#পরিশেষে_ভালোবাসি
#পর্ব_০৪
#সামিয়া_মেহেরিন

ঘরে ঢুকে দেখলাম আহিয়ান গম্ভীর মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তাকে দেখেই আমার কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো।

-এত দেরি হলো কেন ঘরে আসতে?
-না মানে আসলে…
-দেখো ঈশা তোমাকে আমি আগেও বলেছি তোমায় বিয়ে করার পেছনে আমার একটা উদ্দেশ্য আছে। যেটা আমি এখন তোমাকে জানাতে পারব না।
-সেটাইতো আমার সমস্যা। আপনি আমাকে জোর করে বিয়ে করেছেন অথচ বিয়ের কারণটাই আমি এখনো জানতে পারলাম না। তার ওপর কথায় কথায় আমার বোনের ক্ষতি করার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন।
-হুমকি না দিলে তুমি আমাকে বিয়ে করতে? আর ঈশা, আমি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে চাচ্ছি না। যতদিন এ বাড়িতে আমার স্ত্রীর পরিচয়ে আছো ততদিন আমার কথামতো চলো। এতে তোমার এবং তোমার বোন, দুজনেরই মঙ্গল। কালকে তোমাকে দেখতে কিছু আত্মীয়-স্বজন আসবে। আশা করি তাদের সামনে কোনো ধরনের ঝামেলা করবে না।

কাঠ কাঠ গলায় কথাগুলো বলে আহিয়ান সোফায় গিয়ে শুয়ে চোখ বুজলেন। কিন্তু এবার আমার কী হবে? নিজের পাতা ফাঁদে আমি নিজেই ফেঁসে গেলাম। পুরো বিছানায় পানি ফেলে রেখেছি। আমি কই ঘুমাবো এখন?

পরেরদিন লাল একটা শাড়ি পরে সুন্দর করে সেজে ড্রইংরুমে বসে আছি। ঠোঁটে ঝুলছে মিথ্যে হাসি।

কারণটা হলো গেস্টদের বেশিরভাগ ঈশার সৌন্দর্যের জন্য প্রশংসা করলেও কেউ কেউ আবার আহিয়ান এতিম মেয়েকে কেন বিয়ে করেছে তাও কাউকে না জানিয়ে এটা নিয়ে কানাঘুষা করছে। সবই ঈশার কানে এসেছে।

রাতে মনমরা হয়ে বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি। ভাবছি আজ দুপুরের কথা। আহিয়ানের এক মামি আমার সামনেই আহিয়ানকে বলেছেন, এরকম এতিম মেয়েকে কেন বিয়ে করতে গেলি বলতো। মানছি মেয়েটা দেখতে সুন্দর তবু পরিবারও ভালো হওয়া উচিত ছিল। আমার মেয়েটাতো সবদিক দিয়েই পারফেক্ট ছিল তোর জন্য। কিন্তু কি করে ফেললি বলতো! আফসোসের সুরে কথাগুলো বলেন তিনি।

আজ বাবা-মার কথা খুব মনে পড়ছে। তারা থাকলে এমন কোনোকিছু হতো না আজ।

আহিয়ান ঘরে এসে ঈশাকে না পেয়ে বারান্দায় উঁকি দিতেই দেখলো ঈশা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। করাটাই স্বাভাবিক। আজকের ঘটনার জন্য তার নিজেরও খারাপ লাগছে। আহিয়ান মনে মনে ভাবছে ঈশার সাথে আর খারাপ ব্যবহার করবে না। নিজের কাজ হাসিল করতে তার ঈশাকেই প্রয়োজন।

একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। আহিয়ানের ডাক শুনতে পেলাম। তিনি এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। তার দিকে না ফিরেই উত্তর দিলাম।

-জ্বী, বলুন।
-আজকের জন্য আমি সত্যিই সরি। আমি ভাবিনি এমন কোনো ঘটনা ঘটবে।

ম্লান হেসে বললাম
-সমস্যা নেই। উনিতো ভুল কিছু বলেন নি।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আহিয়ান বললেন
-ঈশা, আমরাতো বন্ধু হয়েও থাকতে পারি তাই না? একসাথে যখন আছিই তখন নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করে কি লাভ বলো?

তার কথায় মুচকি হাসলাম।
-বন্ধু হতে হলেতো একে অপরের মনের কথাও শেয়ার করতে হবে। কিন্তু আপনি সেটা করবেন না।
-তোমার কথাটা ঠিক বুঝলাম না।
-আমাকে বিয়ে করার কারণটাইতো জানলাম না এখনো।
-ঘুরে ফিরে একই কথা বলো কেন বলতো। সময় হলে আমি নিজেই জানাবো।

আমি আর কিছু বললাম না। তিনি আবারও বলতে শুরু করলেন
-ঈশা, তুমিতো তোমার পরিবার, মানে মা-বাবা সম্পর্কে কখনো কিছু বলনি।
-আপনি কখনো জিজ্ঞাসা করেন নি।
-আচ্ছা, এখন বলছি। বলো।

-আমার পরিবার বলতে শুধু আমার বোন। আমার মা নিশার জন্মের সময় মারা যান। বাবা আর বোনকে নিয়ে ভালোই ছিলাম। কিন্তু বাবাও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
-ছেড়ে চলে গেলেন মানে?
-আমার বাবা তিশান আহমেদ এক সময় স্বনামধন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন ছিলেন। কিন্তু হঠাৎই ব্যবসায় অনেক লস হয়। বাবা প্রায়ই ব্যবসার কাজে ঢাকার বাইরে যেতেন। শেষবারের মতো গিয়েছিলেন সিলেটে। কিন্তু আর ফিরেন নি।

আহিয়ান মনোযোগ দিয়ে ঈশার কথা শুনছে। ঈশা আবারও বলতে শুরু করল।
-সিলেট থেকে ফেরার পথে বাবার এক্সিডেন্ট হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও বাবার লাশ পাওয়া যায় নি।

কথাটুকু বলতে আমার চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল বেরিয়ে গেল।

-অনেক রাত হয়েছে, ঈশা। যাও, ফ্রেশ হয়ে নাও। আর আজকের জন্য আবারও সরি।

আমি কিছু না বলে ঘরে চলে এলাম। পুরো দিনের ধকলে ক্লান্ত লাগছে। ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে গেলাম।

এদিকে ঈশার কথাগুলো আহিয়ানকে গভীর চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। সে ভাবছে ঈশা যদি সবটা জেনে যায় তাহলে কি মেনে নিতে পারবে। নাকি তাকে অবিশ্বাস করবে।

ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি আহিয়ান বিছানায় বসে আছেন। আমি ঘুমানোর জন্য সোফার দিকে পা বাড়াতে তিনি বলেন,
-তুমি চাইলে বিছানায় ঘুমাতে পারো। আমার কোনো সমস্যা হবে না।
-জ্বীইইইই!( অবাক হয়ে)
-আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারো। আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই। আমি যেটা করছি তোমার এবং আমাদের সকলের ভালোর জন্যই করছি।( ঠাণ্ডা গলায়)

আমি আর কথা বাড়ালাম না। শুরু থেকেই কেন যেন মানুষটাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে বেঁচে থাকার হয়তো কোনো নতুন অবলম্বন খুঁজে পেয়েছি। তাই হয়তো তাকে এতকিছুর পরও কঠিন গলায় কিছুই বলতে পারি নি। চুপচাপ গিয়ে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়লাম। ক্লান্ত থাকায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে গেলাম।

অন্ধকার রাতে নিজের জীবন বাঁচাতে দৌঁড়ে যাচ্ছে একজন লোক। আর পেছনেই তাকে তাড়া করতে দৌড়াচ্ছে কিছু কালো পোশাক পরা লোক। তারা নিজেদের মুখও কালো কাপর দিয়ে ঢেকে রেখেছে। কাউকেই চেনার উপায় নেই।

লোকটা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে একটা নদীর ধারে এসে থমকালো। সামনে আর যাওয়ার জায়গা নেই। কালো পোশাক পরা লোকগুলো তাকে ঘিরে রেখেছে। সকলের হাতেই বন্দুক আর সেটা তাক করে রেখেছে লোকটার দিকে। লোকগুলোর মাঝখান থেকে মাস্ক পরা সেই লোকটি বেরিয়ে এলো। আজও তার চেহারা দেখে তাকে চেনার কোনো উপায় নেই। মাস্ক পরা লোকটি তার হাতে থাকা বন্দুক লোকটার দিকে তাক করে বলল

-তোর আর পালানোর রাস্তা নেই। ভালোয় ভালোয় আমাদের কথা মেনে নে।
-তোরা কোনোদিনো স্যারকে ধরতে সফল হবি না। তার আগেই স্যার তোদের সবাইকে শেষ করে দেবে।

বলে লোকটা নদীতে ঝাপ দিলো। আর এদিকে মাস্ক পরা লোকটি রাগে ফুঁসছে। তার চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। কালকে সব মেহমানরাই চলে গিয়েছিলেন শুধু আহিয়ানের ছোট খালামণি আর তার ৭বছরের মেয়ে মাহিয়া বাদে। ভাবলাম সকলের জন্য আজ সকালের নাস্তা আমিই বানাই। যেই ভাবা, সেই কাজ।

ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে সবাইকে ডাক দিলাম। আমার রান্না খালামণি আর মাহিয়া দুজনেরই বেশ ভালো লেগেছে। খাওয়ার পর্ব শেষ করে মাহিয়াকে আমার দায়িত্বে রেখে মা আর খালামণি শপিং করতে বেরোলেন। নিশা আর আরিয়াও বেরিয়ে গেলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।

আহিয়ান ঘরে এসে দেখে সেখানে ঈশা মাহিয়ার সাথে খেলছে।

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here