গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা হি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_৬ (বোনাস পার্ট
#: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)অহি টলমল পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সদর দরজার কাছে গেল।যত সূরা পারে সব মনে মনে পড়ে দরজা খুলল।সঙ্গে সঙ্গে রোদ্দুর ভাইয়ের বাজখাঁই গলা কানে এলো!
—“ফাঁসির কাষ্ঠে উঠেছিলি নাকি?এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে?তোর হাড় গোড় আজ আমি মাংস থেকে আলাদা করবো।”
অহি দু চোখে ঝাপসা দেখছে।তার সম্পূর্ণ শরীর থরথর করে কাঁপছে।চোখে অন্ধকার নেমে আসছে।সে ভয়ার্ত গলায় গড়গড় করে বলল,
—“রোদ্দুর ভাই, আমায় মাফ করুন।আমায় মাফ করুন।আমি ওসব পাঠাইনি।এই কাঠের দরজা ছুঁয়ে বলছি আমি ওসব পাঠাইনি।আমার আইডি হ্যাক হয়েছে।হ্যাঁ,আমার দোষ নেই!আমায় ক্ষমা করু……”
বাকিটুকু শেষ করার আগেই অহি শরীর এলিয়ে দিল।পড়ে যেতে নিতেই রোদ্দুর ঝটপট হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল।
রোদ্দুরের চোখে মুখে ভয় ছড়িয়ে পড়লো।সে অহির গালে আস্তে করে থাপড় মেরে বলল,
—“অজান্তা!হেই অজান্তা!তোর আবার কি হলো?চোখ খোল!চোখ খোল!কিছু দেখে ভয় পেয়েছিস?কি সব আবোল তাবোল বকছিস?কি পাঠসনি?”
অহি চোখ খুললো না।রোদ্দুর তাকে পাঁজা কোল করে সোফায় শোয়ালো।একি মুসিবতে পড়লো?দরজা খুলতে দেরি করছিল বলে সে ভেবে রেখেছিল দু একটা চড়, থাপ্পড় দিবে।আগের রাগও রয়েছে।তার ফোন কেন পিক আপ করছে না সেসব জিজ্ঞেস করবে।মেয়ে তো তার আগেই অজ্ঞান!
সে রান্নাঘর থেকে পানির জগ এনে অহির মাথায় দিল একটু।চোখে মুখে পানির হালকা ছিটা দিতেই অহি ধড়ফড় করে উঠে বসলো।তার শরীর কাঁপছে।চোখ মুখ ইতোমধ্যে লাল হয়ে গেছে।
রোদ্দুরকে সামনে দেখে আরো ভয়ে কুঁকড়ে গেল।চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বের হলো।রোদ্দুর বুঝতে পেরে পানির জগটা মেঝেতে রেখে অহির মাথাটা নিজের কাঁধে চেপে ধরে বলল,
—“অজান্তা ভয় কেন পাচ্ছিস এত?কিছু হয়েছে?বল আমায়!”
অহির শরীরের কাঁপুনি আস্তে আস্তে থামলো।সে চোখ মুছে হালকা স্বরে বলল,
—“আমি ওসব ইচ্ছে কৃত ভাবে পাঠাইনি রোদ্দুর ভাই।অন্য কেউ ফাজলামো করে পাঠিয়েছে।আমায় ক্ষমা করুন!”
রোদ্দুর কপাল কুঁচকে বলল,
—“দিব এক চড়!কি সব ছাই পাস বলছিস?কিছু খেয়েছিস অজান্তা?”
অহিরও কপাল কুঁচকে উঠলো।সে রোদ্দুরের কাঁধে থেকে মাথা সরিয়ে তার মুখপানে তাকালো।এত স্বাভাবিক কেন?রোদ্দুর ভাই কি তাহলে মেসেজটা দেখেনি?
মুহূর্তে অহির সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়লো।যাক বাবাঃ!এ যাত্রায় সে হয়তো বেঁচে গেল।সে দ্রুত রোদ্দুরের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে একটু দূরে গিয়ে বসলো।
রোদ্দুর এখনো কপাল কুঁচকে অহির দিকে চেয়ে আছে।অহিকে তার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।কেমন উদ্ভট আচরণ করছে।এই কাঁদছে তো এই হাসছে!
সে একটু অহির কাছাকাছি বসে বলল,
—“অজান্তা তুই ঠিক আছিস তো?এত বড়ো বাসায় তোকে একা রেখে এরা কিভাবে যায়?কবে যে এদের আক্কেল হবে কে জানে!তোর কি জ্বর টর?”
বলেই সে অহির কপালে হাত রাখলো।ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে অহি কেমন কেঁপে উঠে।দ্রুত হাতটা সরিয়ে বলে,
—“আমি একদম ঠিক আছি।আসলে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখে একটু ভয় পেয়েছিলাম।”
—“আহ!তাই বল!আমি তো ভেবেছিলাম কি না কি হয়ে গেল।সাত মিনিট দরজার বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম।এমন রাগ উঠেছিল না!তুই যদি সেন্সলেস না হতি তাহলে এতক্ষণে আমার হাতের পাঁচটা আঙুল তোর গালে ফুটে উঠতো!”
অহি মাথা নিচু রেখে বলল,
—“আপনি হঠাৎ আমাদের এখানে কেন?অফিস যাননি?”
—“আমি ছুটিতে আছি।বাবা একাই সব সামলাচ্ছে।তুই এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।”
অহি অবাক হয়ে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।রোদ্দুর হাত দুটো সোফায় এলিয়ে দিয়ে রিলাক্স হয়ে বসলো।চোখ দুটো বন্ধ করে বলল,
—“রোদেলা আপু নিয়ে যেতে বলেছে তোকে।আপুর কলেজে কি যেন একটা প্রোগ্রাম।দুপুর দুটো থেকে আরম্ভ।নে, চট জলদি রেডি হ।”
—“আমি যাব না রোদ্দুর ভাই।আমার প্রোগ্রাম ট্রোগ্রাম ভালো লাগে না।”
রোদ্দুর চোখ না খুলেই বলল,
—“আমি অসহায়।তোর কথা রাখতে পারবো না রে।রোদ আপুর পারমিশন।সোজা কথায় না গেলে জোর করে কোলে তুলে নিয়ে যেতে বলেছে।সময় বেশি নেই।তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নে।পায়ে হেঁটে যাবি নাকি…….”
—“বাসায় তো কেউ নেই।খালি বাসা রেখে যাব কিভাবে?যদি চুরি হয়ে যায়?”
—“হবে না।খালুর সাথে কথা হয়েছে।দুপুরে কলেজ ছুটি হয়ে যাবে।আর একটাও কথা না।দশ মিনিট সময় দিলাম।রেডি হয়ে নে।আমি এই দশ মিনিট একটু ঘুমাব।কয়েক দিন হলো অফিসের কাজের চাপে ঘুমানোর সময়ও পাই না।”
রোদ্দুর চোখ বন্ধ রেখেই সোফায় পা টান করে ঘুমিয়ে পড়লো।অহি উঠে গিয়ে জায়গা করে দিল আরো।কয়েক সেকেন্ড রোদ্দুরের মুখের দিকে চেয়ে উপরে উঠে গেল।
কিছুক্ষণ পর ব্যাগ কাঁধে নিচে নামল অহি।হিজাবে শেষ পিনটা গেঁথে বলল,
—“রোদ্দুর ভাই উঠুন।আমি রেডি।”
রোদ্দুর উত্তর দিল না।সে এখন গভীর ঘুমে।ক্ষণে ক্ষণে ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ আসছে শুধু।অহি কাঁধের ব্যাগটা অন্য সোফায় রেখে গভীর মনোযোগে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।কতগুলো দিন পর এত কাছে থেকে দেখছে!
সে বিড়বিড় করে বলল,
“গাছে গাছে পাখিরা গাহিছে কুজন,
চলো আরো একবার প্রেমে পড়ি দুজন!
অ-প্রেম কেটে গিয়ে ফুটুক প্রভাত
চলো আরো একবার হাতে রাখি হাত!”
~অজান্তা
হঠাৎ মনে পড়তেই অহি রোদ্দুরের আশপাশে ফোনটা খুঁজলো।কিন্তু কোথাও চোখে পড়লো না।বুকপকেটে নেই,প্যান্টের পকেটও উঁচু নয়।তাহলে?বাসায় রেখে এসেছে হয়তো!অহি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।
রোদ্দুর ভাইয়ের সমস্ত শরীরে ক্লান্তি ভর করেছে।মুখটা আগের থেকে শুকিয়ে গেছে।চোখের নিচে কালো দাগ বসেছে।রোদ্দুর ভাই কি এখনো বৃষ্টি আপুর কথা ভেবে রাত জাগে?
অহির বুক কাঁপে।বার বার মনে হয়, মানুষটাকে শক্ত করে জড়িয়ে যদি তার সব দুঃখ নিজের করে নিতে পারতো!
সে পণ করে।একবার মানুষ টাকে কাছে পাওয়ার পর আর দূরে যেতে দিবে না।একটানা সাত দিন সব বাদ দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে থাকবে।তার বুক থেকে মাথা উঠাবে না। কোনো কষ্টকে ছুঁতে দিবে না।সবসময় ভালোবাসায় ডুবিয়ে রাখবে।সবসময় নিজের সাথে বেঁধে রাখবে।
হাত ঘড়ির দিকে তাকায় অহি।দুটো বাজতে মোটামুটি অনেক সময় বাকি।মানুষটা আর একটু ঘুমাক।সে রোদ্দুরের থেকে কয়েক হাত দূরে বসে তার মুখের দিকে অপলকভাবে চেয়ে থাকে।গুনগুন করে গেয়ে উঠে,
“অন্ধ হয়ে তোমায় আমি বেসেছি যে ভালো,
নাই বা থাকুক দু চোখ আমার, না বা থাকুক আলো!”
——————
রোদেলা আজ কালো রঙের সিল্কের শাড়ি পড়েছে।গলায় চিকন চেইনের সাথে ছোট্ট একটা লকেট।চুলগুলো ছাড়া।আর কোনো অর্নামেন্টস নেই।এতটুকু তেই তাকে পরীর মতো লাগছে।কিশোরী মেয়েদের মতো ঝলমল করছে।অহি মুগ্ধ হয়ে বলল,
—“আপু,তোমাকে কি সুন্দর লাগছে!তোমার মনের মতোই তুমি সুন্দর।তুমি এত সুন্দর কেন?”
রোদেলা কিশোরী মেয়েদের মতো খিলখিল করে হাসে।অহির মাথায় একটা চাটি মেরে বলে,
—“তোর দেখার চোখ সুন্দর রে অহি।সেজন্য আমাকে ভালো লাগছে।”
অহি কিছু বলতে নিতেই গাড়ি থেমে যায়।তারা কলেজে পৌঁছে গেছে।অহি রোদেলার শাড়ির রঙের সাথে ম্যাচিং করে আজ কালো রঙের লম্বা গোল জামা পড়েছে।সাথে কালো হিজাব।
রোদেলা গাড়ি থেকে নামলো।অহি তার পাশে এসে পলকহীন নয়নে কলেজ দেখলো।পুরো কলেজ ফুলে ফুলে ছেঁয়ে গেছে।আজ দ্বিতীয় বারের মতো সে এই কলেজে ঘুরতে এলো।
দুজন ভেতরে হাঁটা ধরলো।ভেতরটা মানুষে গিজ গিজ করছে।টিচার,স্টুডেন্ট সবমিলিয়ে হাজার মানুষ।একটা প্রিন্সপালের রিসিপশন যে এত জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পালন করে তা অহির অজানা ছিল।
সে রোদেলার হাত চেপে ফিসফিস করে বলল,
—“আপু,নতুন প্রিন্সিপাল ইয়াং নাকি বয়স্ক মানুষ?”
—“আমি কিভাবে বলবো রে পাগলা?বিদেশ টিদেশ থেকে হরেক রকমের ডিগ্রি নেয়া নাকি।তাহলে তো বয়স্ক মানুষই হওয়ার কথা!”
গার্ডিয়ান সাড়িতে অহিকে বসিয়ে রোদেলা বলল,
—“অহি সোনা!এখানে চুপচাপ বসে থাকো।আমি টিচার্স রুম থেকে ঘুরে আসি।দেখি,কোন কাজ আছে কি না আমার।”
—“হুঁ!”
—“তুই কিন্তু এখান থেকে নড়বি না।এত মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া অনেক টাফ হবে।এখানেই বসে থাকবি,কেমন?”
—“আপু,তুমি যাও।আমি এখানেই থাকবো।”
রোদেলা চলে গেল।অহি চুপচাপ চারিদিকে তাকালো।ফোনটা বের করে দেখলো,রোদ্দুর ভাই এখনো মেসেজ চেক করেনি।মেসেজটা চোখে পড়লে কি যে হবে কে জানে!অহির গা দিয়ে চিকন ঘাম বের হওয়া শুরু হলো।
আধ ঘন্টার মধ্যে অনুষ্ঠান শুরু হলো।রোদেলা স্টেজের উপর বিশাল বড়ো এক ফুলের বুকে হাতে দাঁড়িয়ে আছে।নতুন প্রিন্সিপালকে ফুল দিয়ে বরণ করার দায়িত্ব তার উপর পড়েছে।সমস্ত টিচার্সদের মধ্যে সেই একমাত্র ইয়াং নাকি সেজন্য!
রোদেলা চক্ষু ডান দিকে সামান্য ঘুরিয়ে অহির দিকে তাকালো।অহি ঝলমলে মুখে হাত নাড়লো।রোদেলা মুচকি হাসে!
তার পা ধরে আসছে।অনেক্ক্ষণ হলো এভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।প্রিন্সিপালের স্টেজে উঠার খবর নেই।প্রিন্সিপাল কলেজে এসে পৌঁছেছে মিনিট বিশেক আগে।সে খবর রোদেলার কানে এসেছে।কিন্তু স্টেজে কেন আসছে না?টিচার হওয়ার এই এক ঝামেলা।দুদিন পর পর এটা ওটা উপলক্ষে ঘন্টার পর ঘন্টা উপর মহলের লোকদের গুরুগম্ভীর বকবকানি শুনতে হয়।শুধু শুনলে হয় না,মনোযোগী হওয়ার ভান ধরতে হয়!
রোদেলার ভাবনার মাঝে চারিপাশ করতালিতে মুখরিত হয়ে গেল।হাজারো হাতের শব্দে তার কান ঝাঁ ঝাঁ করা শুরু হলো।শব্দ যেন মধ্য পর্দা ভেদ করে মস্তিষ্কে প্রতিটি নিউরনে গিয়ে আঘাত হানছে।রোদেলা চোখ বন্ধ করে আবার খুলল।
ভাইস প্রিন্সিপাল তার নাম ধরে ডাকছে।ক্রমাগত স্পিকারে বলে যাচ্ছে, অত্র কলেজের সম্মানিত নতুন প্রিন্সিপাল,জুলকারনাইন সাদিদ,বিএসসি,এমএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়;পিএইচডি, কানাডা!উনাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে এই কলেজের ইংরেজির প্রফেসর মিস রোদেলা জান্নাত!
স্পিকারে ঘোষিত নাম শুনে রোদেলার মাথা ঘুরছে।সে অগোছালো ভাবে হেঁটে সামনে এগিয়ে গেল।চারিদিক থেকে করতালির আওয়াজ ছাপিয়ে এক গুচ্ছ ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠলো।কেউ একজন তার হাতে রাখা বুকেটার একপাশ ধরলো।
অনেক কষ্টে রোদেলা চোখ তুলে তাকালো।ফুলের একপাশ ধরে রাখা স্যুট,বুট পরিহিত হাস্যোজ্জ্বল চেহারার মানুষটিকে দেখে তার অন্তরাত্বা কেঁপে উঠলো।
মানুষটি হাসি মুখেই তার চোখের দিকে তাকালো।সেই চেনা চোখ, সেই পরিচিত হাসি!যে হাসিতে রোদেলা বহু বছর আগে ঘায়েল হয়েছে।
- রোদেলার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসছে।গা গুলাচ্ছে।বমি পাচ্ছে।নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।টেনে টেনে দু তিনবার শ্বাস নিয়েই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিষ্ঠুর মানুষটার উপর চোখ বন্ধ করে হেলে পড়লো!
(চলব