#ধারাবাহিক_গল্প
#হৃদয়ে_রেখেছি_তোমায়
#নবম_পর্ব
#আসেফা_ফেরদৌস
মৃদুলা নিস্পলক ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বললো, তুমি এভাবে বললে? ঠিক আছে যাবো না, যাও।
-না গেলে বুঝবে কি করে, বন্ধুর আবদারের সামনে নিজের স্বপ্ন, স্বাধ উপেক্ষিত হলে কেমন লাগে? আমাকে ঘিরে অভিযোগের তো শেষ থাকেনা, নিজেরও একটু উপলব্ধি টা হোক।
মৃদুলা চুপ করে আছে।
আবীর বললো, যাও মৃদুল, কোন সমস্যা নেই। আমি আজো তোমাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারিনা।
মৃদুলা সিদ্ধান্তহীন! আবীর বললো, এত কিছু ভেবোনা তো, আমি দুষ্টুমি করছিলাম। তুমি যাও, ঘুরে এসো।
মৃদুলা হেসে বললো, আমি বেশিক্ষণ দেরি করবো না।
আবীর হাসলো। মৃদুলা বললো,ওহ্ হো আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, আজ সকালে উর্মি ভাবি ফোন করেছিলেন। বললেন, হৃদিকে কিছুতেই বুঝিয়ে রাখতে পারছেন না, ও বারবার আসতে চাইছে। এদিকে তোমার মেয়েও ইনিয়ে বিনিয়ে আবদার জুড়ে বসেছে। শেষমেষ কি আর করবো, আসতে বলে দিয়েছি। উর্মি ভাবি হৃদিকে বাসায় দিয়ে যাবেন এক দু ঘন্টার জন্য, তুমি প্লিজ, ওদেরকে দেখে রাখতে পারবেনা? বাসায় খাওয়া দাওয়ার তো কোন সমস্যা নেই। আমি সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে যাবো। তুমি শুধু ওদের একটু চোখে চোখে রাখবে। দৌড় ঝাঁপ করতে গিয়ে যেন পড়ে টড়ে ব্যাথা না পায়। পারবেনা?
-চেষ্টা করবো।
-প্লিজ আবীর যতোই রাগ উঠুক, ধমক দেবেনা প্লিজ! হৃদির কাছে তুমি নতুন মানুষ, নতুনদের সাথে সহজ হতে সময় নেয় বাচ্চারা, এর মধ্যে তুমি ধমক দিলে ও ভয় পেয়ে যাবে। যদি কিছু বলতেই হয় চেষ্টা করবে আদর করে বুঝিয়ে বলতে।
আবীর আবার হেসে ফেললো। বললো, চেষ্টার ত্রুটি হবেনা, কিন্তু সফল কতটা হবো জানিনা।
মৃদুলা হেসে বললো, আমি গিয়ে রেডি হই তাহলে।
আবীর মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো।
মৃদুলা যাবার পর পয়াতাল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। এই পয়াতাল্লিশ মিনিট আবীরের দৌড়ঝাঁপ করতে করতে কেটেছে। ও বেরিয়ে যাবার পনেরো মিনিট পর উর্মি ভাবি হৃদিকে বাসায় দিয়ে গেছেন। তিনি অবশ্য বসেননি, কিন্তু তাতে কি, হৃদি তো একাই যথেষ্ট! পুরো বাড়িতে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। দৌড়াদৌড়ি, দাপাদাপি, চিৎকার চেঁচামেচি, হাসাহাসি, শব্দ, পুরো বাসাটা এলোমেলো করে ফেলেছে মাত্র দুটো বাচ্চা মিলে। আবীরকে একটু পরপর দেখতে যেতে হচ্ছে ওরা ঠিক আছে কিনা। ওদের ঘরে বসে থাকলেও ওরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেনা। তাই বারবার আসা যাওয়া করতে হচ্ছে। বেচারা ক্লান্ত হয়ে গেছে। বুঝতে পারছে, মৃদুলার কতটুকু কষ্ট হয় ওদেরকে সামলাতে। তাছাড়া একা একা বাসায় ভালো লাগছেনা। ওকে সঙ্গ দেয়ার কেউ নেই। বারবার মনে হচ্ছে মৃদুলা কখন আসবে? হয়তো মৃদুলার ও এমনই লাগে একা একা থাকতে। তাই হয়তো বেশি রাগ করে আজকাল। আবীরের বারবার মনে হচ্ছে, মৃদুলা ইচ্ছে করে মায়ার বাসায় চলে গেলোনা তো! ওকে আঘাত করার জন্য? কি যেন হতেও তো পারে!
আবীর মৃদুলাকে ফোন করলো। দুটো রিং হতেই মৃদুলা বললো, হ্যালো আবীর, কোন সমস্যা?
আবীর মৃদুলার কন্ঠ শুনেই বুঝতে পারছে, ফোনটা ও আশা করছিলো, ভীষণ বলতে ইচ্ছে হলো, তুমি জানোনা, সমস্যা আছে কিনা? কিন্তু মৃদুলা এখন অন্যের বাসায় আছে, এসময় ঝগড়া করা যায় না। তাছাড়া, মৃদুলা যদি ওকে আঘাত করতেই চায় তবে আবীর প্রতিবাদ করবেনা। ভালবাসার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া কষ্ট নিভৃতে লালন করার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। সে আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়াই বা কেন!
ও বললো, মৃদুল, এ তো দস্যি মেয়ে দেখেছি! কি করে সামলাও বলোতো? ওর সঙ্গে থাকলে আমার মেয়েটাও তো বেপরোয়া হয়ে যাবে!
মৃদুলা হেসে ফেললো। বললো,আরে না, অতো দুষ্টু না। আজ আমি বাসায় নেই তো, তাই হয়তো একটু বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে। তুমি ভেবো না তো। প্লিজ, একটু সহ্য করে নাও। রাগ কোরোনা প্লিজ!
আবীরের ভীষণ প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হলো, কখন ফিরবে মৃদুল? কিন্তু করলো না। হয়তো মায়া আশেপাশেই আছে। প্রশ্নটা করলে দুজনের মধ্যে বেশ একটু হাসাহাসি হবে। এ ধরনের প্রশ্নে মেয়েদের মনে কেন যেন পুলক জাগে। ব্যপারটা নিয়ে বন্ধু মহলে হাসাহাসি করতে ভালোবাসে ওরা।
আবীর বললো, রাখি তাহলে মৃদুল।
উত্তরে মৃদুলা বললো,ভেবো না আবীর, আমি জলদি ফিরছি।
আবীর হাসলো। বললো, আচ্ছা।
ফোন রেখে আবীর আবার অবনীর ঘরে ঢুকলো।
অবনী আর হৃদি খাটের উপর লাফাচ্ছে। দেখে আবীরের রীতিমত ভয় লাগছে। ধমক দেয়ার ইচ্ছেটা অতি কষ্টে দমন করে বললো, আম্মু, প্লিজ তোমরা বসে বসে কিছু খেলো। তোমরা যে এত দাপাদাপি করছো, বাবার তো ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। রেস্ট করতে পারছিনা। অবনী সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলো। বললো, ঠিক আছে বাবা। তুমি চিন্তা কোরো না। রেস্ট করো গিয়ে, অ্যাই হৃদি, চলো আমরা অন্যকিছু খেলি। বাবার শরীরটা ভালো নেই। এরমধ্যে যদি অসুস্থ হয়ে যায় মা ভীষণ বকবে আমাকে!
হৃদির যদিও ইচ্ছে নেই তবু সে প্রতিবাদ করলো না। হয়তো আবীরকে ভয় পাচ্ছে। ওকে সহজ করার জন্য দুজনের উদ্দেশ্যে হাসলো আবীর। বললো, ঠিক আছে, অবনী, হৃদি আমি পাশের ঘরেই আছি। কোন প্রয়োজন পড়লেই ডাকবে আমাকে। নিজে থেকে কিছু করতে যেও না কিন্তু!
ওরা দুজনেই হেসে মাথা ঝাকালো।
একটু পর আবীর নিজের ঘরে ফিরলো, কি করা যায় বুঝতে পারছেনা। টিভি দেখতে ওর কখনোই ভালো লাগেনা। এছাড়া তেমন কিছু করারও নেই। আবীর বইয়ের আলমারিটার দিকে এগিয়ে গেলো। না, তেমন কোন বই খুঁজে পাচ্ছেনা যা ও পড়তে পারে। বেশীর ভাগই আত্মজীবনীমূলক বই, এছাড়াও আছে গোয়েন্দা গল্প। আবীরের পারিবারিক উপন্যাস পড়তে ভালো লাগে। তেমন কোনো বই এ মুহূর্তে ওর চোখে পড়ছে না। চোখ ঘুরলো পাশের টেবিলে। সেখানে কয়েকটা খাতা, ক্যালকুলেটর, আর একটা ডায়রি রাখা। খাতা গুলোতে সংসারের হিসাব লিখেছে মৃদুলা। খাতা গুলো দেখা শেষ করে ডায়রিটা হাতে নিলো আবীর। এক দুই পাতা উল্টেই বুঝতে পারলো এটা মৃদুলার ডায়রি। অনেক আগে থেকেই ডায়রি লেখার অভ্যাস ওর। আর সেই ডায়রি চুরি করে পড়ার অভ্যাস আবীরের। যখনই ধরতে পারে চরম রেগে যায় মৃদুলা। তবুও অভ্যাসটা ছাড়তে পারেনা আবীর। আসলে দারুন লাগে ওর কাছে। আবীর ডায়রিটা নিয়ে আরাম করে খাটে এসে বসলো। এক কাপ কফি আর সঙ্গে কিছু নাশতা পেলে হতো, কফি বানাতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। বুয়া একটু আগে চলে গেছে। আবীর ডাইনিং রুম থেকে গিয়ে পেস্ট্রি আর চিপস নিয়ে এলো। খেয়ে নিলো আগে। এরপর ডায়রি খুলে বসলো। প্রথম কয়েক পাতায় মৃদুলা সারাদিনের ঘটনা লিখেছে। সারাদিন কি করেছে, কিভাবে সময় কাটে, অবনীর কথা, পড়তে খারাপ লাগছেনা আবীরের। হঠাৎ এক পৃষ্ঠায় চোখ আটকে গেলো। মৃদুলা লিখেছে,
জীবনের পথচলায় সাচ্ছন্দ্য আমায় নিত্যদিন ছুঁয়ে যাচ্ছে আজকাল, তারপরও যদি নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কি সুখি, উত্তর হয়তো আসবে, না। অথবা সুখের সংজ্ঞা আমার জানা নেই। অথবা, কি জানি হয়তো বা সুখি, হয়তো বা নই। এই দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগতে চাইনা বলেই আজকাল নিজেকে প্রশ্ন করা ছেড়ে দিয়েছি। যে প্রশ্নের উত্তর শুধুই ভাবায়,কি দরকার তার উত্তর জানার? থাক না, অজানা, কিছু কথা!
নিজেকে নিয়ে নিজে হয়তো উদাসীন হওয়া যায়, কিন্তু প্রিয় মানুষটির উদাসীন হয়ে যাওয়া কি মেনে নেয়া যায়?
অথচ আমি চোখের সামনে প্রতিদিন একটু একটু করে আবীরকে বদলাতে দেখছি। ওর ব্যস্ততম জীবনে আমাদের জন্য অবসর বের করা দায়! ব্যস্ততায়, দায়বদ্ধতায়, সামাজিকতায়, পরিবার হয়তো কিছুটা উপেক্ষিত! আমি জানি ও হয়তো ইচ্ছে করে এমনটা করেনা, পরিস্থিতির স্বীকার হয়। ব্যপারটা আমি বুঝলেও আমার অভিমান, আমার আহত ভালোবাসা তো বুঝতে চায়না!
প্রতিদিন দশটা ফোন করা মানুষটার আজকাল যখন একটা ফোন করার অবসর হয়না, তখন হৃদয়ে অভিমান কি গুমরে উঠবে না? ও কি জানে, আমি কেমন অপেক্ষায় থাকি!
একসময় আমার যেমন তেমন রান্না খেয়ে যে উৎসাহ দিতো,বলতো, চেষ্টা করো, চেষ্টা করো, আরো ভালো হবে। অথচ আজ কি সে প্রতিদিন খেয়েও বুঝতে পারেনা, আগের চেয়ে এখন আমি কতটা ভালো রাঁধি!
প্রতিদিন হাজারটা গল্প জমা হয় আমার মনে, জীবনের গল্প, অভিজ্ঞতার গল্প, অবনীর গল্প, কত কিছু ঘটে যায় প্রতিদিন, কিন্তু আবীরের সামনে কথা গুলো সেভাবে তোলা যায়না যেভাবে তোলার ইচ্ছে থাকে। ও তো ক্লান্ত, শ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে, দেখে বিরক্ত মনে হয়। কোন কোন দিন হয়তো মনের কথা তোলাই হয়না, অথচ ঝগড়া একটা হয়েই যায়।
আমি একসময় বেশ জেদী ছিলাম। অবুঝও ছিলাম কিছুটা, আবীরের পরিবারের সাথে মানিয়ে নিতে কষ্টই হয়েছে। ধীরে ধীরে যথেষ্ট পরিপক্ক হয়েছি। কথায় কথায় আগের মত চোখে জল এখন আর আসেনা, অতটা কষ্টও হয়না। তাই হয়তো ওর পরিবারের সাথে সম্পর্কটা অনেক অন্তরঙ্গ হয়ে গেছে। এর আরো একটা কারণ অবশ্য আছে, ওনারাও নিঃসঙ্গতায় আবীরকে খোঁজেন, আমিও খুঁজি। তাই আমরা পরস্পরকে সঙ্গ দেই। কিন্তু ব্যপারটা তো আবীরের চোখেও পড়েনা! সে নিজের মতোই ব্যস্ত।
আবীর কি জানে, আমি ওর চোখে এখনো সেই মুগ্ধতা খুঁজে বেড়াই যে মুগ্ধতা নিয়ে ও একসময় আমায় দেখতো! কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে প্রতিদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করা মানুষটার চোখে এমন মুগ্ধতার দেখা মেলা ভার! আমি আজো সন্ধ্যায় চায়ের আয়োজন করে ওর প্রতিক্ষায় থাকি, হয়তো হুট করে আসবে, আগের মতই মুখে হাসি ছড়িয়ে বলবে, চা খেতে এসেছি।
চলবে