–“রোদ্দুর ভাই, এতরাতে আপনি আমাদের এখানে কেন?আপনার না আজ বিয়ে ছিল?”
রোদ্দুর কিছু না বলে দু পা এগিয়ে এসে অহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।অহি চমকে যায়।ভীষণ চমকে যায়।তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।তার জানামতে আজ রোদ্দুরের বিয়ে এবং হিসেব অনুযায়ী তাকে এতক্ষণে বাসর ঘরে থাকার কথা।কিন্তু বাসর ঘর ফেলে রোদ্দুর তার বাড়িতে?কেন?

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রোদ্দুরের ফোঁপানো শব্দ অহির কানে বাজে।অহি আরেক দফা চমকায়।রোদ্দুরের মতো স্ট্রং একটা ছেলে কান্না করছে?তাহলে কি কোনো ভাবে বিয়েটা হয়নি?কনে পালিয়েছে বা অন্যকিছু?

নিজের ভেতর এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করে অহির।তার রোদ্দুর ভাই তাহলে বিয়ে করেনি!সে দুহাত রোদ্দুরের পিঠে রেখে জড়িয়ে ধরে।তার নিজেরো চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করে।

–“অজান্তা,ও আমায় নাকি ভালোবাসে না।এতদিন নাকি প্রেমের অভিনয় করেছে।শেষ মুহুর্তে সব ভেস্তে দিয়ে চিঠি লিখে পালিয়েছে।বৃষ্টি প্রথমবার যখন আমায় প্রোপোজ করেছিল,ভার্সিটির সবার সামনে ওকে রিজেক্ট করেছিলাম।সেই অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই ও নাকি তিনটে বছর ভালোবাসার নাটক করেছে। ”

রোদ্দুরের ভেজা কন্ঠ কানে আসে অহির।রোদ্দুরের সব কথা ছাপিয়ে তার মুখে অজান্তা ডাকটা যেন প্রতিধ্বনি হয়ে বার বার কানে বাজে।ছোটবেলা থেকেই রোদ্দুর তাকে অজান্তা বলে ডাকে।কখনো অহি বলে ডাকেনি।

রোদ্দুরের যেন হুশ নেই।কিন্তু অহির পা ধরে এসেছে।তাছাড়া রোদ্দুর নিজের সম্পূর্ণ ভর তার উপর ছেড়ে দিয়েছে।এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে নিশ্চিত পা ভেঙ্গে পড়ে যাবে।

–“রোদ্দুর ভাই,আমায় ছাড়ুন।একটু বেডে বসুন।”

অহির কথায় কর্ণপাত করে না রোদ্দুর।যেরকম ছিল, তেমনই থাকে।অগত্যা সে নিজে থেকে রোদ্দুরকে ঠেলে নিজের বেডে বসায়।নিজেও ধপ করে রোদ্দুরের পাশে ধপ করে বসে বড় বড় করে শ্বাস নেয়।তারপর বলে ফেলে,

–“একটুর জন্য তো আমার শ্বাসটাই চলে যাচ্ছিল।এভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে?”

রোদ্দুর তার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায়।তা দেখেই অহি ভয় পেয়ে যায়।সঙ্গে সারামুখে লজ্জার আভা ছড়িয়ে পড়ে।ছি!কি বলতে কি বলে ফেলেছে।

নিজেকে সামলে সেন্টার টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি এনে রোদ্দুরের সামনে ধরে বলে,

–“রোদ্দুর ভাই, পানিটা খান।”

রোদ্দুর দ্বিরুক্তি না করে পানির গ্লাস হাতে নেয়।ঢকঢক করে পুরো গ্লাস শেষ করে।অহি তার দিকে পূর্ণদৃষ্টি দেয়।

রোদ্দুরের চোখ ফোলা ফোলা।মুখে এখনো শুষ্ক পানির বলিরেখা।চোখের মণি অস্বাভাবিক লাল হয়ে গেছে।পরণের পাজামা পাঞ্জাবির ভাঁজ এলোমেলো হয়ে গেছে।চুল গুলো অবিন্যস্ত।তবুও কি সুন্দর লাগছে তাকে!এতসুন্দর মানুষ কি পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউ আছে?

অহি বড়ো করে ঢোক গিলে।

রোদ্দুর তার মায়ের সৎ বোনের ছেলে।তার নানাভাই দুই বিয়ে করেছিল।রোদ্দুর ভাইয়ের মা ছিল প্রথম পক্ষের।আর তার মা দ্বিতীয় পক্ষের।কিন্তু দু বোনের সম্পর্ক এক আত্মার। বড় খালা তার মাকে খুবই ভালোবাসে,নিজেই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে তার মাকে।দু পরিবারের মধ্যে খুবই ভালো সম্পর্ক।

ছোটবেলা থেকে দু পরিবারের মধ্যে যাতায়াত ছিল অনেক ঘন ঘন।রোদ্দুর ভাইয়ের থেকে সে বয়সে অনেক ছোট।

‘রোদ্দুর হিম’ নামক মানুষটার অতিরিক্ত রাগের জন্য অহি তাকে ছোটবেলা থেকেই ভয় পায়।যতটা সম্ভব দূরে দূরে থাকে। ছোটবেলা থেকে কুকুর তার ভীষণ অপছন্দের। সে যখন ক্লাস ফোরে তখন রোদ্দুর একবার ইচ্ছে করে তার কোলে নিজের পোষা কুকুর ছেড়েছিল।সেই কুকুর আবার তাকে আঁচড়ে দিয়েছিল।সেদিন কি যে ভয় পেয়েছিল!

তারপর থেকে ইচ্ছে করেই রোদ্দুর নামক ভয়ানক প্রাণীটাকে সে এভোয়েড করে চলতো।তাকে নিয়ে কোনো আলাদা ফিলিংস কাজ করতো না।

কিন্তু সেদিন যেন হুট করে সব চেঞ্জ হয়ে গেল।চেনা রোদ্দুর যেন তার কাছে অচেনা হয়ে গেল।তাকে নিয়ে অন্য রকম স্বপ্ন বোনা শুরু করলো।

সে তখন সদ্য ক্লাস টেনে উঠেছে।সারাদিন বাদল ঝরা শ্রাবণের এক সন্ধ্যায় কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলে দেখে রোদ্দুর দাঁড়িয়ে আছে।একদম কাকভেজা হয়ে।

রোদ্দুরের সমস্ত শরীর বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ে ফ্লোরে বন্যা বানিয়ে ফেলছে।তার চুলগুলো জবজবে হয়ে কপালে লেপ্টে আছে।ভ্রু যুগল বেয়ে পানির ধারা।চোখের পাতা ভিজে ভারী হয়ে আছে যেন।খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গুলো যেন স্বগর্ভে দাঁড়িয়ে আছে।রক্তিম ঠোঁটের উপর অযাচিত বিন্দু বিন্দু জলরাশি।যেগুলো যেন অহিকে চুম্বকের মতো তার দিকে টানছে।

কতক্ষণ এভাবে তাকিয়ে ছিল জানা নেই।রোদ্দুরের ধমকে সে দরজা থেকে সরে যায়।

তারপর যেন তার কি হয়ে যায়।মনের ভেতর অন্য রকম অজানা অনুভূতি হয় রোদ্দুরকে ঘিরে।প্রতিরাতে স্বপ্ন দেখা,তাকে কল্পনা করতে করতে ঘুমিয়ে যা-ওয়া তার নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়।

একটা সময় সে বুঝতে পারে সে রোদ্দুর হিম নামক মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলেছে।কিন্তু ততদিনে রোদ্দুর নিজেকে অন্য কারো মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে।

তাই তার এক তরফা ভালোবাসা পূর্ণতা পায়নি।

—“এভাবেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকবি?”

রোদ্দুরের কথায় ঘোর কাটে অহির।ব্যতিব্যস্ত হয়ে রোদ্দুরের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে টেবিলে রাখে।ফের তার পাশে এসে বসে বলে,

—“রোদ্দুর ভাই, সব ঠিক আছে?”

—“কিচ্ছু ঠিক নেই।আর হবেও না।আমি সেই বিকেল থেকে কান্না করতে করতে ক্লান্ত এখন।আমি এখন ঘুমাব।তোর রুমে আসার আগে ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েছি।চিন্তা করিস না।২০ এমজির একটা খেয়েছি মাত্র।”

অহিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রোদ্দুর বিছানায় গা মেলে দিল।অহি ঝটপট বলল,

—“রোদ্দুর ভাই, আপনি গেস্ট রুমে যান।এটা আমার রুম।বাসায় কাজের লোক বাদে আর কেউ নেই।সব আপনাদের বাসায়।আপনি না হয় যে কারো রুমে ঘুমান।কিন্তু আমার রুমে নয়।উঠুন!”

রোদ্দুর উত্তর দেয় না।অহি রোদ্দুরের বাহুতে ধাক্কা দিতেই………

(চলবে)

#গল্পের_নাম:পরিশিষ্ট
#লেখিকা : অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_০১

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here