেহেরিশ চিৎকার দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কেইনের হাত জড়িয়ে ধরে তার কান্ডে বাকিরা থতমত খেয়ে গেলেও আফীফ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেহেরিশের হাতের দিকে।তার বুকের ভেতরটায় হঠাৎ মুষড়ে উঠে।হিংসায় বিষিত হয় মন।

– আফীফ ব্রো গান ধরো।
কেইনের কথায় সৎবিৎ ফিরে আফীফের৷
– সরি আমি গান পারি না কেইন।
– মিথ্যা বলছো কেন আফীফ ব্রো।গ্র‍্যান্ডফাদার বলেছে তুমি ছোট বেলায় গান শিখতে।
– সেটা ছোট বেলায় সমাপ্ত এখন আমি গান তেমন গাইনা।সুর ধরতে পারবো কি না নিশ্চিত নই।
– তাতে কি?আমি আর তুন্দ্র ইংলিশ,হিন্দি গান গাইতে পারি।বাংলাটা আমাদের গাওয়া হয় না তেমন।তুমি বরং আমাদের আজ বাংলা গান শোনাও।
– ওকে চেষ্টা করবো।আগে চলো তুমি গানটা শুনে নাও তবে গিটারের সুর তুলতে সহজ হবে।

কেইন এবং আফীফ কিছুটা দূরে গিয়ে আলাপচারিতা শেষে আগের জায়গায় বসে।তুন্দ্র উঠে গিয়ে সোডিয়ামের লাইট গুলো আফ করে দেয়।পুরো ছাদ জুড়ে এখন শুধু নিয়ন বাতির আবছা আলো।কেইন গিটারের তাল তুলতেই আফীফ সেহেরিশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রাখে।তার দৃষ্টির অবস্থান বুঝতে পেরে সেহেরিশ অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে।

♪♪♪ আজ মনে হলো হঠাৎ,তোকে চাইছে মন বারবার-
তোকে ছাড়া বসে না মন এ ঘরে।
কেন থাকো দূরে দূরে কাছে এসে দেখো না।
কত থাকবো একা একা এ মন তো মানে না।
আমার বন্ধুয়া বিহনে গো সহেনা পরানে গো একেলা ঘরে রইতে পারিনা।

আমি হয়ে যাবো তোমার যদি থাকো শুধু আমার
যদি আগলে রাখো আমায় আদরে,
কেন থাকো দূরে দূরে কাছে এসে দেখো না।
কত থাকবো একা একা এ মন তো মানে না।
আমার বন্ধুয়া বিহনে গো সহেনা পরানে গো একেলা ঘরে রইতে পারিনা।…

আফীফের একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা।সেহেরিশকে ইশারা করে গান গাওয়া প্রতিটা কান্ডে লজ্জা মিশ্রিত রাগ উঠে যায় সেহেরিশের।যার দরুনে কেইনের মাথায় থাকা ক্যাপটা আফীফের দিকে ছুড়ে মেরে সেহেরিশ ধমকের সুরে বলে,

– একলা ঘরে না থাকতে পারলে আমানকে নিয়ে থাকুন,মুনিফ ভাইকে নিয়ে থাকুন তবুও এইসব ভুলভাল,অর্থহীন গান গাইবেন না, স্টুপিড!

সেহেরিশের ধমকে সবাই আহাম্মক বনে যায়।
#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here