#জীবনসঙ্গী_১১
#Chhamina_Begam
বাড়ির সামনে এসে থমকে দাড়ায় আদিলা । পুরো বাড়ি মানুষের কোলাহলে মুখরিত হয়ে আছে । থেকে থেকে আম্মু , আব্বু , আবার একটা নতুন অথচ চেনা কন্ঠস্বর ভেসে আসছে বাইরে । কি ব্যাপার ? সাধারণত বাড়িতে আব্বু ছাড়া অন্য কারো উচ্চস্বর শোনা যায় না । আজ ব্যাতিক্রম কেন ? কেউ কি এসেছে ? ভাবতে ভাবতেই কয়েক পা এগোতেই সদর দরজা দিয়ে একটা শিশু দৌড়ে আসে । মুহূর্তেই হাসি ফুটে আদিলার মুখে । শিশুটিও ওকে দেখেই ‘ফুপ্পি-ফুপ্পি’ বলে দৌড়ে আসে । পেছন থেকে শোনা যাচ্ছে ফারিহা ভাবির কন্ঠস্বর ,
-“রহিদ , দাড়াও ,,,কোথায় যাচ্ছ ? আরে , এদিকে এসো বলছি !দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে !গোসল করতে হবে তো …..”
রহিদকে ডাকতে এসে ফারিহা সামনে আদিলা আর মামা শশুরকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আলগোছে মাথায় ওড়না তুলে দেয় । ফারিহা -আদিলা মৃদু হাসি বিনিময় করে । রহিদ ততক্ষণে আদিলার কোলে উঠে পড়েছে । বাড়ির ভেতর যেতে যেতেই রহিদকে আদর করে দিয়ে আদিলা প্রশ্ন করে ,
-” আমার ছোট আব্বুটা এখনো গোসল করেনি কেন ?”
-“আমি আব্বুর সাথে গোসল করব । কিন্তু দেখো না , আম্মু শুনছেই না । তুমি বলে দাও না আম্মুকে, ফুপ্পি ।”
-“উম হু। এটা তো ঠিক নয় আব্বু । দেরি করে গোসল করলে ঠান্ডা লেগে যাবে তো !”
-” না না ,,,আব্বু বলে আমি বড়ো হয়ে গেছি । তাই আমি বড়োদের মতো পরে গোসল করব । ”
-“ও হো , পাকা বুড়ো একটা !” বলেই নাকের ডগা টিপে আদর করে দেয় আদিলা । রহিদ কোমল স্বরে হেসে ওঠে ।
হাতমুখ ধুয়েই খেতে বসেছে আদিলা । সেই ভোর বেলা ফজরের নামাজ পড়েই বেরিয়েছে মামার সঙ্গে , তার পর আর খাওয়া হয়নি । মামানি নাস্তা টিফিন করে দিয়েছিল কিন্তু গাড়িতে খেতে ইচ্ছে করেনি । রাস্তার অবস্থা এত খারাপ ছিল যে খেলেই পেট ব্যাথা হত । যদিও এখন বুঝতে পারছে না মামা এত তাড়াহুরো করে কেন নিয়ে এলো ওকে ? হয়তো আব্বু কাউকে দাওয়াত করেছে , লোক দেখতে আসতে পারে । এ সবই সম্ভাবনা । আদিলা এত কিছু ভাবতে চাইল না । ক্ষিদেয় পেট চো চো করছে তার । পাশেই ফারিহা গল্প বলতে বলতে রহিদকে খাইয়ে দিচ্ছে । আদিলা রেহনুমাকে ডাকল ,
-“আম্মু , আমাকে আর একটু ডাল দাও তো ”
রেহনুমা ডাল দিয়ে আদিলাকে বলে গেল খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম করেই যেন গোসল করে নেয় । আর সাথে নিজের ঘরটাও যেন গুছিয়ে নেয় । আদিলা খেতে খেতেই মাথা নাড়ে । ফারিহার দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করে , ব্যাপার কি ?
-“তোমাকে আজ দেখতে আসবে !”
-“ওহ ”
আদিলার ভাবনা মিলে যাওয়ায় ভীষণ বিরক্ত হলো সে । চুপচাপ খাওয়ায় মন দিল । ওর নিস্পৃহ আচরণ দেখে ফারিহা কথা ঘুরিয়ে ফেলে ,
-“আরুশি কেমন আছে এখন ? ডেলিভারির ডেট কি দিয়ে দিয়েছে ? ”
-“হ্যাঁ , সামনের মাসের আঠারো তারিখ ”
-“আচ্ছা ”
-” সায়নটা কোথায় গেল ? ”
-” সায়ন তো মনে হয় ওর ঘরে !পড়ছে । এত পড়াকু ছেলে আমি জীবনে দেখিনি !”
হাসল আদিলা । বললো,
-“ও অমনি । সারাবছর ঠিক মতো বইয়ের কাছেও ঘেষবে না । আর পরীক্ষা এসে গেলে সারাদিন বই ছেড়ে উঠবে না । এখন ওকে কিছু বলাও যাবে না । তাহলেই ঝাড়ি খেতে হবে । ”
ওর কথায় ফারিহাও মৃদু হাসল।
-“ভাবি ,বললে না তো ভাইয়া কোথায় ? এসে থেকেই দেখছি না ? কোথাও গিয়েছে কি ? ”
– “তোমার ভাইয়া একটা কাজে বেরিয়েছে । আসলে ট্রান্সফারের কথা চলছে তো , তাই ।”
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই বিষম খেয়ে নাকে মুখে ভাত উঠে যায় আদিলার । রেহনুমা দৌড়ে আসে রান্নাঘর থেকে । ফারিহা , রেহনুমা দুজনেই জলের গ্লাস এগিয়ে দেয় ।
-“খাওয়ার সময় এত তাড়াহুড়ো কিসের তোর ? আস্তে আস্তে খেলে কি হয় ? এমন ভাবে খাচ্ছিস যেন একটু দেরী হলেই ট্রেন মিস করে ফেলবি !”
নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু হেসে আদিলা বললো ,
-“আমি ঠিক আছি আম্মু ।তুমি যাও , কি করছ , করো গিয়ে ,, ”
রেহনুমা সাবধানে খেতে বলে আবার ব্যস্ত পায়ে ফিরে গেলেন রান্নাঘরে । বিকেলে মেহমানরা আসবে । তাদের খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে তাকে । আম্মু চলে গেলে আদিলা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে প্রশ্ন করল ফারিহাকে ,
-“তুমি সত্যি বলছ ? ভাইয়ার এখানেই ট্রান্সফার হচ্ছে ? ”
-“হ্যাঁ, অনেক দিন থেকেই চেষ্টা করছিল । এবার মনে হয় হয়ে যাবে । ”
-“আলহামদুলিল্লাহ । আমার যা আনন্দ হচ্ছে না ভাবি । মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি । এই যে ছোট আব্বু , আমাকে একটা চিমটি কাটো তো , দেখি জেগে আছি কি-না ”
রহিদ চিমটি তো দিল না বরং এটো মুখেই আদিলার গালে টকাশ করে চুমু খেয়ে বসল । আদিলা গালে হাত দিয়ে ঠোঁট উলটে কপট অভিমানে বললো,
-“ইস , এটো মুখে কেউ চুমু দেয় ! ”
হেসে উঠল মা ছেলে । রহিদ বললো ,
-“ফুপ্পি-ফুপ্পি, এদিকে ঘুরে বসো দেখি , ওই গালেও দেই একটা । আম্মু বলেছে সবসময় দুটো চুমু দিতে হয় । নাও ঘোরো তো”
রহিদ মুখ এগিয়ে নিয়ে গেলে , আদিলা মুখ সরিয়ে নিয়ে বলে ,
-” নাআ , আমার আর লাগবে না । একটাই যথেষ্ট । এই দেখ, আমার গাল থেকে কেমন ডাল ডাল গন্ধ পাচ্ছি এখন !ইস এত নোংরা আমার আব্বুটা ! ”
রহিদ মজা পেয়ে হেসে উঠল ,আদিলার একটা হাত ধরে টানাটানি করে লাগল ।
অনেক দিন পর নিজের ঘরে ঢুকে শান্তি অনুভব করছে আদিলা । সারা ঘরে একবার চোখ বুলিয়েই গা এলিয়ে দেয় বিছানায় । আহঃ কি আরাম । নিজের ঘরের মতো কি শান্তি কোথাও পাওয়া যায় ? থাকলে ঠিকানা টা জানতে হবে । আদিলার ঘর টা একটু ভিতরের দিকে । দক্ষিণমুখী জানালাটা দিয়ে শীতের মিঠি মিঠি সোনালী রোদকন্যা প্রবেশ করে আরামদায়ক অনুভূতি দিচ্ছে । ঘড়ির দিকে চোখ বোলালো আদিলা । বারোটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট । দশ মিনিটের মতো বিশ্রাম নিলেই হবে ভেবেই চোখ বন্ধ করে সে । আস্তে আস্তে তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে , যাকে দুপুরের ভাতঘুম বললেও ভুল হবে না । শাশুড়ির কথায় ফারিহা বার কয়েক ডাকতে এসেছে আদিলাকে । কিন্তু সে গভীর ঘুমে জন্য আর ডাকেনি । লোক তিনটায় ঢুকবে বলছিল । সেই হিসেবে এক ঘন্টা আগেই জাগিয়ে দিলেই হবে ।
সদ্য গোসল সেরে নামাজ পড়ে মায়ের কাছে এসে দাড়িয়েছে আদিলা । খুব বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লেই ওর ভীষণ ক্ষিদে পায় ।কিছু একটা খেতে ইচ্ছে করছে । বয়ম থেকে কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে খেতে খেতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে আদিলা । রেহনুমা এক মনে মশলা বাটছে । অন্যদিকে ফারিহা কিছু একটা ভেজে তুলছে ।দুজনেই এত ব্যস্ততা যে ফারিহা ওকে খেয়াল করে মৃদু হাসলেও রেহনুমা ওর উপস্থিতি টের পায়নি । এখনো গোসল হয়নি রেহনুমার । পড়নের শাড়িটাই তার সাক্ষ্য দিচ্ছে । এই শীতের বিকেলেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যাচ্ছে । অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আদিলা । প্রতিবার যখনই কেউ দেখতে আসতে চায় আম্মু একা হাতে সবকিছু সামলায় । তবুও আদিলাকে বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে দেয় না । এবার অবশ্য ভাবি আছে তাই রক্ষে ।আম্মু এত পরিশ্রম কীভাবে করে কে জানে ? কিছু বললেই বলেন , ছেলেমেয়েদের ভালোর জন্য কিছু করতে চাইলে বাবামায়েদের নাকি কষ্ট হয় না । কি অসম্ভব মিথ্যা কথাটাই না বলে তারা । দিন শেষে পরিশ্রান্ত হয়ে , এক রাজ্য সমান অসুখ বাধিয়ে হাসি মুখে সন্তানের মঙ্গল কামনা করে যায় তারা । আদিলা ধীর পায়ে বেরিয়ে আসে সেখান থেকে । খুব খারাপ লাগছে ওর । ওর বিয়ে নিয়ে এত তাড়া সবার অথচ এই ‘বিয়ে ‘ শব্দটাকেই সে হিংস্র বাঘের মতো ভয় পায় । কম তো দেখল না এই বাইশ বছরের ছোট্ট জীবনটাতে ।ভালোবেসে বিয়ে করেছে বলে ফারিহা ভাবির সাথে আব্বু আজ অবধি ভালো করে দুটো কথা বলে না । ফারিহা পারত পক্ষে শশুরের সামনে পড়তে চায় না । একি বাড়িতে থেকে যখন দুটো মানুষ সারাক্ষণ একে অপরকে এড়িয়ে চলে সেই দৃশ্য টা পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য কতটা অস্বস্তিকর সেই কথাটা আব্বুকে বোঝায় কে ? এই কারণেই মাঝে মাঝেই অশান্তি বাধে ভাই-ভাবির মধ্যে । আদিলা সবটাই জানে । সব তো চোখের সামনেই ঘটছে । তবুও কিছুই করার নেই । আব্বু মানুষটাই একরোখা , জেদি , গোয়ার স্বভাবের । যদিও নিজের পিতা সম্পর্কে এসব ভাবতে ইচ্ছে করে না আদিলার । কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে ভাবনারা চলেই আসে আপনাআপনি । এতে ওর কোনো হাত নেই । আবার তোহার কথাই ধরা যাক । কলেজ জীবনের সব থেকে কাছের বান্ধবী ছিল তোহা । প্রেম করে বাবা মায়ের সম্মতিতে বিয়ে করল আসিফকে । অথচ এমন পরিস্থিতি দাড়িয়েছে যে বিয়ের দেড় বছরের মাথায় দুজনেই ডিভোর্সের পিটিশন ফাইল করেছে । কলেজে থাকতে যে দুজন সারাক্ষণ খুনসুটি , প্রেমালামে মজে থাকত আজ তারাই একে অপরকে দুচোখে সহ্য করতে পারে না । চার দেয়ালের ভেতরে একে অপরকে করা তীর্যক মন্তব্য গুলো নাহয় অবলাই থাক, লোকের সম্মুখে , পরিবারের ছোট বড়ো সকলের সামনে একে অপরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য , অপমান করতে বাধে না ওদের । আদিলার বুঝে আসে না বিয়ের আগে যারা সারাটাদিন কপোত-কপোতির ন্যায় সারাক্ষণ বাকবাকুম করত আজ তারাই একে অপরকে সারাক্ষণ বিষবাক্য দারা আঘাত করে কি করে ? আদিলা শান্তি প্রিয় মানুষ । যেচে পড়ে বিপদ বাড়াতে তাই ইচ্ছে করে না ওর । কিন্তু মনটা বড়ো অবুঝ আজ । শয়নে-স্বপনে-জাগরণে শুধু একটাই নাম জপ করে যাচ্ছে । আদিলার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ।
-“আদিলা, আম্মু এই শাড়িটা তোমাকে পড়ে তৈরি হতে বলল ”
ফারিহা একটা নীল রঙের জর্জেটের শাড়ি এগিয়ে দিলে আদিলা অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল ।শাড়িটা বেশ সুন্দর, সোনালী রঙের সুতোর কাজ করা , তাতে আবার সোনালী পাথর বসিয়ে হাইলাইট করা আছে । কিন্তু ওর একদম সাজতে ইচ্ছে করছে না । মনের ভিতর কিছু একটা কাঁটার মতো বিধছে । সারা দুপুর এই বিষয়টাকে সেভাবে পাত্তা না দিলেও এখন নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে । চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে । ড্রয়িং রুম থেকে কতগুলো অচেনা কন্ঠস্বর ভেসে আসছে । সাথে মহিলাও আছে মনে হয় । আগে হলে চাবি দেওয়া পুতুলের মতো তাদের সামনে গিয়ে বসে থাকত । কিন্তু এখন বারবার রাহাতের মুখটা ভেসে উঠছে মনের ঘরে । নিজের পাশে ওকে ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনাও করতে পারছে না সে, কষ্ট হচ্ছে ভীষণ । বুকের মাঝে একটা চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে । যেখানে শুরুতেই মনে হচ্ছে বুকের ওপর এক টনের মতো ভারী কিছু চাপিয়ে দেওয়া আছে তাহলে সারাজীবন এই সংসারনামক সম্পর্কের ভার সে বইবে কি করে ? কিন্তু রাহাতকেও তো মেনে নেওয়া সম্ভব নয় । যেখানে পদে পদে আত্মসম্মানে আঘাত লাগার ভয় থাকে সেখানে নিশ্চন্তে সে কিভাবে থাকবে ? কীভাবে করবে দিন পার ?
এইরকম সাত পাঁচ ভেবে মনে মনে নিজেকে বোঝালো আদিলা । অদৃষ্টকে কেউ আটকাতে পারবে না ,শত চেষ্টা করলেও না । তাহলে অত ভেবে কি হবে ? যা হোক দেখা যাবে- এমন একটা ভাব নিয়ে ফারিহার সাহায্যে শাড়ি পড়ে তৈরি হয়ে নিল আদিলা ।
কিন্তু দিনশেষে যে আরো এক চমক অপেক্ষা করছে তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না আদিলা । ফারিহার সাথে যখন বসার ঘরে প্রবেশ করল আদিলা ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল উপস্থিত সবার উৎসুক দৃষ্টি এখন ওর ওপরই নিবদ্ধ । মাথা তুলে তাকাতেও একরাশ উটকো লজ্জা এসে জড়ো হলো ওর নেত্রপল্লবে । আড়ষ্ট ভঙ্গিতে সালাম দিতেই একজন মহিলা মিষ্টি সুরে সালামের জবাব দিতেই আদিলা আপনাআপনি শব্দের উৎস বরাবর চোখ মেলল । মহিলার হাসি হাসি প্রশান্ত , প্রানবন্ত মুখখানা দেখে আড়ষ্টতা উবে গিয়ে সাচ্ছন্দ্য বোধ করল আদিলা । সেই সুযোগেই উপস্থিত সকলের দিয়ে আড়চোখে তাকাতেই আব্বু ,মামা ,প্রতিবেশী এক দাদু , দুজন অপরিচিত বয়স্ক ব্যক্তি , এক কমবয়সি মেয়ে পার করে নজর ঘুরতেই নিমেষে বরফের মতো জমে গেল সে । রাহাত বসে আসে না সামনে ? কি স্নিগ্ধ দৃষ্টিতেই না তাকিয়ে আছে ওর দিকে ! ওর চোখে খুশির ঝিলিক দেখতে পেল আদিলা । হঠাৎ করেই মনটা ভীষণ ভালো হয়ে গেল ওর । জৈনেক মহিলা ওকে পাশে বসতে বললেই ফারিহা অস্ফুটে পাশে গিয়ে বসতে বলল । কিন্তু এর পর আর বেশিক্ষণ ভালো থাকতে পারল না । সৌজন্য মূলক কথা বার্তা শেষ হতেই যখন ওকে ভেতর ঘরে যেতে বলল আদিলা যেন হাফ ছেড়ে বাচঁল । উঠে আসতে আসতেও আনমনেই আড়চোখে তাকিয়ে দেখল রাহাতকে । লজ্জা সরম বলতে কি কোনো জিনিস নেই লোকটার মধ্যে ? আজ অমন বেহায়ার মতো চেয়ে আছে কেন ? ভীষণ লজ্জা লাগল ওর । ভাগ্যিস শ্যামলা মেয়েরা লজ্জা পেলে খুব কাছ থেকে খেয়াল না করলে বোঝা যায় না তাদের মুখের রক্তিম আভা । তাই বোধহয় এ যাত্রায় বেঁচে গেল সে । নাহলে লজ্জার শেষ থাকত না । রাহাতের চোখাচোখি হতেই সঙ্গে সঙ্গে বাম চোখ টিপে দিল রাহাত । আদিলা হতভম্ব হয়ে থমকে দাড়াল , ওর হিচকি উঠে গেল । সাথে তিতলি মেয়েটাও উঠে এসেছে । আদিলার থমকে যাওয়া , হতভম্ব মুখখানা দেখে দৃষ্টি অনুসরণ করে মুখ টিপে হেসে উঠল , ঞঞপ্রায় ফিসফিসিয়ে আদিলাকে বলল,
-” দেখার অনেক সুযোগ পাবে ভাবি । এখন একটু চোখ নামাও । নাহলে তোমার হবু শশুর শাশুড়ির চোখে পড়লে এরপর আর মেরুদন্ড সোজা করে দাড়াতে পারবে না লজ্জায় । আমার আব্বু- আম্মুটা কিন্তু ভীষণ ঠোঁটকাটা । লজ্জা দিয়ে দিয়ে নাজেহাল করে ছাড়বে ।আগেই সতর্ক করে দিচ্ছি কিন্তু । ”
তিতলির কথায় খানিকটা হতচকিয়ে গেল আদিলা ।মেয়েটা মিটিমিটি হেসে ওকেই দেখছে । নিজের নির্বুদ্ধিতার কারণে মনে মনেই নিজেকে ধমকে উঠল আদিলা ।একটা দীর্ঘ শ্বাস টেনে ধীরে ধীরে ছেড়ে দিয়ে লজ্জারাঙানো ভাবটা কাটানোর চেষ্টা করল ।তার পর পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল নিজের ঘরের দিকে । তিতলি মেয়েটা বেশ মিশুক । কি রকম পটরপটর করে কথা বলছে সদ্য পরিচিতা ফারিহা , রহিদের সাথে !এভাবে আদিলা কখনোই মিশতে পারে না । তবুও তিতলির কথার তালে তাল মিলিয়ে মেয়েটাকে বেশ পছন্দ হয়েছে ওর । মেয়েটার মধ্যে আসর জমানোর গুণ আছে বটে। এত অল্প সময়েই নিজের ভাইয়ের গুণকীর্তন করতে বসে গেছে সে। আর ফারিহাও মুগ্ধ শ্রোতার ন্যায় শুনে যাচ্ছে আর মাঝে মাঝেই টিপ্পনী কাটছে আদিলাকে ।
বাইরে থেকে টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসছে ঘরে । যার মর্মার্থ বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না আদিলার । এরপর কি হতে পারে সেই ভাবনাটাই অস্থির করে তুলছে ওর সমস্ত চিত্তকে । তিতলি রহিদকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে । বিছানায় থম মেরে বসে আছে সে। মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ওর ? ঠিক মতো কোনো কিছুই ভাবতে পারছে না । কি থেকে যে কি হচ্ছে ? সেদিনের আরুশি আপার বলা কথাটা হঠাৎ করেই মনে পড়ল ওর । তাহলে কি আপা এই কথাই বলছিল মামানিকে ? একটু একটু করে পরিস্কার হচ্ছে সবকিছু । জট লাগানো সুতো গুলো ধীরে ধীরে ছাড়িয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে আদিলা । কিন্তু তবুও একটা প্রশ্ন থেকেই যায় রাহাতকে সাহায্য করল কে ? হুট করে এত তাড়াতাড়ি ওর বাড়ি অব্দি পৌঁছে যাওয়া সম্ভব নয় । তাহলে কি রাহাত নিজেই এইসব করেছে ? কেন ? ওকে তো আদিলা বারণ করে দিয়েছিল ! তবু কেন করল রাহাত এমনটা ? ওর মতামতের কি কোনো মূল্যে নেই রাহাতের কাছে ? বারবার অস্বীকার করা সত্ত্বেও কেন নিজের সাথে জড়াতে চাইছে রাহাত ? কেন সারাজীবনের সম্মানহানির দলদলে কাদায় ওকে টেনে নামাচ্ছে রাহাত ?
এরপরের ঘটনা গুলো এত দ্রুত ঘটে গেল যে আদিলা বলার মতো কোনো কথাই খুঁজে পেল না । একটা মোমের পুতুলের ন্যায় শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল পিতার তৎপরতা । আগেই ফাহিম আর ওর বাবার থেকে রাহাত এবং ওর পরিবার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে রেখেছিল ।তাই যখন রাহাতের মা সাবিহা আদিলাকে আংটি পড়িয়ে রাখার প্রস্তাব রাখল তখন নিজের সম্মতি জানাতে দেরী করল না আরাফাত সাহেব । কন্যার হতভম্ব মুখখানাকে দেখে মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ ভেবে আংটিবদল সম্পন্ন করে ফেললেন । সাকিব বারদুয়েক আড়ালে ডেকে বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও সেই চেষ্টা সফল হলো না ।
(চলবে)