এক পা দুপা
সিজনঃ ২
শেষ পর্ব
দেখতে দেখতে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। দিন ঘুরে মাস, মাস ঘুরে বছর পার হয়ে গেছে। তৃষ্ণার কেসটা পুরোনো হয়ে গেছে অনেক আগেই। সকল দোষীর শাস্তি হয়েছে। যদিও তারা অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় মামলার নিষ্পত্তি পুরোপুরি হয়নি। হয়তো প্রতিপত্তি বেশি ছিল বলেই কেসটা এতো জলদি সল্ভ হয়েছে। শেষের দিকে মন্ত্রী সাহেবও কেমন পিছিয়ে গেছেন। সেদিনের ঘটনা বলা প্রয়োজন।
সেদিন অনেক খোঁজার পরেও যখন তনুকে খুঁজে পাওয়া যায় না তখন নিজেকে খুব হতাশ দেখতে পায় শিল্প। শাহেদ নিজেও বেশ চিন্তিত হয়ে উঠে। এই কেসে তনুই প্রত্যক্ষদর্শী, সে হারালে সব শেষ। তখনই তনুর নাম্বার থেকে কল আসে। অপরপাশ থেকে শিল্পকে কোনো অপরিচিত কন্ঠ একটি নির্দিষ্ট স্থানে আসার আমন্ত্রণ করে।
খুব তাড়াহুড়োয় পৌঁছে যায় উভয়ে নির্দিষ্ট স্থানে। হাসপাতালের সাদা বিছানায় তনুকে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে যায় শিল্প এবং শাহেদ। খোঁজ করলে জানা যায় কিছু পথচারী তনুকে এখানে এনেছে। সে নাকি রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। নার্সের কাছ থেকে এটুকুই জানা যায়। পরবর্তীতে ডাক্তারের কাছ থেকে জানা যায় অতিরিক্ত স্ট্রেসের জন্য তনু জ্ঞান হারিয়েছে। এছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই। শিল্প হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। তবুও অনেক চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করে। তনু কোথায় ছিল, কেনো বাইরে গেলো, বাইরে কি হয়েছে?
সব সমস্যার নিষ্পত্তি ঘটে তনুর জ্ঞান ফেরার পর।
“তুমি ঠিক আছো?” তনুকে জিজ্ঞেস করে শিল্প। তনু কেমন ভীতু চোখে তাকায়। মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়, তার মানে সে ঠিক নেই। শিল্প চিন্তিত মুখে অদুরে বসা শাহেদের দিকে তাকায়। সেও এদিকেই তাকিয়ে আছে।
“কি হয়েছে তনু? খারাপ লাগছে? থামো ডাক্তার ডাকছি। নার্স, নার্স।”
“আমার মনে পড়েছে।” চমকে উঠে শিল্প আর শাহেদ।
“কি? কি মনে পড়েছে?”
“সেদিনের কথা। সেই মেয়েটা!” তড়িঘড়ি করে লাফিয়ে উঠে শাহেদ নিজের জায়গা থেকে, এগিয়ে আসে তনুর দিকে।
“কি মনে পড়েছে আপনার, কোন মেয়ের কথা?”
“যে মেয়েটা সেদিন… মেয়েটা আর বেঁচে নেই তাইনা? ওরা মেরে ফেলেছে তাইনা? আমার চোখের সামনে মারলো কিছু করতে পারলাম না।” হঠাৎ তনু অস্থির হয়ে উঠলো। শিল্প তনুকে জরিয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকলো। শাহেদ পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। তনু শান্ত হলে শাহেদ আবারো জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছিল সেদিন।” তনু ক্ষাণিক ভাবলো তারপর বলতে আরম্ভ করলো।
“সেদিন আমি নুযহাতের সাথে দেখা করতে কলেজে এসেছিলাম। হুট করেই কলেজের রাস্তা চিনতে অসুবিধা হচ্ছিল। কেনো জানিনা বুঝতে পারছিলাম না কোনদিকে যাবো। সামনে যে রাস্তা পড়লো ঢুকে গেলাম। জানি হারাবো না আর যায় হোক। তখনই হঠাৎ মেয়েটা দৌড়ে এসেছিল, কোনদিক থেকে এসেছে দেখিনি। রাস্তার অপর পাশে ছিল সে, আমার দিকেই ছিল তার দৃষ্টি। মেয়েটা আহত ছিল বেশ, সাথে ক্লান্তও। খুঁড়িয়ে হাঁটছিল সে। রাস্তা পার করে আমার দিকে পৌঁছানোর আগেই একটা গাড়ি এসে চাপা দেয় ওকে। রাস্তায় তখন মানুষ ছিল না একদম। আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে যাই। দেখি গাড়িটা একটু দুরে গিয়ে থেমেছে। গাড়ি থেকে চারটে ছেলে নেমে আসে। তখনও মেয়েটা বেঁচে ছিল, কাতরাচ্ছিল। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি চিৎকার করে লোক ডাকবো, নাকি মেয়েটার কাছে যাবো, মেয়েটাকে বাঁচাবো কিভাবে, কি করবো কিছুই মাথায় আসছিল না। ছেলেগুলো মেয়েটির কাছে এগিয়ে আসে। যখন দেখে মেয়েটি বেঁচে আছে তখন পাশে থাকা বড় ইটের টুকরো তুলে বারি মারে মাথায়। মেয়েটা নিমিষেই নিশ্চুপ হয়ে যায়। তারপর ওরা আমার দিকে ফিরে এগিয়ে আসতে শুরু করে। আমি জানিনা আমার কি হলো তখন, খুব জোরে চিৎকার করতে আরম্ভ করলাম। তারপর কি হয়েছে মনে নেই।”
কথা শেষে শিল্পের কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে থাকে তনু। শিল্প তার মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করে,
“আজ কোথায় ছিলে তনু?” তনু সেভাবে থেকেই বলতে থাকে,
“হঠাৎ মনে হলো নুযহাতের সাথে দেখা করা হয়নি। আমি জানি না তখন মনে হলো আমি সেই সময়ে চলে গেছি যে সময়ে ওর সাথে দেখা হবার কথা ছিল। আমি কিছু না ভেবেই বেরিয়ে পড়ি। তখন এই রাস্তাটা খুব পরিচিত মনে হতে থাকে। সেখানে পৌঁছানোর পর সব কেমন ফ্ল্যাশব্যাকের মতো মনে পড়তে শুরু করলো।”
“আপনি কি সবার চেহারা দেখেছেন?”
“হুম” তনু মাথা নাড়িয়ে জানান দেয়।
“এইবার দেখি কে আটকায়।”
তারপর সবটা শাহেদের কাছে সহজ হয়ে যায়। কোর্টে প্রমাণ প্রদান করা হয়। কেস চলতে থাকে দীর্ঘদিন। তারপর শেষ শুনানি জানানো হয়।
সে ঘটনা এখন অতীত। এখন ফিরে আসি তনু, শিল্পের বর্তমান অবস্থায়।
আজ তনুর জন্মদিন। জন্মদিনে বিশেষ কিছু করা তনুর কখনোই পছন্দের ছিলনা। তবে তার ইচ্ছে ছিল প্রতি জন্মদিন সে পথশিশুদের সাথে কাটাবে, নয়তো কোনো বৃদ্ধাশ্রমে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তা কখনো পূরণ হয়নি।
আজ সেই আশা পূরণ করতেই তনুকে নিয়ে বেরিয়েছে শিল্প আশেপাশের এক এতিম খানায়। সারাদিন ছোট্ট বাচ্চাদের সাথে কাটিয়ে বাড়ি ফিরতেই রাত হয়ে আসে।
পূর্ণিমা রাতে ঝলমল করছে চারপাশ। রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছে দুজনে।
“তনু।”
“হুম।”
“আজকের দিনটা কেমন কাটলো?”
“ভালো।”
“শুধু ভালো?”
“না অঅঅনেক ভালো।”
আকাশে চাঁদ আর মেঘের খেলা চলছে। তারার দেখা নেই। আজ বোধহয় তারারা ছুটিতে আছে।
কিছুক্ষণ নিরবতা শেষে তনু বললো,
“শুনুন।”
“বলো।”
“আজ না আমার জন্মদিন, কিছু বাচ্চাদের খাওয়ানোর কথা। কখন যাবেন? রাত যে হয়ে এলো।” শিল্প অবাক চোখে তনুর দিকে তাকালো। তনু প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। শিল্পের উত্তর না পেয়ে তনু বলে উঠলো।
“কি হলো যাবেন না? কখন যাবেন?” শিল্প জোরে শ্বাস ফেলে বললো,
“আজ নয়, অন্য একদিন যাবো। আজ যে রাত হয়ে এসেছে।”
“আপনি সবসময় এমন করেন। আমাকে কোথাও নিয়ে যান না। ধুর।” মুখ ফুলিয়ে কথাগুলো বলেই দ্রুত পায়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকলো তনু। শিল্প অভিমানী তনুকে দেখে মান ভাঙানোর কোনো প্রচেষ্টা করলো না তৎক্ষণাৎ। তার শুধু ভয় হলো, গভীর ভয়, হয়তো কোনো একদিন তনু তাকেও ভুলে যাবে।
শেষবার ডাক্তারের সাথে দেখা করার কথা মনে পড়লো শিল্পের।তিনি বলেছেন দিনগুলো এভাবেই যাবে, তনু শুধু ভুলতেই থাকবে। একদিন হয়তো সে নিজেকেই ভুলে যাবে সাথে শিল্পকেও। সেদিন বোধহয় ঘনিয়ে আসছে। শিল্প বলেছিল ভাল হবার কি কোনো রাস্তা নেই। ডাক্তার জানিয়েছেন, যদি আল্লাহ চান।
শিল্প আর এসব ভাবতে চায় না। যেক’টা তারা একসাথে আছে, সে দিনগুলো সে ভালো কাটাতে চায়। স্মৃতির খামে মুড়ে রাখতে চায় মূহুর্ত গুলো।
“তনু, দাড়াও।” শিল্প ছুট দিলো তনুর পিছে।
“খবরদার আপনি আমার পিছু আসবেন না।”
“রাগ করে না লক্ষ্মী পাখিটি।”
“আমি কোনো পাখি নই, আমি তো খারাপ, আমি পঁচা।”
“কে বলেছে তুমি খারাপ, তুমি পঁচা। তোমার মতো ভালো কেউ আছে নাকি।”
“হয়েছে এজন্যই তো ঘুরতে নিতে চেয়েও নেন না।”
“কাল সত্যি নেবো। যেখানে যেতে চাও সেখানেই।”
“দরকার নেই।”
“কান ধরছি, আর ভুল হবে না।”
“লাগবে না আপনার কান ধরা, বলেছি না পিছু পিছু আসবেন না।”
“তোমার পিছু যাবো না তো কার পিছু যাবো। তুমি ছাড়া আমার কে আছে।”
“জাহান্নামে যান তাও আমার পিছু আসবেন না।”
“আমি তোমার পিছু ছাড়বো না, আসবোই।”
“ধুর।”
তনু দ্রুত হাঁটতে থাকে। মাঝে মাঝে হাঁটা দৌড়ে পরিণত হয়। শিল্পও পিছু পিছু হাঁটছে, তনুর মান ভাঙাচ্ছে, হরেক রকমের কথা বলছে। আর রাত জাগা পাখিগুলো তাদের দেখছে আর হাসছে।
সমাপ্ত