#হঠাৎ_দেখা
#পর্ব_২৬

আজ হাসান সাহেবের শরীরটা অাগের তুলনায় অনেক খারাপ।বুকের ব্যাথাটাও অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশি।প্রছন্ড ঘামছেন তিনি আজ।সকাল থেকে মাথাটাও ঘুরাচ্ছে।পানির পিপাসা লাগায় বিছান থেকে উঠে টেবিলের দিকে এগুতে লাগলেন তিনি।কিন্তু দাঁড়ানোর সাথে সাথেই চোখে অন্ধকার দেখতে পেলেন।মাথা ঝাকিয়ে দৃষ্টি পরিষ্কারের বৃথা চেষ্টাও চালালেন। কিন্তু শেষ রক্ষাটা হলো না।জ্ঞান হারিয়ে রুমের মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি।
রান্নাঘরে দুপুরবেলারর খাওয়ার আয়োজন করছিলেন নিলুফা বেগম।হঠাৎ রুম থেকে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দে সেদিকে ছুটে গেলেন।রুমে গিয়ে স্বামীকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে আত্না কেঁপে উঠলো নিলুফা বেগমের।প্রথমে স্বামীর কাছে গিয়ে জ্ঞান আনার অনেক চেষ্টা করলেন। সেদিকে ব্যর্থ হলে কি করবে ভেবে উঠতে পারলেন না তিনি।অজ্ঞান স্বামীকে রেখে দৌড়ে গেলেন নিচ তলায়।যদি কোন সাহায্য পাওয়া যায়।

সবেমাত্র ওটি থেকে বের হয়ে এসে পেশেন্টের পরিবারের সাথে কথা বলছে আসাদ।আর রাবেয়া তার পিছনে দাড়িয়ে আছে।মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছে সে তার ডাক্তারসাহেব কে।একজন মানুষ সবদিকটা কেমন করে সামলাতে পারে তা সে আসাদকে দেখে বুঝেছে।ওটিতে একজন কর্তব্যরত ডাক্তাররের ভূমিকায় থাকলেও এখন সে রোগীর পরিবারবর্গের সামনে তাদের সান্তনা ও আশা দিতে ব্যস্ত।তাদের সাথে কথা বলা শেষে রাবেয়ার দিকে তাকালো আসাদ।দেখলো রাবেয়া তার দিকে তাকিয়ে আছে।চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করল ‘কি দেখছো?’রাবেয়া না সূচক মাথা নাড়িয়ে অন্যদিকে তাকালো।আর মনে মনে ভাবলো,মানুষটার চোখের দিকে বেশিক্ষন তাকানো সম্ভব না তার পক্ষে।

জিহানের ফোন পেয়ে দ্রুত পায়ে হেটে সেদিকে ছুটলো আসাদ।যেটার ভয় সে পেয়েছে সেটাই হলো।রুগীর কেবিনে ঢুকে নিলুফা বেগমে দেখলো সে।অনবরত কান্না করছেন তিনি।হাসান সাহেবকে অক্সিজেন মাক্স পরিয়ে রাখা হয়েছে।আসাদকে দেখে এগিয়ে এসে তার কাধে হাত রাখল জিহান আর বলল,”অবস্থা খুব ক্রিটিকাল।মেজর হার্ট এ্যাটাক।দ্রুত অপারেশন করাতে হবে।” জিহানের কথায় সম্মতি জানিয়ে নিলুফা বেগমের কাছে গেল আসাদ।তাকে সান্তনা দিতে লাগলো।এখন তাকে ভাবাছে রাবেয়ার চিন্তা।রাবেয়া নিজের বাবাকে এই অবস্থায় দেখে কি রিয়েক্ট করবে আসাদের জানা নেই।কিন্তু মনে মনে কঠিন একটি সিদ্ধান্ত নিলো সে।

কিছুক্ষন আগে রাবেয়ার ফোনে আসাদের ফোনকল আসলে আসাদ রাবেয়াকে তিন তলার ৩০৩ নাম্বার কেবিনে আসতে বলেছে।রাবেয়া মনে করল হয়তো নতুন কোন হার্ট পেশেন্টের রেগুলার চেকআপের জন্য।তিন তলায় উঠে ৩০৩ নাম্বার কেবিনের সামনে দেখতে পেল আসাদকে।জিহানের সাথে কিছু নিয়ে আলাপ করছে হয়তো।রাবেয়া হেঁটে তাদের দিকে এগিয়ে গেল।রাবেয়াকে দেখে জিহান আসাদকে বলে চলে গেল।রাবেয়া ভালো করে খেয়াল করল আসাদকে।সকালেও তো চেহারায় এতো বিষন্নতা ছিলোনা মানুষটার। হঠাৎ কি হয়ে গেল?রাবেয়া আরো আবাক হলো যখন আসাদ তার একটি হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিল।

“আপনি ঠিক আছেন তো।”
“চলো আমার সাথে।” এই কথাটা বলে ৩০৩ নাম্বার রুমের দরজা খুলে ভিতরে গেল তারা।রুমে ঢুকে প্রথমে চোখ পড়ল বেডে শুয়ে থাকা অক্সিজেন মাক্স লাগানো মানুষটার উপর।রাবেয়া বুকটা কেঁপে উঠলো।ছয় বছর আগে দেখেছিল সে এই বাবা নামক মানুষটাকে।কই তখন তো উনার শরীর আর চেহারার এইরকম ছিলোনা।তখন তার চেহারায় ছিলো গম্ভীরপূর্ণ একটা ভাব আর শরীরটাও ছিলো স্বাস্থ্যসম্মত।আর এখন দুর্বল একটা শরীরের সাথে শুষ্ক একটা চেহারা।

“কি হয়েছে উনার?” কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করল রাবেয়া।আসাদ উত্তর দেওয়ার আগেই নিলুফা বেগম এগিয়ে এলেন মেয়েকে দেখে তারপর রাবেয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন তিনি।

“মা কি হয়েছে বাবার?” নিলুফা বেগম কান্না করার কারনে কোন উওর দিতে পারলেননা। রাবেয়া আবার জিজ্ঞেস করলো তাকে,”কি হলো বলছো না কেন?কি হয়েছে উনার।”

“সকালে রুমে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে সেখানে গিয়ে দেখি তোর বাবা মেঝেতে পড়ে আছে।কত ডাকলাম কোন জবাব দেয় নি।তাই নিচে নেমে দোকানের ছেলেকে নিয়ে কোনমতে হাসপাতালে নিয়ে আসলাম।” কথা শেষ করে পুনরায় কাঁদতে লাগলেন নিলুফা বেগম আর রাবেয়া তখন হাসান সাহেবের দিকে চেয়ে আছে।মানুষটা এতোই অসুস্থ হয়ে গেল।

সন্ধ্যার আকাশটা বড়ই সুন্দর।রক্তিম আলোয় আলোকিত হয় চারদিক।এই সময়টা কেউ কেউ চোখমুদে অনুভব করে আর কেউ জীবনের খারাপ সময়টাকে মনে করে।কারন এরপর নামবে রাত।রাতের সময়টাতে তিক্ত স্মৃতিগুলো আরো ঝেঁকে বসে।হসপিটালের ছাদের একটি টুলে বসে আছে আসাদ রাবেয়া।বাবার এমন অবস্থা দেখে মেয়েটা কেমন যেন পাথর হয়ে গেছে।আসাদ নিজ জায়গা থেকে সরে এসে রাবেয়ার আরেকটু পাশে আসলো।আলতো করে একহাতে জড়িয়ে ধরল রাবেয়াকে।হয়ত এমনি বিশ্বস্ত কাঁধের অপেক্ষা ছিল রাবেয়া চোখের জল বিসর্জনের জন্য।আসাদ তাকে জড়িয়ে ধরতেই রাবেয়া ঘুরে মুখ লুকালো আসাদের বুকে।আসাদ জানে এতক্ষন মেয়েটা আপ্রান চেষ্টা করছিলো কান্না লুকাতে।এইভাবে কিছুক্ষন কেঁটে গেল।আসাদ পানির বোতলের মুখ খুলে দিলে তা হতে কিছুটা পানি পান করল রাবেয়া।

“তুমি যদি এভাবে ভেঙে পড়ো তাহলে মাকে সামলাবে কে?”
“বাবার হঠাৎ এই অবস্থা!”
“কাল আপারেশনের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখো উনি সব ঠিক করে দিবেন।”
“ইন শা আল্লাহ।”
” রাবেয়া,তুমি আমার উপর কতটুকু বিশ্বাস করো?”আসাদের এমন প্রশ্নে কিছুটা আবাক হলো রাবেয়া।
“নিজের চাইতেও বেশি।”
“আমার বিশ্বাস আমি যদি তোমাকে কোন দায়িত্ব দেই তুমি সেটা অব্যশই পালন করবে।”
“আমি আমার সর্বোচ্চ দেওয়ার চেষ্টা করবো।”
“কাল তোমার বাবার আপারেশন আমি লিড করবো না।” আসাদের কথা শুনে চমকিতে তাকালো রাবেয়া।
“তাহলে কে করবে?”
“তুমি।” নিজ কানে বিশ্বাস হচ্ছেনা রাবেয়ার। সে জানতো অতিশীঘ্রয় এইরকম একটা সুযোগ সে পাবে।ওটিতে নিজের দক্ষতা প্রয়োগের।সকল ডাক্তাদের ইচ্ছা থাকে ওটি লিড করার।অন্যসময় হলে রাবেয়া অব্যশই খুশি মনে এই দায়িত্বটা নিয়ে নিতো কিন্তু এখন!
“আমি পারবে না।”
“তুমি পারবে।এইটা আমার বিশ্বাস।”
“নাহ!আমি সত্যিই পারবো না।আমার কারনে যদি বাবার কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।”
“আমি সবসময় তোমার পাশে থাকবো।এই যে এখন যেমন আছি।”
“কিন্তু…”
“একজন কর্তব্যরত ডাক্তারের জায়গায় নিজেকে রেখে কাল এই আপারেশনটা তুমি করবে নাকি সেই পেশেন্টের মেয়ে হয়ে।”
“বাবা যদি জানতে পারেন তাহলে…”
“সেটা পরে দেখা যাবে।আমি জানি তুমি আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবে।”

_____________________________

পরদিন সকালবেলা হাসপাতালে হাজির হলো হাসান সাহেবর দুই মেয়ে কলি ও জেরিন।কেবিনে ঢুকে তারা রীতিমত আবাক হলো রাবেয়াকে দেখে।যখন শুনলো সে এখানের ডাক্তারর তখন আরো বেশি আবাক হলে তারা।হাসান সাহেবের এখনো হুশ আসেনি।নিলুফা বেগম তার পাশেই বসে ছিলেন।রাবেয়া তখন বাবার রিপোর্টগুলো উল্টে পাল্টে দেখছিলো।বোনদের দেখে খুব খুশি হলো সে।তাদের কাছে গিয়ে কেমন আছে জিজ্ঞেস করাতে কলি বলল,”তুই কি সত্যিই ডাক্তার হয়ে গেছিস আপা?”
“আলহামদুলিল্লাহ।কত বছর পর তোদের দেখলাম বলতো।”
“তুই তো সেই মামার সাথে চলে গেলি আমাদের দিকে ফিরেও তাকালি না।”
“তোরাও তো কখনো খোঁজ নিলি না আমার!”
“বড়লোক মামার সাথে চলে গেলি তুই তোর আর কি খোঁজ খবর নিবো বল।ভালোই তো রেখেছে তোকে।”
কলির কথা শুনে জেরিন বলল,”কত স্বাথপর তুই আপা!বড়লোক মামাকে পেয়ে আমাদের কে ভুলে গেলি।”
“চুপ করবি তোরা।কি পেয়েছিস কি!স্বাথপর কে সেটা আর তোদেরকে বলতে হবেনা।মেয়ে হয়ে যা দায়িত্ব তা বাবার পাশে থেকেও কখনো করেছিস তোরা যে আমার মেয়েকে কথা শুনাচ্ছি।ভুলে যাস নে বড় বোন হয় সে তোদের।” দুই মেয়ের কথা শুনে ধমক দিয়ে বলে উঠলেন নিলুফা বেগম।
“আহ মা….” মাকে থামিয়ে দিতে বলল রাবেয়া।
রাবেয়া কি জবাব দিবে তাদের।সেইদিনের সবকিছু এই দুই বোনের সামনে হয়েছিল।অথচ আজ তারাই তাকে স্বাথপর ডাকছে।
“এইটা বুঝি তোর মেয়ে?”কলির কোলে থাকা দুইবছর বয়সী বাচ্চাটাকে দেখে বলল রাবেয়া।
“হ্যা আমার মেয়ে।তো বিয়ে শাদি করলি নাকি তোর বড়লোক মামাও তোকে বিয়ে দিতে পারেনি?”
ঠিক তখনি রুমে প্রবেশ করলো আসাদ।এসেই শুনতে পেল কথাটি।সোজা হেটে এসে রাবেয়ার পাশে দাড়ালো।সামনের মেয়ে দুটিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনারা হয়তো রাবেয়ার বোনরা।আমাকে আপনারা চিনবেন না।আমি রাবেয়ার স্বামী ডা.আসাদ মীর।”
আসাদের কথা শুনে দুই বোন একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো।তাদের কালো বোনটার জামাই নাকী ডাক্তার!ভাবা যায়!
আসাদ রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আধাঘন্টা পর আপারেশন শুরু হবে।তুমি রেড়ী তো।”
“জ্বী ডাক্তারসাহেব।”
“গুড মিসেস আসাদ।”মুচকি হেসে কথাটা বলে চলে গেল সে।রাবেয়া মনে মনে ভাবলে এই মানুষটা আজীবন পাশে থাকলে হবে আর কিছুই লাগবেনা তার।

আসাদের সাহায্যে রাবেয়া তার জীবনের প্রথম সার্জারি সাকসেসফুলি শেষ করলো। হাসান সাহেবকে বাহাত্তর ঘন্টার জন্য অভজারভেশনে রাখা হলো।ওটি থেকে বের হয়ে মামা, মামী, তার শ্বশুর শ্বাশুড়ি দেখতে পেল রাবেয়া।সাথে রয়েছে সাফা আর তুলিও।মামা মিনহাজ চৌধুরী রাবেয়ার মাথায় হাত রেখে শুধু বললেন,”আই এম প্রাউড অফ ইউ!”

তিনদিন পর হুশ আসলো হাসান সাহেবে।এখন আগের তুলনায় অনেক ভালো তিনি।বাবার হুশ আসার খবর শুনে আল্লাহর কাছে কোটি কোটি বার শোকরিয়া জ্ঞাপন করল রাবেয়া।কিন্তু যখন আসাদ তাকে বাবার সাথে দেখা করানোর জন্য নিয়ে যেতে চাইলো রাবেয়া তখন বলল,”আমার পক্ষে সম্ভব না উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ানো। আর উনি এইটা পছন্দও করবেন না।” আসাদও রাবেয়াকে আর জোর করেনি।তাই সে একাই দেখতে গেল হাসান সাহেবকে।ডা.আসাদকে দেখে হাসান সাহেব হেসে তাকে ধন্যবাদ জানালেন। তখন আসাদ বলল,”আপনার আপারেশন আমি নই আমার স্ত্রী করেছে।তাই ধন্যবাদ দিতে হলে আমাকে নয় তাকে দিতে হবে আপনাকে।”
“হ্যা তা তো অব্যশই।আপনার স্ত্রী এলো না যে।”
“সে এখন একটু ব্যস্ত কিন্তু কাল সে অব্যশই আসবে আপনার সাথে দেখা করতে।আপনি এখন বিশ্রাম নিন।”

চলবে…..
©নওশিন সালসাবিল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here