#শুভ্র_বর্ষণ
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_৭
সুমা বেগম জামাইয়ের জন্য পায়েস রান্না করেছেন। নিশান্ত মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসে। তিনি যখন নিশান্তকে জিজ্ঞেস করলো কোন মিষ্টি খাবে? তখন নিশান্ত বললো,
“আপনি পায়েস বানান আম্মা। বেশি করে কাজুবাদাম দেবেন সাথে। বাহিরে থেকে মিষ্টি আনার দরকার নেই।”
ছেলেটা দিলখোলা। খেতেও খুব ভালোবাসে।আবদার, ইচ্ছা সরাসরি জানাতে পছন্দ করে। সুমা বেগমের ভালো লাগে। একটা ছেলের খুব ইচ্ছে ছিলো তার। কিন্তু মিহা হওয়ার পর আবার সন্তান নিতে চেয়ে ডাক্তার দেখিয়েও কাজ হয়নি। তবে এই নিয়ে আফসোস ছিলো না দুজনের। মেয়েটাকে ভালোমতো মানুষ করাতেই নিযুক্ত ছিলেন তারা। মিহার দাদি বেঁচে থাকতে অনেক কটু কথা শুনিয়েছেন সুমা বেগমকে। বংশে ছেলে না থাকলে বংশ আগাবে কি করে? সুমা বেগমের কান্না আসতো। মাঝে মাঝে সইতে না পেরে মুখের ওপর বলেও দিতেন কিছু কথা। তাই নিয়ে অশান্তি আবার তাকেই পোহাতে হতো।
তার স্বামী সবসময় একটাই কথা বলতো।
“আমার যদি এইসব নিয়ে কোনো সমস্যা না থাকে তবে অন্যকারো কথায় কান দেওয়ার প্রয়োজন দেখি না।”
সেই থেকে আর কারো কথা গায়ে মাখে না সুমা বেগম। অনেকে বলেছে ভাই না থাকলে নাকি সেই পরিবারে ছেলের মায়েরা ছেলের বিয়ে দিতে চায় না। ভাই থাকলে ছেলের শ্বশুর বাড়িতে আদর, আপ্যায়ন কিংবা ছেলেপক্ষের ইচ্ছাপূরনের মানুষ থাকে। সেই পরিবারের মেয়ের কদরও বেশি থাকে। এসব কোনো কথাই গায়ে মাখেননি তিনি। এতোদিন পর মেয়ে বিয়ে দিয়ে সেই সকল মানুষের মুখে উত্তম জবাব দেওয়া গেছে। জামাইকে পেয়ে সুমা বেগমের ছেলের আকাঙ্ক্ষাও পূরণ হচ্ছে।
__________
শিরীন বেগম আলাদা করে কিছুটা পায়েস নিয়ে শোভাকে ডাকলো। শোভা তখন দুলাভাইয়ের সাথে আড্ডায় মশগুল হয়ে গেছে। মায়ের ডাকে নাকমুখ ভোতা করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আসতে হলো। শিরীন বেগম কাচের মাঝারি বাটিতে পায়েস দিয়ে সেটা সামনের বাড়িতে দিয়ে আসতে বললো। শোভাদের বাড়ির সামনের বাড়িটাই ইংলিশ আন্টির। সেখানে যেতে হবে শুনে শোভা নাকমুখ কুচকে ফেললো। ‘কেনো? ওদের পায়েস দিতে হবে কেনো? বেশি হয়ে গেলে ফ্রিজে রাখো।’
কিন্তু মায়ের সামনে সেসব বলা যাবে না। নাহলে মাইর একটাও মাটিতে পড়বে না। মনের কথা মনে রেখেই শোভা পায়েসের বাটি নিয়ে হাটা দিলো ইংলিশ আন্টির বাড়ি। শুক্রবার ছুটির দিন। দুপুরের পর প্রায় বেশিরভাগ মানুষকেই বাড়িতে পাওয়া যায়। পাওয়া গেলো রিয়াদকেও। শোভা কলিং বেল চাপতে সে এসে দরজা খুললো। রিয়াদকে দেখে শোভার হঠাৎই একটু লজ্জা করলো। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট এর সাথে হাফ হাতা টিশার্ট। অতিরিক্ত আকর্ষণীয় খোচা খোচা দাড়িতে সম্পূর্ণ মনোযোগ তার মোবাইলে। রোদের তেজে গায়ের রঙটা একটু বেশি ফুটে উঠেছে যেন। রিয়াদ শোভার দিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় মোবাইলে নজর দিলো। বললো,
“কি চাই?”
শোভা অপমানিত বোধ করলো। এটা কথা বলা ধরন হলো? প্রতিবেশী এসেছে কোথায় তাকে ঘরে বসতে বলবে, চা-কফি অফার করবে তারপরই না জিজ্ঞেস করবে কি চাই। তারওপর নজর রেখেছে মোবাইলের মধ্যে। ক্ষোভ ও বিরক্তি চেপে শোভা বললো,
“একটু পায়েস এনেছিলাম আপনাদের জন্য। আন্টি কোথায়?”
“আছে। অপেক্ষা করো ডেকে আনছি।”
রিয়াদ মোবাইলে চোখ রেখেই ভেতরে চলে গেলো। শোভা দাঁড়িয়ে রইলো দরজায়। ওর মেজাজ আরো খারাপ হলো। ভেতরে ডেকে বলতে পারতো অপেক্ষা করতে। দরজায় কেনো দাঁড়াবে? বিড়বিড় করে বললো,
“ম্যানারলেস কোথাকার।”
ইংলিশ আন্টি এলো মিনিটের মধ্যেই। তার মুখে হলুদ রঙের ফেইস প্যাক লাগানো। শোভার বড্ড হাসি পেলো। তিনি এসে শোভাকে ঘরে ডাকলো। যেতে ইচ্ছা না করলেও কথা ফেলতে না পেরে ভেতরে ঢুকলো সে। ইংলিশ আন্টির বসার রুমটা বেশ রুচিশীল বলা চলে। খুব বেশি আসবাব নেই তবুও চোখের শান্তি দেওয়ার মতো। পুরোটা সাদার ওপর ডিজাইন করা। একপাশ বেতের ফার্নিচার দিয়ে সাজানো। অন্যপাশে অফ হোয়াট রঙের সোফা। সেই সোফায় বসে আছেন রিয়াদের বাবা আরিফ। টিভিতে ফুটবল খেলা চলছে। তিনি সেদিকেই মনোযোগী ছিলেন। শোভাকে দেখে এক গাল হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“কেমন আছো শোভা? আজকাল তো তোমার দেখাই পাই না।”
শোভার এই একটা মানুষকে বেশ পছন্দ। ছেলে কিংবা বউয়ের মতো অস্বাভাবিক কিছু নেই ওনার মাঝে। বললো,
“আলহামদুলিল্লাহ আঙ্কেল। আসলে আপনি হয়তো জানেন আপুর পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছে। তো সেই নিয়ে সবাই একটু মেতে ছিলাম।”
“ওহহ। তেমন করে শোনাই হলো না। এসো সব শুনি তোমার থেকে। এমনিতেও বাড়িতে গল্প করার মতো কেউ নেই।”
কথাটা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একটু আস্তেই বললেন আরিফ আঙ্কেল। ইংলিশ আন্টি তবুও শুনে ফেললো। চোখ রাঙিয়ে বললো,
“কথা বলার মানুষ নেই মানে? আমি কথা বললে তো পাত্তা দাও না। আবার বলো মানুষ নেই?”
“তোমার কথা মানেই হিন্দি সিরিয়াল এবং সাজগোজ নিয়ে আলাপ। আচ্ছা বাদ দাও এসব। বাচ্চা মেয়েটার সামনে আর ঝগড়া করো না। শোভা মামনি এসো এখানে।”
ইংলিশ আন্টি দমে গেলেন। শোভা পায়েসের বাটি ইংলিশ আন্টিকে দিয়ে যেই না সোফায় বসতে যাবে তখনই রিয়াদ এসে আরাম করে সোফায় বসে পড়লো। এমন একটা ভাব করলো যেন শোভাকে সে দেখেইনি। এক হাত সোফায় ছড়িয়ে বসে মোবাইলেই দৃষ্টি স্থির রাখলো। শোভার ইচ্ছে করলো মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে। লোকটা কি ইচ্ছে করে ওকে অপমান করছে? নাকি স্বভাবই এমন? ইচ্ছে করলো এক্ষুনি এখান থেকে চলে যেতে। কিন্তু এতে আঙ্কেলকে অসম্মান করা হবে। তাই ভদ্রতা দেখিয়ে রিয়াদের বরাবর সিঙ্গেল সোফায় বসলো।
মিহার বিয়ে, ছেলে কেমন, কি করে এইসব নিয়ে আঙ্কেল আন্টির সাথে বেশ কিছু আলাপ হলো। পুরোটা সময় রিয়াদ মোবাইলেই পড়ে ছিলো। একবার হু হা করলো না এবং মুখও তুললো না। শোভা গল্প করার সময় বেশ কয়েকবার আড়চোখে রিয়াদকে দেখলো। কেনো দেখলো জানা নেই। যেহেতু সামনাসামনি বসা তাই চোখ যেতেই পারে। এতে আর কি এমন আছে বলে মনকে বোঝালো শোভা। যখন বের হয়ে আসবে তখন দরজা দিতে এগিয়ে এলো রিয়াদ। এমনিতেই বারবার অপমান তার ওপর অতিরিক্ত ভাব দেখে সহ্য হলো না শোভার। কিছুটা গটগট শব্দ করেই সদর দরজা পার হলো সে।
শোভা যখন তিন ধাপের সিড়ি বেয়ে মাটিতে পা রাখলো তখন পেছন থেকে রিয়াদের গলা পাওয়া গেলো।
“তুমি কি ট্যারা?”
শোভা কথাটা শুনে পেছন ফিরে তাকালো। রিয়াদ দরজায় গায়ে হেলান দিয়ে মুখে গম্ভীর ভাব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে। শোভা বুঝতে না পেরে বললো,
“মানে?”
“মানে তোমার কি চোখে সমস্যা?”
শোভার মেজাজ খারাপ হলো। এই লোকটা কি ভাবে নিজেকে? খালি ওকে অপমান করে যাবে? রাগ মিশ্রিত কন্ঠে শোভা বললো,
“আমাকে দেখে কি আপনার তাই মনে হয়? এখন তো আমার মনে হচ্ছে আপনার চোখে সমস্যা। নাহলে ভালো মানুষকে ট্যারা বলবেন কেনো?”
রিয়াদ মাথা দুলিয়ে পকেটে হাত রেখে বললো,
“কথা বলছিলে বাবা মায়ের সাথে। অথচ দেখছিলে আমাকে। তো এটাকে কি বলা উচিৎ? তুমি আমায় সরাসরি দেখছিলে নাকি লুকিয়ে? নাকি দেখছিলেই না। ট্যারা বলে মনে হয়েছে আমায় দেখছো কোনটা?”
শোভা হঠাৎ কথা হারিয়ে ফেললো। কি বলবে বুঝতে পারলো না। এই লোক কখন খেয়াল করলো যে শোভা ওকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছে? কন্ঠে জোর আনার চেষ্টা করে আমতা আমতা করে শোভা বললো,
“আমি মোটেও আপনাকে দেখছিলাম না। আপনিই ট্যারা তাই ভুল দেখেছেন, হুহ।”
শোভা আর দাড়ালো না। দ্রুতপদে স্থান ত্যাগ করলো।
বাড়িতে পা রাখতেই দেখলো টফি মিহার গায়ের সাথে মিশে আদর খাচ্ছে। তখন বাড়িতে দেখতে পায়নি ওকে। এখানে এসে মিহার আদর খাচ্ছে সে। শোভাকে দেখেই টফি ডেকে উঠলো। এতে মিহার নজর পড়লো ওর ওপর।
“এটা এখানে কেনো?”
মিহা বললো,
“আমি ডেকে এনেছি।” থেমে আবার বললো,
“টেবিলে একটা বাটিতে কিছু হাড় সহ মাংস রেখেছি দেখ। একটু এনে দে তো টফিটাকে খাওয়াই।”
“ওকে কেনো খাওয়াবে? এই শিয়ালটা আমায় দেখলেই তেড়ে আসে।”
টফি বোধহয় নিজের অপমান বুঝতে পারলো। শোভার দিকে তাকিয়ে ডেকে উঠলো কয়েকবার।
মিহা বললো,
“এভাবে বলিস কেনো? ও কি এমনি এমনিই তোকে দেখলে তেড়ে যায়? এতে তোর দোষ নেই? বোবা প্রানির সাথে এতো হিংসা করিস কেনো? যা খাবারটা নিয়ে আয়।”
শোভা একটা মুখ ভেংচি দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। মাংসের বাটিটা এগিয়ে দিতেই টফি হামলে পড়লো সেটাতে। শোভা টফির কান টেনে মাথায় আলতো থাপ্পড় দিয়ে বললো,
“রাক্ষস একটা। আমায় সহ্য করে না। আবার আমার এনে দেওয়া খাবার খাওয়া হচ্ছে। ”
তারপর মিহাকে জিজ্ঞেস করলো,
“ভাইয়া কোথায় আপু?”
“একটু বেরিয়েছে মামার সাথে। বোধহয় মামার দোকানগুলো ঘুরে দেখে আসবে।”
_____________
সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষন। ধুসর মেঘমুক্ত আকাশে চাদের অনুপস্থিতিতে গুটিকয়েক তারা চকচক করছে। চারিদিকে অল্পবিস্তর বাতাসের আনাগোনা। জানালা ভেদ করে সেই বাতাস মিহার ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। নিশান্ত বিছানায় আধশোয়া হয়ে মোবাইল স্ক্রল করছিলো। বাড়ির সবার সাথে দুজনের কথা হলো একটু আগে। মিহাকে দেখে উঠে বসলো। ওর হাতে পায়েসের বাটি। নিশান্ত ঠান্ডা পায়েস পছন্দ করে। তাই বানিয়ে ফ্রিজে রেখে দিয়েছিলো সুমা বেগম। সেটাই এখন নিয়ে আসলো মিহা। খাটে এসে নিশান্তের পাশে বসে বাটিটা ওর দিকে এগিয়ে দিতেই নিশান্ত মাথা দুলিয়ে না করলো।
মিহা বললো,
“খাবেন না?”
“খাবো তো।”
“তাহলে নিন।”
“উহু। শ্বশুর বাড়ি মানে আরামের যায়গা। সেই আরামটা আমি তখনই পাবো যখন আমার প্রিয় মাহযাবীন তার হাতে আমাকে খাওয়াবে।”
মিহা চুপসে গেলো। কি বলবে ভেবে পেলো না। আজ পর্যন্ত কাউকে খাইয়ে দিয়েছে কিনা মনে করতে পারলো না। ওকে লাল হতে দেখে নিশান্ত নিঃশব্দে হাসলো। বললো,
“চামচে করেই তো খাওয়াবে। হাতে মেখে কিছু খাওয়াতে বলছিনা তো। খুব কি কঠিন কিছু?”
মিহা চামচে পায়েস তুলে নিলো। তা ধরলো নিশান্তের সামনে। তবে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখলো। ওকে অন্যরকম ভালো লাগা ছুয়ে যাচ্ছে। কেমন একটা সুখী সুখী ভাব আসছে। মিহা সত্যিই তো খুব সুখী নিশান্তকে পেয়ে। সেই সুখ মিহার একার পক্ষে বয়ে আনার ক্ষমতা ছিলো না। সেই সুখ বহুলাংশে নিশান্তই এনে দিয়েছে। কে বলবে দুজনের পরিচয়ের সপ্তাহ পেরিয়েছে মাত্র?
নিশান্ত মিহার মুখ নিজের দিকে ফেরালো। পায়েসের চামচটা মিহার হাত থেকে নিয়ে ওর মুখের সামনে ধরে বললো,
“আমার প্রিয় মানুষটা আগে ঠোঁট ছোয়াক এই মিষ্টিতে। তার ছোয়ায় মিষ্টিটুকু অমৃত হয়ে উঠুক।”
মিহার চোখ ছলছল করে উঠলো। মানুষটা এতো ভালো কেনো? এতো যত্ন নেয় কেনো? অথচ এতো খেয়াল না নিলেও বোধহয় মিহার অভিযোগ থাকতো না। চোখের কার্নিশ ঘেঁষে একফোঁটা সুখের জল গড়ালো ওর হলুদাভ কপোল বেয়ে। সেটা ঝরে পড়ে যাওয়ার আগেই শুষে নিলো নিশান্ত। আলতো করে ওর মাথাটা বুকে ঠেকিয়ে নিলো। মিহা বললো,
“আপনি এতো ভালো কেনো?”
“কারন আমার মাহযাবীন যে এতো মিষ্টি।”
মিহা আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো। এই বুকটা তার নিজস্ব স্থান। পরম ভালোবাসার। নিশান্ত বললো,
“তোমার অশ্রুর ট্যাংক টা আমায় দিয়ে দাও। এক ফোটা জলও গড়াতে দেবো না সেখান থেকে।”
চলবে…