- #গল্পের_নাম : পরিশিষ্ট
#লেখিকা : অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_০৪
রোদ্দুর কোনো কথা না বলে অহিকে একটানে রুম থেকে বের করে দিয়ে তার মুখের সামনে ঠাস করে দরজা আটকে দেয়।অহি কিছু বলার সুযোগটাও পায় না।
সে ফের দরজায় টোকা দিতে নিয়েও হাত ফিরিয়ে আনে।রোদ্দুর এখন অনেক রেগে আছে।রাগের বশে তাকে চড়, থাপ্পড় মারতে পারে আবার।যেটা খুবই লজ্জাজনক হবে!
অহি নিচে নেমে আসে।সোফায় শাহিনুর আধ শোয়া হয়ে আছে।রোদেলা পাশে বসে মায়ের মাথায় তেল পানি ঘষে দিচ্ছে।অহিকে দেখেই রোদেলা ঝটপট বলে,
—“কি রে!খাওয়াতে পারলি কিছু রোদ্দুরকে?”
রোদেলা রোদ্দুরের থেকে বয়সে দুই বছরের বড়ো।তার বয়স কয়েক মাস পর আটাশে পড়বে।কিন্তু এখনো বিয়ে করেনি।তাকে বিয়ের জন্য অনেক জোরজবরদস্তি করেও রাজি করানো যায় নি।বাধ্য হয়ে তার আগেই রোদ্দুরের বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল।
অহি ডাইনিং এর চেয়ার টেনে এনে খালার মুখ বরাবর বসে। খালাও অধির আগ্রহ নিয়ে তার মুখপানে চেয়ে আছে।রোদ্দুর খেয়েছে কি না তার উত্তর জানতে চায়।
খালাকে দুশ্চিন্তা মুক্ত করার জন্য অহি বলে,
—“খালামণি, রোদ্দুর ভাই খাচ্ছে।আমি দেখে এসেছি।খেয়ে ঘুমাবে একটু।সেজন্য আমি চলে আসলাম।”
শাহিনুর ব্যথাতুর গলায় বললো,
—“চারপাশে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।আমার দুটো মাত্র সন্তান।তার একটা পণ করেছে জীবনে বিয়ে করবে না।আরেকটার বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে পাগলপ্রায় অবস্থা।”
এটুকু বলেই তিনি কিশোরী মেয়েদের মতো নাক টেনে কান্না শুরু করলো।রোদেলা বিরক্ত হয়ে বলল,
—“মা,আমি কবে বলেছি যে, আমি জীবনে বিয়ে করবো না?বলেছি যে, তোমরা যে ছেলে ধরে আনো তাদের আমার পছন্দ হয় না।আর অপছন্দের কিছু নিয়ে আমি সারাজীবন একত্রে সংসার করতে পারবো না।”
—“তা তুই কাউকে পছন্দই কর না!তোর পছন্দের কাউকেই নিয়ে আয়।বিয়ে দিয়ে চিন্তামুক্ত হই আমরা।”
রোদেলা কিছু বলতে নিতেই অহি থামিয়ে দিল।নরম গলায় বললো,
—“আপু, তুমি খালাকে ধরো।রুমে শুইয়ে দিয়ে আসি।”
দুজন দুপাশ থেকে ধরে শাহিনুরকে রুমে নিয়ে শুইয়ে দিয়ে আসে।তারপর দুজন রোদেলার রুমে ঢুকে।
এ বাসায় আসলে অহি রোদেলার রুমই নিজের করে নেয়।থাকার মতো অসংখ্য ফাঁকা রুম থাকলেও অহি রোদেলা আপুর সাথেই থাকে।আপু অনেক মজার মানুষ।আর প্রচুর জ্ঞান।জ্ঞানীদের মতো গুছিয়ে, কি সুন্দর করে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলে।অহি মুগ্ধ হয়ে তার প্রতিটা কথা শোনে।
আর রোদেলার প্রতিটি কথা সে বেদ বাক্যের মতো মানে।
রোদেলা আপুর ইংরেজিতে অনার্স, মাস্টার্স শেষ তিন বছর হলো।এখন ঢাকার টপ প্রাইভেট কলেজের ইংরেজির প্রফেসর।নিজেদের বিজনেসে তাকে জব করতে বলেছিল।কিন্তু আপু রাজি হয়নি।
তার নাকি শিক্ষকতা প্রচুর ভালো লাগে।
রোদেলা রুমে ঢুকেই এক লাফে বিছানায় উল্টো হয়ে শোয়।কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে বলে,
—“রোদ্দুর এখনো কিছু খায়নি,তাই নারে অহি?”
অহি চমকিত হয়।নিজেও আপুর পাশে শুয়ে বলে,
—“তুমি কিভাবে বুঝলে আপু?”
—“ছাড় না!বুঝতে পেরেছি আমি।তোকে নিশ্চয়ই কোনো একটা কারণে রেগে মেগে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে।আমরা দুজন একই মায়ের গর্ভের হয়েও কতটা আলাদা দুজন, দেখছিস অহি?রোদ্দুর প্রচন্ড রাগী, জেদি,কথা বলতে চায় না বেশি,বললেও মুখের উপর ঠাস করে সব বলে দেয়।আর আমি ওর থেকে পুরো ভিন্ন।শান্ত,বোকা টাইপের,রাগ-জিদ কিচ্ছু নেই,বাচাল,অগোছালো ভাবে বকবক করতে থাকি সবসময়।সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো চরিত্র।”
—“তুমি জানো আপু,তুমি মানুষ হিসেবে অসাধারণ।আমাকে যদি পাঁচ জন ভালো মানুষের লিস্ট করতে দেয় তাহলে এক নাম্বারে তুমি থাকবে আপু।”
রোদেলা হেসে বলে,
—“আমাকে এক নাম্বার স্থান দিয়ে দিলি?তাহলে তোর রোদ্দুর ভাইকে কয় নাম্বারে রাখবি?নিজের ভালোবাসার মানুষকে এক নাম্বারে রাখবি না,এটা কেমন কথা?”
অহির সারামুখে লজ্জা ছড়িয়ে পড়ে।রোদেলা আপু তাহলে তার ব্যাপারটাও ধরে ফেলেছে?সে কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে।
রোদেলা অহির দিকে না তাকিয়েই বলে,
—“বেশি চিন্তা করিস না।বৃষ্টি রোদ্দুরের জন্য সঠিক ব্যক্তি ছিল না।ব্যাপারটা ভাইও কিছুদিন পর বুঝতে পারবে।আসলে বৃষ্টি রোদ্দুরকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় যতটা না কষ্ট পেয়েছে তার চেয়ে বেশি ইগো তে লেগেছে।এতগুলো মানুষের সামনে বিয়ে ভেঙে যাওয়া চূড়ান্ত অপমানকর।কিছুদিন গেলেই ভাই ঠিক হয়ে যাবে।নতুন করে তখন নিজের করে নিস।তুই তো আর ছোট নেই অহি।প্রকৃতি কিন্তু সব মানুষকে সেকেন্ড চান্স দেয় না।এবার রোদ্দুর অন্য কারো হওয়ার আগেই নিজের আঁচলে বেঁধে নিস।”
রোদেলা থামে।অহি শোয়া অবস্থাতেই হাত বাড়িয়ে বালিশ টেনে আনে।একটা নিজের মাথার নিচে দিয়ে আরেকটা রোদেলার মাথার নিচে দেয়।তারপর একপাশ হয়ে রোদেলার দিকে তাকায়।
চিকন ভ্রু যুগল,একটু মোটা নাক,পাতলা ঠোঁট,ফর্সা ত্বক,আর ঝলমলে চোখ দুটো নিয়ে কি সুন্দর চেহারা রোদেলা আপুর।যে কেউ রোদেলা নামক মানুষটাতে আটকে যাবে!রোদেলা আপুর সবকিছুতে অহি মুগ্ধ।
সে রোদেলার ঘন চুলে হাত বুলিয়ে বলে,
—“আপু,তুমি এত ভালো কেন?তোমার মন এত সুন্দর কেন?জানো,যেই মানুষটা তোমায় পাবে সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে লাকি পারসন হবে!”
রোদেলা হাসে।কি প্রাণবন্ত সে হাসি!হাসতে হাসতে অহির নাকে আলতো করে ছোঁয়।
অহি ফের বলে,
—“আচ্ছা, আপু!এতগুলো বসন্ত পেরিয়ে গেল।অথচ সত্যিই কি তোমার কাউকে পছন্দ হয়নি কোনোদিন?ইট,পাথরের শহরের এত এত প্রেমিক যুগলের ভীড়ে তোমার একবারের জন্যও কারো হাত ধরতে ইচ্ছে হয়নি?”
রোদেলা পাশ ফিরে অহির মুখোমুখি হয়।হাসি হাসি মুখে বলে,
—“বাদ দে এসব।তোকে একটা গল্প বলি।একটা মেয়ের গল্প।সদ্য ১৭ তে পা রাখা প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে। নতুন কলেজে উঠেছে তখন সে।নতুন কলেজ,নতুন পরিবেশ, নতুন টিচার,নতুন বন্ধুবান্ধব।এত এত নতুনত্বের মাঝেও মেয়েটা নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিল না।বহু কষ্টে এক মাস ক্লাস করার পর সে যখন সিদ্ধান্ত নেয় টিসি নেবে তখন তার জীবনে একটা মীরাকল ঘটে।একদিন একটু লেটে ক্লাসে ঢুকতে গিয়ে দেখে নতুন এক শিক্ষক।ঝাকড়া চুলের সদা হাস্যোজ্জ্বল এক সুদর্শন ছেলে।
কি মনে করে যেন ছেলেটি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে প্রথম দেখাতেই স্মিত হাসলেন।ব্যস!সেই হাসিতেই কিশোরী মেয়েটা ঘায়েল।তাকে নিয়ে মস্তিষ্কে জলজ্যান্ত এক সংসার সাজাতে বসলো।একটু সময়, সুযোগ পেলেই কল্পনার শহর খুলে বসতো।ক্লাসে হা হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতো।
তিন মাসের মাথায় হুট করে স্যারটা আসা বন্ধ করে।কিশোরী মেয়েটা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়।এর ওর মুখে শুনতে পায়,স্যারটা নাকি এ বছরই ভার্সিটি কমপ্লিট করেছে এবং পিএইচডির জন্য কানাডা চলে গেছে।বিদেশ যাওয়ার মাঝের তিন মাস কলেজে গেস্ট টিচার হিসেবে ছিল।
ব্যস!কিশোরী মেয়েটার মনটা ভেঙে চুড়ে, খান খান হয়ে যায়।মস্তিষ্কে স্বযত্নে সাজানো প্রথম ঘর বাঁধা সংসারটা ঝড়ো বাতাসে দুমড়ে মুচড়ে যায়।কিশোরী মেয়েটার সব অভিমান গিয়ে জমা হয় টিচারবেশী ছেলেটার উপর।কেন, মেয়েটির থেকে বিদায় নিয়ে যায় নি?তবে কি সে মেয়েটির মনের ভাষা পড়তে পারেনি?না পারলে কেন মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আশকারার হাসি দিত?কেন টুকটাক কথা বলে তার কল্পনার শহরে রামধনু উঠাতো?
সেই থেকে কিশোরী মেয়েটার কি যেন হয়ে গেল।তার বয়স বাড়লো ঠিকই, কিন্তু ছোট্ট মনটাতে আর কাউকে বসাতে পারলো না কোনোদিন!”
রোদেলা কাঁদছে।নিরব,নিঃশব্দ সে কান্না।সে কান্নার আওয়াজ যেন অহির কান অবধিও পৌঁছে না।শুধু থেকে থেকে তার শরীর কেঁপে উঠে।অহি ডান হাতে রোদেলার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে শুধু।
অহির দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকায়।তার রোদ আপুরো এত কষ্ট?কই, কাউকে তো কখনো বুঝতে দেয় না?তার বাচ্চাদের মতো ওই খিলখিল হাসির আড়ালে লুকানো কষ্টের পাহাড়টা কেন কারো চোখে পড়েনি?
অহি মনে মনে আওড়ায়—
“ক্ষত শুকিয়ে গেলেও কিছুটা
চিহ্ন তো থেকেই যাবে
পোড়া স্মৃতির মতো
অথবা সঞ্চিত বিষাদ।
তুমি তো আঙুল তুলেই দেখিয়ে দিলে
অথচ বললে না
কোন পথে যেতে হবে আমাকে
কোন দিকে!
কবিতাঃকোন পথে যেতে হবে আমাকে
-রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্”
চারিদিকে সন্ধ্যা নামা শুরু হয়েছে।রুমটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।তবুও অহি উঠে আলো জ্বালায় না।যাদের মনের শহরে এত এত অন্ধকার, বাহ্যিক আলো কি তা দূর করতে পারবে?
———————-
রাতের বেলা এক প্লেট খাবার হাতে নিয়ে রোদ্দুরের দরজার সামনে দাঁড়ায় অহি।অনেক সাহস করে এসেছে সে।বিকেলের পর এক সেকেন্ডের জন্যও দেখা হয়নি দুজনের!
দরজায় টোকা দিতেই খুলে গেল।ভেড়ানো ছিল শুধু।বাহ!অবস্থার একটু বোধ হয় উন্নতি হয়েছে।দরজা যেহেতু খুলে রেখেছে।
রোদ্দুর বিছানায় শুয়ে ফোন টিপছিল।তার ভ্রু যুগল কুঁচকানো।পরণে কালো টিশার্ট আর কালো ট্রাউজার।টিশার্টের কলার উঁচু নিচু হয়ে আছে।মাথার চুল গুলো শাওয়ারের পর ব্রাশ করা হয়নি।এলোমেলো ভাবে কপাল লেপ্টে আছে।
অহি যে ভেতরে ঢুকে সেটা এখনো অনুভূতিতে আসেনি।অহির মন খারাপ হয়ে গেল।সে কত মনোযোগ দিয়ে মানুষটার খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে।আর মানুষটা!তার দিকে কোনো নজরই নেই।সে কি রঙের জামা পড়ে,কি ফুল খোঁপাতে গুঁজে,চোখে কাজল দেয় কি না এসব কিচ্ছু খেয়াল করে না।
রোদ্দুর ভাই তার ব্যাপারে এত উদাসীন কেন?তার ডান চোখের কোণার তিলটা কি রোদ্দুরের কখনো নজরে এসেছে?ঠোঁটের দুই ইঞ্চি উপরের বাদামি তিলটাতে কি কখনো চুমু খেতে ইচ্ছে হয়নি?
এই যে সে এখন রোদ্দুর ভাইয়ের প্রিয় রঙের কথা মাথায় রেখে পার্পল কালারের থ্রি পিস পড়েছে।এত রাতে শাওয়ার নিয়ে মাথার চুল ছেড়ে রেখেছে এসব কি নজরে পড়ে না?
অহি নিঃশব্দে হেঁটে গিয়ে রোদ্দুরের মাথার কাছে দাঁড়ায়।অনেক কষ্টে মুখ খুলে বলে,
—“রোদ্দুর ভাই, আপনার খাবার।খেয়ে নিন!”
রোদ্দুর এক লাফে উঠে খাটে হেলান দিয়ে বসে।চোখে মুখে গম্ভীর গম্ভীর ভাব।ফোন থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বলে,
—“অজান্তা,খাইয়ে দে তো।আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করি।ক্ষুধায় শেষ আমি!”
অহি আবার চমকায়।তার হাত কাঁপে।রোদ্দুর ভাই কি বিকেলের কথা ভুলে গেছে?
(চলবে)
- ?