#হঠাৎ_দেখা
#পর্ব_০৮

লাল বেনারসি গায়ে জড়িয়ে দাড়িয়ে আছে রাবেয়া।মনে তার হাজারটা প্রশ্ন।সব প্রশ্নের উওর সে জানে।তবুও বিশ্বাস করতে চাইনা সে।এই কেমন জীবন তার যেখানে তার ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্য নেই শুধুমাত্র তার গায়ের রং কালো বলে।কেন তার বাবা তার অন্য দুই বোনের মত ভালোবাসে না তাকে।কেন সে এত অবহেলিত?কেন? তার বাবার গায়ের রং ওতো কালো।তাহলে কেন তিনি এমন।কেন তাকে অন্য বোনদের মতো সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না নিজের জীবনকে সুন্দর করে সাজানোর।
এই মুহূর্তে আসাদের বলা কথাগুলো খুব মনে পড়ছে তার। “নিজেকে নিজের জন্য লড়াই করতে হবে।নিজের সাথে অন্যায় হতে দেওয়া যাবেনা।”

_______________________

হাসান সাহেব আজ খুব ব্যস্ত।নিজের ঘাড় থেকে বোঝা নেমে যাবে যার জন্য খুব তোড়জোড় করছেন তিনি।সারা বাড়ি সাজানো হয়েছে নীল সাদা লাইটে।কিছুক্ষনের মধ্যে চলে আসবে বরযাত্রী। নিলুফা বেগমও জোরপূর্বক হাসি মুখে রেখে মেহমানদারিতে মন দিচ্ছেন।তিনি জানেন এই বিয়েতে রাবেয়ার মত নেই।কিন্তু স্বামীর বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়ের সুন্দর জীবনের ভিক্ষা তিনি চাইতে পারবেননা।এমন দুঃসাহস যে তার নেই।মা হয়ে মেয়ের জন্য কিছু করতে না পারার কষ্ট তার ভিতরটাকে খুবলে খুবলে খাচ্ছে।

রুমে জানালার ধারে দাড়িয়েছিল রাবেয়া।এমন সময় সেখানে আগমন হলো তার দুই বোনের।গুনে না
থাকলেও রুপে তাদের তুলনা নেই।আর এই রুপ নিয়ে তাদের অহংকারেরও শেষ নেই।বোনদের মধ্যে রাবেয়া বড়।গায়ের রং কালো হওয়ার দরুন তাকে বিয়ে দিতে কষ্ট হবে তা অনেক আগেই বুঝতে পরেছিলেন হাসান সাহেব।বড় মেয়ের বিয়েতে দেরি হওয়া মানে পরে দুই মেয়ের বিয়েতেও দেরি হওয়া।মেয়ে কালো বলে অনেকে বিয়ে করতে চাইবেনা আর অশিক্ষিত হলে তো আরও না।সেজন্য তিনি ররাবেয়াকে এতদিন লেখাপড়া করিয়েছিলেন।এখন যেহেতু মেয়ে উচ্চমাধ্যমিক এর গন্ডি পার করে ফেলেছে তাহলে এখন তার মেয়ে বিয়ে দিতে কোন বাঁধা থাকবেনা।বিয়ের বাজারে কালো মেয়ের ডিমান্ড কম হতে পারে কিন্তু অল্প শিক্ষিত মেয়ের ডিমান্ড বরাবরই বেশি।তাছাড়া মেয়ে তার অল্পশিক্ষিতের চেয়ে একটু বেশি শিক্ষিত।শুধুমাত্র মেয়ে কালো তাইতো বরপক্ষের যৌতুক, দাবিদাওয়া সব মেনে নিয়েচ্ছেন তিনি। কনে কালো হওয়ার দরুন পাত্রপক্ষকে মোটাঅংকের টাকা,ফুলসেট ফার্নিচার ও পাত্রের দাবীতে একটি মোটরবাইকও দিতে হচ্ছে হাসান সাহেবকে।এতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই তার।আপদটা বিদায় হলেই হলো।

বোনদের ডাকে পিছনে ফিরে তাকালো রাবেয়া।দুইজনকে খুব সুন্দর লাগছে।যেন কোন হুর পরী।

“কিরে আপা এইভাবে দাড়িয়ে আছিস যে।আজ তোর বিয়ে।মুখে একটু হাসি তো আন।”

“বাদ দে তো ঝুমা।ওকে কি তুই চিনিস না।আচ্ছা এমন কেন তুই বলতো।বিয়েতো সবার হবে।আজ হলে যে কথা কাল হলেও সেই একই কথা।এখানে এত মন খারাপ করার মতো কি আছে যতসব।”

“ঠিক বলেছিস মেঝ আপা।আর আপা তুই তো জানিস বাবা কেমন।তোকে তিনি একেবারে দেখতে পারেননা।তার উপর তোর জন্য উনাকে এত টাকা খরচ করতে হচ্ছে।তোকে বিদায় মানে বিয়ে দিতে পারলেই যেন তিনি বাঁচেন।”

বোনদের কথা শুনে রাবেয়ার ভাঙ্গামন আরো ভেঙ্গে গেল।বোন যে এমন হয় তা রাবেয়ার জানা ছিলনা।সবাই তাকে আপদ মনে করে।বিদায় করতে পারলেই যেন খুশি।অার আজ তারই আয়োজন চলছে।রাবেয়া মনে মনে ভাবছে এই দুইবোন কি সেই ছোট দুইবোন, যাদের কোলে নিয়ে সারাদিন পার করতো সে।যাদের না খায়িয়ে দিয়ে কখনো খেত না সে।নিজের আবদার গুলো পূরণ না হলেও তাদের সব আবদার পূরন হতে দেখে কখনো মন খারাপ করেনি বরং খুশি হয়ে যেতো সে।আর আজ সেই বোনগুলো তার দুঃখকষ্ট কিছুই বুঝতে পারছেনা।
হ্যা,ডাক্তারসাহেব ঠিক বলেছিলেন,কারো উপর ভরসা করলে জীবন কখনো তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেনা।আপনার হয়ে অন্যকেউ আপনার লড়াই লড়বে না।সব করতে হবে নিজেকে নিজেই।

_______________________

সবে মাত্র বিয়ে পড়ানো শুরু করেছিলেন কাজী সাহেব।তার মাঝেই বাড়ির গেটে এসে দাড়ালো পুলিশের গাড়ি।ইন্সপেক্টর সাহেবকে বিয়ের আসরে দেখে হতবাক সবাই।কানাঘুসাও শুরু করে দিয়েছে বিয়ের আসরে আসা লোকজন। হাসান সাহেব এগিয়ে গেলেন সামনে।গম্ভীরভাব বজায় রেখে জিজ্ঞাসা করলেন পুলিশ আগমনের কারন এবং কে তাদের এখানে ডেকেছে।

ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন,”আপনাদের এইখান থেকে ফোনকল এসেছে।এইখানে যে বিয়েটা হচ্ছে সেই বিয়েতে নাকী কনের মত নেই।তাকে জবরদস্তি করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে এমন ইনফরমেশন পেলাম আমরা।”

কথাটা শুনেই মাথার ভিতরে দাও দাও করে আগুন জ্বলতে লাগলো হাসান সাহেবের। রক্তচক্ষু নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি,”কে দিল আপনাকে এই মিথ্যাে খবর।কার এত বড় সাহস।কার?”

“ফোন আমি করেছি বাবা।”

কারো কন্ঠস্বর শুনে পিছনে ফিরে তাকালেন হাসান সাহেব।পিছনে তার কনেসাঁজে দাড়িয়ে আছে রাবেয়া।

চলবে…….

®নওশিন সালসাবিল

[ ইসলামে বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলে যেমন মেয়ে পছন্দ করতে পারবে তেমনি মেয়েরও ইখতিয়ার রয়েছে ছেলে পছন্দ করার। ‘পরিবারের পছন্দনীয় ছেলেকে বিয়ে করতে হবে’-এ মর্মে প্রাপ্ত বয়স্ক কোনো মেয়ের ওপর জোর করার কোনো নিয়ম নেই। হাদিসে পাকে এসেছে-

> হজরত সালামা বিনতে আব্দুর রহমান রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন এক মেয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার পিতা, কতইনা উত্তম পিতা। আমার চাচাত ভাই আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল আর তিনি তাকে ফিরিয়ে দিলেন। আর এমন এক ছেলের সঙ্গে (আমাকে) বিয়ে দিতে চাইছেন যাকে আমি অপছন্দ করি।”

এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পিতাকে জিজ্ঞাসা করলে (মেয়েটির) পিতা বলে, মেয়েটি সত্যই বলেছে। আমি তাকে এমন পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছি যার পরিবার ভাল নয়।

তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘এ বিয়ে হবে না, (মেয়েটিকে বললেন) তুমি যাও, যাকে ইচ্ছে বিয়ে করে নাও’। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা)

হাদিসের আলোকে পাত্র নির্বাচনে মেয়ের মতামত নেয়া আবশ্যক। বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র নির্বাচনে কোনোভাবেই কোনো মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর খাটানো ঠিক হবে না। তবে কোনো পিতামাতাই চান না তার মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যাক।

তবে ছেলে নির্বাচনের আগে অবশ্যই মেয়ের সঙ্গে পরিবারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের পরামর্শ করা জরুরি। কেননা সারা জীবন সংসার করবে মেয়েটি। পরিবার যদি ভালো কোনো পাত্র নির্বাচন করে, তার সঙ্গে ছেলের ভালো দিকগুলো তুলে ধরা আবশ্যক।

আর মেয়ে যদি কোনো ছেলেকে পছন্দ করে সেক্ষেত্রে পরিবারের লোকদেরকেও ছেলের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেয়া জরুরি। তাহলে পরিবারও ছেলের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে সহজ হবে। কেননা মেয়ে তার অধিকারের ব্যাপারে বেশি হকদার। হাদিসে এসেছে-

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মেয়ে তার ব্যক্তিগত বিষয়ে অভিভাবকের চেয়ে অধিক হকদার।’ (মুয়াত্তা মালেক, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিজি)

তবে বিয়েকে কেন্দ্র করে কিংবা পিতা-মাতা বা পরিবারের অগোচরে পালিয়ে ভালোভাবে চেনা-জানাবিহীন কোনো ছেলেকে বিয়ে করা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। যদিও প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের বিয়ের জন্য ছেলে নির্বাচনের অধিকার দিয়েছেন প্রিয়নবি।

বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের পাত্র নির্বাচনের অধিকার প্রসঙ্গে অন্য হাদিসে এসেছে-

হজরত বুরাইদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এক মহিলা প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, আমার পিতা আমাকে তার ভাতিজার কাছে বিয়ে দিয়েছে, যাতে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।

হাদিস বর্ণনাকারী রাবী বলেন, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিষয়টি মেয়ের ইখতিয়ারের (ইচ্ছার) ওপর ন্যস্ত করেন। (অর্থাৎ ইচ্ছে করলে বিয়ে রাখতেও পারবে, ইচ্ছে করলে ভেঙ্গেও দিতে পারবে) তখন মহিলাটি বললেন, আমার পিতা যা করেছেন, তা আমি মেনে নিলাম। আমার (প্রিয়নবিকে বিষয়টি জানানোর) উদ্দেশ্য ছিল, (প্রাপ্ত বয়স্ক) মেয়েরা যেন জেনে নেয় যে, বিয়ের ব্যাপারে পিতাদের (চূড়ান্ত) মতের অধিকার নেই।’ (ইবনে মাজাহ, দারাকুতনি)

মনে রাখতে হবে বিয়ের ব্যাপারে অবশ্যই দ্বীনদারিকে প্রাধান্য দিতে হবে । সামাজিক কুফু তথা সামঞ্জস্য ঠিক আছে কিনা তা বিবেচনায় রাখতে হবে। সঠিকভাবে সাংসারিক হক আদায় করতে পারবে কিনা সে বিষয়গুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সব মেয়েকে পাত্র নির্বাচনে সঠিক দ্বীনদারি বিবেচনার তাওফিক দান করুন। পরিবারের মর্যাদা রক্ষায় শ্রদ্ধাশীল হওয়ার তাওফিক দান করুন। পরিবারের দায়িত্বশীলদেরকেও মেয়েদের সঙ্গে পরামর্শের আলোকে সঠিক পাত্র নির্বাচনের তাওফিক দান করুন। আমিন। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here