#গল্পের_নাম : পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_০৩ (বোনাস)
অহিকে দেখে কেউ অবাক হয় না।যেন তারা ধরেই নিয়েছিল এই অসময়ে সে আসবে।রোদ্দুরের পাশে থাকবে।অহি ইশারায় কি হয়েছে জিগ্যেস করতেই তার খালা এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।অহি খালার মুখ সামনে এনে মাথা নেড়ে কাঁদতে বারণ করে।
চোখের জল নিজ হাতে মুছে দেয়।তার খালা শাহিনুরের ভারিক্কি চেহারা।কয়েক মাস হলো ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে।ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর থেকেই যেন হু হু করে তার মেদ বেড়ে যাচ্ছে।সামান্য বাতাসটুকু গ্রহণ করেই যেন ওয়েট বেড়ে যাচ্ছে।খালা এখন অল্পতে হাঁপিয়ে উঠে।
একটু কান্না করতেই তার ফর্সা মুখ, গাল লাল হয়ে গেছে।বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিচ্ছে।অহি খালাকে জড়িয়ে বলল,
—“খালামণি,তুমি নিচে যাও।আমি দেখছি।”
তারপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোদ্দুরের বড় বোন রোদেলাকে বলল,
—“আপু,খালামণিকে নিচে নিয়ে যাও।প্রেশার হাই হয়ে যাবে।”
রোদেলা একপাশ থেকে মাকে জড়িয়ে বলল,
—“অহি রে!তুই একদম ঠিক সময়ে এসেছিস।আমি তোর কথাই ভাবছিলাম।এই দেখ,তোকে ফোন করার জন্য ফোনও হাতে নিয়েছি।”
অহি একটু হাসার চেষ্টা করলো।তার খালা শাহিনুর রোদেলার হাত ধরে নিচে নেমে গেল।
অহি মাথার হিজাবটা খুলে চুলগুলো আলগা করলো।বিচ্ছিরি গরম লাগছে!ওড়নাটা কাঁধের দুপাশে ঝুলিয়ে দরজায় টোকা দিল।
ওপাশ থেকে কোনো প্রতিত্তর আসলো না।অহি দরজায় আঘাতের পরিমান বাড়িয়ে দিল।সঙ্গে সঙ্গে রোদ্দুর বাজখাঁই গলায় বললো,
—“একদম শব্দ করবে না।মাথায় কিন্তু রক্ত উঠে যাচ্ছে।চুপচাপ রয়েছি, তোমরা সেটা থাকতে দিবে না।তাইতো?”
রোদ্দুরের কথা শেষ হতেই ঘর থেকে বিকট একটা শব্দ হলো।কিছু একটা ভাঙার শব্দ।এপাশ থেকে অহির পিলে চমকে উঠল।কি রাক্ষস রে বাবা!
সে মৃদু স্বরে বলল,
—“রোদ্দুর ভাই, আমি!আমি!অজান্তা অহি!”
রোদ্দুর কোনো উত্তর দিল না।অহি পাশে তাকিয়ে দেখে ফজিলা খালা।মধ্যবয়স্কা মহিলা,যিনি প্রায় দুই যুগ ধরে
এ বাসায় কাজ করে আসছে।তাকে ছোটবেলা থেকেই খুব আদর করে।
অহি ফজিলাকে বলল,
—“খালা,তুমি নিচে থেকে খাবার নিয়ে আসো বরং।আমি দেখছি।”
ফজিলা দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেল।অহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজায় হাত রাখে।সে মানুষটা একটু শান্তিতে,নিরিবিলিতে থাকতে চায়।কিন্তু কেন জানি ঝামেলা একদম তার পিছু ছাড়ে না।
কি হতো যদি রোদ্দুর ভাই শুরু থেকেই তাকে ভালোবাসতো?তার মনের মনিকোঠায় রাখতো?বুকে আগলে রাখতো?খুব ক্ষতি হয়ে যেত কি?
রোদ্দুর ভুল মানুষকে ভালোবেসে কষ্ট পাচ্ছে।আর সে রোদ্দুরকে ভালোবেসে কষ্ট পাচ্ছে।হিসেব বরাবর।সত্যিই প্রকৃতি সাম্যাবস্থা পছন্দ করে।
অহি ফের দরজায় মৃদু কড়া নেড়ে ভাঙা গলায় অনুরোধ করলো,
—“রোদ্দুর ভাই, প্লিজ দরজাটা খুলুন।আমি একা আছি।আশপাশে কেউ নেই।”
কয়েক মিনিট নিরবতার পর রোদ্দুর দরজা খুললো।সাতদিন পর রোদ্দুরকে দেখে অহির বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো।একি চেহারা হয়েছে রোদ্দুর ভাইয়ের?
এই কয়েক দিনে মনে হচ্ছে ওজন বেশ কমে গেছে।তালগাছের মতো লম্বা লাগছে শুধু।দাড়ি,গোঁফ আর মাথার চুলে এমাজনের জঙ্গল হয়ে গেছে যেন।চোখ দুটোতে কেমন ছন্নছাড়া ভাব।চোয়াল ভেঙে গেছে।চেহারায় কেমন অবিশ্রান্ত আর সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী ভাব।মনে হচ্ছে জগৎ সংসারের কোনো কিছুতেই তার কিচ্ছু যায় আসে না।
অহি আলগোছে বলে ফেলল,
—“একি চেহারা হয়েছে আপনার?”
রোদ্দুর কোনো উত্তর দিল না।এলোমেলো ভাবে পা ফেলে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল।অহি ভেতরে ঢুকে দেখে রুমের যাচ্ছে তাই অবস্থা।
এখানে,ওখানে সব এলোমেলো, ছড়ানো ছিটানো।কাপড় চোপড় সব মেঝেতে পড়ে আছে।ফুলদানি গুলো ভেঙে টুকরো টুকরো।পুরনো একটা ডায়েরির পৃষ্ঠা ছেড়া ছেড়া।পাশেই এক মুঠ ছাই।হয়তো আগুন জ্বালিয়ে কিছু পোড়ানো হয়েছে।
অহি ওয়ারড্রব থেকে বেছে বেছে কাপড় বের করে রোদ্দুরের হাতে ধরিয়ে বলল,
—“রোদ্দুর ভাই, গোসল করে আসুন।”
রোদ্দুর অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল।অহি তার দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তাকে টেনে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিল।
রোদ্দুর অবাক কন্ঠে বলল,
—“কি রে অজান্তা।তোর হঠাৎ এত সাহস কোথা থেকে আসলো?তুই না এতদিন আমাকে দেখলে ইঁদুরদের মতো গর্তে লুকিয়ে পড়তি।আজ হঠাৎ কেমন অধিকা৷ দেখাচ্ছিস!ব্যাপার কি?আমি ট্রমাতে আছি বলে আমায় ভয় পাবি না?”
অহির বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো।রোদ্দুর ভাই তো ঠিকই বলেছে।সে এতদিন রোদ্দুরের থেকে দূরে দুরে থেকেছে।তাকে দেখলেই কেমন ধমনীর মধ্যে দিয়ে শীতল রক্ত বয়ে যেত।আজ কি না রোদ্দুরের সাথে মুখে মুখে কথা বলছে।
সে অন্য দিকে চেয়ে বলে,
—“আপনাকে ভয় পাওয়ার কি আছে?”
—“তুই সত্যি আমাকে ভয় পাস না?তাহলে অন্য দিকে তাকিয়ে কেন কথা বলিস?চোখে চোখ রেখে কথা বল।”
অহি মনে মনে বলে,
—“আপনার চোখে চোখ রাখলে তো আমি শেষ হয়ে যাব রোদ্দুর ভাই।কেন বোঝেন না আপনি?কেন আমার ভালোবাসা বুঝতে পারেন না?”
সে মুখে কোনো কথা না বলে দ্রুত ওয়াশরুমের দরজা বাইরে থেকে লক করে নিঃশ্বাস ফেলল।তাকে সাবধানে কথা বলতে হবে।রোদ্দুর ভাই যেন কিছুতেই টের না পায় যে সে রোজ তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে।তাকে নিয়ে কল্পনার শহর সাজায়।
অহি দ্রুত মেঝের কাপড় চোপড় উঠিয়ে এক পাশে রাখলো।রুমটা আজ সে নিজ হাতে গোছাবে।
ফজিলা খাবারের প্লেট হাতে ভেতরে ঢুকে বলল,
—“আম্মা,আপনে এসব ক্যান করেন?আমি পরিষ্কার কইরা দিচ্ছি।দাঁড়ান।”
অহি বাধা দিয়ে বলে,
—“খালা,তোমার কিছু করতে হবে না।আমি পরিষ্কার করবো।তুমি খাবারটা কর্ণারের টেবিলে ঢেকে রাখো।রোদ্দুর ভাই গোসল করে।”
ফজিলা খাবার প্লেট টেবিলে রেখে ফিসফিস করে অহিকে বলে,
—“সেই সক্কাল থেইকা কেউ দরজা খুলতে পারলো না।আমি তুমি আইসা চউক্ষের পলকে খুইলা ফেললা।তুমি কি পোলাডারে জাদু করছো অহি মা?তবে হগ্গলে অনেক খুশি হইছে।”
অহি মিষ্টি একটা হাসি দেয়।সে যদি সত্যি সত্যি রোদ্দুরকে জাদু করতে পারতো!নতুন করে তার মায়ায় ফেলতে পারতো!তাহলে কত ভালো হতো।
মিনিট তিরিশেক বাদে ওয়াশরুমের দরজায় ধাক্কা পড়ে।অহি বিছানার চাদর টান করে দ্রুত গিয়ে বাইরে থেকে ছিটকিনি খুলে দেয়।
রোদ্দুর ট্রাউজার পড়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হয়।তার চোখে মুখে এক রাশ বিরক্তি।যেন চারপাশের সবকিছুতে সে বিরক্ত।
অহি আড়চোখে একবার রোদ্দুরের দিকে চেয়ে লজ্জায় চোখ সরিয়ে নেয়।রোদ্দুর খালি গায়ে বের হয়েছে।ঘরে যে এত বড়ো একটা মেয়ে গুটিশুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে তার খেয়াল নেই।
অহির মাথা ঘুরছে।কেমন যেন বমি বমি পাচ্ছে হঠাৎ করে।হাত পা কেমন অসাড় হয়ে আসতে চাইছে।সে কয়েক পা এগিয়ে বিছানার এক কোণায় বসে পড়লো।
রোদ্দুর ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিজের দিকে একবার পরখ করে বলল,
—“অজান্তা,আমি অনেক রোগা হয়ে গেছি তাই নারে?”
অহি তার দিকে না তাকিয়েই বলল,
—“হুঁ।খাওয়া দাওয়া সব ছেড়ে দিলে তো এমন হবেই।”
—“তুই বেলকনির দিকে কেন তাকিয়ে আছিস?নাকি ওদিকে আরেকটা আমি আছি?”
অহি চোখ তুলে একবার রোদ্দুরের দিকে তাকায়।রোদ্দুরকে এখন অনেকটা ফ্রেশ লাগছে।চোখে মুখে থেকে উদ্ভ্রান্ত ভাবটা অনেকখানি চলে গেছে।
সে চট করে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,
—“রোদ্দুর ভাই, কিছু খান।”
—“খাব না রে।আমি চব্বিশ ঘণ্টার অনশন করছি।মাত্র সতেরো ঘন্টা হয়েছে।একেবারে ডিনার টাইমে খাব।”
—“একদম ঢং করবেন না।এমন ভাব করছেন যেন আর কারো বিয়ে ভেঙে যায় না।বছরের পর বছর সংসার করার পর বউ অন্যের সাথে পালিয়ে যান তারা কিভাব৷ বাঁচে?”
অহি একটানে বলার পরেই জিভ কাটে।ছি!কি বলতে কি বলে ফেলেছে।চোখ বন্ধ করে নিজেকে জঘন্য একটা গালি দেয়।
সঙ্গে সঙ্গে রোদ্দুর তার হাত চেপে রাগান্বিত কন্ঠে বলে,
—“তোর মনে হচ্ছে আমি ঢং করছি?”
অহি ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে দেখে রোদ্দুরের দু চোখ অগ্নিকুণ্ডের মতো জ্বলছে।সে তোতলানো স্বরে বলে,
—“আ-আসি আসলে তা বো-বোঝাতে চাই নি।”
রোদ্দুর কোনো কথা না বলে তাকে একটানে রুম থেকে বের করে মুখের সামনে ঠাস করে দরজা আটকে দেয়।
(চলবে)
🖤 কেমন হচ্ছে জানাবেন সবাই।রিচেক করিনি।ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।🥰