#জীবনসঙ্গী_১২
#Chhamina_Begam
-“এত তাড়াহুড়ো করার কি কোনো প্রয়োজন ছিল আব্বু ? অন্তত একদিন সময় নিতে পারতে ভাবার জন্য । বানির মতামত না নিয়েই ওর জীবনের এতবড় একটা সিদ্ধান্ত কিভাবে নিয়ে ফেললে তুমি !ওর মতামত নেওয়া কি জরুরি ছিল না ?”
রাহাত ওর পরিবারসহ বিদায় নিয়েছে ঘন্টা খানেক আগে । এখন রাত প্রায় পৌনে দশ’টা । রাতের খাওয়া সাড়া হয়ে গেছে ইতিমধ্যে । অবশ্য অতিথি দের খাইয়ে দাইয়েই বিদায় দেওয়া হয়েছে । এই মুহূর্তে লিভিং রুমে বসে আলোচনার আসর বসিয়েছেন আরাফাত সাহেব । চোখমুখে তার খুশি উপচে পড়ছে । অবশ্য খুশি হওয়ারই কথা । একমাত্র কন্যা দায়গ্ৰস্থ পিতাই জানেন নিজের আত্মজাকে সুপাত্রস্থ করার মধ্যে কি অপার শান্তি লুকিয়ে থাকে ।সেই তৃপ্তির ভাষা হয় না । শুধু সবসমক্ষে বুকের ছাতি অনেকখানিই যেন চওড়া হয়ে যায় । এই মুহূর্তে তিনি বড়ো শ্যালক আর ছেলে সাকিবের সঙ্গে শলা পরামর্শ করতে বসেছেন আঁকদের অনুষ্ঠানে কাকে কাকে নিমন্ত্রণ করবেন সেই নিয়ে । এত তাড়াতাড়ি তো আর কাউকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলা সম্ভব নয় তাই সবাইকে একে একে ফোনে জানানো হবে । তাই সায়ন বসেছে তাদের লিস্ট করতে । সবার মুখে খুশি ঠিকরে পড়লেও সাকিব কেন যেন খুশি হতে পারছে না । হ্যাঁ , রাহাত আর ওর পরিবারকে পছন্দ হয়েছে ওর তবুও মনে হচ্ছে সবকিছু এত দ্রুত না হলেও ক্ষতি কিছুই হতো না । একেবারে দেখতে এসেই আংটি পড়িয়ে দিয়ে একদিন বাদে আকদের সিদ্ধান্ত করা , এই বিষয়টা ওকে ভেতরে ভেতরে খুচিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু তখন বাবাকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে কিছু বলার মতো পরিস্থিতিও ছিল না । আরাফাত সাহেব আগেই সম্মতি দিয়ে বসে আছেন । আর তখন আত্মীয়দের মানা করা মানে নিজের পিতাকে তাদের সামনে অপদস্থ করা । এটা আর যাই হোক সাকিব কখনোই করত না । কিন্তু আব্বুর উচিত হয়নি এত তাড়াহুড়ো করা । এমন তো নয় যে ওর বোনের কোনো দোষ ত্রুটি আছে , অথবা খারাপ রেপুটেশন আছে । সাকিবের মনটাই তিক্ত হয়ে যায় । আব্বুর এমন হুটহাট সিদ্ধান্তের জন্য অনেক বার ভুগতে হয়েছে তাদের । কিন্তু তাই বলে নিজের মেয়ের বিয়েতেও তিনি এই রকম বেহিসেবি আচরণ করবেন । এটা পেনসিল দিয়ে সাদা কাগজে লেখা কোনো লাইন নয় যে ভুল হলে শুধরে দেওয়া যাবে । তাই একরকম রুক্ষ্ম স্বরেই সাকিব কথাগুলো বলতেই গর্জে ওঠেন আরাফাত সাহেব ।
-” কি বলতে চাস তুই , হ্যাঁ? আমার মেয়ের বিষয়ে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারব না ! ওর ভালোর জন্য কিছু করতে চাইলে আমাকে তোমাদের মতামত নিতে হবে ?”
-“আমি কিন্তু সেটা বলিনি আব্বু । অবশ্যই তোমার অধিকার আছে ওর বিষয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার । কিন্তু সে তো এখন আর ছোট নয় । নিজের ভালো খারাপ সব কিছুই বোঝে । তুমি বিয়ের মতো এতো বড়ো একটা সিদ্ধান্ত ওর মতামত না নিয়েই ঠিক করে ফেললে এটা কিন্তু উচিত হয়নি তোমার । ”
-” ওহ ,তাই নাকি ? এখন কি আমার তোর কাছ থেকে শিখতে হবে কোনটা উচিত আর কোনটা অনুচিত ?”
এবার আর নিজেকে সংযত রাখতে পারল না সাকিব । মুখনিঃসৃত কথাগুলি এবার বাক্যবাণ হয়ে বেরিয়ে এল ,
-” হ্যাঁ , প্রয়োজন হলে তাই করবে । তবুও এমন অনাচার আমি হতে দেব না বানির সাথে । সবসময় তুমি নিজের ইচ্ছে আমাদের ওপর চাপাতে পারো না । এই অধিকার তোমার নেই আব্বু ।”
সায়নও এতক্ষণ থেকে উশখুশ করছিল কিছু বলার । আপুর বিয়ে নিয়ে আব্বুর সিদ্ধান্ত টা ওর একেবারেই মনপুতঃ হয়নি । তাই সেও গলা মেলালো ,
-হ্যাঁ , ভাইয়া ঠিক বলেছে । তুমি সবসময় নিজের সিদ্ধান্ত আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারো না । আর আপুর জীবনের এত বড়ো একটা ডিসিশন তুমি একা একাই কিভাবে নিয়ে নিলে আব্বু ? একবার আপুকে জিজ্ঞেস করলে না আপুর ওনাকে পছন্দ হয়েছে কিনা ? আপুকে কি তোমার পুতুল মনে হয় ? যখন যেভাবে খুশি নাচাতে থাকবে ।”
আদিলার মামা আর চুপ থাকতে পারলেন না । দুই পক্ষকেই শান্ত করতে এগিয়ে এলেন ,
-” আহঃ কি হচ্ছে এসব । তোরা সবাই এমন করছিস কেন ? এত ভালো একটা প্রস্তাব কি সচরাচর পাওয়া যায় । তাই শুভ কাছে দেরী কিসের ? আর রাহাত ছেলেটা তো খারাপ নয় । ফাহিমের বন্ধু হয় বলেই না আমরা এগোলাম । নাহলে নিশ্চয়ই বাজিয়ে দেখা যেত । কিন্তু তোরা কি শুরু করলি বলতো ? ”
নিজের দুই ছেলেকে নিজের বিরুদ্ধে যেতে দেখে মারমুখী ভঙ্গিতে তেড়ে এলেন আরাফাত সাহেব । ক্রোধে তার চোখজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে ।
-“আমার ওপর চিৎকার করছিস তুই ? অধিকার চেনাচ্ছিস ? রেহনুমা , ওকে সাবধান করে দাও এদের আমার বাড়িতে থাকতে হলে আমার কথা মতো চলতে হবে । না হলে দরজা খোলা আছে যার ইচ্ছে বেরিয়ে যেতে পারে । ”
কথায় বলে টিনেজের ছেলেমেয়েদের আবেগ বেশি থাকে । আবেগের বশবর্তী হয়ে দুঃসাহসিক কাজ করতে তাড়া কখনোই পিছপা হয় না । সায়নও তো এখনো কৈশোর পেরোয়নি । নিজের বোনের জন্য ঢাল হয়ে দাড়াতে চাইল সে । এ যেন বিনা তরবারী হাতে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়া ।
-“হ্যাঁ । দরকার পড়লে চলে যাব । থাকব না এখানে । কারো হাতের পুতুল হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে একা থাকা অনেক ভালো । কিন্তু একটা কথা মনে রেখো আপুর সাথে কোনো অন্যায় আমি হতে দেব না । সব কিছুতে তোমার জোচ্চরি খাটাতে আসবে না । অনেক হয়েছে, আর না । গতবার ও তুমি প্রায় জোরজবরদস্তি করে রহিম চাচার জুয়াড়ি ছেলের সাথে ধরেবেঁধে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলে । কিসের জন্য ? শুধুমাত্র রহিমচাচা প্রভাবশালী ব্যক্তি বলে, তার অনেক সয়সম্পত্তি বলে তার ছেলের খোঁজখবর না নিয়েই সব ঠিক করে ফেলেছিলে তুমি । ভাইয়া খোঁজ খবর না নিলে তো তুমি একপ্রকার ভাসিয়েই দিচ্ছিলে আপুকে । আপু তোমাকে সম্মান করে কখনো তোমার কথার ওপর কথা বলে না । কখনো অভিযোগ জানায়নি । তাই বলে তুমি যা ইচ্ছে তাই করবে ? ভালো খারাপের বাছবিচার করবে না ? ”
ক্রোধ সংবরণ করতে না পেরে আরাফাত সাহেব সরোষে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় সায়নের গালে । এতক্ষণ ভীত চোখে রান্নাঘরে দরজা ঘেষে দাড়িয়ে থাকলেও এবার দৌড়ে এসে ছেলেকে আড়াল করে ফেলেন রেহনুমা ।
– “কি করছ এসব ? পাগল হয়ে গেলে নাকি । এত বড়ো ছেলের গায়ে কেউ হাত তোলে ? আর ভুল কিছু বলেনি ও । তোমার বেহিসেবি স্বভাব কি কখনোই যাবে না !এভাবেই তো কতবার ঠেকলে ! আর কত ?”
-“চুপ করো তুমি । এই তোমার জন্যেই সবাই লাই পেয়ে এক একটা বাদড় তৈরি হয়েছে । আমার কথার কোনো মূল্যই নেই তাদের কাছে । আমি কি আমার মেয়ের খারাপ চাই না কি ? খোঁজখবর নিয়েই তো এগিয়েছি ? আর কি করতে বলো তোমরা আমাকে, হ্যাঁ ?তোমাদের কথা শুনলে আমার মেয়ের কখনো বিয়েই দিতে পারব না আমি । যত্তোসব গাধার দল এসে ভিড়েছে আমার সংসারে । আচ্ছা, ডাকো আদিলাকে ? ওই এসে বলুক ওর আপত্তি আছে কি না !আদিলা ? আদিলা? এদিকে আয় তো শিগগির ,, ”
বাবার ডাকে চমকে উঠল আদিলা । আরাফাত সাহেবের রুদ্র মূর্তি ওকে ভেতর থেকে কাপিয়ে দেয় । ঝগড়াঝাটি বিষয়টা কখনোই কোনো পরিবারের জন্য সুখকর নয় । অনেক পিতা মাতাই বোঝে না তাদের দ্বন্দ্বের কারণে তাদের সন্তান কতটা মানসিক নিপীড়নের মধ্যে দিন অতিবাহিত করে । তাদের প্রতিটি দিন কতটা আতংকে কাটে ! একটু উচ্চবাচ্য হলেই মনে হয় এই বুঝি ঝগড়া লেগে গেল !আর এবারের ঝগড়ার কেন্দ্রবিন্দু যে সে এই কথাটা ভাবতেই হৃদয়টা মোচড় দিয়ে উঠল আদিলার । একদিকে ভাই অন্য দিকে বাবা । কার পক্ষ নেবে সে ? কাকে ভুল প্রমান করবে ? ভাইয়ের পক্ষে মতামত দিলে বাবার সাথে সাথে নিজের অনূভুতি গুলোকেও অপমান করা হয় । আবার বাবাকে সমর্থন করলে নিজেকে চুড়ান্ত অসম্মানের অনিশ্চিত দরিয়ার ফেলে দেবে সে । কি করবে আদিলা ? কি করা উচিত ওর ? আমাদের দেশের প্রায় বেশিরভাগ মেয়েই বাবামায়েদের সিদ্ধান্তের ওপর নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে ইতস্তত করে । পরিবারের সম্মানহানির ভয়ে নিজেকে ডুবিয়ে দেয় অকূল সাগরে । কেউ কেউ খুঁজে পেতে খড়কুটো জোগাড় করে ঠিক পাড় পেয়ে যায় । কেউবা অসহায় হয়ে ডুবে মরে । তবুও এ তাদের কাছে সম্মানের , সমাজের চোখে এটাই যুক্তিযুক্ত । আদিলাও না হয় তাদের দলে নাম লেখাবে !কি হলো তাতে যদি বাকি আর পাঁচটা মেয়ের মতো সেও সমাজ নামক ব্যবস্থার অলিখিত চিন্তাধারার সাথে একাত্ম হতে গিয়ে মিশে যাবে অগনিত ভীড়ের মাঝে । তবুও আদর্শ কন্যার তকমাটা তো ওর জন্য বহাল থাকবে । বাবার ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে পদযুগল টলে ওঠে ওর । দরজায় হাত রেখে নিজেকে সামলে নিয়ে কম্পিত কন্ঠ বলে ওঠে ,
– “আমি বিয়ে করব আব্বু । তোমরা আয়োজন শুরু করো ।”
বলেই দরজা বন্ধ করে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয় আদিলা । ও জানে এই মুহূর্তে বড়ো ভাইয়া দুঃখি দুঃখি চোখে ওর ঘরের দিকেই চেয়ে আছে। হয়তো অভিমান করবে ওর ওপর । কথা বলবে না দুদিন । তারপর আস্তে আস্তে আদিলা মানিয়ে নিতে শিখবে । দাদাও ওকে ভালো থাকতে দেখে ভুলে যাবে সব অভিমান , সব অভিযোগ । আর আব্বু , তিনি হয়তো এখন বিশ্বজয়ের হাসি হাসছেন । তীর্যক মন্তব্য করবেন ভাইয়াকে । বলবেন ‘তিনি জানতেন তার মেয়ে কখনোই তার সিদ্ধান্তকে অবহেলা করবে না ‘। তৎক্ষণাৎ ওর ভাবনাকে সার্থক করে আরাফাত সাহেবের দীপ্ত কন্ঠস্বর শুনতে পায় আদিলা । নিজের প্রতি বিতৃষ্ণায় ভরে যায় । ভালো মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে ভীষণ ক্লান্ত লাগে নিজেকে । আজ প্রথমবারের মতো আদিলার মনে হয় সে নিজেকে যতোটা শক্ত মনে করে আসলে সে ততটা নয় । তার স্বৈরাচারী বাবার সামনে সে আজও বড়ো দূর্বল ।
বসার ঘর থেকে ক্ষীণ স্বরে ভেসে আসে সাকিবের কথা ,
-“আমি তোমার প্রতিদন্দ্বি নই আব্বু ।কখনোই ছিলাম না । বানির ভালো থাকাটাই আমার সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি । তাই আমি দোয়া করব তোমার সিদ্ধান্ত যেন ভুল না হয় !”
(চলবে)