এক পা দুপা
সিজনঃ ২
পর্বঃ ১৩
বের হতেই দেখে সোফায় বসা তনু। খুব স্বাভাবিক, হাসছে রক্তিমের সাথে। শিল্প সেখানে যেতেই তনু তার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
“এই আপনি ওখানে কি করছেন? এখনো ফ্রেশ হননি।” শিল্প হতভম্ব দাঁড়িয়ে আছে। তনু ফের বললো,
“কি হলো?”
“নাথিং, এই যাচ্ছি ফ্রেশ হতে।” নিজেকে সামলালো শিল্প।
“হ্যাঁ জলদি যান।” তারপর রক্তিমের পানে তাকালো। রক্তিমের হাতে খেলনা, সে তা নিয়ে ব্যস্ত। জাগতিক কিছু নিয়ে তার মাঝে কোনো চিন্তা নেই। প্রকৃতিতে ঘটা কোনো ঘটনায় তাকে খুব একটা প্রভাবিত করে না, করলেও তার স্থায়িত্ব সামান্য বলা চলে। তনু গভীর মনোযোগে রক্তিমের খেলার মাঝে হারিয়ে গেছে। হঠাৎই নিজের দৃষ্টি শিল্পের দিকে ফিরিয়ে নিলো। বললো,
“আচ্ছা আমাদের সন্তানও রক্তিমের মতো মিষ্টি বাচ্চা হবে, তাইনা?”
“আমাদের বাচ্চা!” অতি আশ্চর্য হলো শিল্প।
“ওমা ভুলে গেলেন নাকি, ওহ্ আপনাকে তো আগে বলিনি তাই রাগ করেছেন? আরে নিজের সন্তানের উপর কেউ রাগ করে। কান পেতে দেখুন পিচ্চুটা হাসছে।”
তনু হাসতে শুরু করলো। তার অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে হতভম্ব শিল্প। শুধু শিল্প না পরিবারের সকলেই মারবেলের মতো চক্ষু খুলে তাকিয়ে আছে তনুর দিকে। আবার বারে বারে শিল্পের দিকেও তাকাচ্ছে। কি বলছে তনু, বাচ্চা! বাচ্চা কোথা থেকে আসবে?
______________
রাতটা কেটে গেলো কোনোমতে। তনু কিছুসময় পর নিজে থেকে ভুলে গিয়েছে সবটা। শিল্প কেস সম্পর্কে বা তনুকে ডাক্তার দেখানো সম্পর্কে কাউকে কিছু জানায়নি। আজকে অফিস শেষে থানায় যাবে সে। জানেনা কপালে কি আছে। একবার ওই পুলিশের সাথে কথা বলা যেতে পারে। থানার ওসি কি তার সাথে কথা বলবে? ভাবতে গেলে অনেক ভাবনারা ডানা মেলবে, এরচেয়ে ভাবনার রেশ কাটিয়ে বাস্তবতাকে আঁকড়ে ধরায় ঠিক হবে।
তনু ঘুমের মাঝে হাসছে, মুচকি হাসি। মুচকি হাসির মতো সুন্দর হাসি বুঝি আর নেই। নিজেকে বাহিরে যাবার জন্য প্রস্তুত করে তনুর পাশে গিয়ে বসলো শিল্প। জীবনের উঁচু নিচু সময় কম পার করেনি দুজনে, উত্থান পতনের এই খেলায় কবে তারা বিজয়ী হবে, জানেনা তারা। তবু চলতে হয়, মুখোমুখি হতে হয় অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত সময়ের, অনাকাঙ্খিত ঘটনার।
আমি খুঁজে নাহি পাই, আমার অন্তরায়,
ক্লান্ত হয়ে যায়, এই বৃথা মোহনায়।
আমি স্বপ্ন হতে চাই, যা তোমায় হাসায়,
তবু দুঃখ হয়ে যাই, যা নিজকে কাঁদায়।
আমি খুঁজে নাহি পাই, আমার অন্তরায়।
তনুর কপালে চুমু এঁকে বেরিয়ে এলো শিল্প। নাস্তা করে তনুর খেয়াল রাখতে বলে বেরিয়ে পড়লো অফিসের উদ্দেশ্যে। সবাইকে জানিয়ে গেলো তনুকে যেন ডাকাডাকি না করা হয়।
_____________
অফিসে প্রবেশ করতেই দেখা হয়ে গেল আমিনুল সাহেবের সাথে। তিনি যেন শিল্পের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। শিল্প প্রবেশ করতেই তার কাছে এগিয়ে এলো। চারিদিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “কি খবর ভাই, ডাক্তার দেখালেন?”
ভদ্রলোকের চোরের মতো ভাব দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো শিল্পের। উনি একটু অগোছালো হলেও মানুষ ভালো এটুকু বুঝেছে শিল্প। শুধু তাঁর হাব ভাব গুলোই বেশ বিরক্তিকর।
“দেখালাম, টেস্ট করতে দিলো। রিপোর্ট নিয়ে যেতে বলেছে।”
“ওহ্, কি বোঝা যায় খারাপ কিছু নয়তো।”
“খারাপ কিছু মানে!”
“আরে মেনটাল ডিজিস কিন্তু ওই মানে পাগল হবার পূর্বলক্ষণ।”
“কি বলছেন যা তা।” বিরক্ত হলো শিল্প। এ কারণেই লোকটাকে তার ভালো লাগে না।
“আরে ভাই এভাবেই তো শুরু হয়। ধীরে ধীরে সব ভুলে যাবে, রাগ করবে, মারবে। তারপর একেবারে দড়ি দিয়ে বেধে রাখা পাগলে পরিণত হবে। আমি ভয় পাচ্ছি তোমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আরে আরে কই যান কথা তো শেষ হলো না।” শিল্প প্রস্থানদ্যত হতেই ডেকে উঠলেন আমিনুল।
“আপনার কথা আপনার কাছেই রাখেন দয়া করে। এতো জানতে হবে না আমার।”
নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে শিল্প। আমিনুল সাহেব এতে মোটেও দমে না। সে নিজের মতো পুরোটা সময় কথা বলে কাটিয়ে দেয়।
____________
থানায় সাধারণত প্রচুর ভিড় থাকে। সারাদিন ক্যাঁচক্যাঁচ জোর ছ্যাচরে গরম থাকে মহল। সোহান শিল্পকে নিয়ে থানা থেকে একটু দুরে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে যাবার সাহস হচ্ছে না শিল্পের। যদি পুলিশ সন্দেহ করে। ওই অফিসার যদি কিছু করে। আশ্চর্যের বিষয় এখনো অফিসার তাদের এখনো ডাকেনি বা কোনো যোগাযোগ করেনি। ব্যাপরটা খটকা লাগছে। অনেকটা সময় পার হয়ে গেলো কিন্তু সোহানের পরিচিত হাবিলদারের দেখা মিলল না।
“লোকটা কি আসবে না?”
“টাকা খেয়েছে না আসলে খবর আছে।”
“আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।”
“যতক্ষণ না আসবে।”
“না আসলে কি সারারাত অপেক্ষা করবো।”
“দরকার হলে তাই করবো।”
সোহানের নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দেওয়াতে প্রচন্ড রাগ হয় শিল্পের। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। মাথা ধরেছে খুব, অফিসের ঝামেলা শেষে সরাসরি এখানে। দুপুরে খাওয়াও হয়নি, সঠিকভাবে বলতে গেলে খাবার ঢুকছে না ভেতরে। তারা দাঁড়িয়ে আছে কম সময় হয়নি। এখনো লোকটার আসার সময় হলো না। মাথা চেপে পায়চারি করতে শুরু করলো শিল্প। সোহান সেদিকে নজর দিলো না। আরো মিনিট দশেক পর হেলতে দুলতে হাজির হলেন দাবিলদার রফিকউল্লাহ। পেটানো উদর, জীর্ণ দেহ, কয়লার মতো দেহবদন। এসেই বড় করে সালাম দিলেন তিনি।
“আসসালামু আলাইকুম সোহান ভাই।”
“ওআলাইকুমুসসালাম, অনেক সময় দাঁড়িয়ে আছি ভাই।”
“কি করুম, সরকারি কাম করি, কাম ছাইড়ে আহন যায় নি।”
“সেসব কথা ছাড়েন, আসল কথা কন।”
“মেলা খবর আছে, তয় চা খাওয়ার ফিস যদি দিতেন।”
“সে তো আগেই দিসি।”
“খবর নেওয়ার লাইগা দিসেন। খবর তো নিয়া আসছি। ব্যাটরির চার্জ শেষ। অহন কি করুম।” সোহান পাঁচশো টাকার নোট বের করতে নিতেই শিল্প আটকায়।
“তুই এই লোকের কথা বিশ্বাস করে টাকার পর টাকা ঢালছিস। আমার তো মনে হয় লোকটা আমাদের ধোঁকা দিচ্ছে।”
“কি কন ভাই, ধোঁকা দিমু ক্যান। এসব কামে আমরা সৎ থাহি। বিশ্বাস না হইলে যাইগা।”
“আরে তুই থাম। রফিক ভাই আপনি বলেন।” রফিকউল্লাহর পকেটে চকচকে নোটটা ঢুকিয়ে দিতেই লোকটি বলতে শুরু করলো ঠিক যেন চাবি দেওয়া পুতুল, টাকা ছিল তাঁর চাবি।
“হেই মাইয়ারে যারা মারছে হেরা মাইয়ার বন্ধু লাগে। নেতার পোলা আছে মইধ্যে। সবগুলান বড়লুক(বড়লোক)। যেই মরছে হেইও বড়লুক। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলতাছে। তাড়াতাড়ি আদালতে উঠবো কেস। সবগুলান রে ধরসে পুলিশে।”
“কবে ধরলো?”
“কালকা রাতে ধরসে। মেলা ঝামেলা চলতেছে। আপনেরা খবর দেহেন না। আজকা সব চ্যানেলে দেহাইতাছে।”
সোহান বোকার মতো শিল্পের দিকে তাকালো। শিল্পের চোয়াল শক্ত হচ্ছে।
“তাইলে টাকা নিলেন কি কামে।” একটু রেগেই বললো শিল্প।
“আপনে গো কামই তো কইরা দিলাম।”
“উদ্ধার করছিস শালা।” শিল্প মারতে উদ্যত হতেই সোহান তাকে সামলে নিলো। টেনে সরিয়ে নিলো খানিক দুরে।
“এখানে উত্তেজিত হওয়া ঠিক হবে না। চুপ থাক।”
“আর একখান কথা কওয়ার ছিল।”
“আবার কথা বলিস, তোরে তো শালা।” আবার তেড়ে আসতে নেয় শিল্প। ফের আঁটকায় সোহান।
“আরে থাম, আমরা থানায় আছি।”
“থানার কাছে আইসা পুলিশরে ধমকাও মিয়া। আর কিছু কইতাম না মিয়া।”
“আরে দাঁড়ান ভাই।” শিল্পকে দুরে সরিয়ে রফিকউল্লাহর কাছে এগিয়ে আসে সোহান।
“ও মাথা গরম মানুষ, ওর কথা আমলে নিয়েন না।”
“সেই, পুলিশের সামনে এতো গরজ ভালা না। যায় হোক উনার বউয়ের সামনে মেলা বিপদ।”
“বিপদ মানে?” শিল্প নিজেও এগিয়ে এলো।
“দেখ আবার কোন ফাউল গল্প শোনায়।”
“দেখেন বেশি কইলে চইলা যাবো।” সোহান পড়েছে মহা ফ্যাসাদে।
“তুই থাম তো, ওদিক যা। আপনি বলেন ভাই।”
রফিকউল্লাহ একবার শিল্পের দিকে তাকালো তারপর বলতে থাকে,
“খুনিদের ধরলেও তাদের বিরুদ্ধে স্ট্রোং কোনো প্রমাণ নাই। কারণ হেরা খুব ভালো বন্ধু। তবে স্যারে মনে করতাছে আপনের বউ কিছু জানে। মানে কইতাছি আই উইথনেস হিসেবে তারে পেশ করা যাইতে পারে। তাই হেও এই কেসের একটা অংশ। এখন কথা হইতাছে গিয়া খুনি গো মধ্যে একজনের বাপে তো হইলো গিয়া নেতা। হেরা ঝামেলা করবার পারে।” শিল্প কিছু একটা ভাবলো।
“আপনি বললেন ওদের কাল ধরা হয়েছে। ওদের ধরা হয়েছে কখন মানে কটার সময় বলতে পারবেন?”
“রাত্রে এই দশ এগারো নাগাদ। মরা মাইয়ার বাপ মার টাকা আছে ভালোই। তাই এদের মইধ্যে যুদ্ধ হইতাছে সমানে সমানে।”
শিল্পের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো সবটা। কাল রাতে সেখানে কালপ্রিটগুলো ছিল। আর তারা এই বিষয় নিয়ে তখন কথা চালিয়ে যাচ্ছিল। শিল্প সোহানের দিকে তাকালো, সোহান আগে থেকেই তাকিয়ে ছিল তার দিকে।
____________
রাস্তায় যেতে যেতে দু বন্ধুতে অনেক কথায় হলো। দরকারি অদরকারি হরেক কথা। দুশ্চিন্তার পারদ যেন গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলো। তাদের মাথায় হাবিলদারের বলা কথাগুলোই ঘুরে ফিরে আসছিল।
“আপনেরা সাবধানে থাকবেন। স্যারে কয়েকদিনের মইধ্যে কেস কোর্টে তুলবো। আপনার বউ হইলো পাক্কা সাক্ষী, এইডাই মনে হইতাছে স্যারের কাছে। তাছাড়া আপনের বউয়ের চিৎকার শুইনাই আশেপাশের মানুষ আইছিল।”
“ওর চিৎকার শুনে?”
“হো দোকানদার গুলা তাই কইলো। জায়গাটা ভালা ছিল না। মানুষ কম চলে হেন(সেখান) দিয়ে। ওই ভাঙা বাড়ির দিকে কেউ খোঁজ রাখে না। আড্ডা তো তাগো আগে থাইকা চলতো। নেতার পোলা কি কইবো। আর এই কেস অন্যভাবেও প্রমাণ করা যাইবো কিন্তু টিকবো না।কেউ যদি দেইখা থাকে তাহলে কেস শক্ত হইবো। তাই সামনাসামনি যে দেহে সেই বেশি দামি হয়। আপনেরা সাবধানে থাইকেন।”
টাকা বিফলে যায়নি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা গিয়েছে রফিকউল্লাহর কাছ থেকে। বিষয়গুলো হয়তো তারা জানতে পারতো আজ না হয় কাল। কারণ উভয়পক্ষের জন্য তনু দরকারী। একপক্ষের জন্য প্রয়োজনীয় অপরপক্ষের জন্য বিপদ। কিভাবে রক্ষা করবে তনুকে শিল্প? তার উপর কি এক অসুখ বাসা বেঁধেছে কে জানে। রিপোর্ট হাতে না আসা পর্যন্ত কিছু বলাও যাবে না।
সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় তনুর কিছু মনে নেই। যেখানে সেই প্রধান চরিত্র সেখানে তারই কিছু মনে নেই।
“আহ্ আমি পাগল হয়ে যাবো।” দুহাতে মাথা ঝাকিয়ে বলে উঠে শিল্প। সোহান কাঁধে হাত রাখে।
“এতো ভাবিস না, আল্লাহ সাহায্য করবেন। ভরসা রাখ।”
বাড়ির বাইরে অপরিচিত মানুষের জুতো দেখেই তারা বুঝে যায় কেউ এসেছে। দুজনে একে অপরের দিকে দেখে দ্রুত পায়ে প্রবেশ করে ভেতরে। ড্রইংরুমের কাছাকাছি আসতেই চোখাচোখি হয় সেদিনের মহিলাটির সাথে। বড় টিপ পড়া, সিঁথি ভরা সিঁদুর, আভিজাত্য ধরে রাখা বিধ্বস্ত এক রমণী। ভেজা পাপড়িগুলোও যেন আর্তনাদে ব্যস্ত। শিল্পের মনে হলো ছলছল চোখে মমতাময়ী এক মা তার সামনে আঁচল পেতে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে আঁচল পূর্ণ করার মতো সম্পদ যে তার নেই।
মেহবুবা তানজীম
চলবে…
(ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।)