#ধারাবাহিক_গল্প
#হৃদয়ে_রেখেছি_তোমায়
#পঞ্চম_পর্ব
#আসেফা_ফেরদৌস
মৃদুলা বললো, আবীর ডিম খাবে?
-না ডিম তো প্রতিদিনই খাই।
-আচ্ছা।
এমন সময় অবনী এলো। বললো,কি ব্যাপার মা, সেই কখন থেকে উঠে বসে আছি। অথচ তুমি তো আমার ঘরে আসছোই না।
-সরি আম্মু। একটু ব্যস্ত আছি। বলে মৃদুলা রান্নাঘরে চলে গেলো।
গুড মর্নিং আম্মু। আবীর বললো।
– বাবা তুমি এখনো বাসায়? অফিসে যাওনি? অবনী একটু অবাক!
-না মামনি। আজ আমি সারাটা দিন তোমার সঙ্গে থাকবো।
-সত্যিই?
-হ্যাঁ সত্যি।
-তুমি আমার সঙ্গে খেলবে?
-তুমি যা বলবে আমি তাই করবো আম্মু।
হুররে! কি মজা!কি মজা! বাবা আজ সারাদিন বাসায় থাকবে, আমার সঙ্গে খেলবে। দারুন মজা হবে। আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে খেলবো, ঠিক আছে বাবা? অবনী লাফাতে লাফাতে বললো।
ওর আনন্দ দেখে আবীরের বেশ আনন্দ লাগছে। ও বললো, এদিকে এসো।
অবনী ছুটে ওর কাছে চলে এলো। আবীর ওকে কোলে উঠিয়ে বসালো। বললো, কখন উঠেছো?
-অনেকক্ষণ!
-চলো আমরা একসাথে নাশতা করি।
-আমি তো প্রতিদিন মার হতে খাই।
-আজ একটু ব্যতিক্রম হোক নাহয়, আজকে আমার হাতে খাও?
অবনী সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা।
-প্নিজ আম্মু! আবীর বললো।
-কিন্তু আমি তো হাতমুখ ধুইনি।
-ধুয়ে এসো। আমি অপেক্ষা করছি। তুমি এলে একসঙ্গে খাবো।
মৃদুলা পরোটা এনে টেবিলে রখলো, বললো নাও শুরু করো। অবনীকে বলা আবীরের শেষ কথা গুলো ও শুনেছে। দেখলো, অবনী এখনো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। মৃদুলা বললো, অবনী যাও, হাতমুখ ধুয়ে এসে বাবার পাশে খেতে বোসো। বাবার কথা শোনো।
অবনী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, মৃদুলা বললো, একটা কথা না! চট জলদি গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে খেতে এসো। বাবা কতক্ষন বসে থাকবে তোমার জন্য?
অবনী মুখে কালো করে বললো, আচ্ছা।
-আর শোন, তোমাদের দুজনকেই বলছি, নাশতার পর তুমি পড়তে বসবে,আর আবীর তুমি, রেস্ট করবে।
-না। আর রেস্ট করার দরকার নেই। আবীর বললো।
-আবীর, শরীরটা ভালো নেই তোমার, আরো খারাপ হয়ে গেলে কি করবে বলো? একটু বুঝতে চেষ্টা করো, জেদ কোরোনা প্লিজ!
আবীর কিছু বললো না।
মৃদুলা অবনীকে বললো,অবনী আম্মু, বাবার শরীরটা একটু ভালো হলেই তোমার সাথে খেলবে। এখন শরীরের উপর চাপ নিলে শরীরটা আবার খারাপ হয়ে যেতে পারে। তুমি কি চাও, বাবা অসুস্থ হয়ে যাক?
অবনী মাথা নেড়ে না করলো।
-তাহলে মন খারাপ কোরোনা। যাও, হাতমুখ ধুয়ে খেতে এসো।
অবনী দৌড় দিয়ে ওর ঘরে ঢুকে গেলো।
আবীর বললো, তুমি খাবে না?
-আমি বাকী পরোটা গুলো ভেজে নিয়ে আসি। তুমি শুরু তো করো। খাও, আমি আসছি।
একটু পর মৃদুলা আবার যখন ভাজা পরোটা নিয়ে রান্নাঘর থেকে ফিরলো, তখন দেখলো, আবীর অবনীকে খাওয়াচ্ছে।
ও বললো, সেকি, তুমি ওকে খাওয়াতে বসলে কেন? তুমি খাও! অবনী নিজের হাতে খাও তো মা, বাবাকে খেতে দাও।
অবনী আবীরের দিকে চাইলো।
আবীর সঙ্গে সঙ্গেই বললো, আমার হাতে খাচ্ছে,খাক না, তুমিও এই ফাঁকে কাজ শেষ করে এসো তুমি এলে আমরা একসঙ্গে খাবো।
-আরে আমার আসতে দেরি হবে। জানো তো, রান্নাঘরের কাজ আমি একদম চট জলদি করতে পারিনা, তুমি খিদে নিয়ে এতক্ষণ কেন বসে থাকবে? এমনিতেই তোমার সকাল সকাল নাশতা করার অভ্যাস, আজ যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে, আরো বসে থাকলে শরীর খারাপ করবে। তাছাড়া, কাল এই শারীরিক অবস্থায় তুমি খিদেয় কষ্ট পেয়েছো, আজ আর কষ্ট করার দরকার নেই। বসে পড়ো তো!
আবীর কিছু বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় কলিংবেলটা বেজে উঠলো। মৃদুলা বললো, তুমি বোসো, আমি দেখছি।
মৃদুলা গিয়ে দরজা খুললো। বুয়া এসেছে।
ও বললো, আল্লাহর রহমত, বুয়া তূমি এসেছো! আমি আর কুলিয়ে উঠতে পারছিনা। হাত ধুয়ে রান্নাঘরে যাও, ময়দা মেখে তৈরি করে রেখেছি। দু-তিনটা পরোটাও বানানো আছে। বাকি গুলো বানিয়ে জলদি ভেজে নিয়ে এসো না, প্লিজ। দেখো, তোমার ভাইয়া এখনো খাওয়াই শুরু করতে পারেনি।
বুয়া হেসে বললো,আনতেছি ভাবী, আপনি গিয়া টেবিলে বসেন।
-থ্যাংক ইউ বুয়া।
বুয়া দ্রুত রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। মৃদুলা এসে টেবিলে বসলো। বেচারা ভালোই ঘেমে গেছে। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে সেই পানিটা ঢকঢক করে খেয়ে নিলো মৃদুলা।
আবীর উঠে গিয়ে ফ্যানটা বাড়িয়ে দিলো।
মৃদুলা চোখ বন্ধ করে একটু রেস্ট নিচ্ছে। চোখ খুলতেই ও দেখলো, আবীর এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি।
মৃদুলা বললো, কি হলো, হাসছো কেন?
আবীর বললো,জানো, মাকে আমি একসঙ্গে চল্লিশটা পরোটা পর্যন্ত বানাতে দেখেছি, কখনো এতটা হাঁপিয়ে উঠতে দেখিনি। অথচ আজকে দুই পরোটা বানিয়েই তোমার যা অবস্থা হয়েছে না! এটুকু বলে আবীর থেমে গেলো। অবনী খিলখিল করে হাসছে।
মৃদুলার দৃষ্টি আবীরের উপর নিবদ্ধ। যদিও চেহারা ভাবলেশহীন, কিন্তু আবীর জানে, ভেতরে ভেতরে রেগে গেছে ও। আবীরের ঠোঁটের হাসিটা একটু একটু করে চওড়া হচ্ছে।
মৃদুলা বললো, কি করবো বলো, আমি রান্না করতে পারিনা। আমাদের বাসায় আমাকে কখনো রান্না করতে দেয়া হয়নি। তাই রান্নায় পিএইচডিটা নেয়া হয়নি আমার।
শেষ লাইনটা যে খোঁচা, বুঝতে কষ্ট হলোনা আবীরের। ও মৃদুলাকে খেপিয়ে দেয়ার জন্য বললো, রান্না করতে পিএইচডি লাগেনা মৃদুল, শখ লাগে। সেই শখটাই নেই তোমার।
এবার মৃদুলা শত চেষ্টা করেও মেজাজ ধরে রাখতে পারলোনা। বললো, না থাকলে নেই! তুমি এখন খাও তো।
আবীর খাওয়া শুরুই করতে যাচ্ছিলো, এমন সময় মৃদুলা কান্না কান্না গলায় আপন মনে বললো, যে আমাকে সবসময় কষ্ট দেয়,তার জন্যই আমি বোকার মত খাটতে যাই! সকাল সকাল উঠে রান্নাঘরে গেলাম ওর খুশির জন্য, অথচ এর কোন দাম নেই!
ওর কথা শুনে আবীর ঊচ্ছল হাসিতে ফেটে পড়লো।
-আমি কিন্তু না খেয়ে উঠে যাবো আবীর!
-আচ্ছা সরি, সরি। কষ্ট পেওনা মৃদুল, বোসো না।
-না। তুমি একাই খাও, আমার খিদে নেই। মৃদুলা উঠে দাঁড়িয়ে গেলো।
-কতদিন তৃপ্তি করে নাশতা খাইনি জানো? অথচ আজ প্রিয় নাশতা সামনে নিয়ে এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য, আর তুমি রেগে উঠে যাচ্ছো? আমার সঙ্গে খাবনা মৃদুল?
মৃদুলা বসে পড়লো, বললো সরি, এসো খাই।
নাশতার পর। আবীর ওর বিছানায় শুয়ে আছে। শরীরটা ভালো লাগছেনা। একটু আগেও ড্রইং রুমে অবনীর সাথে খেলছিলো, হঠাৎ করেই মাথা ব্যথাটা বাড়তে শুরু করে ওর। তাই অবনীকে পড়তে বসার কথা বলে চুপচাপ রুমে চলে এসেছে আবীর। মৃদুলাকে কিছুই বলেনি। সে জানতে পারলে বাবা, মেয়ে কাউকেই কথা শোনাতে ছাড়বেনা। আবীর চায়না বাসার পরিস্থিতিটা খারাপ হোক। শুধু শুধু অবনী বকা খাক, বাচ্চা মানুষ, বাবার কাছে এটুকু আবদার তো সে করতেই পারে। সমস্যাটা আবীরের, এজন্য ওকে শাস্তি দেয়ার তো কোন মানে হয়না।
আবীর চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। একটু আগেই ট্যাবলেট খেয়েছে। মাথায় কেউ হাত বুলিয়ে দিলে ভালো লাগতো, কিন্তু এ কথাটা এখন মৃদুলাকে বলতে গেলে প্রথমে একটা তুলকালাম হবে, তারপর সেবা। আবীর আপন মনে হেসে ফেললো। ভাবছে, মৃদুলাকে ও বেশ ভয় পায়, কিন্তু ব্যপারটা ওর কাছে খারাপ নয়, বরং ভালোই লাগে। আবীর এসবই ভাবছিলো, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটায় চোখ পড়তেই দেখলো রাশেদ ফোন করেছে।
আবীর ফোনটা ধরে বললো, হ্যালো?
-কিরে, শরীরটা কেমন তোর এখন?
-আছে মোটামুটি।
-সরিরে, আমার জন্য তোর অনেক চাপ যাচ্ছে। আমি ভীষণ লজ্জিত।
-কি বলছিস এসব? বন্ধুদের মধ্যে এমন কথা হয় নাকি?
উত্তরে রাশেদ হেসে ফেললো। বললো, তারপর, অবনী তোকে পেয়ে ভীষণ খুশি তাইনা?
-হ্যাঁ তাতো বটেই!
আর ভাবী, তিনি কি আমাকে বকাঝকা করছেন?
-না, না, তেমন কিছু নয়। বলতে গিয়ে হেসে ফেললো আবীর।
এরপর দু বন্ধুতে উচ্ছল হাসাহাসি হলো।
পনেরো মিনিট পর। মৃদুলা ঘরে ঢুকেই দেখতে পেলো, আবীর কথা বলছে। রাশেদ ফোন ছাড়েনি তখনো। মৃদুলার দু এক মিনিট লাগলো বুঝতে যে ফোনটা কার, ও বারবার আবীরের দিকে তাকাচ্ছে। দু একবার তো চোখাচোখিও হয়ে গেলো। আবীর দেখলো মৃদুলা কাপড় পাল্টে এসেছে, হয়তো কোথাও বের হবে। মৃদুলার অস্বস্তি বোধ বুঝতে কষ্ট হলো না আবীরের। ও রাশেদকে বললো, আচ্ছা রাশেদ, এখন রাখিরে।একটু ঘুমোবো।
ফোন রাখতেই মৃদুলা বললো, ও কি বাসায় চলে আসবে নাকি?
-আরে হ্যাঁ। ওর একটু সমস্যা। বাসায় আসতে চাইছিলো, আমি বললাম, একা আসবি কেন, ভাবী, আর বাচ্চাদেরও সঙ্গে নিয়ে আয়। ও বললো, বাসায় মেহমান আছে। আমি বললাম, তারাই বা বাদ থাকবে কেন, তাদেরকেও নিয়ে চলে আয়।
কথাটা শুনে মৃদুলা ওর হাতের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো। বললো, এজন্যই কি আমি বের হচ্ছি? আমাদের কি একটু ও নিজেস্ব সময় থাকতে পারেনা?
আবীর হাসতে হাসতে বললো, মৃদুল, তোমার ছেলেমানুষি এখনো রয়েই গেছে।
-দুষ্টুমি করছো?
-তা নয়তো কি? আজকাল কি কেউ বাসার মেহমান সহ নিয়ে আরেক জনের বাসায় চলে আসে? এটুকু বোঝার ক্ষমতা নেই তোমার?
মৃদুলা হেসে ফেললো।
আবীর বললো, রাশেদ এমনিতেও আসবেনা। সেও বুঝতে পারছে তোমার মেজাজ গরম।
-ভালো। এটুকু তার বোঝা উচিত!
চলবে।