#একজোড়া_পায়রা
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট২০
জার্নি করে এসে আমি ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছি।পাশে সোফায় বসে শুভ্র আর দাদি গল্প করছে।একেবারে খাস টাংগাইলা ভাষায় যাকে বলে দাদি নাতনি জামাই প্যাচালের ছালা খুলে বসেছে।এই কিনা সেই দাদি যে একসময় শুভ্র আর আমায় নিয়ে খারাপ কথা বলেছে!সময়ের সাথে মানুষ কত বদলে যায়।আজ সেই শুভ্রই দাদির প্রিয়পাত্র।এরই মধ্যে শিশির আসে ফ্রেশ হয়ে আসে।সেও দাদির সাথে রাজ্যের কথা নিয়ে বসে।আমায় চুপচাপ শুয়ে থাকতে দেখে দাদি বলে,,
-এইযে এই ছেমড়িডা!একটাও টু শব্দ করে না। কিবা জানি ঘরকোণা।দেখ শুভ্ররে দেইখা কিছু শিখ।
আমি মুচকী হাসি।কথা বলার এনার্জি নেই আমার।এইবারের জার্নি আমায় পুরো কাবু করে ফেলেছে।
দুপুরের খাওয়া শেষে আমরা সবাই মিলে ঘুরতে বের হই।গন্তব্য ২০১গুম্বজ বিশিষ্ট পাথালিয়া মসজিদ।আমার শ্বাশুড়ি মার মসজিদটা দেখার খুব শখ।উনি প্রায়ই আমায় বলতেন,,
-তোমাদের ২০১গুম্বজ মসজিদটা শুধু খবরেই দেখেছি।কত সুন্দর মসজিদ! ঘুরতে নিয়ে যাবে আমায়?
আমি মুচকী হেসে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিতাম।আমারও কখনো সরাসরি মসজিদটা দেখার সুযোগ হয়নি।ভাইয়া বোধহয় শুরুর দিকে দু একবার বন্ধুদের নিয়ে গিয়েছিলো।সেবার আমি ওর সাথে যাওয়ার বায়না ধরেছিলাম।নিয়ে যায় নি আমায়।তা দেখে শান্ত বলেছিলো আমায় নিয়ে যাবে।আমি সায় দিই না।মুরগী হয়ে কে যে চে শেয়ালের কাছে যাবে?
শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় জায়গাটায় খুব ভীড় হয় সাথে জ্যামও থাকে অনেক।যেহেতু রাস্তাগুলো খুব চাপা!তাই জ্যাম থাকে।দুপুরের দিকে বেরিয়ে পড়ায় খুব একটা ভীড়ে পরতে হয়নি আমাদের।
টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে গোপালপুর উপজেলা থেকে প্রায় আট কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম কোণে নগদা শিমলা ইউনিয়নের দক্ষিণ পাথালিয়া গ্রামে ঝিনাই নদীর তীরে নির্মাণ করা হচ্ছে পৃথিবীর মানচিত্রে বিরল সৃষ্টির বিশ্বের ঐতিহাসিক কালজয়ী মুসলিম স্থাপত্য ২০১গম্বুজ বিশিষ্ট দক্ষিণ পাথালিয়া জামে মসজিদ কমপ্লেক্স। পৃথিবীর বুকে সুন্দরতম, সর্বাধিক গম্বুজ বিশিষ্ট, সৌসাদৃশ্য, চিত্তাকর্ষক ও আলোচিত এবং আকর্ষণীয় বৃহৎ মসজিদ গুলোর মধ্যে এটি সর্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টিকারি ঐতিহাসিক ২০১ গম্বুজ বিশিষ্ট জামে মসজিদ কমপ্লেক্স। এত বেশি সংখ্যক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ বিশ্বের আর কোথাও নেই। মহান আল্লাহর এ স্বর্গীয় ঘরটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে নতুন করে সুপরিচিতি লাভ করবে এবং এ উপলক্ষ্যে প্রচুর দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমনে মুখরিত হবে বাংলার সোনাফলা মাটির উপর দাঁড়িয়ে থাকা কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণ।
মসজিদটির পাশেই আজান প্রচারের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পাথরের তৈরী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ রফিকুল ইসলাম মিনার। যা পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে উঁচু ও অদ্বিতীয়। মিনারটির উচ্চতা হবে ৪৫১ ফিট বা ৫৭ তলার সমপরিমাণ। মিনারটি নির্মাণের জন্য ঢাকায় কুর্মিটোলায় অবস্থিত সিভিল এভিয়েশন অথরিটি থেকে ছারপত্র নেওয়া হয়েছে। উঠা-নামার সুবিধার্থে মিনারটির ৫০তলা পর্যন্ত লিফট চলাচলের সুব্যবস্থা থাকবে।
১৫বিঘা জমির উপর এই কমপ্লেক্সে আরো থাকবে অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা। মিহরাবের দুই পাশে থাকবে লাশ রাখার জন্য হিমাগার। পূর্ণ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মসজিদটিতে ফ্যান লাগানো হবে সহস্রাধিক। মোট গম্বুজের সংখ্যা হবে ২০১টি। মসজিদের ছাদের মাঝখানে থাকবে ২৫টি গম্বুজের সমপরিমাণ ৮১ফুট উচ্চতার ১টি বড় গম্বুজ এবং চারদিকে থাকবে ১৭ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ২০০টি গম্বুজ। মূল মসজিদের চার কোনায় ১০১ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট চারটি মিনার থাকবে। পাশাপাশি আরও ৪টি মিনার থাকবে ৮১ফুট করে উচ্চতা বিশিষ্ট। ১৪৪ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪৪ ফুট প্রস্থ’র দ্বিতল বিশিষ্ট মসজিদটিতে একসঙ্গে প্রায় ১৫ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। মসজিদের দেয়ালে পিতলের উপর সারি সারি ভাবে অঙ্কিত থাকবে ৩০ পারার পূর্ণ পবিত্র কোরআন শরীফ। যে কেউ বসে বা দাঁড়িয়ে দেয়ালের অঙ্কিত কোরআন শরীফ পড়তে পারবেন। ৫০ মন পিতলের তৈরি নয়নাভিরাম মসজিদটির প্রধান দরজায় মহান আল্লাহর রাব্বুল আলামিনের নিরানব্বইটি নাম স্পষ্টাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। এর উত্তর ও দক্ষিণ পাশে নির্মাণ করা হচ্ছে আলাদা আলাদা ৫তলা বিশিষ্ট ভবন। সেখানে থাকবে দুঃস্থ মহিলাদের জন্য বিনামূল্যের মাতৃসনদ হাসপাতাল, এতিমখানা, হেফজ্খানা, বৃদ্ধাশ্রম, কোরআন সুন্নাহ ভিত্তিক গবেষণা কেন্দ্র, বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের পূণর্বাসনের ব্যবস্থা। উত্তর পশ্চিম পাশে নির্মিত ভবনে দেশি-বিদেশি মেহমানদের থাকা-খাওয়ার সু-ব্যবস্থা সম্মেলিত ডাকবাংলো।
আকাশপথে মানুষের যাতায়াতের সুবিধার্থে মসজিদ থেকে আধা কিলোমিটার দূরে নির্মাণ করা হচ্ছে হেলিপ্যাড। কমপ্লেক্স এর সকল প্রজেক্ট পরিচালনা করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে। আর এ জন্যই ১২ বিঘা জমির দুই বিঘাতে হেলিপ্যাড ও বাকি ১০ বিঘাতে নির্মাণ করা হচ্ছে মৎস খামার, গবাদিপশুর খামার ও কৃষি খামার। কল্যাণ ট্রাষ্ট ও খামার গুলোর আয় থেকে প্রজেক্ট গুলো পরিচালনা করা হবে। পশ্চিমে প্রবাহিত ঝিনাই নদী থেকে মসজিদ পর্যন্ত থাকবে সৌন্দর্যবর্ধন সিঁড়ি এবং পারাপারের জন্য নদীর উপর নির্মাণ করা হবে একটি সুদর্শন সেতু। চারপাশে করা হবে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের বাগান।
মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়েছে ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসের ১৩ তারিখে। কাজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ রফিকুল ইসলামের জননী রিজিয়া খাতুন। প্রায় ৪৫০ শতাংশ জায়গায় নির্মাণাধীন মসজিদের কাজ শেষ হয়েছে। এখন সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য অত্যাধুনিক কারুকাজ ও বৈদেশিক টাইলস বসানোর কাজ চলমান আছে। মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হলে কাবা শরিফের ইমাম মোঃ আব্দুর রহমানের ইমামতির মাধ্যমে মসজিদের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে।
বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।নভেম্বরের শুরু হওয়ায় সন্ধ্যা নামতে না নামতেই ঠান্ডা পরে যায়।আর শীত এলেই আমার পা বরফ শীতল হয়ে যায়।শীতের দিনে নিজের হাত পা নিজের শরীরের স্পর্শে আসলে ঠান্ডার ছ্যাকা খাই!
বাসায় গিয়েই কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ি। মিনিট দশেক পর মার ডাক আসে রান্না ঘর থেকে।গিয়ে মা কে রান্নার কাজে সাহায্য করি।ড্রয়িং রুমে দাদি, বাবা,আম্মু,আব্বু বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।শুভ্র শিশিরকে নিয়ে বাহিরে গেছে।শিশিরের নাকি খুব আইসক্রিম খেতে মন চাচ্ছিলো তাই ওকে নিয়ে বেরিয়েছে।হালকা ঠান্ডা পরায় আম্মু মানা করছিলো।কিন্তু কে শোনে কার কথা!বেরিয়ে গেলো দুই ভাই বোন মিলে।
সন্ধ্যার নাস্তা হয়ে গেলে আমি ট্রেতে করে খাবার গুলো ড্রয়িংরুমে নিয়ে যাই।এরই মধ্যে শুভ্র শিশিরকে নিয়ে আসে।ড্রেস চেঞ্জ করে ও ড্রয়িংরুমে আসে।
বড়রা কথা বলছে।আমি আর শুভ্র আবুলের মতো দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছি।শিশির আমার ফোন নিয়ে ঘরে গেছে।ইউটিউবে ফাইভ মিনিট ক্রাফট দেখবে।আলোচনার টপিক আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান। যেহেতু বিয়েটা হুট করে হয়েছে।আমি বাবার একমাত্র মেয়ে আবার শুভ্রও একমাত্র ছেলে।তাই ছোটখাটো করে হলেও অনুষ্ঠান করতে চান অভিবাকবরা।
বড়দের আলোচনায় এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার একদমই ভালো লাগছে না।নিজের ঘরে চলে যাই।কিছুক্ষণ বাদে দেখি শুভ্রও আমার পিছু পিছু চলে এসেছে।
-চলে আসলে যে?
-বড়দের ওইরকম জরুরি মিটিংয়ে আমার ভাল্লাগলো না। তাই চলে এসেছি।
-জার্নি করে এসেছো।সারাদিনে অনেক ধকলও গেছে।শুয়ে পড়ো।
-তুমি হচ্ছো দুনিয়ার অলস।কিছু হলেই বলো শুয়ে পড়ো।কোথায় নিজের বাসা এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখাবে তা না।
-বাসা ঘুরে দেখানোর কি আছে?আর ঘুরেই তো এলে!আর কত ঘুরতে চাও?
উনি আমার দিকে এগিয়ে আসেন।কেমন একটা নিষ্পাপ চাহনিতে আমার দিকে তাকান।তাকিয়ে বলেন,,,
-জানো মেঘ ?আমার না অনেক কিছু করা বাকি!
উনার কথার মাথামুন্ডু আমি বুঝে উঠতে পারি না।বড্ড প্যাচিয়ে কথা বলে লোকটা।বিরক্তি নিয়ে বলি,,,
-কি করা বাকী?আমি বুঝি নাই।
-অনেক কিছু করা বাকী।তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভেজা,পুর্ণিমার চাঁদ দেখা,একসাথে চা খাওয়া অনেক কিছু!
-এই নভেম্বর মাসে বৃষ্টি পাবে কোথায়?
-বৃষ্টি নেই তো কি হয়েছে?চাঁদ তো আছে।চলো না একটু একান্তে কিছু সময় কাটিয়ে আসি ছাদে গিয়ে!
যা ভয় করেছিলাম।এই ঠান্ডায় আমি ছাদে যেতে পারবো না।এমনিতেই আমি খুব শীত কাতুরে।এই হাল্কা শীতেই আমার ভোর রাতে কাঁপুনি উঠে যায়।অসম্ভব,আমার পক্ষে এখন ছাদে যাওয়া জাস্ট অসম্ভব। আমি ডিরেক্ট না করে দেই।কিন্তু পরে শুভ্রের আকুতি মিনতিতে আর না করতে পারি নি।আলমারি থেকে একটা চাদর বের করে ওর সাথে ছাদে যাই।মিনিট দশেক থাকতেই আমার কাঁপুনি উঠে যায়। উনাকে বলি ঘরে যেতে।আমার কথার জবাবে উনি বলেন,,,
-শীত লাগছে?
আমি কাঁপতে কাঁপতে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলি।উনি আমায় জড়িয়ে ধরেন।তারপর বলেন,,,
-এখনো ঠান্ডা লাগছে?
আমি লজ্জা মাখা কন্ঠে আসতে করে বলি,,,
-উহু
চলবে,,,ইনশাআল্লাহ