#অমানিশা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১৯
শয়নকক্ষজুড়ে হরিদ্রাভ বাতির অবারিত বিচরণ। নিদ্রিত রাত্রির স্তব্ধকালে শ্রান্ত-অসাড় দেহে ঘুমোচ্ছে ক্লান্ত যুগল।
তীব্র প্রণয়ে মাখো মাখো ঘর্মাক্ত নারী সামান্য নড়েচড়ে উঠতেই সন্ধানী ভঙ্গিতে ঘুমে কাতর চোখদুটো মেলল আরশাদ। মুনতাহা কাছ থেকে সরে উল্টোদিকে ফিরে শুয়েছে। বা’পাশে ফ্যানের বাতাস বেশি। মেয়েটার গরম লাগে অতিরিক্ত।
দেখা শেষে কপালের দু’পাশে আঙুল চেপে ক্ষণকাল চোখ বুজে রইলো সে। মুনতাহার ঘুমের ওষুধের রেশ কেটেছে আরো ঘন্টা দু’য়েক আগেই। একটুপর ভোর হয়ে যাবে। রাস্তার মোড় থেকে কুকুরের বাকবিতন্ডতা শোনা যাচ্ছে। রাত উঠলে এদের এতো বেয়াদবি কিসের?
আরশাদ উঠে বসে। মুনতাহা এদিকে পিঠ দিয়ে শুয়েছে। চাদর অগোছালো। ঘড়িতে পৌনে চারটা।
নেমে দাড়ায় আরশাদ। দুপুর থেকেই অযত্নে পড়ে থাকা ওষুধের পাতাটা নিশব্দে ড্রয়েরে আটকে ওয়াশরুমে ঢুকে। পনেরো মিনিটের ব্যবধানে বেরিয়েও আসে পূর্বের ন্যায় উদোম গায়েই। মুনতাহা দিক পাল্টেছে। ডানদিকে কাত হয়ে শুয়েছে। মেয়েটা স্হির থাকেওনা। এগিয়ে যায় আরশাদ।
টেবিলল্যাম্পের সুইচ চাপার আগেই আবার ঘুরে গেলো মুনতাহা। তাও ভালো, ওষুধের ঘুমে মৃতের মতো একাধারে পড়ে থাকে শুধু। এখনতো নিজ থেকেই ঘুমিয়েছে।
কাঁধ থেকে চাদর সরে গেছে। আরশাদ সুইচে আঙুল রেখেই শান্ত চোখে আরেকবার দেখলো কাঁধের একটু নিচেই হাল্কা দাবানো জা’গাটা। ছোটবেলায় দৌড়ঝাপ খেলতে যেয়ে মাংস উঠে গেলে যেমন হয় তেমনই ক্ষতটা। বেশ পুরনো ক্ষত। ঘা-ব্যাথা মিলিয়ে গেলেও দাগ মিলেনি।
আরশাদ চোখ নামায়। আলো নিভিয়ে মুনতাহার গা থেকে চাদরের পরত সরিয়ে দেয়। রেগুলেটর ঘুরিয়ে ফ্যানের গতি বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট হাতে চুপচাপ চলে যায় বারান্দায়। হেডলাইটের টি ম টি মে আলো জ্বলছে। পায়রাদুটো খাঁচার এককোণে চেপে একটা আরেকবার সঙ্গে লেগে ঘুমোচ্ছে। আরশাদের হাল্কা পায়ের শব্দেই ঝুপঝাপ ঘুম ভেঙে যায় তাদের। পুরুষ পাখিটা তীক্ষচোখে তাকায়। যেন চরম অপরাধ করেছে আরশাদ। তার জোড়ার ঘুম ভাঙালো কোন সাহসে?
আরশাদ নিরবে হাসে। ঘাড় বাকিয়ে মুনতাহাকে দেখতে চায়। অথচ ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার না হলেও বিছানা অবধি আলো পৌছোচ্ছেনা। কপাল! বারান্দার দরজা ভিজিয়ে লাইটার চেপে সিগারেটের মুখে আগুন ধরায় সে।
মেয়েটার শরীরে ক্ষতটা সেই পাঁচ বছর বয়সেই হয়েছিল। নরপশুটার হিংস্র আঁচর বাচ্চাটার নরম গায়ের মাংস তুলে নিয়েছিল। সেই বিভৎস কালো স্বৃতি মেয়েটা চাইলেও ভুলতে পারে না।
পাশে একটা বেতের চেয়ার রাখা। আরশাদ পিঠ এলিয়ে বসে পড়লো। মেয়েটা একটুপরই বিছানা ছেড়ে উঠে আসবে। মিনমিন করে তাকে সিগারেট ফেলতে বলবে। সে কথা না মেনে আরো দু’তিনটে টান দিয়ে বারান্দায় রীতিমত আগুন লাগিয়ে দিবে। মেয়েটা তবু চোখদুটো কুচকে দাড়িয়ে থাকবে। খুক খুক করে কাঁশলে সিগারেট ফেলে দিবে সে। অত:পর কাছে আসার জন্য হাত মেলে দিলে মেয়েটা চুপচাপ বুকে গাল পেতে আকাশের দিকে চেয়ে থাকবে।
আরশাদ জোরে টান দিলো ধোঁয়াটে নেশায়। সাদা পদার্থের বহরে ঝাপাঝাপি শুরু করে দিলো কবুতর দুটো।
–
হাল্কা বেগুনী সুতির শাড়ি পরণে সূর্যের আলোর বিপরীতে বসে থাকা রমণীকে দেখেই সকালের ঘুম ভাঙল আরশাদের। হাতের তালুতে ঘষে চোখ পরিষ্কার করে একটু ভালোভাবে নজর দিতেই দেখলো মুনতাহা খাঁচার সামনে দু’হাঁটুগেড়ে বসে আছে। উল্টোদিকে ফেরা বিধায় চেহারা দেখা যাচ্ছে না। আচঁল গড়াগড়ি খাচ্ছে ফ্লোরে। চুলে গামছা পেঁচানো। সবুজ গামছা। বেগুনী সবুজের কোনো মিশেল ফুল আছে কি পৃথিবীতে? থাকলে সেটার সঙ্গে অনায়াসেই তুলনা করা যেত। কিন্তু আফসোস! তার জানা নেই।
আরশাদ অবাক হলো খানিকটা। সবকিছুতে অনাগ্রহ দেখানো মুনতাহাকে এমন আগ্রহের সহিত কবুতরের সামনে বসে থাকায়ই দুদণ্ড শান্তি মিলল যেনো। ভাঙা গলায় ডাকল,”মুনতাহা?”
মুনতাহা ডাক শোনেনা। আরশাদ আবার ডাকে। এবার সাথেসাথেই ঘাড় ঘুরায় সে। সাড়া দিয়ে বলে,”হু।”
আরশাদ ডাক ছেড়ে মুখে হাত দিয়ে হাই তুলছিলো। মুনতাহা তার হাই তোলাটাও দেখে মনোযোগ দিয়ে। আরশাদ হাই শেষ করে তাকায়। কেঁশে গলা পরিষ্কার করে বলে,”কি করছেন?”
মুনতাহা একবার খাঁচায় তাকিয়ে আবার আরশাদের দিকে চাইলো। শান্তশিষ্ট নরম গলায় অভিযোগ ছুঁড়ল,”খাবার দিচ্ছি। আপনিতো কাল দুপুর থেকে পানিটাও দেননি। ওরা ক্ষিদেয় খালি বাটি ঠোঁকরাচ্ছে।”
—“খাবার দিয়ে দেয়নি ভেতরে?”
—“দিয়েছিলো হয়তো, খেয়ে ফেলেছে।”
—“আপনি কি উল্টোপাল্টা খেতে দিচ্ছেন? ওরা গমের দানা খায়। আমি নিয়ে এসেছিলাম তো দোকান থেকে। আম্মার কাছে আছে। নিয়ে আসুন, ওটা খেতে দিন।”
মুনতাহা ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
—“আমি জানি ওরা গম খায়। ওটাই দিচ্ছি।”কন্ঠ নেমে যায়। মুনতাহা চোখও নামিয়ে নেয়। অন্যমনস্ক হয়ে বলে,”আব্বু সবসময় ওদের জন্য গম নিয়ে আসতো জানেন? যখন ছাদে যেতাম হাতে করে নিয়ে যেতাম।”
মুনতাহা কাঁদেনা। আরশাদ তবু বলে,”মুনতাহা!”
মৃদুকন্ঠে উওর আসে,”কাঁদছিনা।”
–
দুপুরের কড়া রোদ উঠে গেছে তখন। ড্রইংরুমের মেঝেতে রোদ্রপ্রজাপতির ছড়াছড়ি। জানলার গ্রিলের ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে অদ্ভুত আল্পনায় বোধহয় কতকগুলো তপ্ত হলদে প্রজাপতিই অবিশ্রাম উড়ছে সাদা মেঝেতে। খুব কড়া রোদে একটা ঝলসানো ঝলসানো গন্ধ পাওয়া যায়। এইযে এখনো পাওয়া যাচ্ছে। মুনতাহা বসেছে মেঝেতেই। তবে রোদের কাছে নয়। একটু দূরে।
সাবিনা বেগম সোফায় বসে তার চুল আঁচরে দিচ্ছেন। কাজটা তিনি রোজই করেন। রুটিনমাফিক।
পরিপাটি মুনতাহা চুলে হাতও দিতনা। মেয়েটার এখন সবতেই অনিহা। সাবিনা বেগম ‘চুল নষ্ট হয়ে যাবে’, ‘চুল নষ্ট হয়ে যাবে’ করতে করতে তাকে বসাবে। আকুলিবিকুলি বকতে বকতে গতকালের করে দেয়া বিনুনি খুলে সারারাতে লেগে যাওয়া জট ছাড়াবে। তারপর আধঘন্টা যাবত চুল আঁচরে আঁচরে পুনরায় বিনুনি গেঁথে দিবেন।
আজও ব্যাতিক্রম নয়।
—“পাখি পসোন্দ হইসে বউ?”
মুনতাহা হাতের নখ খুটছিলো। মনোযোগ না থাকায় প্রশ্ন ঠিকঠাক শুনতে না পেয়ে বলল,”জি দাদু?”
—“তোমারে না পাখি আইনা দিসে?”
—“হ্যাঁ, দিয়েছে তো। পাখি না, কবুতর।”
সাবিনা বেগম হো হো করে হাসেন,”আরে বোকা মেয়ে, কবুতর তো পাখিই।”
–
সন্ধ্যার সময় একটু বেরিয়েছিলো আরশাদ। ফিরে ঘরে ঢুকে দেখে মুনতাহা ফ্যান বন্ধ করে রেখেছে। বারান্দার দরজার ছিটকিনি তোলা। জানলা বন্ধ করে পর্দা টানা। বদ্ধ ঘরে গরমের মধ্য মেয়েটা করছে কি? জিজ্ঞাসা করতে হয়না; তার আগেই নজরে আসে সাদা পায়রাদুটো। একটা ফ্যানের পাখার উপর ওর আরেকটা আলমারির উপর বসেছে। মুনতাহা আড়চোখে তাকে দেখে। আরশাদ সন্দিহান কন্ঠে বলে,” ঘরে ছেড়ে রেখেছেন কেন?”
—“অতটুকু খাঁচায় উড়তে পারছিলনা।” মুনতাহার কথা শেষ হয়না তার আগেই একটা পায়রা পালক ঝড়িয়ে স্ব শব্দে ডানা ঝাপটায়। ঘরময় উড়ে মুনতাহার কাঁধের ওপর বসে। মুনতাহা কেনো যেনো ডান তালু মেলে ধরে। পায়রাটা এক’পা দু’পা করে হাত বেয়ে নেমে নেমে শেষমেষ তালুতেই পা রাখে।
আরশাদ রাজ্যসম বিস্ময় নিয়ে দেখে, মুনতাহা হাসছে।
~চলবে~