এক পা দুপা
সিজনঃ ২
পর্বঃ ১১

“ভেতরে আসবেন না?” শিল্পের ঘোর ভাঙে। সাক্ষাতে লাল পরিহিতা লাস্যময়ী নারীকে দেখে সে সত্যি কল্পনার দোলাচলে দুলছিল। সত্যি মিথ্যা, দেখা অদেখার মাঝে সংঘর্ষ চলছিল এতো সময়। সত্যি তনু সামনে! ওর তো এখানে থাকার কথা না।
“কি হলো, আসুন।” তনুর মুখে ফুটন্ত লাল গোলাপের বিস্তৃতির মতো মিষ্টি হাসি। হতভম্ব শিল্প জিজ্ঞেস করলো, “তুমি এখানে?”

“হ্যাঁ, এখানে। এখানে না থাকলে কোথায় থাকবো?” তনু হেসে উত্তর দিলো।
“না মানে তুমি তো ওই বাড়ি…”
“ছিলাম, কিন্তু এখন আমি আমার শ্বশুরবাড়ি এসেছি। আপনি কি খুশি হননি।”
“না না খুশি কেনো হবো না। আমি খুব খুশি হয়েছি, সত্যি।”
“সে তো দেখতেই পাচ্ছি। আসুন ভেতরে আসুন। নাকি সারারাত বাইরে কাটিয়ে দিবেন বলে ভেবে রেখেছেন।”

তনু দরজা ছেড়ে সামনের দিকে চলতে শুরু করলো। পিছু পিছু শিল্প পা বাড়ালো। দোদুল্যমান শাড়ির আঁচল, মাথায় খোলা চুলে বেলি ফুল গাঁথা। চপল পায়ে এগিয়ে চলেছে তনু। চলার পথে এক দুবার পিছু ফিরতে ভুলেনি। নতুন এক তনুতে আবিষ্কার করেছে শিল্প। সেই লাজময়ী কন্যা আজ কৈশোরে পতিত হয়েছে যেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে চললো শিল্প।

“আপনি রুমে যান আমি আসছি।” তনু রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। শিল্প সেই অবাক জলপানের পথিকের মতো অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ছেলের এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে এগিয়ে এলেন নাজমা। তাঁর ঠোঁটের হাসিতে আজ সন্তুষ্টি, সেখানে নেই কোনো অহংবোধ, নেই হিংসা আর না বিদ্বেষ।
“কি ব্যাপার বাবা দাঁড়িয়ে আছো কেনো? রুমে যাও ফ্রেশ হও।”
“মা, তনু?” নাজমা মিষ্টি করে হাসলেন।
“হুম তনু। তনু নিজে থেকে ফিরেছে। আমার ঘরের বউ ঘরে ফিরেছে।”
“কিন্তু কিভাবে কি, মানে…”
“ওসব ভেবে লাভ নেই। যা হয় ভালোর জন্য হয়। যাও রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। দেখি আমার মেয়েটা কি করছে একা একা।”
শিল্প হেসে রুমের দিকে পা বাড়ালো। নাজমার মনে আজ অনেক আনন্দ। দিন ফিরছে বুঝি, এমন করেই চমক দিয়ে যদি সবটা ঠিক হয়ে যায় তবে হয়তো পাপের বোঝা খানিক হালকা হয়।

ফ্রেশ হয়ে বের হতেই তনুকে গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। শিল্পকে দেখেই গ্লাসটা এগিয়ে দিলো তনু। শিল্প হাসিমুখে হাতে নিয়ে নিলো গ্লাসখানা। যদিও সব হঠাৎ করে ঘটছে তাতে কি মূহুর্ত টা উপভোগ করাই ঠিক। বাইরে থেকে এসে ঠান্ডা লেবুর শরবত সত্যিই প্রশান্তিকর। বিছানায় বসে তনুর দিকে তাকিয়ে তিন চুমুকে শেষ করলো শরবত টুকু।
“থ্যাংক্স।” গ্লাস তনুর হাতে দিয়ে বললো। তনু একটু মুখ বাকিয়ে বললো, “হুহ্ ঢং।”

চপল পায়ে ছন্দ তুলে চলা রমণীর বহির্গমণের পাণে তাকিয়ে থাকলো শিল্প। আজ একমূহুর্তের জন্য চোখ ফেরানো দায়। দরজার কাছে গিয়ে থামলো তনু।
“শুনুন মহাশয় নিচে আসুন জলদি। আধাঘন্টার মধ্যে খাবার বাড়ছি, সবাই একসাথে খাওয়া পর্ব চলবে।” চলে গেলো তনু।
“এতো জলদি?”
“জ্বি এতো জলদি।”
সবকিছু কল্পনা লাগছে শিল্পের কাছে, মনে হচ্ছে এই ভেঙে গেলো সুখস্বপ্ন। কিন্তু না সবটা সত্যি, তার চোখের জল সবটা প্রমাণ করছে। শিল্পের এই মূহুর্ত গুলোকে আটকে রাখতে ইচ্ছে করছে। সময় থামিয়ে দেওয়ার কোনো মেশিন থাকতো যদি, তবে কি খুব ক্ষতি হতো। ভালো সময়গুলো এতো জলদি কেনো যায়।

_________________

নিচে নেমে আশেপাশে কাউকে দেখলো না শিল্প। শুধু রক্তিম টিভি দেখছে। শিল্প ওর পাশে গিয়ে বসলো।
“কি খবর মামা টা? কি দেখা হচ্ছে?” রক্তিম চোখ বাঁকিয়ে তাকালো।
“তুমি কি অন্ধ, মামা?” শিল্প অবাক হয়ে তাকায়।
“আমাকে দেখে তোমার অন্ধ মনে হয় নাকি?”
“তাহলে তুমি দেখতে পাচ্ছ না আমি টিভিতে কি দেখছি?” শিল্প হেসে কোলে তুলে নেয় রক্তিমকে। ইচ্ছেমতো কাতুকুতু দিতে থাকে।
“ওরে বাচ্চু, বড় হয়ে গেছিস না। খুউউব চালাক।”
“হাহাহা, মামা কাতুকুতু দিও না।”
“তাই না, আমার সাথে চালাকি।”
“হাহাহা হু আমি অনেক চালাক, হাহাহা, তোমার থেকে বেশি মামীর থেকেও বেশি।” তনুর কথা শুনতেই শিল্পের হাত থেমে গেলো। রক্তিম তখনো হাসছে।
“বোকা বানিয়েছিস মামীকে?”
“না তো, মামী তো অংক পারেনা।”
“কে বলেছে তোকে?”
“মামী তো চকলেট গুনতে পারেনি।”
“কোন চকলেট?”
“আম্মু আমাকে দশটা চকলেট দিয়েছিল, বলেছিল গুনতে পারলে পাঁচটা আমাকে খেতে দিবে। আমি গুনতে পেরেছি কিন্তু মামী পারেনি। মামী দশ গুনতেও পারেনা, মামী বোকা।”

শিল্প রক্তিমকে সোফায় বসিয়ে দিলো। প্রচন্ড রকম শকড হয়েছে সে। খনিকেই নিমগ্ন হলো চিন্তায়।
তখনই তনু এসে ডাকলো খাবার রেডি বলে। শিল্প রক্তিমকে কোলে তুলে নিলো।
“চল ব্যাটা খেয়ে আসি।”

খাবার টেবিলে আগে থেকেই করিম সাহেব বসা। তিনি মহাআনন্দে পা নাচাচ্ছে প্লেট হাতে নিয়ে। সামনে হরেক রকম খাবারের পসরা, গন্ধে মো মো করছে চারিদিক। মাঝে মাঝে তিনি রসালো স্বরে বলে উঠছেন,”আহা গন্ধেই পেট ভরে গেলো দেখি। খাবো কি?” বাবাকে এতো উৎফুল্ল কখনো দেখেনি শিল্প। বরং সংসার সম্মন্ধে উদাসীন ছিলেন বরাবর।

শিল্প লম্বা শ্বাস টেনে ঘ্রাণ টেনে নিলো নিজের মাঝে। তনু তখন পানির গ্লাস নিয়ে আসছে টেবিলের কাছে। তার পিছনে নাজমা আর রাকাও আসছে।
“আজ তনু সব রান্না করেছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে বলো কেমন হয়েছে। আমরা শুধু হালকা পাতলা সাহায্য করেছি।”
“তোমরাও বসে পড়ো আপু। আমি সার্ভ করছি।” জোর করেই সবাইকে বসিয়ে দিলো তনু। নিজে সার্ভ করলো প্রতিটা খাবার। আজ অনেকদিন পর শিল্প মনভরে খাচ্ছে। শান্তিতে দু-চোখ ভরে আসছে। সবার চোখেমুখে প্রশান্তির ছোঁয়া। কতোদিন পর যেন ফিরে এলো সেই আগের মতো একসাথে বসে খাওয়ার দিন। তবে আজ কারও মাঝে কোনো অহংবোধ, বিদ্রুপ ভাব নেই। ঝাল, লবণ উনিশ-বিশ হলেও সবাই প্রশংসা করলো। সবার প্রশংসায় আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলো তনু। তার মুখে ফুল ফোঁটা হাসির দিকে নজর শিল্পের। এই হাসিতে যাদু আছে। মন ভরে দেখলো সেই লাজবন্তী হাসিমাখা মুখ।

________________

খাবার শেষে শুয়ে আছে শিল্প। তনু তখনও নিচে। শিল্প সারাদিনের ঘটনাগুলো ভাবছে। ভাবতে ভাবতে একটা সময় চোখ লেগে আসলো। হালকা ঘুম ঘুম ভাবে বুঝতে পারলো কেউ তাকে জরিয়ে ধরে শুয়ে আছে। বুকে কারও মাথা, বেলি ফুলের গন্ধ আসছে নাকে। সে বুঝতে পারলো তনু ব্যতীত কেউ না। শিল্প আঁকড়ে ধরলো তনুকে। হঠাৎ মনে হলো কেউ ডাকছে। কাঁচা ঘুম হারিয়ে গেলো নিমিষে। তনু ডাকছে, খুব সুন্দর করে ডাকছে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলছে, “উঠুন, চলুন ছাদে যাবো।” মাথা নেড়ে, মাঝে মাঝে চুলগুলো টেনে দিচ্ছে। এভাবে কেউ কাউকে ডাকে?
“কি হলো, উঠুন না। ছাদে যাবো। এতো ঘুম কিসের, উঠুন।” অগত্যা উঠতেই হলো শিল্পকে। ঘুমে পাপড়ি জরিয়ে আসছে। হঠাৎ মুখে পানি পরায় চমকে উঠলো শিল্প। চোখ মেলে দেখলো তনু হাসছে।

“তবে রে।” প্রজাপতির মতো উড়ে গেলো তনু। ছপছপ পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলো। পিছু পিছু ধাওয়া করলো শিল্প। পুরো ছাদজুড়ে শুরু হলো ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। ছুটোছুটির খেলা চলছে তাদের। একসময় শিল্পের হাতের ভাঁজে আটক পড়লো তনু।
“এবার।”
“কি?”
“কই পালাবা?”
“পালাতে তো চাইনা।”
“তাই?”
“হুম।” তনু হাসতে শুরু করলো, অকারণ হাসি।মাঝে মাঝেই আমাদের হাসির রোগ পায়, সেই হাসির নাম অকারণ হাসি। তখন কারণ ছাড়ায় হাসি পায়। তনুর হাসিটা আজ প্রশান্তমহাসাগরের অশান্ত ঢেউয়ের মতো, কলকল শব্দে মুখরিত করছে চারপাশ। বাড়ির সামনের গন্ধরাজের গাছ ভরা ফুল, গন্ধে মোহনীয় হয়ে উঠেছে রজনী। দেয়াল ঘেঁষে ছাদের মেঝেতে বসে পড়লো দুজনে। নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে পৃষ্ঠে। পরিষ্কার আকাশ ভরা নক্ষত্র মিটিমিটি জ্বলজ্বল করছে। আকাশে চাঁদ নেই, মিটিমিটি তারা আকাশকে অলংকার স্বরূপ সাজিয়েছে।

“জানো পৃথিবীর সব বালিকনা তুলনায় আকাশে অধিক তারকা আছে।” আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো শিল্প।
“কিহ্! আজাইরা। বালিকনা বোঝেন?” শিল্প হাসলো।
“তোমার কি মনে হয় বুঝি না।” তনু নিজের মাথা শিল্পের কাঁধে রেখে বসলো। তাকালো গভীর অজানায় ঢাকা নভোমণ্ডলে। কতো কি জানা অজানার আছে।
“জানি তো আপনি জানেন। তবুও ব্যপারটা কেমন না।”
“যেমনি হোক ব্যপারটা সত্যি। পৃথিবীর বালুকণা অপেক্ষা ১০গুণ বেশি নক্ষত্র আছে মহাকাশে। যার ৭০ সেক্সটিলিয়ন টেলিস্কোপ দ্বারা পৃথিবী থেকে দেখা যায়। ইউ নো হোয়াট ৭০ সেক্সটিলিয়ন ইক্যুয়াল কতো টা। ৭০ এর পর একুশটা শূন্য। ভাবো এখন।”
“আল্লাহ! এতো এতো তারা আকাশে।”
“হুম। ওইটুকু পৃথিবী থেকে দেখা যায় এ ব্যতীত আরো তো আছেই।”

“আকাশ কতো বড়, কতো গভীর, তাইনা?”
“মহাকাশ অনেক বড় অনেক গভীর। এখান থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। পৃথিবীর প্রতিটা জিনিসেই আছে শিক্ষা।”
“হুম।”

রাত্রি নিঝুম, সময় বহমান, ক্রমণ গভীর হচ্ছে রাত নিশিরাত। একজোড়া কপোত-কপোতী রাতের সৌন্দর্য অবগাহনে ব্যস্ত। দু একটা বাদুড় উড়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা বাতাস বইছে, সতেজ প্রানচ্ছল বাতাস। প্রাণভরে শ্বাস নিচ্ছে তারা।

“এই তনু একটা কথা বলা হয়নি।”
“কি কথা?”
“তোমায় আজকে খুব সুন্দর লাগছে।”
“ইশ যা তা।” শিল্পের বুকে মুখ লুকালো তনু। শিল্প ভাবলো, দোয়া করলো এভাবেই যেন জীবনের শেষটা কাটে।

_______________

শেষ রাতের দিকে রুমে এসেছে ওরা। নামাজ পড়েই শুয়ে পড়েছে শিল্প। রাত্রিটা বেশ কেটেছে। গল্পে গল্পে, নিঝুম প্রকৃতির মাঝে। কখনো সে ঘুমে গড়িয়ে পড়েছে, নাক টেনে চুল টেনে ঘুম ভাঙিয়েছে তনু। সারারাত কতো কথা বলেছে হিসাব নেই। তবে বাচ্চার কথা আর একবারও বলেনি।
তনুকে বেশ খুশি লাগছে। গুনগুন করতে করতে বিছানায় শুয়ে পড়লো। খানিক পর ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু সারারাত জেগেও ঘুম আসলো না শিল্পের চোখে। পুলিশী ঝামেলা, তনুর শারীরিক অবস্থা সবটা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছে শিল্প। না জানি সামনে কি অপেক্ষা করছে।

তনুর দিকে তাকিয়ে থেকে সকালটা পার তরে দিলো শিল্প। অফিসের জন্য রেডি হয়ে বের হবে তখনও তনুর ঘুম ভাঙেনি। কোনো নড়াচড়া না দেখে শিল্প ডাকলো না, সারারাত জাগা এমনিতেই। নিচে এসে নাস্তা করে বের হতেই আননোন নাম্বার থেকে ফোন।

“আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?”
“ওআলাইকুমুসসালাম, এতো জলদি আমাকে ভুলে গেলেন ইউসুফ সাহেব। কিন্তু আপনি ভুললেও আমি তো ভুলতে পারলাম না। যা হোক কেমন আছেন?”
“আপনি?”
“হ্যাঁ আমি। আপনাদের সাথে দেখা করার সময় এগিয়ে আসছে। বি রেডি। উই উইল মিট এগেইন ফেস টু ফেস। গুড বাই।”

ফোনটা কেটে গেলো। শিল্প তখনও ফোন কানে নিয়ে দাঁড়িয়ে। ভালো সময় বুঝি তাদের জন্য না। এই সমস্যা গুলো কবে ফুরোবে?

চলবে……
মেহবুবা তানজীম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here