এক পা দুপা
সিজনঃ২
পর্বঃ১২

ডাক্তারের সামনে বসে আছে শিল্প। তনু বাইরে বসা। সময় সুযোগ নিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলা জরুরী। শিল্প নিজেই তনুর সকল সমস্যা তুলে ধরছে ডক্টরের সামনে। সব শোনার পর ডাক্তার তনুকে ভেতরে আসতে বললো। তনুর সাথে কিছু সময় কথা বললো। তার আর কোনো শারীরিক সমস্যা আছে কিনা। এম আর আই টেস্ট দিলো। বললো টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে দেখা করতে। কাজ শেষে বের হয়ে এলো তনুকে নিয়ে।

“আমরা এখানে কেনো এসেছিলাম?”
“রেগুলার চেক-আপ।”
“কিসের জন্য?”
“তোমার এক্সিডেন্ট হলো না, তারপর তো ডাক্তার দেখানো হলো না। তাই আজ এলাম।”
“এক্সিডেন্ট! আমার কবে এক্সিডেন্ট হলো?” শিল্প অবাক হয়ে তাকালো। তাকিয়েই থাকলো।

“কি হলো বলুন।”
“না কিছু না।”
“না কিছু না মানে কি। নিশ্চয় কিছু, বিরাট কিছু। আপনি বলুন, কিছু তো একটা আছে মনে পড়ছে না।”
“তেমন কিছু না তনু, চলো আইসক্রিম খেয়ে আসি।”
“আপনি কথা ঘোরাচ্ছেন।”
“না কথা ঘোরাচ্ছিনা, চলো তো।”

শিল্প তনুর হাত ধরে আইসক্রিম পার্লারে নিয়ে গেলো। আইসক্রিম খেতে খেতে শুরু হলো তাদের পথ চলা। তনু বললো,
“হেঁটে হেঁটে যাবো কিন্তু।”
“আরে হেঁটে কেনো!”
“ভালো লাগছে, চলেন হাঁটি।”
আজও আকাশে চাঁদ নেই। নিয়ন আলোতে কপোত-কপোতী হাঁটছে রাস্তার কোণ ঘেষে। পাশ দিয়ে শো শো করে পার হয়ে যাচ্ছে যানবাহন। রিকশার টুংটাং বেল বাজার শব্দ কানে আসছে। রাস্তাটা জনবহুল বলা চলে।

শিল্পের আইসক্রিম হাতের মাঝে গলে যাচ্ছে। সে চিন্তিত, কারো সাথে পুলিশি বিষয়ে কথা বলা হয়নি। কথা বলা প্রয়োজন, কি করা যায় সেটাও তো ভাবতে হবে। এতো চিন্তা সে আর নিতে পারছে না।

“আরে আপনার আইসক্রিম তো গলে যাচ্ছে।”
শিল্প নিজের হাতের পানে তাকালো। কখন যেন সেসব গলে হাত থেকে কবজিতে চলে গেছে, কবজি বেয়ে শার্টের হাতা ভরে যাচ্ছে। হুট করেই হাত থেকে আইসক্রিম ফেলে দিলো শিল্প।
“আরে ফেলে দিলেন কেনো?”
“ভালো লাগছে না, চলো।”

তনুর হাত ধরে এগোতে লাগলো শিল্প। তনুর হাতের শখের আইসক্রিম রাস্তার পিচে পতিত হতে থাকলো।

প্যাডেল চালিত রিকশায় খুব অস্থির ভাবে বসে আছে শিল্প। পাশে তনু তার দিকেই রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে আছে। যানবাহন পূর্ণ এলাকা নিস্তব্ধ, নিথর লাগছে। রিকশার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দও তাদের থেকে দুরে।
বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে সোহানের উদ্দেশ্যে চলে গেলো শিল্প। সেখানে রাগান্মিত চোখে দাঁড়িয়ে থাকলো তনু।

________________

“তুই আমাকে আগে কেনো জানাসনি?”
“ঘটনাটা কালকের, আর কবে জানাবো।”
“কালকেই জানানো উচিৎ ছিল।”
“এখন তো বলেছি রে ভাই।”
“উদ্ধার করেছেন।” দু-হাত জড়ো করে মাথায় ঠেকিয়ে বললো সোহান। বেজার মুখে বসে থাকলো শিল্প।
“পুলিশের ফোন এসেছিল কি আর?”
“হুম আজ সকালে। উনি খুব দ্রুত দেখা করবেন।”
“আচ্ছা কেসের খবর কিছু জানিস? তনু কি কিছুই বলছে না?”
“কেসের খবর কেমনে জানবো? আমি কি সেসবের খবর নিয়েছি? আর তনু তো পুরোপুরি অস্বিকার করছে। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না।”
“এতো ভাবিস না দেখছি কি করা যায়।”

দু বন্ধু ভাবতে বসলো সমস্যার সমাধান নিয়ে। অনেক ভেবেও মিললো না কূল-কিনারা। মিলবে কেমনে তারা পুরোপুরি অজ্ঞ কেসটা নিয়ে।
সোহান হঠাৎ বলে উঠলো, “শোন প্রথমত আমাদের কেস সম্পর্কে সবটা জানতে হবে। মেয়েটা কে, কিভাবে মারা গেলো, বা আদার্স সব।”
“কিভাবে জানবি? তাছাড়া ওই পুলিশ তো বললো মে বি রেপ করা হয়েছে। সেখানেও আমাকে সন্দেহ করছে।”
“আরে পুলিশদের কাজই সন্দেহ করা। সন্দেহ না করলে কেস সল্ভ করবে কেমনে। যায় হোক তুই দোষী না এটা তারা এমনিই জেনে যাবে। এখন শুধু চিন্তা তনুকে নিয়ে। আসলে ও সেখানে কি কাজে গিয়েছিল? বা ওখানে ঘটেছিল কি?”
“আজ ডাক্তারের কাছে গেছিলাম। টেস্ট দিয়েছে, কাল করাবো।”
“মনে না থাকার সমস্যা নিয়ে কথা বললি।”
“হ্যাঁ।”
“কি বললো ডাক্তার?”
“রিপোর্ট পাবার পর সব জানা যাবে। তারপরই তনুর সমস্যার সমাধান হবে। ডাক্তার সন্দেহ করছে তনু মেন্টালি স্টেবল না।”
“আমারও সেটাই মনে হচ্ছে। ও স্ট্রেস নিতে পারছে না। তারপর দেখ তোকে সেদিন সহ্য করতে পারছিল না সেই আজ তোর সাথে আছে, ভাবা যায়।”
“আমি আগেই বিষয়টা নিয়ে ভয় পেয়েছিলাম। তাছাড়া মাথার আঘাতটা ভালো ছিল না। আমি আরো খারাপ কিছুর আশংকা করেছিলাম। জ্ঞান ফেরার পর ভেবেছিলাম তনু খুব সিনক্রিয়েট করবে, রাগবে বা অন্যরকম আচরণ করবে। কিন্তু ওর আচরণে সেদিন তব্দা খেয়েছিলাম। এতোটা শান্ত আচরণ আশা করিনি, তারপর হঠাৎ এগ্রেসিভ আচরণ। দেন এমন ভাবে চলাফেরা করলো যেন কিছুই জানে না সব ঠিক আছে।”
“রিপোর্ট না আসলে কিছুই বলা সম্ভব না। কাল না হয় একবার থানা থেকে ঘুরে আসি।”
“কি করবি গিয়ে, সকালের পর পুলিশ আর আমাদের সাথে কন্টাক্ট করেনি। আমরা যদি বেশি মাথা ঘামায় তবে তো ব্যপারটা সন্দেহজনক হবে ”
“বাল হবে, সমস্যা আমাদের সমাধান আমাদেরই করতে হবে। তাছাড়া বিষয়টা জানতে হবে। আমার পরিচিত হাবিলদার আছে ওখানে। কাল অফিস থেকে ফেরার পথে আসিস যাবো দুইজন।”
“আচ্ছা।”

_____________

বাড়ি পথে রওনা দিতে গিয়ে কি মনে করে শিল্প এক্সিডেন্ট স্পটের দিকে রওনা হলো, যেখানে মেয়েটাকে আহত অবস্থায় আর তনুকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে।
কলেজ থেকে পনেরো মিনিটের পথ। তবে কলেজের আশপাশে যেমন চাঞ্চল্যতা বা মানুষের আনাগোনা এদিকে তেমন নেই। দু একটা রোড লাইট টিপটিপ জ্বলছে। নিষুতি রাতে তা যেন নিস্তব্ধতাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। তিন চারটা বন্ধ দোকানপাট। শিল্প ঘুরে ঘুরে জায়গাটা পর্যবেক্ষণ করছে। গাছপালাও তেমন বেশি নেই, সরু রাস্তা। দু একটা বাড়ি। রাস্তাট্ প্রস্থতে খুব সংকীর্ণ। ঠিক মেইন রোড থেকে দোকানপাটের কাছাকাছি আসা পর্যন্ত যেই অংশ সেটাই মূলত বেশি নিঝুম। রাস্তার পাশে ভাঙা বিল্ডিং। বিল্ডিংয়ের চারপাশে আগাছায় ভরপুর। শিল্প সেদিকে এগিয়ে গেলো। যদি কিছু জানা যায়। কাছাকাছি যেতেই কিছু মানুষের আওয়াজ পাওয়া গেলো। বিল্ডিং খুব পুরোনো, হাত দিয়ে বুঝলো ইট থেকে সিমেন্ট বালু খসে পড়ছে। ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলো শিল্প। ষাট ওয়াটের বাতি জ্বলছে ভাঙা রুমটাতে। সেখানে কয়েকটা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে, একজন মেয়েও আছে। প্রত্যেকেই নেশায় আচ্ছন্ন। আশ্চর্য এতো রাতে ছেলে মেয়েরা বাইরে বাবা মা কি একটুও চিন্তা করে না! উঠতি বয়সী একজন মেয়ে ছেলেদের সাথে বসে নেশা করছে, সত্যি কখনো এমনকিছু দেখতে হবে ভাবেনি শিল্প।

তারা কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। শিল্প কান পাতলো তাদের কথা শুনতে।
“তোর বাপে কিছু করতে পারবে তো?” লাল গেঞ্জি পড়া ছেলেটা বলে উঠলো।
“আরে পারবো না আবার। কমিশনারের পোলা আমি, এতো সহজ ধরা।” এলোমেলো চুলের ছেলেটা সিগারেটে একটা টান দিয়ে বলে উঠলো। তার কথায় হেসে উঠলো চারটি ছেলের মধ্যমণি মেয়েটা। বললো,
“তা আর বলতে। এর লাইগা তোরে এত্তো ভালো লাগে।” ছেলেটিও হাসিতে তাল মিলালো সাথে বাকিরা।

তাদের মাঝে চুপচাপ ছেলেটি অনুসন্ধানি চোখে চারপাশে দেখতে শুরু করলো। ওদেরকে থামতে বলে, ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বললো। তাতেই সবাই তটস্থ হয়ে গেলো। কোণা চোখে তারাও চারপাশ পরখ করতে আরম্ভ করলো। শিল্প দুর থেকে সবটাই দেখছে কিন্তু তাদের মধ্যে চলা ইশারা ইংগিতের কথাগুলো বুঝতে পারছে না। তবে এটুকু বুঝেছে এখানে আর দাঁড়ালে বিপদ আছে। সম্ভবত তারা কারো উপস্থিতি টের পেয়েছে। ওরা নেশাগ্রস্থ যেকোনো কিছু করা ওদের পক্ষে সম্ভব।

শিল্প দ্রুত পা চালিয়ে সেখান থেকে সরে আসে। একটা কোণে গিয়ে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে পড়ে নয়তো ধরা পড়ার চান্স খুব বেশি। ছেলেগুলো টর্চের আলো জ্বালিয়ে চারিদিক কিছু সময় পায়চারি করলো। তারপর আবারো সেই ভাঙা রুমে ঢুকে গেলো। তারা ভেতরে যেতেই শিল্প বাড়ির পথে হাঁটতে আরম্ভ করলো।

এতোটা সময়ে সে একজন কেও এই রাস্তায় হাঁটতে দেখেনি। সম্ভবত সে কারণেই এই ছেলে মেয়েরা অবাধে খারাপ কাজ করে যাচ্ছে।
এখন চিন্তার বিষয় হলো কি বিষয়ে তারা কথা বলছিল? এরা আবার কৃষ্ণা মেয়েটার খুনের সাথে জড়িত নয় তো? কিছু একটা বিষয় নিয়ে তো আলোচনা হচ্ছিল। সম্পুর্ন আলোচনা শুনতে পারলে ভালো হতো।

____________

বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা পার হয়ে যায়। তখনো সবাই জেগে আছে তার জন্য। বেশ ভালো লাগে শিল্পের। শিল্পকে দেখে রক্তিম সোফায় বসে বড়দের মতো পায়ের উপর পা তুলে বলে,
“এতো লেট কেউ করে। জানোনা রাত করে বাইরে থাকা ব্যাড ম্যানার্স।”
“ভুল হয়ে গেছে বাবা আর হবে না।”
“ইটস্ ওকে, লাস্ট টাইম মামু।” শিল্প হেসে দিলো।
নাজমা বললেন, “খাবার কেউ খায়নি কিন্তু, যাও ফ্রেশ হয়ে আসো, খাবার বারছি।”
“অপেক্ষা করার কি ছিল খেয়ে নিতে তোমরা।”
“সে তুমি বুঝবে না।”

সবাই থাকলেও তনু নেই ড্রইংরুমে। টিভি তে সিআইডি চলছে। খুব মনোযোগের সহিত করিম আর রাকা দেখে চলেছে। একটা মার্ডার কেস সল্ভ করছে সিআইডিরা। সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে শিল্প নাজমাকে জিজ্ঞেস করলো, “তনু কোথায় মা?”
“রুমে আছে। ওকেও ডেকে এনো।”
শিল্প রুমের দিকে চলে গেলো।

“আমি তনুনিমা এহসান ডটার অফ আ সিংগেল মাদার নিবেদিতা এহসান।” শিল্প রুমে ঢুকতেই জানালার সামনে দাঁড়ানো তনুকে বিরবির করতে দেখে। কাছাকাছি যেতেই বারবার উপরের উক্তি কানে আসে শিল্পের। ভ্রু কুঁচকে তনুর কাছে এগিয়ে যায়। কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠে দুরে সরে দাঁড়ায় তনু।

“আপনি কে?” আতংকিত তনু প্রশ্ন করে। শিল্প প্রচন্ড চমকে উঠে।
“আমি কে মানে! আমায় চেনো না?”
“না, আমি এখানে কিভাবে এলাম। কে আপনি?”
“তনু কি বলছো? আমি শিল্প, তুমি আমাকে কিভাবে ভুুলে যেতে পারো। তনু আ’ম ইয়োর হাজবেন্ড।”
“কি বলছেন পাগলের। আমার তো বিয়েই হয়নি। কোথায় আমার মা কোথায়? আমি কোথায়?”
চমকের পর চমক, কি বলছে তনু এসব! তাকে চেনে না তনু! প্রায় দেড় বছরের পবিত্র সম্পর্ককে মনে নেই তনুর! কি হচ্ছে এসব? শিল্পের মাথা পাগল হবার জোগাড়।

শিল্পের চিন্তার মধ্যে বেরিয়ে পড়ে তনু। কেমন অস্থির তার কার্যকলাপ। শিল্পের হুঁশ আসতেই দৌড়ে বেরিয়ে পড়ে।

চলবে……..
মেহবুবা তানজীম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here