#ভালবেসে_অবশেষে
#নুশরাত_জেরিন
পর্ব: ১২
সিয়াম ঘরে ঢুকেই প্রথমে বলল,
“তোমার রুম কোথায় মিলি, বড্ড ঘুম পেয়েছে।”
মিলি হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো। তার মুখ ফুটে কথা বের হচ্ছে না। কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। নাকি অতিরিক্ত ঘুমে উল্টো পালটা দেখছে? এমনটা হলেও হতে পারে। মিলির অতিরিক্ত ঘুমের কারনে প্রায়ই সে বিব্রত পরিস্থিতিতে পরে। একবার কলেজের এক বন্ধুকে আড্ডার মাঝে মা ভেবে চা চেয়ে বসেছিলো। আড্ডা ফেলে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। হাসির শব্দে ভালোমতো চোখ কচলে বন্ধুকে দেখে সে কী লজ্জাটাই না পেয়েছিলো। যদিও এর চেয়েও বেশি লজ্জা পেয়েছিলো কলেজে গিয়ে। সেই বজ্জাত বন্ধু পুরো কলেজ ভাসিয়েছিলো এই ঘটনাটা।
এমন অহরহ ঘটনা ঘটেছে মিলির সাথে। আজ তার ব্যতিক্রম নাও হতে পারে।
তাছাড়া মিলির দাদি বেচে থাকাকালীন প্রায় ভূতের গল্প শোনাতেন। ভূতেরা নাকি সন্ধে বেলা, ভোর রাতে পরিচিত মানুষের রূপ ধরে কাছে ডাকে, কাছে গেলেই ঘাড় মটকে কাহিনী খতম। নীরা মিলি ছোটবেলা কাথা মুড়ি দিয়ে সেই গল্প শুনতো।
আজও তেমন কিছু হলো নাকি কে জানে।
মিলির ভাবনার মাঝে সিয়াম আবার বলল,
“রুম কই বলো না কেনো? আর দাড়িয়ে থাকতে পারছি না তো।”
এবারের কন্ঠে তার অসহায়ত্ব।
মিলি অগোছালো ভাবনাগুলো একপাশে রেখে বলল,
“এটা সত্যি আপনি?”
সিয়ামের ভ্রু কুঁচকে গেলো আপনাআপনি।
বলল,
“একদিনও হলো না এসেছো অথচ এতটুকু সময়ে আমার চেহারা অবধি ভুলে গেলে?”
মিলি থতমত খেলো।
“না মানে, এটা আসল আপনি? নাকি নকল?”
“এসব আজগুবি কনভার্সেশন আপাতত মুলতবি রাখো। ঘুমে চোখ খুলে রাখতে পারছি না। ঘুম থেকে উঠে আবার এখান থেকে শুরু করো।”
এবার আর মিলির অপেক্ষা না করে সে নিজেই মিলির ঘর খুঁজে বের করলো। দ্রুত বিছানায় শুয়ে সে চোখ বুঝলো।
মিলির হতভম্ব ভাব এখনো কাটেনি। সে ভ্যবলার মত তাকিয়েই রইলো।
ঘুম থেকে উঠার সাথে সাথে সিয়াম বেশ বিব্রত পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো। মিলিদের বাড়ির কাজের মেয়ে লায়লা। অতিরিক্ত কথা বলার সাথে সাথে তার অন্যতম গুন হচ্ছে সে অতিরিক্ত হাসে। বিনা কারনেই হাসে। সিয়ামের প্রথমেই মনে হলো মেয়েটা মানুসিকভাবে অসুস্থ। নয়তো বিনা কারনে কেউ কিভাবে হাসে! সিয়ামকে রুমের বাইরে বেরোতে দেখেই সে বলল,
“দুলাভাই ভালা আছেন?”
কথা শেষ হবার সাথে সাথে সে আবার হাসলো।
এ বাড়িতে আসার পর থেকে সেই যে একবার মিলির দেখা মিলেছিলো তারপর একবারও সে সামনে আসেনি।
সিয়াম নিজেই নিজেকে বেশ খানিকটা বকলো। এভাবে হুটহাট চলে আসাটা তার একদমই উচিত হয়নি। তারউপর বাড়িতে পরার জামা কাপড় পরে আসাটা তো আরও অন্যায় হয়েছে। অন্তত কাপড় বদলে আসতে পারতো! কিন্তু খাবার টেবিলে মায়ের কথা শুনে আর দেরি করতে পারেনি সিয়াম, যেভাবে ছিল সেভাবেই বেড়িয়ে পরেছে। মেয়েটা কিভাবে যে এতটা আপন হয়ে গেলো কে জানে! তাকে না দেখতে পেয়ে অতটুকু সময়েই সিয়ামের দম আটকে আসছিলো, দু’টো দিন কিভাবে থাকতো!
তবে হটকারিতায় কী বাজে ছেলেমানুষী কাজ করেছে সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
কাজের মেয়েটার সাথে শশুড় শাশুড়িও কেমন করে যেনো তাকাচ্ছে। ব্যাপারটা বেশ লজ্জাজনক। এর মাঝে যদিও আতাউর রহমানের সাথে সিয়াম দেখা করে এসেছে। তবুও মিলির দেখা পাওয়া যায়নি।
সে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে একবার মিলির নম্বরে কল করলো। ফোনটা বাজছে বিছানার উপর বালিশের উপর। সিয়াম হতাশ ভঙ্গিতে বসলো।
মিলি ঠিক তক্ষুনি ঘরে ঢুকলো।
বলল,
“ফ্রেশ হয়েছেন? নাস্তা করবেন না? আসুন।
সিয়াম বলল,
” এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি? দেখলাম না কেনো?”
মিলি সিয়ামের গা ঘেসে পাশে বসলো। সিয়াম লম্বা নিশ্বাস টানলো। মেয়েটার গায়ে কী মিষ্টি গন্ধ!
মিলি বলল,
“রান্নাঘরে ছিলাম, তাই দেখেননি।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,
“এমন পাগলামি কেনো করছেন বলুনতো, আমি কত লজ্জায় পড়েছিলাম জানেন? মা যখন জিজ্ঞেস করলো….”
“আমি কী করেছি?”
সিয়ামের প্রশ্নভরা দৃষ্টি।
মিলি বলল,
“সত্যি করে বলুন তো, প্রেমে টেমে পড়েছেন?”
সিয়াম একহাত দিয়ে মাথা চুলকালো।
“তাই তো মনে হয়।”
মিলির মুখের হাসির রেখা ততক্ষণে বিস্তৃত হয়েছে।
“সঠিক জানেন না তবে?”
“বুঝতে পারছি না।”
মিলি বড় কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। লোকটা নিজে নিজের অনুভূতির ব্যপারে বোঝে না, অথচ অন্যান্য সবাইকে ঠিকই বুঝিয়ে দিচ্ছে। বাবা মায়ের সামনে যেতেই মিলির লজ্জায় পালাতে ইচ্ছে করছে। রেনু বেগম তো কল করে বলেই ফেললেন,
“আমার ছেলেটাকে বদলাতে বলেছিলাম, তাই বলে এমন বউপাগলা বানিয়ে দিলি!”
….
দুপুরে খাবার সময় সিয়ামের অবস্থা প্রায় ‘ছেড়ে দে মা বাঁচি।’
মিলির মা টেবিল ভর্তি খাবার তৈরি করে সিয়ামের পাতে তুলে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সিয়াম এত খাবার কখনও খায় না, এত তেল মশলা দিয়ে তো নয়ই। তবু ভেবেছিল শাশুড়ীর মন রক্ষায় হালকা পাতলা মুখে তুলবে। কিন্তু এখানে এসে বুঝলো একবারে দু’মাসের খাবার একবারে খাওয়ানোর পায়তারা করা হচ্ছে। সে বার বার নিষেধ করা সত্বেও মিলির মা এটা ওটা তুলা থেকে বিরত হবার নামই নিচ্ছেন না।
সিয়াম তার পাশের চেয়ারে বসা মিলিকে উদ্দেশ্য করে ফিসফিসিয়ে বলল,
“তোমরা আমাকে মানুষ না ভেবে রাক্ষস কেনো ভাবো মিলি? এত খাবার তো রাক্ষসও বোধহয় খেতে পারবে না আমি তো তুচ্ছ! ”
মিলি খাবার মুখে তুলতে তুলতে ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“এটাকে বলে জামাই আদর বুঝলেন, শশুর বাড়ি এসেছেন অথচ জামাই আদর খাবেন না তা কী হয়!”
সিয়াম এবার মিলির হাত টেনে ধরলো।
“আই বেগ ইউ প্লিজ, আমি আর খেতে পারবো না। মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যায় আমি বোধহয় আজ খেতে খেতে মরে যাবো।”
মিলি একটু উচ্চস্বরে বলল,
“ওনাকে আর জোর করো না মা, আসলে ওনার পেটে একটু সমস্যা তো।”
মিলির মা বললেন,
“একথা আগে বলবি না আমায়?”
“ভুলে গেছিলাম মা।”
সিয়ামের ততক্ষণে গলায় খাবার আটকে গেছে। সে বিস্ফোরিত নয়নে মিলির দিকে তাকালো।
কাজের মেয়েটা ফট করে বলে উঠলো,
“এজন্য বোধহয় দুলাভাই ঘর থেকা বাইর হইতে চাচ্ছিলেন না তাই না দুলাভাই? কয়বার বাথরুমে গেছিলেন দুলাভাই? ঔষধ খাইছেন? ডাক্তার ডাকমু? এখন কী অবস্থা? আবার যাইবেন বাথরুমে? ”
সিয়াম দীত্বিয় বারের মতো আবারও বিষম খেলো।
মিলি আর হাসি আটকাতে পারলো না। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ। আতাউর রহমান এতক্ষণে মিলির দুষ্টুমি ধরতে পারলেন।
তবে কেনো যেন তার খুব ভালো লাগলো। কাল সারাদিন মিলির ভবিষ্যত ভেবে যে চিন্তায় মগ্ন ছিলেন সেটা হুট করে গায়েব হয়ে গেলো।
…
মিলি মন খারাপ করে সোফায় বসেছে। সে আজ বাড়ি ফিরবে না। মাত্র কাল এসেছে আর আজই কিনা চলে যাবে? সিয়াম নাছোড়বান্দা। সে মিলির জামকাপড় হাতের কাছে দু’একটা যা পেলো সেটাই ব্যাগে ঢুকাতে শুরু করেছে। সি নিজেও আজ মার্কেট থেকে তার জন্য শার্ট প্যান্ট কিনেছিলো। শশুর বাড়িতে আর যাই হোক ট্রাউজার পরে তো আর ঘোরা যায় না।
মিলিকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বলল,
“কি হলো রেডি হও না কেনো? সময় নেই কিন্তু একদম। ”
মিলি বলল,
“আপনি এমন করছেন কেনো বলুনতো? কাল মাত্র এলাম, আর আজ কিনা নিয়ে যেতে চাইছেন?”
“আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আসিনি, বোঝো না কেনো?”
“তবে আপনি যান!”
“তোমাকে ছাড়া?”
মিলি জবাব দিতে পারলো না। লোকটা এমনভাবে কথাটা বলল। সে মুখ গোমড়া রেখেই একটা জামা হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।
,
চলবে…..