#ধারাবাহিক_গল্প
#হৃদয়ে_রেখেছি_তোমায়
#তৃতীয়_পর্ব
#আসেফা_ফেরদৌস
একটু পর টেবিলে খাবার দিয়ে মৃদূলা বেডরুমে গিয়ে ঢুকলো। আবীর আর অবনী হাসাহাসিতে ব্যস্ত। ও বললো, খাবার দিয়েছি, এসো। অবনী বললো, আসছি মা। আবীর কিছু বললো না। ওর চোখে অভিমান স্পষ্ট।
মৃদুলা প্লেট সাজাচ্ছে। এমন সময় আবীর আর অবনী রুম থেকে বেরুলো। আবীরকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে ওর শরীরটা বেশ খারাপ। অবনী নাচতে নাচতে টেবিলের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। ওর চেহারায় বিশ্বজয়ের আনন্দ! যেন অসাধ্য সাধন করে ফিরেছে।
আবীর এখনো অনেক পেছনে। মৃদুলা অবনীকে আস্তে করে বললো, বাবাকে হাত ধরে নিয়ে এসো, যাও। অবনী মাথা ঝাঁকিয়ে পিছিয়ে গেলো। গিয়ে আবীরের হাত ধরে বললো, এসো বাবা। মৃদুলা তাকিয়ে আছে। আবীর অবাক হয়ে অবনীর দিকে তাকালো। ও আবেগে আপ্লুত! অবনীও হাস্যোজ্জ্বল। ওরা যখন টেবিলের কাছে এসে পৌঁছালো,মৃদুলা চেয়ার টান দিয়ে আবীরকে বললো, বোসো।
আবীর খেতে বসে দেখলো, টেবিলে গরু, মুরগী, মাছ মিলিয়ে তিন আইটেম। অথচ ফ্রিজে তো মাছ ছাড়া কিছুই ছিলো না! যাইহোক, এতকিছু চিন্তা করার সময় নেই। ভীষণ খিদে লেগেছে। ও খেতে শুরু করলো। বেশ তৃপ্তি করে খাচ্ছে আবীর। ওর খাওয়া দেখে মায়াই লাগলো মৃদুলার। বুঝতেই পারছে, বেচারার বেশ কষ্ট হয়েছে আজ। তাই এ সময় ও কোন প্রশ্নে গেলো না। তৃপ্তি করে খাচ্ছে, খাক না, ওর মেজাজটা খারাপ করানোর কি দরকার? এমনিতেই নিজেকে অপরাধী লাগছে। তাছাড়া ফ্রিজে রাখা নুডুলসের বাটিটা দেখে ফেলেছে মৃদুলা। দেখেই বুঝেছে পুরোটা শেষ করতে পারেনি আবীর।
আবীরের খাওয়া যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখন অবনী প্রশ্ন করলো, বাবা কখন ফিরেছো?
-চারটার সময়।
উত্তর শুনে মৃদুলা আকাশ থেকে পড়লো। চারটা থেকে সাড়ে নটা। বেশ অনেকক্ষণ সময়। এতক্ষণ ও বাসায় একা?এবার আর প্রশ্ন না করে থাকা যায়না। মৃদুলা বললো, আজকে রাশেদের অফিসে যাওনি?
-না শরীরটা ভালো লাগছিলো না, খুব দুর্বল লাগছিলো, তাই যাইনি।
বহু চেষ্টা করেও মৃদুলা রাগ সামলাতে পারলো না। বললো, শরীরের উপর এত চাপ নিলে শরীর টিকবে? তোমার বন্ধু তো কিছুই বুঝতে চায়না, শুধু আবদার করতেই জানে,আরে ও নতুন ব্যবসা শুরু করেছে ভালো কথা, তোমাকে নিয়ে এত টানাটানি কেন, আর ওকেই বা কি বলবো, তোমারও তো অযথা খাটতে ভালো লাগে! মানুষ বোকা হলে যা হয়!
আবীর বললো, মৃদুল, প্লিজ! আমার শরীরটা ভালো লাগছেনা, মাথা ব্যথা, কথা বলতে পারছিনা, এখন ঝগড়া শুরু কোরোনা। নিতে পারছিনা।
মৃদুলা চুপ করে গেলো। অসুস্থ মানুষের সাথে ঝগড়া চলেনা। তাছাড়া ওর নিজেরই আবীরের জন্য খুব খারাপ লাগছে।
পরদিন সকাল সাড়ে আটটা। আবীরের ঘুমটা মাত্র ভেঙেছে। চোখ মেলতেই ও শুনতে পেলো মৃদুলা খুব মিষ্টি সূরে গান গাইছে,
তুমি এসেছিলে পরশু,কাল কেন আসোনি?
তুমি কি আমায় বন্ধু, কাল ভালোবাসো নি?
কাল কেন আসো নি, কাল মনে রাখো নি!
একটা সময় ছিলো যখন মৃদুলাকে উদ্দেশ্য করে এই গানটা গাওয়া ওর শখ ছিল, মৃদুলাও গানটা শুনতে ভালোবাসতো। অথচ এখন এসব শুধুই অতীত স্মৃতি! আবীর শুনতে পাচ্ছে, মৃদুলা গাইছে,
বনে বনে পাখি ডেকে যায়, আবোল, তাবোল,
থেকে থেকে হাওয়া ডেকে যায়, দিয়ে যায় দোল,
তুমি কি আমায় বন্ধু একবারও ডাকোনি?
কাল কেন আসোনি,কাল ভালোবাসো নি!
গানটা শুনতেই ঝট করে ওর মন বেশ কয়েক বছর পেছনে চলে গেলো, চোখের সামনে এক এক করে ভেসে উঠছে সে সময়ের দৃশ্যপট, আহা কি স্বর্নালী ছিলো সেই দিন গুলো! হঠাৎ করেই আবীরের ভেতর একটা ছেলেমানুষি কাজ করলো। মৃদুলা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ানো, ও যে জেগে উঠেছে দেখতে পায়নি এখনো! আবীর মনে মনে ভাবছে, দেখা যাক, মৃদুলা আগের মতই ওর প্রতি লক্ষ রাখে কিনা, ও গায়ের উপর থেকে কাঁথাটা ফেলে দিলো, বেশ একটু এগিয়ে এসে শুয়েছে, ওর একটা হাত এখন খাটের বাইরে।আর একটু এগিয়ে গেলেই পড়ে যাবে নির্ঘাত! মাথার বালিশটাও এমন ভাবে রাখলো, যেন তা মাথায় ঠিক মত না থাকে। মৃদুলার চোখে ব্যপারটা ধরা পড়ে কিনা দেখতে চায়! মৃদুলা মাথা আচড়াচ্ছে,আর আপন মনে গুনগুন করছে, বেশ লম্বা চুল ওর। আবীর ঘুমের ভান করে পড়ে আছে।
চোখে ঘুম না থাকলে ঘুমানোর অভিনয় করা সহজ ব্যাপার না। আবীর প্রতি মূহুর্তে ভেতরে ভেতরে ভীষণ রেগে যাচ্ছে। আরে,এত রুপ চর্চা করার কি আছে! চট করে ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেখে ফেললেই হয়! কিন্তু না, ম্যাডামের তো সাজগোজই শেষ হচ্ছে না। এতক্ষণ ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে কি করছে মৃদুলা বিছানায় শুয়ে তা বোঝা সম্ভব হচ্ছেনা আবীরের পক্ষে, হয়তো চোখে আই লাইনার লাগাচ্ছে, এটা ওর প্রিয় কাজ। স্বাভাবিক ভাবেই এরপর হয়তো লিপস্টিকও লাগাবে, মেয়েরা তো তাই করে সাধারণত! কতক্ষন এভাবে শুয়ে থাকবে আবীর? বারবার চোখ খুলে মৃদলার কর্মকান্ড দেখে নেয়াও কম ঝামেলার কাজ না, ধরা পড়ে গেলে পুরো প্ল্যানটাই মাটি হবে। কিন্তু মৃদুলা তো ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে সরছেইনা এখন আবার গানও পরিবর্তন হয়েছে, মৃদুলা গাইছে,
জোছনা করেছে আড়ি,আসেনা আমার বাড়ি,
গলি দিয়ে চলে যায়, লুটিয়ে রুপোলি শাড়ি।
একবার আবীরের মনে হলো, আচ্ছা মৃদুলা ওর দিকে খেয়াল করবে তো! যদি না করে, তো মনটা ভেঙে হাজারটা টুকরো হবে ওর। আবীর আর সহ্য করতে পারছেনা। এমন সময় ও মৃদুলার গলা শুনতে পেলো,কি আশ্চর্য! একটা মানুষের গা থেকে কতবার কাঁথা পড়ে যেতে পারে? এ নিয়ে চারবার ঠিক করলাম, আবার ফেলে দিয়েছে! আবীর মনে মনে লজ্জ্বা পেয়ে গেলো। ও ভেবেছিলো, কাজটা ও মৃদুলাকে পরীক্ষা করার জন্য করছে, অথচ ঘুমের ঘোরে এর আগে আরো চারবার ও কাঁথা ফেলে দিয়েছে, এবং প্রতিবারই মৃদুলা ঠিক করেছে! অদ্ভুত তো! এমন সময় মৃদুলা ওকে ডাকলো, আবীর, আ্যই আবীর, ঠিক করে শোও, পেছাও, পিছিয়ে যাও, পড়ে যাবে তো! আবীর পিছিয়ে গেলো খুব আস্তে করে। মৃদুলা ওর হাতটা উঠিয়ে খাটের উপর রাখলো। বললো,আরেকটূ অসাবধান হলেই, হাতে প্রচন্ড ব্যথা পেতে তূমি। দেখি মাথাটা ওঠাও, বালিশটা ঠিক করে দিচ্ছি। আবীর এমন ভাবে মাথাটা ওঠালো,যেন মোটেও ইচ্ছে নেই। ঘুম থেকেই জেগে উঠতে পারছেনা। মৃদুলা বালিশ ঠিক করে দিচ্ছে। কাঁথাটাও আবার ওর গায়ের উপর টেনে দিলো। আবীর ঘুম জড়ানো কন্ঠে প্রশ্ল করলো, কটা বাজে মৃদুল?
মৃদুলা ঘড়ি দেখে বললো,আটটা চল্লিশ। তুমি কি আরো কিছুক্ষণ ঘুমাতে চাইছো?
আর কত ঘুমাবো,কাল বিকেল থেকেই তো ঘুমাচ্ছি। আবীর ক্লান্ত কন্ঠে বললো।
-ঠিক আছে ভালো না লাগলে উঠে পড়ো। আবীর ধীরে ধীরে উঠে বসলো।
-চা দেই এক কাপ?
-না ইচ্ছে করছেনা।
তাহলে কফি খাবে?
আবীর মাথা ঝাকালো।
ঠিক আছে। তুমি হাতমুখ ধুয়ে এসো। আমি ঝটপট কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি।
আবীর হাসলো। মৃদুলা বেরিয়ে গেলো।
আবীর হাতমুখ ধুয়ে এসেছে। চুপচাপ বসে ভাবছে, আজকের সকালটা সুন্দর ছিলো, ওর ব্যস্ততম জীবনে আজ অনেক দিন পর এমন একটা সকাল এসেছে। জীবনের ব্যস্ততায়,পথচলায়, পাওয়া না পাওয়ার হিসেব কষতে গিয়ে, মান অভিমানে, যখন একে অপরের কাছে ওরা অচেনা হয়ে উঠছে,তখন এমন একটা সকাল পাওয়াই কি কম ভাগ্যের! আবীর এসব ই ভাবছিলো এমন সময় মৃদুলা কফি নিয়ে ঢুকলো।
আবীর বললো,এনেছো?
-হ্যাঁ। একদম কড়া। ঠিক যেমন তোমার পছন্দ।
আবীর হেসে ফেললো। বললো, অবনী এখনো ওঠেনি?
না আসলে কাল ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত ছিলো,তাছাড়া রাতে তোমাকে ঘুম থেকে তুলতে পেরে সে ভীষণ উত্তেজিত, আনন্দিত, সম্ভবত তার ধারণা,সে বিরাট এক দায়িত্ব পালন করেছে। তাই উত্তেজনায় ঘুমাতে ঘুমাতে রাত করে ফেলেছে। এখনো উঠতে পারেনি।
একথার পর দুজনেই হেসে উঠলো। আবীর বললো, হ্যাঁ, কাল ওর ব্যবহারে আমিও একটু অবাক হয়েছি।
দেখেছি আমি। কাল তোমাকে নিয়ে এসে ও যতটা আনন্দিত হয়েছে, ওর সঙ্গে আসতে পেরে তুমিও কম খুশি হওনি।
আবীর হেসে চোখ নামিয়ে নিলো। মৃদুলা বললো, অবনী তোমার চাইতে আমার বেশী ক্লোজ, ব্যপারটা তোমাকে কষ্ট দেয়, তাইনা আবীর?
আবীর চমকে উঠলো। মৃদুলা ঠিকই আগের মত ওর মনের কথাটা পড়ে ফেলেছে।
ও সামলাবার জন্য বললো, না, না,ছি,ছি, এতে কষ্ট পাওয়ার কি আছে?
-কেন অকারণ চেষ্টা করছো, তুমি মিথ্যে বলতে পারো না। তুমি এক কথা বলছো, তোমার চোখ অন্য কথা বলছে।
আবীর চুপ করে গেলো। মৃদুলার চোখে চোখে তাকাতে পারছেনা।
মৃদুলা বললো, অবনী সারদিন আমার সঙ্গে থাকে, ওর স্কুল, টিচার, বন্ধু- বান্ধব সবার সঙ্গে আমি বেশি পরিচিত, সেই তূলনায় তোমাকে বলতে গেলে কাছেই পায়না। তাই আমার সাথে বেশী প্রাণোচ্ছল! আমার সঙ্গে জেদ করার সাহসটা আছে ওর। কিন্তু তোমার সঙ্গে সে তেমনটা করতে সাহস পায়না। কিন্তু বিশ্বাস করো, ও তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। আর এখনো তো বাচ্চা মানুষ, একটু বড় হলেই দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। যত বড় বড় আবদার তখন সে তোমার কাছেই করবে। বলে হাসলো মৃদুলা। আবীর চুপ করে আছে। কিছু বলার নেই। মৃদুলা প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্য বললো, শরীরটা কি এখন ভালো লাগছে?
হ্যাঁ, ভালোই, মাথা ব্যথাটা কমেছে।
আবীর, একটা প্রশ্ন করি উত্তর দেবে?
-বলো না,
-রাগ করবেনা তো?
-না,না রাগ করবো কেন? বলো কি বলবে?
-আজকাল তো আমাদের মধ্যে কথাবার্তা সেরকম হয়না, তবু মনে হচ্ছে যেন কোনোকিছু তোমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে, কিন্তু তুমি আমাদের সঙ্গে তা ভাগ করে নিতে চাইছো না, কেন?
চলবে
আগের পর্বের লিংক