#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৫
সূর্যের আলোতে আলোকিত হয়ে শুরু হলো আরেকটি দিন।আড়মোড়া ভেঙ্গে সেহেরিশ দ্রুত বিছানা থেকে নেমে তার বারান্দার ছাদ বাগানের দিকে যায়।ফুল গাছ গুলোতে পানি দিয়ে রুমে ঢুকতেই দেখা হয় তার ফুফু মারুফার সাথে।
– ফুফি দেখো দেখো আমার সব ফুল গাছে আজ ফুল ফুটেছে।ইয়েয়য়য় আজ পার্টি হবে পার্টি।
– আজব! সেহেরিশ তোর পাগলামী গুলো এখনো গেলো না।ফুল ফুটেছে বলে তুই পার্টি দিবি।যাই হোক ভাইজান আর ভাবী তোর অপেক্ষায় বসে আছে নিচে চল।
– আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি ফুফি।তুমি যাও।
মারুফা রুম থেকে চলে গেলে সেহেরিশ ফ্রেশ হওয়ার জন্য ড্রেস নিতে আলমারি খুলে।ভার্সিটিতে যাওয়াত উদ্দেশ্য তাকের শেষ সীমানা থেকে একটি কুর্তি টেনে বের করতেই তার পায়ের কাছে ঝনঝন শব্দ করে একটি নুপুর গড়িয়ে পড়ে।
সেহেরিশ দু পা পিছিয়ে গিয়ে মেঝেতে তাকাতেই সেই নুপুরটি চোখে পড়ে।সঙ্গে সঙ্গে শান্ত মেজাজের সেহেরিশের রাগ তড়াক করে বেড়ে যায়।মেঝে থেকে নুপুরটি হাতে তুলে একমনে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।না চাইতেও বার বার কেন মনে পড়ে যায় আফীফ দেওয়ানের কথা!
– আমি তোকে ঘৃণা করি আফীফ।তবুও তুই আমার মন থেকে কেন যাচ্ছিস না।তোর আর আমার দূরত্ব হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে তবুও কেন ভুলিনি তোকে।
সেহেরিশ হাতের নুপুরটা আবারো ছুড়ে মারে আলমারিতে।ড্রেসটা হাতে তুলে ওয়াশরুমে ডুকে বিকট শব্দে দরজা বন্ধ করে দেয়।
ওয়াশরুমের আয়নার দিকে তাকিয়ে সেহেরিশের বেহায়া মন আনমনেই ভাবতে থাকে আবারো আফীফের কথা।
সেদিনের পর কেটে গেছে আট বছর!দূরত্ব বেড়েছে সমান তালে সেহেরিশের বর্তমান অবস্থান ইতালির বলুনিয়া শহরে।সেদিন ফুফু মারুফার হাতে হাত রেখে চন্দনপুর গ্রাম ছেড়েছিল সেহেরিশ।তারপর শহর থেকে সোজা ইতালি।এর মাঝে আর কোন খোঁজ পায়নি চন্দনপুরের, পায়নি আফীফের।তার বন্ধি দশা জীবনের ঘটে যাওয়া দশটি দিনের কথা জানে না তার মা বাবা।শুধু মাত্র ফুফি মারুফা ছাড়া।এই আটটি বছর একটি মূহুর্তের জন্য সেহেরিশ তার অতীতের কথা ভুলে গেলেও হুট হাট আবারো মনে পড়ে যায় আফীফ নামের কোন এক রাগী ছেলের কথা।যে কী না নিজের স্বার্থকে মূল্যায়ন করতো।
—–
ফ্রেশ হয়ে সেহেরিশ নিচে নামতেই সবাই একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে।সেহেরিশের বাবা খুরশীদ আনোয়ার তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– গুড মর্নিং মামনি।
– গুড মর্নিং পাপা।
– তোমার এক্সাম কবে শেষ হবে?
– এইতো আর মাত্র দুটো দিন আছে তার পরেই আমি ফ্রি।এবার কিন্তু আমরা লং ট্যুরে যাবো পাপা।ফ্যামিলি ইউথ ফ্রেন্ড’স।
-ওকে। আগে তোমার এক্সামটা শেষ করো।
সেহেরিশ খাওয়া দাওয়া সেরে বাসা থেকে বের হতেই তার মা ফাহমিদা তাকে পেছন থেকে ডেকে উঠে।
– সেহেরিশ শোন..
– বলো মাম্মী
– তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
– সারপ্রাইজ?
– ইয়াহ।এবার এক্সাম দিতে যাও।পরে কথা হবে।
সেহেরিশ দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।তার জন্য রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করছে তার বন্ধু কেইন।কেইন একজন খ্রিস্টান ধর্মের ছেলে।তার সাথে সেহেরিশের বন্ধুত্ব প্রায় পাঁচ বছর আগে থেকেই।
– হেই কেইন হোয়াটস’আপ?
– ফাইন।ইউ?
– অল সো গুড।কেইন তোমার জন্য একটা ভালো নিউজ আছে।ইভেন তোমার না আমর ফ্রেন্ড সার্কেল সকলের জন্য।
– কি সেই নিউস সেহেরিশ?
– আমরা সকলে মিলে ট্যুরে যাবো কেইন।সাথে তোমারাও।
– ওয়াও ইট’স আল সো গুড নিউজ।
– ইয়াহ।
সেহেরিশ অনন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে যায়।এদিকে কেইন সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে আছে একমনে।পকেট থেকে একটি ফুল বের করে আবারো ছুটে আসে সেহেরিশের কাছে।
– হেই সেহেরিশ স্টপ!
কেইনের কথায় সেহেরিশ দাঁড়িয়ে যায়।তখনি কেইন হাতে থাকা সাদা ফুলটি নিয়ে সেহেরিশের কানে গুজে দেয়।কেইন তার দুহাতে সেহেরিশের মুখদ্বয় আবব্ধ করে আবেগী সুরে বলে,
– সেহেরিশ ইউ আর সো ফ্লাফি।
– থাংকু মাই কিউটি ফ্রেন্ড।
সেহেরিশের মজার কথায় হেসে দেয় কেইন।দুজনেই আবার তাদের গন্তব্যের যাত্রা শুরু করে।
প্রায় দু-বছর আগে থেকেই কেইন সেহেরিশের প্রতি দূর্বল কিন্তু বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ে “ভালোবাসি” নামক শব্দটি ভুলেও মুখ থেকে বের করে নি সে।
—–
একজন রমণীর হাজার’টা ছবি দিয়ে একটি দেয়াল সুসজ্জিত করে রেখেছেন একজন যুবক।
গুটিয়ে রাখা শার্টের হাত পকেটে ঢুকিয়ে
সেই দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন আরক্ত দৃষ্টিতে।ক্ষণিকেই চোখ বন্ধ করে গাঢ় করে নিশ্বাস ছাড়েন।দু-ঠোঁট চেপে ধরে আবারো চোখ খুললেন। ছবি গুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি অভিপ্রায় হাসেন।
তৎক্ষণাৎ তার কানে আসে বাড়ির কোলাহল। দ্রুত পর্দা সরিয়ে সেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য নির্মিত হলে আবারো ঘুরে তাকায় সেই দেয়ালের দিকে ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি রেখা টেনে দ্রুত কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান।
দু কদম এগিয়ে যেতেই সামনে তার দাদাজানের চনমনে অবস্থা দেখে দাঁড়িয়ে যান।
– দাদাজান এত শোরগোল কিসের?
– তোমার দাদীমা আবার অসুস্থ হয়ে গেছে আফীফ!এইভাবে আর কত দিন শুধুমাত্র তোমার উদ্দেশ্য পূরণে আমার ছেলে, ছেলের বউ’কে দেশের বাইরে থাকতে হচ্ছে।তোমার দাদীমা যে দু-চোখে দেখে যেতে চায় তাদের। শেষ কবে সামনা সামনি দেখা হয়েছে তাদের মনে আছে তোমার?
আফীফ গাঢ় করে শ্বাস ছাড়লেন।নিজেকে ধাতস্ত করে দাদাজানের দিকে নিরুদ্যম চোখে তাকালেন।তার দাদাজান আহনাফ ভয়ার্ত কন্ঠে আক্ষেপ সুরে বলেন,
– ছোট্ট মেয়েটাকে মাফ করে দিলে হয়না আফীফ?বাচ্চা মেয়ে ভুল করেছিল সেই ভুলের শাস্তি, শোধ কি তুমি এই প্রাপ্ত বয়সে তুলবে?
– কে বলেছে আমি প্রতিশোধ নেবো।আফীফের শাস্তি অন্তত ভয়ানক! আর আফীফ কখনো তার হৃদয়বতী’কে শাস্তি দেয় না বরং অন্তরিন ভাবে ভালোবেসে যায়।এত সব আয়োজন মোটেও তার বিষাক্ত শাস্তির নয়! তবে হ্যা অন্যরকম শাস্তি তার জন্য অপেক্ষা করছে।তার শাস্তিটা হবে অন্তত সুমিষ্ট।
আফীফ তার গমগম সুরের বাক্য শেষ করেই বড় বড় পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
কিন্তু বৃদ্ধ আহনাফ ঘামছে, কি চলছে এই ছেলের মাথায় এত বছর ধরে?এই ছেলের কান্ডকীর্তিতে বাধা দেওয়ার সাধ্যে কারো নেই। সে যে অন্তত ভয়ানক একজন সুপুরুষ!
আফীফ দ্রুত তার দাদীজানের কক্ষে প্রবেশ করে।অচেতন ফাতেমার মুখটা দেখে তার ভেতরটা হাহাকার করে উঠে।দাদীজানকে তো সে ভালোবাসে।আর ভালোবাসার মানুষ গুলোর কষ্ট আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারিনা।আবারো রুম থেকে বেরিয়ে ছাদের উদ্দেশ্য রওনা হয়।যাওয়ার আগে হাত দিয়ে ইশারা করে মুনিফকে ছাদের দিকে যেতে বলে।
মুনিফ আফীফের একমাত্র ফুফুর ছেলে।গত কয়েক বছর তারা সবাই এই বাড়িতেই আছে।মুনিফ আর আফীফ সমান বয়সের তাদের বন্ধুত্বের অবস্থাটাও বেশ দৃঢ়।
– মুনিফ দাদীজানের জন্য একজন নার্সের ব্যবস্থা কর।বাড়িতে থেকেই সেই নার্স দাদীজানের সেবা করবে।
– কিন্তু নানীজান মামা মামীকে দেখতে চেয়েছে আফীফ।তাদের দেশে আসতে বল।এভাবে আর কতদিন চলবে?
– উতলা হচ্ছিস কেন তোরা?আমি যদি আমার প্রাণ পাখির জন্য দেখা হীন কথা হীন দৈর্য্যর সাথে থাকতে পারি তবে তোদের এত সমস্যা কিসের?চাচাজন,চাচিআম্মার সাথে তো সবার ভিডিও কলে কথা হচ্ছেই।আর দাদীজানের এইসব মনের ভুল একটু অসুস্থ হলেই মরে যাবো মরে যাবো যতসব জাস্ট বিরক্তকর।তিনি একবার ভাবেন না আমরা তার কথায় কতটা কষ্ট পাই।
– আচ্ছা বাদ দে।তোর তাকিয়ার খবর কী?
– উহুহ সে তাকিয়া নয় সে তো এখন সেহেরিশ!
– যাই হোক। কী খবর তার?
– সে তো মুক্ত আকাশে উড়ছে।উড়তে থাকুক।পীপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।
কথাটি শেষ করেই গাঢ় করে শ্বাস ছাড়ে আফীফ।তার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে মুনিফ বলে,
– এত কিপটামি করছিস কেন আফীফ?আমি তোকে কতবার বলেছি সেহেরিশকে আমায় একটু দেখা কি এমন মেয়ে যার জন্য আফীফ দেওয়ান, দেওয়ানা হয়ে গেছে।
মুনিফের কথায় বাকা হাসে আফীফ।
– আফীফের পছন্দের জিনিসের দিকে তাকাস না। ভুলেও না,তাহলে চোখ দিয়ে আর তোর এই সুন্দর পৃথিবী দেখা হবে না। সো বি কেয়ারফুল।
গত আট বছরে পাল্টে গেছে আফীফের জীবন।সেদিন রাগ দেখিয়ে দরজা বন্ধ করলে শত চেষ্টার পরেও আফীফ দরজা খুলেনি।কোন উপায়ন্তর না পেয়ে আহনাফ দেওয়ান দরজা ভাঙলে আরো উগ্র হয়ে যায় আফীফ।একে একে পুরো বাড়িতে তান্ডব চালায়।তার হিংস্রতা ঠিক দু-মাসেও কমে নি।চাপা রাগ থেকে থেকে এখনো মনের ভেতর জ্বলে উঠছে।
মুনিফ চলে গেলে আফীফ মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ।স্মৃতি থেকে এখনো মুছে যায় নি সেহেরিশ বরং উদ্দীপ্ত হয়ে আরো বাড়ছে।তাকে পাওয়ার তৃষ্ণা জাগছে মনে।
– তাকিয়া আনওয়ার সেহেরিশ!নিজেকে খুব চালাক ভাবো?অবশ্য আমিও মানি তুমি চালাক।খুব চালাক।তবে আমার থেকেও নয়।তুমি কী ভেবেছো আট বছর আগের কাহিনি আট বছর আগেই শেষ?উহু’হ ভুল।সেই আট বছর আগের কাহিনি এখনো চলছে তোমার অন্তরালে।আশা করি খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে নতুন আঙ্গিকে নতুন পরিচয়ে।
#চলবে…./