#ধারাবাহিক_গল্ল
#হৃদয়ে_রেখেছি_তোমায়
#১ম_পর্ব
#আসেফা_ফেরদৌস
আবীর সিএনজিতে বসে আছে। শরীরটা বেশ খারাপ ওর। ভীষণ দুর্বল লাগছে, মাথাটা মনে হয় যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। মনে মনে ভয় পাচ্ছে ও। ভাবছে, ঠিক মত গিয়ে বাসায় পৌঁছাতে পারবে তো! নাকি সিএনজিতেই কোন অঘটন ঘটে যাবে! আজ প্রায় চার মাস ধরে চরম পরিশ্রম যাচ্ছে ওর। এমনকি শুক্রবারেও বাসায় থাকা হয়না। ওর বন্ধু রাশেদ, নতুন ব্যবসা শুরু করেছে। রাশেদের অনুরোধে শুক্রবার দিন যেতে হয় ওর অফিসে। বিকেলের আগে সেখান থেকে চাইলেও ফিরতে পারেনা আবীর। ব্যপারটা মেনে নিতে পারছেনা মৃদুলা। ফ্যামিলি টাইম বলে কিছু নেই আবীরের। গত সাতদিন ধরে চরম খাটুনি গেছে ওর। সন্ধায় অফিস শেষ করে যেতে হয়েছে রাশেদের অফিসে। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা, এগারোটা। এতটা খাটুনি নিতে পারেনি আবীর। আজ দুপুরের পর থেকেই শরীর খারাপ করতে শুরু করেছে। এবং বিকেল নাগাদ তা চরমে পৌঁছে গিয়েছে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় যাচ্ছে ও। একে তো শরীর খারাপ, তার উপর কাল থেকে মেজাজটা সপ্তমে চড়ে আছে। আবীরের মনে হচ্ছে ওর জীবনে কোনো ধরাবাধা ছক নেই। তাছাড়া মৃদুলাও আজকাল ওকে বুঝতে পারছেনা। সারাদিনের খাটুনি শেষে বাসায় ফিরে বেশি কিছু তো চাওয়ার থাকেনা, ও দেখতে চায় মৃদুলার হাসিমুখ, প্রত্যাশা করে একটু ভালো ব্যবহার, কিন্তু কোথায় কি, আজকাল বাসায় ফিরলেই দেখতে হয় ওর বিরক্ত চেহারা, শুনতে হয় খোঁচা। কথা শুনলেই মনে হয় যেন ভীষণ চটে আছে মৃদুলা আবীরের উপর। কাল রাতেই বাসায় ফেরার পর বেশ কিছুক্ষণ বাঁকা বাঁকা কথা শুনিয়েছে ওকে মৃদুলা। ওর ধারণা আবীর নাকি এতক্ষণ আড্ডা দিয়ে এসেছে। এমন কথা সে ভাবতে পারলো কি করে? মনটা ভেঙে গেছে আবীরের। ভীষণ কষ্ট পেয়েছে ও। কিন্তু কোন উত্তর দেয়নি। আসলে ঝগড়া করার মতো শারীরিক, মানসিক অবস্থা ছিলো না। দূটো মুখে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়েছে। রাগ পুষে রাখার জন্যই হয়তো মেজাজটা সপ্তমে চড়ে আছে। ইচ্ছে করছে কারো সাথে মন খুলে চিৎকার করতে। আজ অফিসেও কাজে একদম মন বসেনি। তার উপর শরীরটাও খারাপ হয়ে গেছে। যাইহোক, বাসায় পৌঁছে গিয়েছে আবীর। কোন রকমে সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে সিঁড়ির দিকে এগুচ্ছে, ভয়ই হচ্ছে এমন শারীরিক অবস্থায় এত গুলো সিঁড়ি ভেঙে চারতলায় উঠতে পারবে তো! লিফটাও আজ দুদিন ধরে নষ্ট, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ভাবছে, ওকে এ অবস্থায় দেখলে নির্ঘাত ঘাবড়ে যাবে মৃদুলা, অসম্ভব বকা ঝকা শুনতে হবে। রীতিমত ভয় পাচ্ছে আবীর। মৃদুলা রেগে গেলে ভীষণ নার্ভাস লাগে ওর কাছে। তার উপর শুরু হয়েছে প্রচন্ড মাইগ্ৰেনের ব্যথা। দুটোকে কিভাবে সামলাবে কে জানে! কিন্তু চারতলায় পৌঁছে দেখলো বাসায় তালা, মৃদুলা বাসায় নেই। ঘড়ি দেখলো আবীর। বিকেল চারটা বাজে, এমন সময় তো ওর বাইরে থাকার কথা না! যাইহোক, পকেট খুঁজে বাসার চাবিটা বের করলো। বাসার লকের একটা চাবি ওর কাছে থাকে। তালা খুলে বাসায় ঢুকলো। ওর সামনে সাজানো পরিপাটি ঘর। কিন্তু বাড়িতে কেউ নেই। আবীর মাথা ধরে রাখতে পারছেনা। হাতমুখ ডাইনিং রুমের বাথরুমে ধুয়ে রুমে ঢুকলো, আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে সোজা গোসল করতে চলে গেলো ও। আধঘন্টা পর। আবীর গোসল সেরে বেরিয়েছে, মাথাটা এখনো পাতলা হয়নি। তার উপর ভীষণ খিদে লেগেছে। দুপুরে খাওয়া হয়নি। ফ্রিজ খুলে দেখলো ওর খাওয়ার মত কিছুই নেই। ফলমূল আছে, আর আছে ঠান্ডা মাছ তরকারি, অথচ ভাত নেই। যা আছে তা খেতে ইচ্ছে করছে না আবীরের। মেজাজ খিচড়ে গেছে ওর। আসলে চরম খিদের জন্য মাথার ঠিক নেই। আবীর মৃদুলাকে ফোন ঘোরালো, মৃদুলার মোবাইল বন্ধ। না, আর নিতে পারছেনা। হঠাৎ মনে হল বুয়া তো এই সময়ে একবার আসে ফোন করে বলে দিলে অন্তত কিছু নিয়ে আসতে পারবে। ফোন করলো বুয়াকে। তিনবার রিং হবার পর বুয়া বললো, হ্যালো,
-হ্যাঁ বুয়া, আচ্ছা তুমি বাসায় আসছো কখন?
-আমি তো আজকে বিকালে আসতেসি না ভাইয়া, ভাবি বলছে আজকে ভাবি আফারে নিয়া উনার আম্মার বাসায় যাবে, রাইতের আগে ফিরবে না, তাই আমিও আজকে ছুটি নিছি।
-ও আচ্ছা।
-ভাইয়া, ভালো আছেন? অনেক দিন পর ফোন দিলেন।
-হ্যাঁ ভালো আছি, আচ্ছা বুয়া রাখছি।
-জ্বি ভাইয়া।
আবীর ফোন রেখে দিলো। বুঝতে পারছেনা কি করবে, মৃদুলা বাসায় নেই, বুয়া আসবে না, বাসায় ওর খাওয়ার মতো কিছু নেই, অথচ খিদে সহ্য হচ্ছে না। শরীর বেশ খারাপ। হঠাৎ মনে হলো ডিম তো আছে, একটা ডিম ভেজেও তো খাওয়া যায়। শরীরে শক্তি আসবে। আবীর আবার ফ্রিজ খুললো। একটা ডিম নিয়ে রান্না ঘরে চলে এলো। ডিম ভাজতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়লো রান্নাঘরের শেলফে। সেখান কয়েক প্যাকেট ম্যাগী নুডুলস রাখা আছে। ম্যাগী নুডুলস দেখে এতটা স্বস্তি জীবনে কখনো অনুভব করেনি। ও ঝটপট একটা ম্যাগী নুডুলস ছিঁড়ে চুলায় বসালো। কিছুক্ষণ পর একবাটি ধোঁয়া ওঠা ডিম মেশানো ম্যাগী নুডুলস নিয়ে খাবার টেবিলে বসলো আবীর। দু তিন চামচ মুখে দেয়ার পর দেখলো আর খেতে পারছে না। নুডুলস খেতে ওর একটুও ভালো লাগে না। খাওয়ার কিছু নেই, তাই খাচ্ছে। তাছাড়া, শরীর খারাপ, কষ্ট, রাগ, অভিমান মিলিয়ে মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। আজ এতদিন পর তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছে হোক না অসূস্থতার কারনে, আশা ছিলো মৃদুলা এসে দরজা খূলবে, ওকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দেবে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বে ওকে একটু স্বস্তি দেয়ার জন্য। মৃদূলার তীব্র অভিমানের মধ্যে যে ভালোবাসার ছোঁয়া লুকিয়ে আছে তা অনুভব করার জন্য ব্যাকুল ছিলো আবীর, কিন্তু মৃদুলা তো বাসায়ই নেই। একটা সময় ছিলো যখন ছোট ছোট কাজও ওকে জিজ্ঞাসা করে করতো মৃদুলা, অথচ সময়ের সাথে সাথে সবকিছু ফিকে হয়ে যাচ্ছে। আজকাল মৃদুলার নিত্যদিনের জীবনে হয়তো এমন অনেক কিছুই ঘটে যা ও আবীরকে বলা প্রয়োজন মনে করে না।
অবনী ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। কি দেখছে ও? বাবা প্রতিদিন চরম ব্যস্ত, বাবার ব্যস্ত জীবনে ওর জন্য খুব একটা সময় নেই। এবং এ নিয়ে মা ভীষণ বিরক্ত। কিন্তু অবনী কি জানে, একটা সময় ছিলো যখন ওর মা বাবা একে অন্যকে অস্থির ভাবে ভালোবাসতো, দুজন দুজনার জন্য অধীর থাকতো!
জীবনের প্রয়োজনে আবীরকে প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। অনেক চাওয়া,পাওয়া, স্বপ্ন,স্বাধ উপেক্ষা করে ছুটতে হয় জীবিকাব জন্য। জীবনে আর্থিক সচ্ছলতা হয়তো এসেছে, কিন্তু কোথায় গেলো সে ভালবাসা যা ওদের দুজনকে একে অন্যের জন্য অপরিহার্য করে তুলেছিলো? যে ভালোবাসার টানে ওরা ঘর বেধেছিলো! দিন দিন আবীর-মৃদুলা আপন ভূবন ব্যস্ত হয়ে উঠছে, একে অন্যের কাছে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এ দূরে সরে যাওয়ার কষ্ট কি মৃদুলাকে সেভাবে ছুঁয়ে যায়না, যেভাবে আবীরকে প্রতিনিয়ত ছুঁয়ে যাচ্ছে? না, আবীর আর ভাবতে চাইলো না। শরীরটা এমনিতেই খারাপ, এসব ভাবনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে আরো বেশি খারাপ হয়ে যাবে। ও জোর করে নুডুলসটা খেতে শুরু করলো। ট্যাবলেট খেতে হবে। খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু পুরোটা শেষ করতে পারলো না। বিস্বাদ লাগছে, ভেতরটা গুলিয়ে উঠছে। আবীর আর চেষ্টা করলো না। যেটুকু বাকি আছে সেটা ঢেকে ফ্রিজে রেখে দিলো।
মৃদুলা যখন বাসায় ফিরলো, তখন রাত সাড়ে নটা। ওর হিসেবমতে আবীর ফিরতে ফিরতে এগারোটার কম বাজবে না। সেদিক থেকে বিচার করলে খুব একটা দেরি হয়নি। মা আসার সময় খাবার রান্না করে সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন। যাতে বাসায় ফিরে ভাতটাও বসাতে না হয়। আসলে আজ প্রায় দুমাস পর বাবা মার বাসায় বেড়াতে গিয়েছে মৃদুলা। সাংসারিক নানা ব্যস্ততায় অনেক দিন যাওয়া হয়নি। আজ সকাল সকালই অবনীকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে, রান্না-বান্না কিছুই করেনি। বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে মৃদুলা আর অবনী। দারুন সময় কেটেছে ওদের। দুজনেই বেশ হাসি খুশি, কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। অবনী আজকাল অনর্গল কথা বলে। ওর কথা শুনতে শুনতেই চারতলায় পৌছে গেলো মৃদুলা। বাসার দরজায় পৌঁছে যথারীতি একটা ধাক্কা খেলো। দরজার লক লাগানোর পরও বাহির থেকে তালা লাগিয়েছিলো, অথচ দরজায় তালা নেই। লক এবং তালার জোড়া চাবি আছে, একজোড়া ওর কাছে থাকে, অন্য জোড়া আবীরের কাছে। আবীরের তো এত তাড়াতাড়ি ফেরার কথা না! মৃদুলা ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। ও দরজায় লকের চাবি ঢুকাতে পারছেনা, হাত কাঁপছে। লক খোলার পরও খুললো না দরজা। মৃদুলা বুঝতেই পারছে দরজা এবং লক ভেতর থেকে লাগানো হয়েছে। কলিংবেল বাজানোর সাহস হলোনা ওর। অবনী কথা যাচ্ছে, অন্যদিকে মৃদুলার গলা শুকিয়ে আসছে। ও অবনীকে বললো, মা চুপ করো, সরাসরি আবীরকে ফোন করলো মৃদুলা। সবগুলো রিং হয়ে কেটে গেলো অথচ ফোন ধরলো না আবীর। আবার করলো। এবার ছয় সাতটা রিং হবার পর আবীর ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো, হ্যালো,
ওর গলা শুনে চমকে উঠলো মৃদুলা, বললো, কি হয়েছে তোমার আবীর? কোথায় তুমি?
-আমার কথা ছাড়ো, তুমি কি ফিরেছো?
হতভম্বের মতো মৃদুলা বললো, হ্যাঁ।
-দাঁড়াও আসছি।
চলবে