#পরিশেষে_ভালোবাসি
#শেষ_পর্ব
#সামিয়া_মেহেরিন
আজ আবারও আমি এই বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তবে এবার আহিয়ানের স্ত্রী হিসেবে নয়, বরং মা আর আরিয়ার অনুরোধ রাখতে।
চারদিন পর আরিয়া আর ইরফানের বিয়ে। মা আর আরিয়ার অনুরোধ আমি ফেলতে পারিনি। তাই আবারও এই বাড়ির চৌকাঠ পেরোতে হলো। ভেবেছিলাম আহিয়ানের মুখোমুখি হব না। আলাদা ঘরে থাকবো আর যতদূর সম্ভব তার থেকে দূরে থাকবো। কিন্তু বাড়ি ভর্তি মেহমান। আলাদা ঘরে থাকলে হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। উপায়ান্তর না দেখে আহিয়ানের ঘরেই যেতে হলো। ঠিক করেছি আরিয়ার বিয়ে হয়ে গেলে মাকে আহিয়ান আর কুহুর সম্পর্কের ব্যাপারে জানিয়ে সবার জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যাব।
ঈশাকে দেখে আহিয়ান যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেলো। তার হৃদয় জুড়ে শুধু প্রশান্তির হাওয়া বইছে।
🌸🌸🌸
আজ আরিয়ার গায়ে হলুদ। দেখতে দেখতেই তিনটে দিন পেরিয়ে গেছে। এই তিন দিনে আহিয়ান বারবার চেষ্টা করেছে ঈশার সাথে কথা বলতে কিন্তু ঈশা প্রতিবারই তাকে এড়িয়ে গেছে। আহিয়ান কিছুতেই তার এড়িয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না। ঈশার এড়িয়ে যাওয়া তার হৃদয়কে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে। ঈশার সাথে একটু কথা বলার জন্য তার মন আনচান করছে। তবুও আহিয়ান ব্যর্থ। হয়তো এটাই তার প্রাপ্য। ঈশাকে অন্ত্যত সে নিজের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে এতেই সে খুশি।
ড্রেসিংটেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শাড়ি ঠিক করছে ঈশা। পরনে তার সবুজ-পাড় হলুদ শাড়ি আর ফুলের গহনা। হালকা সাজেই তার থেকে চোখ ফেরানো দায়। আহিয়ান একটা কাজে ঘরে এসে ঈশাকে দেখে থ মেরে যায়। একধ্যানে সে ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে।
ঈশা আহিয়ানকে খেয়াল করতেই কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে নিজের শাড়ির আঁচল ঠিক করে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। তা দেখে আহিয়ান মুচকি হাসে। তবে তার হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল দেয়।
-অনুষ্ঠান শেষে ছাদে এসো।
গায়ে হলুদের পুরো সময়টায় আহিয়ান একদৃষ্টিতে ঈশার দিকে তাকিয়ে থেকেছে। ঈশা যতবার বিষয়টা খেয়াল করেছে, ততবার আহিয়ানের থেকে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আহিয়ান! সে তো ছাড়বার পাত্র নয়। অর্থাৎ ঈশা নিজের চেষ্টায় ব্যর্থ।
ছাদে কুহুর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আহিয়ান। আহিয়ান কী বলবে বুঝতে পারছে না। তা দেখে কুহু তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বলে
-ভালোবেসে ফেলেছো ঈশাকে, তাইতো?
-আমাকে ক্ষমা করো কুহু।
কুহু ম্লান হাসে।
-সব ভালোবাসারই যে পূর্ণতা পেতে হবে এমন-তো কোনো কথা নেই। অপূর্ণ ভালোবাসা আছে বলেই মানুষের মনে ভালোবাসা হারানোর ভয় জেঁকে বসে। ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিতে এত লড়াই করে। আমার ভালোবাসা নাহয় অপূর্ণই থাক। ভালোবাসার মানুষের খুশির মাঝেই আমার খুশি নিহিত থাক।
🌸🌸🌸
আহিয়ান ছাদ থেকে নেমে ঘরে এসে দেখে ঈশা ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের গহনা খুলছে।
আহিয়ান ঈশার কাছে গিয়ে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। ঈশা আহিয়ানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে সর্বশক্তি দিয়ে আহিয়ানের গালে একটা চড় মারে।
এক মাস পর
গত এক মাসে বদলেছে অনেক সম্পর্ক, পরিবর্তন হয়েছে অনেক সম্পর্কের নাম। আরিয়া আর ইরফার সুখে সংসার করছে। নিশা আর মাহাদীর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তারাও সুখে আছে। কুহুরও বিয়ে হয়েছে।
ফারহান কুহুর ক্লাসমেট ছিল। কুহুকে মনে মনে ভালোবাসলেও কখনো সে তা প্রকাশ করে নি। কেননা সে জানতো কুহু আহিয়ানকে ভালোবাসে। পারিবারিক ভাবে ফারহান আর কুহুর বিয়ে হয়। কুহুও সম্পর্কটা মেনে নিয়েছে।
তবে আমার আর আহিয়ানের সম্পর্ক কেন যেন আগের জায়গায়ই স্থির হয়ে আছে। আরিয়ার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরপরই আমি ওই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলাম।
এই মুহূর্তে জানালা দিয়ে বাইরে বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। এ আর নতুন কিছু না। গত একমাস ধরেই এমন হয়ে আসছে।
জানি রাত দেড়টা পর্যন্ত আহিয়ান এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবেন বাড়ির দিকে একমনে তাকিয়ে। তারপর আবার সকাল ৭টার দিকে চলে আসবেন। অফিসে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবেন। অফিস শেষ হলে আবারও আসবেন।
প্রথম প্রথম আমার সাথে কথা বলতে আসলেও, আমার এড়িয়ে যাওয়াতে এখন আর আসেন না। একদৃষ্টিতে বাড়ির গেটের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আভিউ তার দিকে তাকিয়ে থাকি তবে সেটা তার অগোচরে। একয়দিনে মানুষটা অনেক শুকিয়ে গিয়েছে। চোখের নিচেও কালো দাগ পরেছে।
এমন নয় যে আমি তাকে ফিরে পেতে চাই না। কিন্তু যতবার আমি তার কাছে যেতে চাই ততবার আমার মধ্যে তীব্র অপরাধবোধ কাজ করে। একদিকে আমার বাবা তার বাবার খুনি। আমি তার সামনে গেলে হয়তো তার পুরনো ক্ষত আবারও তাজা হয়ে উঠবে। অন্যদিকে আমার জন্য কুহু তার ভালোবাসা হারালো।
এদিকে আহিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গত এক মাসের মতো আজও তাকে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। হয়তো এটাই ঈশার সাথে করা তার অন্যায়ের শাস্তি। আহিয়ান নিজের কাজের জন্য অনুতপ্ত। “অপেক্ষা” জিনিসটাই হয়তো তার জন্য উপযুক্ত শাস্তি। আহিয়ান জানে না তার এই অপেক্ষার প্রহর করে শেষ হবে। তবুও আশা রাখে হয়তো একদিন ঈশা তার অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটিয়ে তাকে গ্রহণ করবে।
রোজকার মতো আজও সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছি আহিয়ানকে দেখবো বলে। কিন্তু কই তিনিতো আজ আসেননি।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো তবুও তিনি আসছেন না। মনটা কেন যেন খুব কু গাইছে।
অবশেষে তিনি এলেন সন্ধ্যা ৬টায়। তাকে আসতে দেখে দেহে প্রাণ ফিরে পেলাম। কিন্তু তার একি অবস্থা! কপালে, হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ।
আজ আর কোনো বাঁধা আমাকে আটকাতে পারলো না। দৌঁড়ে গেলাম তার কাছে। জাপটে জড়িয়ে ধরলাম। আশেপাশের মানুষ যে আমাদের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে, সেদিকে আমার কোনো খেয়াল নেই। আমি ব্যস্ত আহিয়ানের বুকে নিজের আশ্রয় খুঁজতে।
এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে আহিয়ানের এক্সিডেন্টের। এখন তিনি মোটামুটি সুস্থ।
আজ আমি আবার বিয়ের কনের সাজে সাজলাম। ড্রইংরুমে সোফায় আহিয়ানের পাশে বসে আছি। কিছুক্ষণ আগেই আমরা দ্বিতীয় বারের মতো বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। তবে এবার কারো জোড়াজুরিতে নয়, বরং স্বেচ্ছায়।আহিয়ান আমার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন
-ভালোবাসি।
নিজের লেখা ডায়েরিটা বন্ধ করে রাখলো ঈশা। অজান্তেই কয়েক ফোঁটা অশ্রুকণা বিসর্জন দিলো। সাত বছর পেরিয়ে গিয়েছে আহিয়ান আর ঈশার একসাথে পথচলার। তবে এখন আর তারা একা নেই। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন প্রাণ। আজই আহিয়ান আর ঈশার ছেলে ইশানের স্কুলের প্রথমদিন। আহিয়ান ইশানকে নিয়ে স্কুলে গিয়েছে।
-ঈশা, তুমি কাঁদছো কেন?
চিরপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে ঈশা সাতমাসের ভারী পেট নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আহিয়ানের দিকে ফিরে মুচকি হাসে।
-আপনারা এসে পরেছেন। ইশান কোথায়?
-সে তো বাড়ি এসেই তার দাদিয়ার কাছে ছুটেছে। কিন্তু তুমি কাঁদছিলে কেন?
ঈশা ডায়েরিটা আহিয়ানকে দেখায়।
-অনেকদিন পর ডায়েরিটা চোখে পড়লো।
আহিয়ান মুচকি হেসে ঈশাকে জড়িয়ে ধরে। ঠিক সেই সময় ইশান ঘরে আসে।
-মাম্মাম-বাবাই, তোমরা কী করছো?
আহিয়ান আর ঈশা কিছুটা চমকে গিয়ে ইশানের দিকে তাকায়। একপলক একেঅপরের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দেয় দুজনে।
সমাপ্ত
“পরিশেষে ভালোবাসি” গল্পটা আমার লেখা প্রথম গল্প। ফেসবুকে পোস্ট করার আগেই পুরো গল্পটা আমি হাতে-কলমে লিখে ফেলেছিলাম। এত তাড়াতাড়ি গল্পটা শেষ করতে আমার নিজেরও ভালো লাগছে না। কিন্তু ঐ যে বললাম প্রথম লেখা, তাই কোনোদিন কল্পনাতেও আসে নি এত রেসপন্স আর ভালোবাসা পাবো। গল্পটা এর থেকে বড় করলে অনেকটাই খাপছাড়া হয়ে যাবে। “পরিশেষে ভালোবাসি” গল্পটা নাহয় এখানেই সমাপ্ত হোক।
অনেকে বলেছেন আহিয়ানকে যেন নায়ক না বানাই। আসলে “আহিয়ান” চরিত্রটাকে যে আমি এতটা নেগেটিভ করে ফেলেছি আমি নিজেও খেয়াল করি নি। আপনাদের কমেন্টগুলো পড়ার পর বিষয়টা আমার নজরে পরেছে। কিন্তু ততদিনে গল্পের অনেকগুলো পর্ব শেষ হয়ে গিয়েছিল। এত পর্ব পেরিয়ে আসার পর নায়কের এন্ট্রি দিলে আপনাদের পড়তে ভালো লাগতো না, আমারও লিখতে ভালো লাগতো না। আর থাকে “কুহু” চরিত্রের কথা। কুহুকে আমি কখনোই নেগেটিভ করতে চাইনি। ভালোবাসাকে নিজের করে না পেলে, সবসময় খারাপ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে এমন-তো কোনো কথা নেই।
জানি নি গল্পটা আপনাদের ভালো লেগেছে কিনা। গল্পের নামের সার্থকতা কতটুকু আনতে পেরেছি তাও জানি না। এতদিন যারা আমার পাশে ছিলেন তাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। আর এটা যেহেতু গল্পের শেষ পর্ব, তাই আশা করব সকলে গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। আবারও সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ।