#সভ্যতার_সভ্য
#দ্বাদশাংশ
#NishchupSpriha
==============
সময় বহমান… সে তার আপন গতিতে চলে। তেমনি আমার আর সভ্যর দিন যাচ্ছিলো সময়ের সাথে…
বর্তমানে আমি একটা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ক্লাস থ্রির সেকশন ‘বি’ – এর ক্লাস টিচার। ভালোই লাগে ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে।
ছোট বাচ্চারা এত দুষ্ট কিভাবে হয়? আমি এদের ক্লাস টিচার না হলে সেটা জানতেই পারতাম না। আচ্ছা আমিও কি ছোটবেলায় এমন দুষ্ট ছিলাম?
আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল মেডিকেল, সেটা না হওয়াতে ভবিষ্যৎতে কি করবো সেটা নিয়েও ভাবা হয়নি। ফ্যামিলি থেকেও কখনো কেউ প্রেশার ক্রিয়েট করেনি।
হায়ার স্টাডিজের জন্য যে বাহিরে কোথাও এপ্লাই করবো, সেটাও করিনি।
কিছু একটা করতে হবে, কিন্তু কি করবো সেটাও ভেবে পেলাম না। সরকারি চাকরির পিছনেও দৌড়ানোর ইচ্ছে নেই। অবশ্য দৌড়েও লাভ নেই, সেখানে যে কম্পিটিশন! আমার মতো অলস কখনোই টিকে থাকতে পারবে না। সবাই ওই বিসিএস আর সরকারি চাকরির জন্যই হন্যে হয়ে ঘুরে। আমার থেকেও অনেক কোয়ালিফাইড মানুষ সরকারির পিছনে ঘুরছে!
অবশেষে মাথায় ক্লিক করলো টিচিইং! যেই ভাবা সেই কাজ! ঢাকার বেশ কয়েকটা ভালো ভালো স্কুলে সিভি জমা দিলাম। রির্টানে টেকার পর কয়েকটা থেকে ভাইবার জন্য ডাকা হলো। এরপর দুটো থেকে জয়েনিং লেটার এলো।
কোনটা রেখে কোনটায় যাবো ভেবে পেলাম না! অবশেষে সকল সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করে এটায় জয়েন করলাম।
নাও আই অ্যাম এ টিচার! ‘‘টিচার্স ডে’’ – তে স্টুডেন্টের থেকে বেস্ট টিচারের উপাধি, গিফট, কার্ড, আরো অনেক কিছুই পাই।
অবাক করা বিষয় হচ্ছে ছোট ছোট বাচ্চা গুলো আমার জন্মদিন কিভাবে যেন জেনে যায়! জন্মদিনে তাদের থেকে যখন গিফট পাই নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে মনে হয়। ছোট ছোট বাচ্চা গুলো সব সময় মিস মিস করে পাগল করে রাখে! মাঝে মাঝে মনে হয় বিয়ের পর আমি এত্তগুলো বাবু নিবো। সবসময় যেন আম্মু আম্মু করে আমাকে ব্যস্ত রাখবে।
=====
বর্তমানে আমার বিনোদনের বিষয় হচ্ছে আমার জন্য আসা বিয়ের প্রস্তাব গুলো! কিছুদিন পর পর বাপি অথবা ছোটবাবা ফোন করে আমাকে ছেলের ডিটেলস দিবে।
তারপর বলবে, ‘ভেবে চিনতে ডিসিশন নাও।’
আমি কিছু বলি না। চুপচাপ বাপি আর ছোট বাবার কথা শুনে যাই। তার কিছুক্ষণ পর সভ্যর কল আসবে, দেন শুরু হবে ঝাড়ি! ওর কথা শুনে হাসবো নাকি কাঁদবো নাকি রাগ হব বুঝি না! আরে ভাই আমার কি দোষ? আমি কি নিজে যেচে পড়ে কাউকে বলেছি যে আমাদের বাসায় আমার জন্য বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে আসো? সেটা আমার এই পাগল বয়ফ্রেন্ডকে কে বুঝাবে?
একটা কথা আছে, ‘‘ বাড়িতে বরই গাছ থাকলে, মানুষ ঢিল দিবেই। তেমনি বাড়িতে অবিবাহিত মেয়ে থাকলে বিয়ের প্রস্তাব আসবেই।’’
আমার সাথে রাগারাগি করে তারপর উনি মাম্মাম আর ছোটমাকে ফোন করবে! আমি কিছু বলার আগেই মাম্মাম আর ছোটমা বিয়ের প্রপোজাল রিজেক্ট করে দিবে! আমার বসে বসে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই। কিছুদিন থেকে এটাই চলছে আমার জীবনে।
সভ্য এখন বাসায় আছে। ওর বাহিরে যাওয়ার সবকিছু রেডি। নেক্সট উইকে ওর ফ্লাইট। বাংলাদেশে ডাক্তারি পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে সভ্য এখন লন্ডনে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে ডাক্তারদের নিয়ে দুটি ধারণা আছে। সেগুলো হল,
এক. ‘যে ডাক্তারের ভিজিট যত বেশি, সে তত বড় ডাক্তার।’
দুই. ‘যে ডাক্তারের নামের পাশে যত ডিগ্রী, সে তত ভালো ডাক্তার।’
সভ্যর বাহিরে যাওয়ার কথা শুনে আমার ভালো লেগেছে নাকি খারাপ লেগেছে আমি জানি না। কয়েক বছর আগের একটা ভয় শুধু মনে হানা দিয়েছে! পরে আবার নিজের এসব ফালতু ধারণা নিয়ে নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিয়েছি, আমি তো কোন টিনএজ স্কুল গোয়িং গার্ল না। এসব বাজে চিন্তা কিভাবে আমার মাথায় এলো?
শুধু কত দিন ওকে দেখতে পারবো না, সেটা ভাবলেই একটা কান্না দলা পাকিয়ে এসে গলায় আটকে…!
=====
এখন আমি বসে আছি বাসে, উদ্দেশ্য বাড়ি। পরশু রাত সাড়ে বারোটার দিকে ছোটবাবা আমাকে ফোন করেছে। অত রাতে ছোটবাবার ফোন কল দেখে আমি কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম। বাসায় কারো কিছু হয়নি তো?
ছোটবাবা আমাকে খুব কম ফোন করেন। খুব বেশি জরুরি না হলে আমাকে ফোন করে না। তাই অত রাতে ছোটবাবার ফোন কলে ভয় পাওয়ারই কথা..!
কল রিসিভ করতেই ছোটবাবার গলা,
— ‘হ্যালো, মামণি? ঘুমিয়েছো?’
আমি বললাম,
— ‘না, বাবা বলো। হঠাৎ এত রাতে? কোন সমস্যা?’
ছোটবাবা হেসে বললো,
— ‘না.. মামণি। কোন সমস্যা নেই। আমি কি তোমাকে বিরক্ত করলাম?’
— ‘না বাবা.. বিরক্ত কেনো করবে?’
— ‘মানে ঘুমিয়েছো হয়তো তুমি..’
— ‘না বাবা.. এখনো ঘুমাইনি। অবশ্য একটু পরেই ঘুমোবো.. কাল আবার আমার বাচ্চা গুলোর ক্লাস টেস্ট আছে।’
আমার কথা শুনে ছোটবাবা চিন্তিত গলায় বললো,
— ‘ওহ! তাহলে তো তুমি ব্যস্ত।’
ছোটবাবার এমন কন্ঠ শুনে আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম,
— ‘কি হয়েছে ছোটবাবা? কোন সমস্যা?’
— ‘না না মামণি, কোন সমস্যা না। তুমি কি বাসায় আসতে পারবে মামণি?’
— ‘হঠাৎ বাসায় কেনো বাবা?’
— ‘আর্জেন্ট একটা কাজ ছিল।’
— ‘খুব জরুরি কিছু ছোটবাবা?’
— ‘হ্যাঁ, মামণি তেমন কিছুই। পারবে কি তুমি আসতে?’
— ‘আচ্ছা আমি চেষ্টা করবো। কিন্তু কাল হবে না। পরশু যাওয়ার চেষ্টা করবো।’
— ‘আচ্ছা মামণি। তোমার সুবিধা মতো এসো।’
— ‘আচ্ছা বাবা।’
তারপর স্কুলে এপ্লিকেশন জমা দিয়ে ইমার্জেন্সিতে লিভ নিয়ে বাড়ির পথে..! বাসায় কিছু হয়েছে কিনা আমি এখন অবধি জানি না। হঠাৎ এত জরুরি তলব কেনো..!
আর এদিকে আবার অসভ্যটা আমার কল রিসিভ করছে না। কেমন লাগে? যাস্ট অসহ্য…
=====
কয়েক মুহূর্ত পর কার জীবনে কি হবে সেটা কেউ বলতে পারবে না। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মানুষের জীবন বদলে যেতে পারে..!
এই তো কিছুক্ষণ আগেও আমি ছিলাম, ‘‘মিস মুহসিনাত তানজীম সভ্যতা’’ আর এখন ‘‘মিসেস….!’’
মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত! এই কয়েক মুহূর্তেই জীবন কতটা বদলে গেলো! আমি এখন কারো অর্ধাঙ্গিনী। যার সঙ্গে আমি সারা জীবনের জন্য বাধাঁ পড়ে গেলাম।
এই তো কয়েক ঘন্টা আগেও যখন বাসায় এলাম তখন কি জানতাম যে কয়েক ঘন্টা পরেই আমি কারো অর্ধাঙ্গিনী হয়ে যাবো?
কাজী এলো.. বিয়ে পড়ালো.. চলে গেলো.. এই এতটা সময় আমি যাস্ট ঘোরের মধ্যে ছিলাম।
বাপি আর ছোটবাবা যখন বললো কিছুক্ষণ পরেই আমার বিয়ে তখন আমি কিছুই বলতে পারিনি।
আমার আর সভ্যর, বাবা-মায়ের সাথে একদম বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। বাবা-মাকে আমরা কখনোই ভয় পাই না, কিন্তু তাই বলে আমরা তাদের অবাধ্য নই। তাদের আমরা শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। এজন্য বাপি আর ছোটবাবার মুখের উপরে কিছু বলতে পারিনি।
আমার আর সভ্যর বারান্দায় বসে আমি যখন এসব ভাবছি, তখন ফোনের রিংটোনের শব্দে আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো।
ফোন হাতে নিয়ে দেখি রুশাপু! কানাডা যাওয়ার পর রুশাপু আর ফাইয়াজ ভাইয়া একবার দেশে এসেছিল। তখন তাদের সাথে ছিল তাদের এক বছরের ছেলে ‘‘ফারিস’’। বাবুটা এত্ত কিউট!
ভাইয়া আপু দেশে আসার পর ফারিস সবসময় আমার কাছে ছিল। ওকে আমি নিজের কাছ ছাড়া করতাম না। ওরা চলে যাওয়ার সময় আমি এবার ফারিসের জন্য কেঁদেকেটে ভাসিয়ে ফেলেছিলাম।
অসভ্যটা তখন কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘সুইটহার্ট ডোন্ট ক্রাই.. চিন্তা করো না আমাদের ফাস্ট অ্যানিভার্সারিতে তোমার কোলে আমাদের এমনই একটা প্রিন্স থাকবে।’
সত্যিই কি থাকবে?
কল রিসিভ করতেই রুশাপু বললো,
— ‘বিবাহিত জীবনের শুভেচ্ছা।’
রুশাপুর কথা শুনে আমি হেসে বললাম,
— ‘ধন্যবাদ রুশাপু।’
আপুও হেসে বললো,
— ‘ওয়েলকা’ম… তো আপনার বর কোথায়?’
— ‘জানি না..’
— ‘কেমন লাগছে?’
— ‘মানে? বুঝিনি..’
— ‘আরে গাধি! ম্যারেজ লাইফ।’
— ‘বুঝতে পারছি না আপু—— ‘
আর কিছু বলার আগেই কেউ একজন আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো, তারপর চুলের খোঁপা খুলে তাতে মুখ ডুবিয়ে দিলো।
আমি জানি এটা কে! তবুও হঠাৎ করে এমনটা করায় চমকে উঠলাম।
নিচুস্বরে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, ‘চুলে কি শ্যাম্পুর বদলে অ্যালকোহল মাখো, সুইটহার্ট? এতো নেশাভরা ঘ্রাণ কেনো তোমার চুলে!’
ওর এমন কন্ঠ শুনে আমি একদম জমে গেলাম…! ওর কন্ঠটা এত নেশাভরা কেন?
ফোনের ওপাশ থেকে আপু বললো,
— ‘কিরে! বুঝতে পারছিস না মানে?’
— ‘ন–আয়া ম–আয়া–নে আ—পু….’
বলতে বলতে এক হাত দিয়ে ওর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু হায়! ও আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমার গলায়, ঘাড়ে ওর নাক মুখ ঘষতে লাগলো। আবেশে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম, শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে, নিঃশ্বাস নিতেও কেমন কষ্ট হচ্ছে।
ওপাশ থেকে রুশাপু আবার প্রশ্ন করলো,
— ‘কি হলো? তোতলাচ্ছিস কেনো? ওহ! ফাজিলটা এসেছে বুঝি?’
আমি ছোট করে বললাম,
— ‘হুঁ!’
রুশাপু হেসে আবার জিজ্ঞেস করলো,
— ‘কি করছে?’
আমি বহু কষ্টে উত্তর দিলাম,
— ‘জ্বা—-লা—-চেচ্চছে…’
আমার কথা শেষ হতে না হতেই ওর হাতের বাঁধন আরো শক্ত হয়ে এলো, এবার ও ঘাড়ে, গলায় ছোট ছোট করে চুমু খাওয়া শুরু করলো। এতক্ষণ নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো.. আর এখন মনে হচ্ছে দমটাই বন্ধ হয়ে যাবে।
আমার কথা শুনে রুশাপু হা হা করে হেসে ফেলে বললো,
— ‘আচ্ছা তাহলে আমি রাখছি… গুড লাক সোনা ফর ইয়্যোর ফাস্ট নাইট।’
আমি কিছু বলার আগেই রুশাপু ফোন কেটে দিলো। ইশ্! রুশাপুটাও কতটা অসভ্য..! হবে নাই বা কেনো! অসভ্যটার বোন বলে কথা!
রুশাপু ফোন কাটতেই ও আমাকে নিজের দিকে ঘুরালো।
আমার কাঁধের দু’পাশের গ্রিলে হাত রেখে বললো,
— ‘কি বললে? আমি জ্বালাচ্ছি তোমাকে?’
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ‘হুঁ!’
এবার ও দুই হাতের তালুতে আমার মুখ আঁজলা করে ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
— ‘আমি জ্বালাই তোমাকে?’
আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়েই বললাম,
— ‘হুঁ, খুউউউউউব্বব্বব্ববইইইইইইই…..’
আমার বলতে দেরি, কিন্তু তার চুমু খেতে দেরি নেই। চট করে আমার ঠোঁটের উপরে চুমু খেলো।
আমি চমকে উঠে বললাম,
— ‘অসভ্য….’
আর কিছু বলার আগেই ও আবার আমাকে অধরবন্দি করে ফেললো। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য আমি ওকে যত ধাক্কা দিচ্ছি, ও তত আগ্রাসি হয়ে উঠছে। ওর সঙ্গে আমি এখন অবধি কখনো পেরে উঠতে পারিনি। তাই আজও আমাকে হার মেনে নিতে হল।
এভাবে কতটা সময় কেটে গেছে দুজনের কেউই জানি না।
ও ঠোঁট সরিয়ে নিচুস্বরে বললো, ‘ওয়েলকাম মিসেস মুদাসি্র তানজীম সভ্য…’
তারপর আমাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে ওর রুমের দিকে যেতে যেতে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, ‘সুইটহার্ট! আই কা’ন্ট ওয়েট এন্যিমোর…’
ওর এমন নেশা মাখানো মাতাল করা কণ্ঠস্বরে আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো.. আমি কিছু না বলে দুইহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে, ওর বুকে মুখ গুঁজে দিলাম।
বারান্দার কাঁচ ভেদ করে হালকা আলোর ছাঁট আসছে ঘরে। চারদিকে ঘন কালো অন্ধকার, সাথে শুনশান নিরবতা। লিভিং রুমের ঘড়িটা ঢং ঢং করে দু’বার বেজে উঠলো। তারমানে রাত দুটো বাজে। আবছা আলো আবছা অন্ধকারের মাঝ দিয়ে দু’জনে মিলে পাড়ি জমালাম ভালোবাসার নতুন এক অধ্যায়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্রতম অধ্যায়! স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার বৈধ এবং পবিত্র সম্পর্ক!
সাথে সভ্যর ঘরে লো ভলিউমে বেজে যাচ্ছিলো,
‘‘ When I see stars I think of you…
Then I always pray for you…
And I know what
My heart was made for
To love you forever more…
When I feel you in my heart
Then I hear your voice
From your eyes…
I will always love you…
And i’m waiting for you
Until the end of time…
You are my everything…’’
=====
দেখতে দেখতে কিভাবে পুরো সপ্তাহ কেটে গেলো বুঝতেই পারলাম না।
এই পুরো সপ্তাহে আমি সভ্যকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। এ যেন নতুন এক সভ্য আমার কাছে! প্রেমিক সভ্য আর স্বামী সভ্যর মধ্যে অনেক অনেক অনেক পার্থক্য…!
বিয়ের পর স্বামী হিসেবে সভ্য সম্পূর্ণ আলাদা একজন মানুষ। আমার সবকিছুতে তার অধিকার! এটা কিন্তু দম বন্ধ করা ডমিনেটিং না! সম্পূর্ণ আলাদা একটা জিনিস…
আজ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার ফ্লাইটে আমরা সবাই ঢাকায় যাচ্ছি। কাল রাতে সভ্যর ফ্লাইট।
ঢাকায় এসে আমরা মাম্মামের ফ্লাটে উঠলাম।
সারারাত আমি ঘুমোতে পারিনি। সভ্যর বুকে মুখ গুঁজে চুপচাপ শুয়ে ছিলাম। চোখ দিয়ে শুধু পানি পড়ছিল…
আর সভ্য! ও শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে ছিল। আমি জানি ও-ও ঘুমোয়নি।
সকাল থেকে সারাদিন আমি সভ্যর থেকে দূরে দূরে ছিলাম। ওর দিকে তাকালেই একটা কান্না দলা পাকিয়ে এসে গলায় আটকে।
এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য আমি সাদা পাড়ের আকাশী রংয়ের একটা সুতি শাড়ি পড়লাম। আর সাজের মধ্যে শুধু চোখে হালকা কাজলের ছোঁয়া, কপালে একটা টিপ। বারবার চোখ ভিজে উঠছিল।
খোঁপা করার সময় পিছন থেকে সভ্য বলে উঠলো, ‘তুমি আমার সাথে এরকম পর পর ব্যবহার কেন করছো, সভ্যতা? আমি কি করেছি? তুমি আমার সঙ্গে ঠিকমত কথা বলছো না, আমার দিকে তাকাচ্ছো না, আমার কাছে আসছো না। মোটকথা আজ তুমি আমাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাচ্ছো…’
ওর কথা শুনে আমি চমকে উঠে পিছনে তাকালাম। সভ্য কখন আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, আমি বুঝতেই পারিনি।
নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম,
— ‘কই? কিছুই তো করিনি আমি।’
ও আমার একদম কাছে এসে বললো,
— ‘তুমি কি করেছো সেটা তুমি আমার থেকেও ভালো জানো, জান।’
আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম,
— ‘তোমার কিছু লাগবে, সভ্য?’
সভ্য দুই হাতের তালুতে আমার মুখ আঁজলা করে ধরে বললো,
— ‘হুঁ, তোমাকে…’
বলেই গভীরভাবে অধরচুম্বন করলো।
তার কিছুক্ষণ পর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ কন্ঠে বললো,
— ‘চোখে কাজল দিলে তোমাকে দেবী দেবী লাগে..।’
বলেই দু’চোখের পাতার উপরে আলতো করে চুমু খেল।
অন্যসময় হলে আমি লজ্জায় সভ্যর দিকে তাকাতে পারতাম না। কিন্তু আজ ভেতরে তীব্র একটা কষ্ট হানা দিল। কয়েক বছর ওকে কাছ থেকে দেখতে পারবো না..! স্পর্শ করতে পারবো না..! ওর বুকে মুখ গুঁজে থাকতে পারবো না…! মন চাইলেই ওর কাছে ছুটে চলে যেতে পারবো না..! আর.. আর আমি ওর আদর গুলো পাবো না…!
এসব ভাবতেই আমার ভেতরটা কষ্টে জর্জরিত হয়ে উঠল। মুহূর্তেই আমার চোখ ভিজে উঠলো।
সভ্য ব্যস্ত গলায় বললো,
— ‘জান, কি হয়েছে? কাঁদছো কেনো? কি হয়েছে বলো আমাকে… প্লিজ সুইটহার্ট, কেঁদো না।’
আমি কান্নার চোটে কিছুই বলতে পারলাম না। কথা গুলো গলায় এসে আটকে গেছে।
সভ্য আমার চোখমুছে দিয়ে আবার বললো,
— ‘প্লিজ জান, কান্না বন্ধ করো… কেন কাঁদছো তুমি?’
আমি কিছু না বলে শক্ত করে সভ্যকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুঁজে দিলাম। সভ্যও দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
এভাবে কতক্ষণ ওকে জড়িয়ে ধরে ছিলাম জানি না। রুমের বাহির থেকে ছোটমা যখন আমাদের ডাকলো তখন আমার ধ্যান ভাঙ্গলো।
আমি ওর থেকে সরে যেতে চেয়েও পারলাম না। ওর মুখের দিকে তাকাতেই ও আমার চোখের দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো।
তারপর একটু ঝুঁকে এসে আমার ঠোঁটে একটা গভীর চুমু দিয়ে বললো,
— ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, সভ্যতা। ভালোবাসা কি সেটা বোঝার আগে থেকেই আমি তোমাকে ভালোবেসে আসছি। ছোট থেকে আমার একটাই স্বপ্ন, সেটা হল তুমি আমার বউ হবে। আর এখন তা পূরণ হয়েছে। আমার কোর্স শেষ হলেই আমি চলে আসবো সোনা। প্লিজ আর কেঁদো না লক্ষীটি। তুমি কাঁদলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। অনেক অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি আমার বউ।’
সভ্যর কথা শুনে আমি আবার কেঁদে ফেললাম।
এয়ারপোর্টে সভ্যকে সি অফ করতে যেয়ে এতটা কষ্ট হচ্ছিলো, যে কাউকে বলে বুঝানো মুশকিল। মনে হচ্ছিলো এত কষ্ট পাওয়ার থেকে মরে যাওয়া ঢের ভালো। কোন কথাই বলতে পারলাম না। চোখ দিয়ে শুধু টপটপ করে পানি পড়ছিল। লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে বাপি আর ছোটবাবার সামনেই সভ্য বুকে মুখ গুঁজে হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেললাম।
=====
সভ্যকে ছাড়া আমার দিন গুলো রংহীন ক্যানভাসের মতো। কোন কিছু ভালো লাগতো না। স্কুলের সময়টুকু বহু কষ্টে নিজেকে সামলে রাখতাম, কিন্তু যখন একা থাকতাম তখন আপনাআপনি চোখ দিয়ে পানি পড়া শুরু হত।
প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকতাম সভ্যর ফোন কলের। রাতে ঘুমাতাম না, ঘুমিয়ে গেলে যদি ওর সাথে কথা বলতে না পারি! ঘুম বাদ দিয়ে অপেক্ষা করতাম সভ্য কখন ফ্রী হবে!
অপরদিকে আমি নিজের মধ্যে অনেক পরিবর্তন আবিষ্কার করলাম।
বাপি-মাম্মাম, ছোটবাবা-ছোটমা চলে যাওয়ার পর, আমি কবে ঠিকভাবে খাওয়াদাওয়া করেছি সেটা মনে নেই।
ধীরে ধীরে শরীর দূর্বল হয়ে যেতে লাগলো। খাওয়ার প্রতি অরুচি বেড়েই যাচ্ছিলো। যদিও বা কিছু খাই, সেটাও বমি হয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। সব সময় ক্লান্ত লাগে, শরীরের তাপমাত্রা সব সময় কিছুটা বেশি থাকছে। বিপি সব সময় লো থাকছে, যার ফলে মাথা ঘুরে।
একদিন তো পড়েই যাচ্ছিলাম, দ্রুত দেয়াল ধরে নিজেকে সামলেছি। খাবারের প্রতি অনীহা তো বেড়েই যাচ্ছেই। আর সবচেয়ে বিশ্রী ব্যাপার হচ্ছে, মেজাজটা সব সময় খিটখিটে হয়ে আছে। সেদিন ক্লাসেও একজন স্টুডেন্টের সাথে রাগারাগি করেছি! ছিহ্! কেমন বিশ্রী একটা ব্যাপার! কিভাবে পারলাম আমি এমনটা করতে? নিজের এমন পরিবর্তনে, আমি নিজেই প্রচুর বিরক্ত।
কাল সকালে খালি পেটে র-চা খেয়ে ছিলাম। খালি পেটে র-চা! পরশু দিন থেকে না খাওয়া! যার ফলে কিছুক্ষণ পরেই তিতা বমি হল। মনে হচ্ছিলো ভিতর থেকে সবকিছু বের হয়ে যাবে। তারপর থেকে শুধু পানি ছাড়া আর কিছু খাওয়া হয়নি। খাবারের গন্ধে মনে হয় ভেতর থেকে সবকিছু বের হয়ে আসবে।
সেদিন ভিডিও কলে সভ্য আমাকে দেখেই অনেক রাগারাগি করেছে। কেনো আমি নিজের যত্ন নেই না! আমাকে কয়েকজন ডাক্তারের নামও সাজেস্ট করেছে দেখানোর জন্য। বারবার করে বলেছে আমি যেনো ডাক্তারের কাছে যাই। কিন্তু ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আমার কোন ইচ্ছা নেই। ঔষধ আমার যাস্ট অসহ্য লাগে।
আমার ডাক্তার তো ও নিজেই! আমি জানি ও এলেই আমি সুস্থ হয়ে যাবো। কিন্তু সেটা তো কখনোই সম্ভব না।
তারপর থেকে আমি আর সভ্যর সাথে ভিডিও কলে যাই না। কাল ফোন করে জিজ্ঞেস করেছে আমি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম কিনা! আমি মিথ্যে বলেছি, হ্যাঁ গিয়েছিলাম।
আর এখন অপেক্ষা করছি ওর অনলাইনে আসার জন্য। কিছুক্ষণ পরেই ও কল করবে। কয়েকদিন থেকে ভিডিও কলে কথা না বলার কারণে অনেক রাগারাগি করেছে। এরজন্য আজ সেজেগুজে ওর জন্য অপেক্ষা করছি। সাজলে বাহিরের অসুস্থতা অনেকটা ঢাকা পড়ে যায়।
সভ্যর কল রিসিভ করার পর ও ভালো মন্দ কিছু জিজ্ঞেস না করে সরাসরি বললো,
— ‘তুমি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে তাই না?’
সভ্যর এমন সরাসরি প্রশ্নে আমি হকচকিয়ে গেলাম।
দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
— ‘হুঁ!’
আমার কথাশুনে ও চোখ ছোট ছোট করে বললো,
— ‘তাই না! তা ডাক্তার কি বললো শুনি?’
গড এখন কি বলবো? আমি তো যাইনি!
বহু কষ্টে মিথ্যে বললাম,
— ‘কিছু বলেনি। শুধু কয়েকটা টেস্ট দিয়েছে।’
সভ্য এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
— ‘ওহ তাই বুঝি! আচ্ছা কি কি টেস্ট দিয়েছে শুনি? থাক বাদ দাও.. শুধু ডাক্তারের নামটা বলো যে কোন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে। আমি নিজে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে নিবো।’
এখন কি বলবো? আমি তো ডাক্তারের নাম গুলোও পড়ে দেখিনি। আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে নখ খুকটে লাগলাম।
ও এবার ধমকে উঠে বললো,
— ‘কি হল? চুপ করে আছো কেনো? বলো? ওহ্! আমি তো ভুলেই গেছি! তুমি বলবা কিভাবে? তুমি তো ডাক্তারের কাছে যাওইনি। নিজেকে শিয়াল পণ্ডিত মনে কর তাই না? অতি চালাকের গলায় দড়ি সেটা জানো তো? কি ভেবেছো আমি দেশে না থাকলে তোমার কোন খোঁজখবর পাবো না?’
আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে ও আবার ধমকে বললো,
— ‘কি হল? কথা বলছো না কেনো?’
সভ্যর এমন ধমকে আমি কেঁপে উঠলাম।
ভয়ে ভয়ে বললাম,
— ‘স্যরি…’
সভ্য একই গলার স্বরে বললো,
— ‘কি? কি বললে তুমি?’
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ‘আ’ম স্যরি…’
এরপর সভ্য আর কিছু বললো না। অনেক্ষণ ওকে কিছু বলতে না শুনে, ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকালাম। সভ্য একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অনেক সাহস সঞ্চয় করে বললাম,
— ‘কি দেখছো এভাবে?’
ও বললো,
— ‘দেখছি না, ভাবছি..’
— ‘কি ভাবছো?’
— ‘আমার এখানে আসা ভুল হয়েছে..’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
— ‘মানে? কি বলছো? মাথা ঠিক আছে?’
সভ্য বললো,
— ‘হুঁ.. সত্যি আমার আসা ঠিক হয়নি.. আমি চলে এসেছি, আর তুমি কি করছো এসব? নিজের যত্ন কেনো নিচ্ছো না? তুমি কতটা অসুস্থ, তোমার কোন ধারণা আছে? নিজের কি হাল করেছো তুমি, দেখেছো? কি মনে করেছো সাজলেই আমি কিছু বুঝতে পারবো না? তোমার থেকেও আমি তোমাকে বেশি চিনি। কেনো আমাকে এত কষ্ট দাও, জান? আমি কত টেনশানে আছি জানো?’
সভ্যর কথা শুনে আমি অপরাধীর মতো করে বললাম,
— ‘স্যরি..! আর এমন হবে না.. আমি পরশুই ডাক্তারের কাছে যাবো।’
— ‘পরশু না.. তুমি কাল যাচ্ছো ডাক্তারের কাছে.. ডাঃ নিলিমা জাহান, চিনো তো? মনে আছে? দেখা হয়েছিল একবার তোমার সাথে ওনার। আমার সিনিয়র একজন আপু… ওনার সাথে আমি কথা বলেছি। কাল সন্ধ্যা সাতটায় তোমার অ্যাপয়ন্টমেন্ট আছে।’
সভ্যর কথা শুনে আমি হতবিস্মিত হয়ে বললাম,
— ‘উনি তো স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ…!’
আমি যতটা বিস্মিত কন্ঠে বলেছি, সভ্য ততটাই নির্বিকার কন্ঠে বললো,
— ‘হুঁ.. তো?’
— ‘ওনার কাছে কেনো?’
— ‘দরকার আছে তাই.. আর হ্যাঁ.. কাল তুমি একা যাচ্ছো না.. মামণি আর বড়মাও তোমার সাথে যাচ্ছে।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
— ‘ওদের কোথায় পাবো?’
— ‘এত অবাক হওয়ার কি আছে? কাল বারোটা দশের ফ্লাইটে ওরা তোমার কাছে আসছে।’
আমি আগের মতই বিস্মিত কন্ঠে বললাম,
— ‘কই আমাকে তো কিছু বলেনি..!’
— ‘তুমি কি সবকিছু আমাদের বলো? রেহানা আপার কাছে না শুনলে তো আমি জানতেই পারতাম না তুমি এতটা অসুস্থ..’
ওহ হো! এবার বুঝতে পারলাম! রেহানা আপা! উনি তাহলে স্পাইগিরি করছে! রেহানা আপা আমার বাসায় কাজ করে। আমাকে একদম নিজের ছোট বোনের মতো আদর করে।
আমাকে চুপ দেখে সভ্য আবার বললো,
— ‘কি হল? কথা বলছো না কেনো?’
আমি ছোট করে বললাম,
— ‘স্যরি! আর এমন হবে না..’
— ‘আচ্ছা ঠিক আছে জান.. তুমি এখন ঘুমোও.. তোমার রেস্ট করা প্রয়োজন। কাল থেকে আর রাত জাগবে না তুমি।’
— ‘তুমিও রেস্ট নাও। আল্লাহ্ হাফেজ।’
— ‘খোদা হাফেজ.. লাভ ইউ, সুইটহার্ট.. ‘
— ‘লাভ ইউ টু.. বায়।’
— ‘বায়..’
———-
একটা পাঁচে ফ্লাইট ল্যান্ড করলেও, মাম্মাম আর ছোটমার আমার কাছে আসতে আসতে দুটো পার হয়ে গেলো। তারা আসতেই তাদের ঝাড়ির কবলে পড়তে হল আমাকে।
তাদের প্রতিটা কথার শেষ ছিল, ‘একি হাল করেছিস নিজের?’
মনে মনে আমি সভ্যর পিন্ডি চটকাচ্ছিলাম।
সন্ধ্যায় মাম্মাম আর ছোটমার সাথে ডাক্তারের চেম্বারে গেলাম। অনেকে বলে ডাক্তারদের ব্যবহার নাকি অনেক রুড হয়। অথচ নিলিমা আপুর ব্যবহার অমায়িক! নিলিমা আপু আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করলো। কি কি সমস্যা হচ্ছে? কবে থেকে এমনটা হচ্ছে? লাস্ট পিরিয়ড কবে হয়েছিল? এমন অনেক প্রশ্ন করলো। তারপর কিছু টেস্ট দিল। যার মধ্যে আমি দুটো টেস্ট চিনতে পারলাম। একটি হল ব্লাড টেস্ট, আর আরেকটি হল আলট্রাসনোগ্রাম (USG)।
রিপোর্ট পরের দিন দিবে। এজন্য বাসায় চলে এলাম। রাতে মাম্মাম আর ছোটমা মিলে আমাকে ঠেসেঠুসে খাওয়ালো। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না। বরং আমার আরো ক্ষতি হল।
খাওয়ার শেষে দশমিনিট না যেতেই আমি বমি করে সব বের করে ফেললাম। বমি করার পর শরীর এত ক্লান্ত হল যে আমি বসে থাকতেও পারছিলাম না। সভ্যর সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষাও করতে পারলাম না। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখে রাজ্যের ঘুম চলে এলো।
পরের দিন রিপোর্ট দেখানোর সময়ও মাম্মাম আর ছোটমা আমার সাথে গেলো। আমি এত করে মানা করার পরেও কেউ শুনলো না। আরে বাবা রিপোর্ট দেখানোর জন্য এতজন যেতে হবে কেনো? কিন্তু কে শুনে কার কথা? তারা যাবেই…!
রিপোর্ট দেখার পর নিলিমা আপু যা বললো, তা শুনে আমি কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম জানি না। পৃথিবীর কোন কিছুই আমাকে স্পর্শ করতে পারছিল না। মন চাচ্ছিলো আমি চিৎকার করে কান্না করি.. খুশিতে।
আ’ম প্রেগন্যান্ট! ইয়েস আ’ম প্রেগন্যান্ট!
ব্লাড টেস্টে রক্তে এইচসিজি- এর মান 72000-180000 এর মধ্যে। দ্যাট মিন’স আ’ম প্রেগন্যান্ট! নাইন উইক’স রানিং… তার থেকেও বড় ব্যাপার হচ্ছে একাধিক গর্ভবস্থা! এত এত খুশি কি আমি সভ্যকে আপন করে পাওয়ার পরেও হয়েছিলাম? মনে পড়ছে না!
আমি মা হব! ছোট ছোট এক জোড়া বাবু হবে আমার! ওরা আমার এই পেটের মধ্যে বেড়ে উঠবে! ভাবতেই পুরো শরীরের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে!
সভ্যকে জানাতে হবে! ইশ্! ও শুনলে তো খুশিতে পাগল হয়ে যাবে!
কিন্তু মানুষ যা ভাবে তা যে সব সময় হয় না আমি সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম।
শরীর দূর্বল হওয়ার কারণে নিলিমা আপু কিছু ঔষধ দিয়েছিল। রাতে খাওয়ার পর সেগুলো খেয়ে কখন ঘুমিয়েছি সেটাও মনে নেই। সভ্যর সাথে আর কথা হয়নি।
সারাদিন আমি ছটফট করছিলাম কখন সভ্যর সাথে কথা বলতে পারবো! অবশেষে সভ্যর সাথে আমার কথা হল…
সভ্যর সাথে কথা বলার পর আমার খুশির জোয়ারে ভাটা পড়লো। ওর কথা শুনে আমি নির্বাক হয়ে বসে রইলাম!
সভ্য বেবি চাচ্ছে না। ওর কথা গুলো হলো, ‘কেনো তুমি সাবধান হওনি, সভ্যতা? তোমার উচিত ছিল সাবধান থাকা.. ওহ গড! আমার উচিত ছিল এই বিষয়টা খেয়াল করা। কেনো তুমি আমাকে বাঁধা দিলে না? এখনো সময় আছে.. আমি নিলিমা আপুর সাথে কথা বলে রাখবো। তুমি বেবি এবোরশন করে ফেলবে।’
সভ্যর কথা শুনে আমি যাস্ট হতবাক! একজন ডাক্তার হয়ে কিভাবে নিজের সন্তানকে মেরে ফেলতে বলে?
একজন মা কি কখনো তার সন্তানকে খুন করতে পারে? বাবা হয়ে সভ্য এমনটা কিভাবে বলতে পারলো? আচ্ছা সবার বাবাই কি এমন? যেমন রুশাপুর বাবা… কই আমার বাপি আর ছোটবাবা তো বেস্ট বাবা ইন দিস ওয়াল্ড…
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম পুরো পৃথিবী আমার বিরুদ্ধে চলে গেলেও, আমি জীবন দিয়ে হলেও আমার সন্তানদের রক্ষা করবো….
………………………..
(চলব)
[ বিঃদ্রঃ যারা আগে পড়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, ‘‘নো স্পয়লার প্লিজ…’’ ]