#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_০৫
—“অজান্তা, খাইয়ে দে তো আমায়!আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করি।ক্ষুধায় শেষ আমি!”
অজান্তা আবার চমকায়।তার হাত কাঁপে।রোদ্দুর ভাই কি বিকেলের কথা ভুলে গেছে?এতদ্রুত ভুলে গেল?কিভাবে সম্ভব?
রোদ্দুর এক মনে ফোনে কি যেন করছে।দেখে মনে হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই!কয়েক সেকেন্ড পর সে ফোন থেকে চোখ সরিয়ে অহির দিকে তাকালো।ভ্রু কুঁচকে বলল,
—“খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন ?নে বোস।খাইয়ে দে।”
রোদ্দুর একটু সরে গিয়ে অহির জন্য জায়গা করে দেয়।তার ধমকেই অহি বসে পড়ে। প্লেটটা বেডে রেখে ভাত মাখানো শুরু করে।তিন রকমের ভর্তা দিয়ে সাদা ভাত শুধু।তরকারি রান্না হয়েছে আজ।কিন্তু অহি জানে রোদ্দুর ভাই ভর্তা বেশি পছন্দ করে।
শুটকি ভর্তা দিয়ে সে ছোট্ট করে একটা লোকমা করে রোদ্দুরের মুখের সামনে ধরে।আজ প্রথম সে রোদ্দুরকে খাইয়ে দিবে।তার যেন বিশ্বাসই হতে চায় না।যেই মানুষটা থেকে সবসময় পালিয়ে বেড়াতো,কিভাবে যেন সেই মানুষটার এত কাছাকাছি যাচ্ছে!
রোদ্দুর ভাতের লোকমা টা মুখে পুড়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খায়।একটুপর ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলল,
—“অজান্তা,তোকে বললাম ভাত খাইয়ে দে।আর তুই সঙ্গে সঙ্গে ভাত মাখানো শুরু করলি।হাত ধোয়ার প্রয়োজন বোধ করলি না?”
অহি জিভ কাটে।ছি!মনেই তো ছিল না।তার নিজের উপর বড্ড রাগ হয়।এতটা বেখেয়ালি মানুষ কিভাবে হয়?সে নিচু হয়ে দ্রুত হাতের ভাত ছাড়িয়ে বলে,
—“মনে ছিল না।এক্ষুনি হাত ধুয়ে নিচ্ছি।”
রোদ্দুর হো হো করে হেসে উঠে।অহি মুগ্ধ হয়ে তার দিকে চেয়ে থাকে।মানুষটা হাসলে সাথে চোখও হাসে।কি অনিন্দ্য সুন্দর সে দৃশ্য!এই মানুষটার হাসির শব্দও এত সুমধুর কেন?কানে মৃদু ঝংকার তুলে যায়।
সে বিড়বিড় করে বলে,
“তুমি হাসলে আমার ঠোঁটে হাসি
তুমি আসলে জোনাকি রাশিরাশি
রাখি আগলে তোমায় অনুভবে
বলো কি করে বোঝাই ভালোবাসি!”
রোদ্দুরের কানে তা পৌঁছাল না।সে প্রাণ খুলে হাসছে।হাসতে হাসতেই বলল,
—“তুই এতটা ডাফার আমি তো জানতাম না রে!ভাত মাখানো শেষ।এখন বলছিস হাত ধুবি!”
হঠাৎ করেই রোদ্দুরের হাসি থেমে যায়।অনেকটা বসন্তের পাগলা হাওয়ার মতো।হুট করে শুরু হয়ে হুট করে শেষ হয়ে যায়।
রোদ্দুর যেন ভুল করে হেসে ফেলেছিল।এক ধরনের অপরাধ বোধ জেগে উঠেছে তার সারা মুখ জুড়ে।সে ফোন নিয়ে পুনরায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
অহি বুঝতে পারে।সে ভাতের আরেক লোকমা তার মুখে পুড়ে দিয়ে অপরাধী সুরে বলে,
—“আমার হাত পরিষ্কার ছিল রোদ্দুর ভাই।মাত্র শাওয়ার নিয়েছি।”
—“তুই খেয়েছিস তো?”
অহির মুখে অযাচিত হাসি ফুটে উঠে।মাথা নেড়ে বলে,
—“হুঁ!”
তারপর বেশ কিছুক্ষণ দুজনের কেউ কোনো কথা বলে না।একটুপর রোদ্দুর নিজে থেকে জিজ্ঞেস করলো,
—“আমার জন্য বাসার সবাই চিন্তিত, তাই না রে অজান্তা?”
অহি কিছু বলে না।কি না কি বলে ফেলবে,আর রোদ্দুর ভাই আবার রাগ করবে।সে শুধু মাথা নেড়ে সায় জানায়।
রোদ্দুর নিজে থেকে বলে,
—“এভাবে নিজের জন্য এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই।ভাবতেছি কাল থেকে অফিস করবো।”
—“সেটা খুবই ভালো সিদ্ধান্ত।”
—“তোরা সবাই আমাকে খাওয়ানো নিয়ে ব্যস্ত।কিন্তু কেউ একবারের জন্যও জিগ্যেস করলি না হুট করে আমি খাওয়া বাদ দিলাম কেন?”
অহির চোখে মুখে ছটফটানি ভাব ছড়িয়ে পড়ে।সে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
—“কেন?”
—“সাত দিন পর আজ ভোরে অনলাইনে ঢুকেছিলাম।উদ্দেশ্য বৃষ্টির আপডেট জানার জন্য।ভেবেছিলাম ও হয়তো আমাকে সমস্ত সোস্যাল মিডিয়ায় ব্লক করে দিয়েছে।কিন্তু না!কোনো জায়গা তেই ব্লক করেনি।উল্টো আমার ম্যাসেন্জারে ওর বিয়ের পিক পাঠিয়ে রেখেছে।”
—“কি!বৃষ্টি আপু ইতোমধ্যে বিয়ে করে নিয়েছে?”
—“হ্যাঁ রে।তাও আবার ওর সেই বেস্টফ্রেন্ডকে।শাকিল না কি যেন নাম!ওদের দুজনকে আমি মাঝে মধ্যে একসাথে দেখতাম।বৃষ্টিকে কিছু বলতেই ও বলতো,বন্ধু মানুষ।এভাবে ধোঁকা দিবে ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি।এই আমি কে,এই রোদ্দুর হিমকে ও ধোঁকা দিয়েছে?এটা ভাবা যায়?”
রোদ্দুরের চোখের কোণ ভিজে গেছে।সাদা আলো সেখানটায় প্রতিফলিত হয়ে বালির মতো চিকচিক করছে।অহি মানুষটার ব্যথা অনুভব করতে পারছে যেন!
রোদ্দুর নিজেকে সামলে বলে,
—“বুঝলি অজান্তা!সকালবেলা ভেতরটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল।কেমন যেন পাগল পাগল আর শূন্য লাগছিল নিজেকে।সেজন্য ভাবলাম,নিজেকে শারীরিক ভাবে কষ্ট দিবো।তাতে যদি মনের কষ্ট একটু কমে!এবং অবাক করা বিষয় হলো তাতে সত্যি মনের কষ্ট কমতে শুরু করলো।দুপুরের দিকেই বৃষ্টির কষ্ট ছাপিয়ে ক্ষুধার কষ্ট মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল।রাত হতে হতেই অনেকখানি কমে গেছে।আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বৃষ্টিকে ভোলার জন্য, ওকে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য, অন্য কাউকে বিয়ে করবো।কি বলিস?”
অহির হাত থেমে যায়।বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠে।রোদ্দুর ভাই তাহলে আবার অন্য কাউকে বিয়ে করবে?
অহি প্লেটের বাকি ভাতটুকু রোদ্দুরের মুখে পুড়ে দিয়ে বলল,
—“বিয়ে করবেন, ভালো কথা।এতদ্রুত মেয়ে কোথায় পাবেন?”
—“তোরা খোঁজ নিবি।রোদ আপু আছে,তুই,মা, খালামণি,খালু সবাই আছে।বাইরে গিয়ে রোদ আপুকে পাঠিয়ে দিস তো।কথা বলবো।”
অহি উঠে দাঁড়ালো।প্লেট গুছিয়ে হাতে নিয়ে সামনে পা বাড়াতেই রোদ্দুর ধমকে বলল,
—“পানি খাওয়াবে কে?টেবিল থেকে পানির গ্লাস দিয়ে যা।আমি ভেবেছিলাম তুই হয়তো একটু পরিবর্তন হয়েছিস।না তো!তুই তো সেই আগের মতই বেয়াদব আছিস।হুট করে কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিস।”
অহি থামে।তার পা ভারী হয়ে গেছে।গলা দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না।নিজেকে কেমন অসাড় অসাড় লাগছে।সে এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে রোদ্দুরের হাতে ধরিয়ে দিল।
রোদ্দুর এক চুমুকে পানিটুকু শেষ করে বলল,
—“নিচে প্লেট রেখে আরেক বার আমার রুমে আসিস তো।রান্নাঘর থেকে সরিষার তেল নিয়ে আসবি।আমার মাথায় সরিষার তেল ঘষে দিবি।আমি একটু ঘুমাব।অনেক দিন হলো ঘুমাতে পারি না।”
অহি দৃঢ় কন্ঠে বলল,
—“আমি পারবো না রোদ্দুর ভাই।অন্য কাউকে বলুন।”
অহির কাঠ কাঠ জবাব শুনে চমকে তার মুখপানে তাকায় রোদ্দুর।কয়েক সেকেন্ড পর বলে,
—“তুই হঠাৎ এমন কঠিন হয়ে গেলি কেন?আমি কি তোকে ভুল কিছু করতে বলেছি?মাথায় একটু জাস্ট তেল দিয়ে দিতে বলেছি।কবে জানি তোদের বাসায় গিয়ে দেখলাম, অপূর্বর মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছিস।সেজন্য বললাম।অপূর্ব আর আমার মধ্যে তফাৎ কোথায়?মেয়ে জাতি মানেই অদ্ভুতের কারখানা। যা যা!লাগবে না।তুই রোদ আপুকে পাঠিয়ে দে।আপু দিয়ে দিবে।”
অহি কিছু বললো না।দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকালো।সে বড় হয়ে গেছে।কিছুদিন পর তার বয়স বাইশে পড়বে।এই বয়সে হুটহাট কান্না করা একদম সাজে না।
সে অসাড় পা দুটোকে টেনে টেনে প্লেট হাতে বাইরে বের হয়ে গেল।একবারের জন্যও পিছন ফিরে তাকালো না।ভোর হলেই সে এ বাসা থেকে চলে যাবে।আর কোনোদিন পা রাখবে না।
——————
অহি নিজের বাসায় তার বিছানায় শুয়ে ফোন নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।এই ভোরবেলাতেই ‘রোদ্দুর হিম’ নামক মানুষটার ফেসবুক আইডি পনেরো বারের মতো দেখা হয়ে গেছে।
এক মাসের বেশি হলো সে ও বাসা থেকে চলে এসেছে।আর যায় নি।ইতোমধ্যে নতুন করে রোদ্দুরের বিয়ের তোড়জোড় চলছে।ডজন ডজন মেয়ে দেখা হচ্ছে।সেসব মেয়ে খালামনির নাকি পছন্দ হচ্ছে না।রোদ্দুর এবার নাকি পরিবারের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবে।
কিন্তু কেউ একটি বারের জন্যও অহির নামটি উচ্চারণ করছে না।রোদেলা আপু,অপূর্ব এ দুটো মানুষ তো অন্তত জানে সে রোদ্দুরকে ভালোবাসে।কিন্তু তারাও কেমন নির্বাক রয়েছে।
বিগত এক মাসে রোদ্দুর বেশ কয়েকবার মেয়ে দেখার জন্য অহিকে ফোন করেছে।কিন্তু সে ইচ্ছে করে ফোন রিসিভ করেনি।কেন করবে?মানুষটা তাকে কেন বোঝে না?সে যে সামনাসামনি রোদ্দুর ভাইকে প্রোপোজ করবে সে সাহসও নেই।ভয় লাগে।যদি বৃষ্টি আপুর সতো প্রথমেই রিজেক্ট করে দেয়?তাহলে সে মুখ দেখাবে কি করে?
অহি এক লাফে বিছানা থেকে উঠে সারা রুমে পায়চারি করলো।কয়েক বার বেলকনিতে গিয়েও ঘুর ঘুর করলো।কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না।ভেতরটা কেমন অশান্ত!আজ তার মা কাজের লোকসহ সবাইকে নিয়ে আবার খালামণির বাসায় গেছে।সদরঘাটের ওদিকে নাকি মেয়ে দেখতে যাবে।
অহি কয়েক সেকেন্ড এক জায়গা দাঁড়িয়ে গভীর কিছু চিন্তা করলো।টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে শেষ করলো।তারপর বিছানা থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে বেলকনিতে বসলো।
রোদ্দুর হিম নামক আইডির ম্যাসেন্জারে ঢুকে বাংলায় টাইপ করলো,
“রোদ্দুর ভাই, এবার যদি আমাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করিস তাহলে তোকে একদম খুন করে ফেলবো।তারপর নিজের গলায় দড়ি দিবো।আমার গল্পের প্রথম পাতায়, মাঝামাঝিতে বা শেষ অধ্যায়ে তুই না থাকলেও পরিশিষ্টে তোকে চাই।শুধু তোকে চাই।রোদ্দুর হিমকে চাই।”
এটুকু লিখে সেন্ড করে দিল।অহির হাত পা কাঁপছে।এভাবে লেখা কি খুব প্রয়োজন ছিল?রোদ্দুর ভাই কি না কি ভাববে কে জানে?
অহি নেশাখোর দের মতো টলতে টলতে রুমে ঢুকলো।বিছানায় গা এলিয়ে দিল।তার মাথা ঘুরছে।সাথে পুরো পৃথিবী!
চোখ বন্ধ করে ফোনটা হাতে নিল।দ্রুত ম্যাসেন্জারে ঢুকে ম্যাসেজটা রিমুভ করতে চাইলো।কিন্তু হলো না।সে ফোনটা এক ঢিল দিয়ে বিছানার অপরপাশে ফেললো।তারপর নিজেকে জঘন্য ভাষায় গালি দিল।
মিনিট দশেক পরেই তাদের বাসার কলিং বেল বাজা শুরু হলো।অহি চমকে চোখ খুলে বড়ো বড়ো করে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।এই সময় আবার কে এলো?
রোদ্দুর ভাই না তো?আল্লাহ গো!
অহি এক লাফে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে ভেতরে ঢুকে বসে রইলো।সদর দরজার ওপাশে কেউ অনবরত কড়া নেড়ে যাচ্ছে।ভেঙে ফেলবে প্রায়!কিন্তু কেউ খুলছে না কেন?
পরমুহূর্তে অহির মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল।বাসায় তো সে বাদে দ্বিতীয় কেউ নেই!
(চলবে)
Ccচেক করা হয়নি।