যখন এসেছিলে অন্ধকারে

১৩ এবং ১৪।।

‘অনি, আসলে না তুমি? খুব একা একা লাগছে বললাম না? বোর হচ্ছি!’

‘আমারও না ভাল্লাগছে না।’

‘কেন সোনা?’ নাকে নাকে আদুরে ভঙিতে বলে আবরার।

‘দেখো না, চার বছরের বেশি আমি কাজ করছি, লিডরোল পেলাম না এখনো, না একটা প্রমিনেন্ট কমার্শিয়াল। আমিও বোর হচ্ছি। ছেড়েছুড়ে গ্রামে চলে যাব ভাবছ। লাউ আর শিমের গাছ লাগাব। পালংশাকের ক্ষেত থাকবে। দুটো ছাগল, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে আর একটা গরু থাকবে আমার। একখাঁচা কোয়েল পুষব…’

‘থামো থামো। কতদূর চলে যাচ্ছ…’ অনির কথার ইঙ্গিত ধরে ফেলে আবরার ‘প্রডিউসাররা হিট জুটি ছাড়া ইনভেস্ট করতে চায় না, আমি কী করব বলো, জান? এখন যে কয়টা নাটক আমার হাতে সব মিলার সাথে। আমি তোমার কথা কায়েস ভাইকে বলে রেখেছি। সামনে একটা নাটক আসছে, ভ্যালেন্টাইনের, ওটাতে তোমাকে কাস্ট করতে বলেছি। কিন্তু বোঝোই তো, আজকাল সবই কনজিউমার প্রডাক্ট। দর্শক যেটা খায়, সেটাই বেশি করে বানানো হয়। আমার আর মিলার জুটি এখন দর্শক ভালো খাচ্ছে…’

আবরারের কথা শেষ করতে না দিয়েই অনি বলে ‘আচ্ছা, মিলা ও তো আছে টিমে না? তাহলে কেন বোর লাগছে? মিলা আর তোমার তো ভালো কেমিস্ট্রি, তাই না? ওকে একটু ডাকো না? আমার না খুব অসময়ে ঘুম পাচ্ছে। আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি, প্লিজ।’ খট করে ফোনটা রেখে দিলো অনি।

আবরার অনিকে নিয়ে খেলছে নাকি অনি আবরারকে নিয়ে, বলা মুশকিল, একা একা হাসে অনি।

ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে অনি। এক ঘুমেই সকাল হয়ে যায়।

ঘুম ভাঙে কলবেলের আওয়াজে। চোখ ডলতে ডলতে পিপহোলে চোখ দিয়ে দেখে অলি এসেছে। দরজা খুলে ওকে বসতে বলে ফ্রেশ হয়ে আসে অনি।

মিল্কশেক রাখা ছিলো ফ্রিজে। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে অলির পাশে বসল।

‘সকালবেলা এসব খেতে ভালো লাগে?’

‘খেয়ে দেখ?’

অলির কাছে এগিয়ে দিতেই ও নাক সিঁটকে ফেলে ‘এটা কী?’ মিল্কশেক না তো!’

‘না। স্মুদি। কীসের স্মুদি জানিস? বেবি স্পিনাচ। বাচ্চা পালংশাক!’

‘ছিঃ! ইউউ। খাস কীভাবে?’

‘অভ্যাস হয়ে যায়। তারপর ভালো লাগে।’

‘অভ্যাস করার দরকার কী?’

‘ফিট থাকতে। এই একটা গ্লাস, সকালে ব্রেকফাস্ট লাগবে না, একবারে ব্রাঞ্চ সেরে ফেলব, সাড়ে বারোটা কী দেড়টায়!’

‘এইভাবে শরীর ফিট রাখার চাইতে আলুভর্তা দিয়ে একপ্লেট ভাত খেয়ে উঠে, আমি ভুটকি হবো!’

‘তোর মেডিকেল এডমিশন হয়ে গেছে?’

‘না। পাশ মার্কই আসেনি।’

‘এত পড়ে তাহলে কী করলি?’

‘আমি তো মেডিকেলের জন্য পড়িনি। ডিইউর জন্য পড়েছি। ওটা হবে। ক ইউনিটে না হলেও ঘ ইউনিটে ঠিক হয়ে যাবে।’

‘পড়ছিস ভালো করে?’

‘হুম।’

‘পড়া বাদ দিয়ে এত সকালে এখানে এলি কেন?’

‘মা পাঠালো।’ অলি একটা শপিং ব্যাগ এনেছে সাথে। আড়ং এর। ওটার ভেতর থেকে দুটো প্ল্যাস্টিকের ফুড কন্টেইনার বের করল।

‘কী ওতে?’

‘খিচুড়ি আছে। ইলিশ মাছ আছে। গরুর মাংস ভুনা করে দিয়েছে। দুইদিন তোর আর রান্না করতে হবে না।’

‘আমি এমনিতেও রান্না করি না। খাইই তো কম। কাজু, আমন্ড আর শশা। মাঝেমাঝে স্যুপ আনিয়ে নেই। রাতে একটা আপেল, কখনো একপিছ মাছভাজা। খুব বেশি ইচ্ছে হলে পাস্তা নইলে বিরিয়ানি হোম ডেলিভারিতে আনিয়ে ফেলি।’

‘তবুও মায়ের রান্না। তোকে ছাড়া খায় কীভাবে?’

‘হুহ!’ মুখ বাঁকায় অনি।

একটা চামচ এনে কন্টেইনারটা নিয়েই বসে যায়, প্লেট আনার ঝামেলা করে না।

‘মজা হইছে রে! খাবি তুই?’ এক চামচ মুখে পুরে অলিকে জিজ্ঞেস করে অনি।

‘হুম। তুই খেয়ে দে আমাকে। আমি নাস্তা করে আসিনি।’

‘তুই এলি কেন? ভাইয়া আসতে পারত।’

‘ও আসে আর প্রতিবার মন খারাপ করে যায়। তুই ওর কোনো কথা শুনিস না।’

‘বাদ দে এইগুলা। এই বিষয়ে অনেক কথা হয়ে গেছে। অনেকবার হয়ে গেছে।’

‘সেলিব্রেটি হয়ে দেখায়ে দিতে হবে, এই জিদ নিয়েই বসে থাকবি?’

অনি উত্তর দেয় না।

অলি প্রশ্ন করে ‘তা তুই ডাক পাস না কেন?’

‘আমার মেরিট নেই, অভিনয় আসে না, শুধু গ্ল্যামার দিয়ে র‍্যাম্পে হাঁটাই যথেষ্ট।’ হাই তুলতে তুলতে বলে অনি।

‘আর রাজন স্যার। উনি তো তোর সবচেয়ে কাছের মানুষ। ভাই বোন থেকেও বেশি হয়ে গেছে। সে তোকে ব্রেক দিতে পারে না?’

‘ না। এই কারণ দেখিয়ে রাজন মানিকও আমাকে হাইলাইট করবে না।’

‘আর তোর এত কন্টাক্ট? কত জায়গায় তো কাজ করলি?’

‘অনেক জায়গায়ই ডাকে। স্ক্রিনটেস্টে বাদ পড়ে যাই। আমার ডায়লগ থ্রোয়িং নাকি হয় না। চরিত্রের সাথে মিশতে পারি না। বাদ দে তো!’

‘কত কত একট্রেসই তো দেখি ঠিক করে বাংলাও বলতে পারে না। তাদের কীভাবে নেয়? তোর কেন হয় না?’

‘অনেক কাহিনী আছে। ধর, কেউ কেউ হুট করে লাইমলাইট পেয়ে ফেমাস হয়ে গেছে, কেউ কেউ যাস্ট নেপোটিজমের জোরে রাজ করে যাচ্ছে। আবার কেউ পরিশ্রম করে অনেক। আরও অনেক ব্যাপারস্যাপার আছে। তুই বুঝবি না।’

‘আচ্ছা বুঝলাম না। কিন্তু তুইও তো কাজ করছিস। পরিশ্রমও তো করিস।’

‘আমি ভুল করেছি প্রথমদিকেই এক্সট্রা রোলগুলো একসেপ্ট করে। তখন তো আর এসব বুঝি না, একটা কোনো কাজ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম, ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে এতসবকিছু ভাবিইনি। যেখানেই ডাক পেতাম, রাজি হয়ে যেতাম।’

‘তাতে কী?’

‘ অনেকে এটাকেও অজুহাত করে আমাকে বাদ দেয়। এই যে নায়িকার বান্ধবীর রোল, এসবকে বলে শর্টরোল, যারা শর্টরোল করে ফেলে তাদেরকে নাকি বড় রোলে ব্রেক দেওয়া যায় না। ফ্রেশফেসের ভ্যালু আছে শোবিজে, এক্সট্রা রোলগুলোকে এক্সট্রাই থেকে যেতে হয়।’

‘আচ্ছা বুঝলাম। আর আবরারের ব্যাপারটা কী? ওকে নিয়ে ভাবছিস কিছু। মানে, তোরা কী একসাথে আছিস? আই মিন, এনি রিলেশনশিপ, কমিটমেন্ট? আবরারের গুণে তো ঘাট নেই। কাপড়চোপড়ের মতো মেয়ে পালটায়। তোর ব্যাপারটা কি?’

‘কোনো ব্যাপার নাই।’

‘ আবরার তোকে ভালোবাসে?’

‘সেটা জানি না। ভালো মনে হয় কাউকেই ও বাসে না। আমিও ওর জীবনে পার্মানেন্ট কেউ হতে চাই না। শুধু শোবিজে এস্টাবলিশমেন্ট চাই।’

‘এত হিসাবনিকাশ কীভাবে শিখলি তুই? কী বোকা ছিলি কয়েকটা দিন আগেও!’

‘আমার মতো ঘাত প্রতিঘাতের জীবন যদি হতো তোর, তবে তুইও বয়সের আগেই ম্যাচিউরড হয়ে যেতি।’

‘তোর সাথে যা যা হয়েছে, অবশ্যই খারাপ হয়েছে। কিন্তু এর চাইতেও খারাপ অনেককিছু অনেকের সাথেই ঘটে। সবাই তোর মতো করে না।’

‘আমার মতো কী? কী করে না? আমার মতো করে না, বলতে হলে আমার জায়গায় আসতে হবে তোকে। আমার অবস্থায় পড়ে ভাবতে হবে, কী করা উচিত আর কোনটা করা উচিত না। কখনো এমন সময় আসে উচিতবোধ কাজ করে না। তখন শুধু সামনে থাকা রাস্তাটাই চোখে পড়ে। রাজন স্যার বলেন, অর্জুনের মতো মাছের চোখেই লক্ষ্যভেদ করতে হলে অন্য কোনোদিকে তাকাবো চলবে না। আমি জানি আমাকে এই ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা করতে হবে, এর জন্য যা যা করা দরকার সব করব আমি। সরে আসব না।’

‘অনি? বাসায় চল? ভাইয়া খুব মন খারাপ করে। মা কাঁদে।’

‘যাব। যাব না কেন? সময় আসুক।’

‘এত জেদ করিস কেন? ক্ষমা করে দে না! নরম হ প্লিজ!’

‘এই তোর না পরীক্ষা আছে? যা তো! আমি ঘুমাব।’

‘ঘুমালে ফিট থাকবি কীভাবে? মোটা হয়ে যাবি না?’

‘না। ট্রেডমিলে চার কিলো দৌঁড়ায় নেবো। এই যে খিচুড়ি খেলাম। এটার জন্য আরও চারকিলো এক্সট্রা দৌঁড়াতে হবে।’

‘তাইলে না খাইতি! এত দৌঁড়াতে গেলে কাজ করে কখন মানুষ। ধর বলিউডের নায়িকারা। ওরা কী শুধু শাকপাতা খায়? সবসময়? ভালো খেতে ওদের মন চায় না? রুচিতে লাগে?’

‘অনেক সময় খায়। পেট ভরে মাটন বিরিয়ানি খায়। এক্সট্রা চিজ দিয়ে ডাবল পেটি বার্গার খায়। ম্যাক এন চিজ খায়। গুলাবজামুন খেয়ে ফেলে গোটাকয়। খেয়েদেয়ে ঢেঁকুর তুলে, ওয়াশরুমে গিয়ে গলায় আঙুল দিয়ে বমি করে ফেলে দেয় সব। খাওয়াও হলো, শরীরেও লাগল না কিছু।’

‘ছিঃ। এইটা জীবন? এইভাবে গ্ল্যামার ধরে রেখে বেঁচে থাকার লাভ কী?’

‘দেখ, সবার কাছে সবার কাজ বেশি গুরুত্ব রাখে। নায়িকাদের কাজ হচ্ছে নিজেকে ফিট রাখা, মেদহীন থার্টি ফোর, টুয়েন্টি ফোর, থার্টি ফোর রেশিওতে ফিগার আটকে রাখা। দাগহীন চকচকে নিঁখুত মুখ রাখা। তাই শরীরচর্চা আর রূপচর্চা থাকে দিনের রুটিনের বেশীরভাগ সময় জুড়ে। এটাই ওদের মেইন কাজ। গ্ল্যামার ধরে রাখতেই হবে। প্রপার ডায়েট মানতে হবে। জিম করতে হবে। আমার যখন অনেক টাকা হবে, ঘরেই একটা জিমনেসিয়াম থাকবে, বুঝছিস? একটা অটো ট্রেডমিল কিনব। আমারটা তো ম্যানুয়াল। টেনে টেনে দৌঁড়ানো লাগে। পায়ে ব্যথা করে। মাসলক্র‍্যাম্প হয় রাতে ঘুমানোর সময়।’

‘আর?’

‘ডিজাইনার কালেকশন দিয়ে ভর্তি ক্লজেট। জামা, জুতো, ঘড়ি, গগলস, ব্যাগ!’

‘আর?’

‘একটা পোরশে। কী কিউট একেকটা গাড়ি রে অলি…’ এইটুকু বলেই অলির দিকে তাকিয়ে অনি থেমে যায়। অলি চাপা হাসিতে ভেঙে পড়েছে। ওর মাথায় চাপর দিয়ে অনি বলে ‘তুই কি আমার সাথে ইয়ার্কি করছিস?’

অলি চট করে অনিকে জড়িয়ে ধরে ‘আগের মতো হয়ে যা অনি। বাসায় চল। এসব তোকে দিয়ে হচ্ছে না মানে হবে না।’

‘কী হবে না? হতেই হবে। আমি হেরে যাব না অলি।’

‘হার জিত নিজের ক্যাপাবিলিটির ভেতর থেকে ঠিক করতে হয় অনি। কেউ যদি তোকে হিট দেয়, বলে পারলে পিএম হয়ে দেখাও, তুই কী পিএম হওয়ার জন্য রাস্তায় নেমে পিকেটিং শুরু করবি? রাস্তা গরম করা আর রাজপথের রাজনীতি এক না। তেমনি এইভাবে শোবিজে ক্যারিয়ার করাও সম্ভব না। হয়তো একটা ব্রেক তুই পেতে পারিস, কিন্তু এই ইন্ড্রাস্টিতে তোর মেধা না থাকলে টিকবি কী করে? হয়নি যখন ছেড়ে দে না?’

‘কী করব তবে। পড়াশোনা? ওটাও তো আমার দ্বারা সম্ভব না। তাহলে কী এইরকম অযোগ্যই থেকে যাব? আমাকে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে অলি!’

‘কার কাছে? কার কাছে নিজেকে প্রমাণ করবি তুই?’

‘যা অলি। আমি ঘুমাব। আমার কথা বলতে ইচছে করছে না।’

অলিকে প্রায় ধাক্কা দিয়েই বের করে দিয়ে বিছানায় কাঁথামোড়া দিয়ে শুয়ে পড়ে অনি। ঘুমের বদলে গত হওয়া চার বছরের স্ট্রাগল চোখের সামনে ভাসতে থাকে।

বাসা থেকে বেরিয়ে আসার পরদিনই রাজন মানিক পরশের সাথে যোগাযোগ করেছিল। পরশ অনিকে ফিরিয়ে নিতে এসেছিল। কিন্তু অনির জেদের কাছে হেরে গেছে।

নিজের জায়গা তৈরি না করে ও ফিরবে না।

যখন এসেছিলে অন্ধকারে
১৪।।

‘অনি?’

‘হুম।’

‘তোর বয়স কত?’

‘একুশ।’

‘মাত্র জীবন শুরু, বল?’

‘কেন?’

‘ধর একটা দশতলা বাড়ি। ছাদে উঠবি তুই। অথবা সাততলায় কিংবা আটতলায়। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে, নইলে লিফট খুঁজতে হবে অথবা কারও ঘাড়ে চড়তে হবে। তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘লিফটটা হয়তো কয়েকজন প্রভাবশালীর জন্য সংরক্ষিত। তুই সেসব কেউ না, তো লিফট তোর জন্য নয়। তাই এই অপশনটা বাদ। পরের অপশন অন্য কাউকে ব্যবহার করা, কারো ঘাড়ে চড়া। কারো ঘাড়ে চড়লে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটানোর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ঠিক না?’

‘এসব বলছিস কেন?’

‘তাহলে সিঁড়ি ধরে ওঠাটা সবচেয়ে নিরাপদ, তাই না?’

‘এসব কথার মানে কী?’

‘অনি, সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে সময় লাগে, পা টনটন করে। কিন্তু যদি হোঁচট খাস, পড়ে গেলেও হালকাই লাগে ব্যথাটা, সামলে নেওয়া যায়। মুম্বাই যাবি?’

পরশের কথায় চমকে ওঠে অনি ‘মুম্বাই কেন?’

‘মুম্বাইতে অনেকগুলো এক্টিং স্কুল আছে। বালাজি, অনুপম খের, ব্যারি জনের এক্টিং স্কুল, ড্রামা স্কুল। কোথাও থেকে একটা কোর্স করে আয়। নিজের স্কিল ডেভেলপ হবে, ভুলগুলো জানতে পারবি।’

‘মানে তো সেই পড়াশোনা!’ হতাশ হয় অনি।

‘পড়াশোনা না করলে কোনো কাজই সুন্দর হয় না অনি। যে ভালো রাঁধুনি সেও কিন্তু একদিনে রান্না শেখেনি। তাকেও পড়াশোনা করতে হয়েছে। মায়ের রান্নাঘরে সে মায়ের চামচ নাড়ানো খেয়াল করে দেখেছে, কোনো রান্না ভালো লাগলে তার রেসিপি লক্ষ্য করেছে, নিজের রান্নায় মশলার পরিমাণ কমবেশি করে সবচেয়ে সেরাটা নিয়েছে। তারপর ধর যারা সিনেমা করে, সিনেমা বানায়, তারা আগে বানানো সিনেমা দেখে দেখে শিখে নেয়। এই সিনেমা দেখাটাই তখন তার পড়াশোনার বিষয়।’

‘বাংলাদেশে তো কেউ করে এভাবে করে না!’

‘তুই যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিসই যে, শোবিজে থাকবিই, তখন চেষ্টা করা উচিত। অনেকভাবেই তো চেষ্টা করলি, হলো না তো। তো নিয়ম মেনেই চেষ্টা কর। যদিও আমাদের দেশে এটাই অপ্রচলিত। এখানে একটিং স্কিল কেউ শিখে আসে না, এই সাবজেক্টে কেউ পড়াশোনা করে না।’

‘তুমি এতকিছু কীভাবে জানো?’

‘খোঁজ নিয়েছি। তুই তো আমাদেরকে অসহায় করে রেখে দিয়েছিস। বাধ্য হয়েছি খুঁজতে।’

‘সরি ভাইয়া।’

‘সরি বলে কী লাভ, অনি? তোর জীবন, তুইই বুঝবি। সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা তোর। তবে তোর সিদ্ধান্ত সবসময় সঠিক হবে এটা ভাবা বোকামি। তাছাড়া তোর বয়সটাও নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো একা একাই নেওয়ার মতো যথেষ্ট নয়। তাই অভিভাবক দরকার হয়, অভিভাবকদের পরামর্শ প্রয়োজন হয়। কিন্তু তুই তো কাউকে প্রয়োজনই মনে করিস না।’

‘সরি ভাইয়া’ অনি পরশকে জড়িয়ে ধরে। ‘কিন্তু আমি সবসময় তোমার কথা শুনে চলি। তোমাকে যা যা কথা দিয়েছিলাম, কিছু ভুলিনি।’

‘তবে আবরারের কথা যেসব শোনা যায়? সব রিউমার?’

‘একেবারেই সবটুকু গুজব না। কিছুটা সত্যি আছে। তবে আমার পা পিছলে যায়নি ভাইয়া। অন্যায় কিছু করলে আমি আরও অনেক আগেই সাকসেস পেয়ে যেতাম।’

‘কতটুকু সত্যি?’

‘অল্প একটুকু। এইটুকু’ আঙুলের মাথায় চিমটি দেখায় অনি।

‘মানে? তোদেরকে যে একসাথে দেখা যায় অনেক জায়গায়?’

‘যায়। তবে সেসব জায়গায় যেখানে যেখানে আমাকে দেখা গেলে রাজন স্যারের কানে সংবাদ পৌঁছে যাবে।’

‘কেন? রাজন মানিক কেন?’

‘ভাইয়া?’ লজ্জায় মুখ লাল হয় অনির। ‘আমি ওনাকে খুব পছন্দ করি।’

‘সে তো পুরোনো কথা। তাকে পছন্দ করিস বলেই ফ্যামিলি ছেড়ে তার আশ্রয় নিতে পেরেছিলি।’

‘সেটা আলাদা ব্যাপার ভাইয়া। সেদিন ঢাকাশহরে যাওয়ার মতো চেনা লোক আমার আর কেউ ছিলো না। তাই আমি রাজন স্যারের কাছে গিয়েছিলাম। সেটা না ভাইয়া, তুমি বুঝতে পারছ না, আমি রাজন মানিককে ভালোবাসি। আই লাভ হিম।’

‘মানে?’ এই ছোটোবোনটা কতরকমভাবে চমকে দেবে ওকে পরশ ভেবেই পায় না। ‘অনি? মানে তুই ওকে পার্টনার হিসেবে পছন্দ করিস? বিয়ে করতে চাইছিস?অনি? ওই লোকটার বয়স তোর ডাবল!’

‘তাতে কী?’

‘তোকে ওই লোকটা ম্যানিপুলেট করছে। তোর বোকামির সুযোগ নিচ্ছে! তুই এত বোকা?’ নিজের মাথার চুলগুলোকে মুঠো করে ধরে চিৎকার করে পরশ। রাগে কাঁপছে ও।

‘ভাইয়া, এমন কিছু না। তুমি ওনাকে ভুল ভাবছ। বিশ্বাস করো, কখনো আমার বিন্দুপরিমাণ খারাপ করেননি উনি।’ অনি কেঁদে ফেলে।

‘কী মানে এর? মেয়ের বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছেন, অবুঝ হওয়ার সুযোগ নিয়ে প্রলোভিত করছেন, এরপরেও আমি বলব, উনি তোর ক্ষতি করছেন না? অনি প্লিজ বুঝতে চেষ্টা কর। এটা হয় না। পরে বুঝতে পারবি কতটা ছেলেমানুষী চিন্তা এগুলো। কতটা বিপৎজনক।’

‘রাজন স্যারও ঠিক এই কথাটাই বলেন, জানো ভাইয়া?’

‘উনিও বলেন? রাজন মানিক?’

‘হ্যাঁ। কিছুতেই আমার ভালোবাসা স্বীকার করেন না। শুধু আমিই চাই তাকে।’ অনি কাঁদতেই থাকে।

‘রাজন সাহেব তোকে ভালোবাসেন না?’

‘না।’

‘তবে তুই কেন পাগলামি করছিস? ওনাকে তোর সাথে মানায় না অনি। এতটা ব্যবধান!’

‘আমাকে এর সাথে মানায় না, ওকে আমার সাথে মানায় না, মানে কী ভাইয়া? এগুলো বোগাস কথা।’

‘কবে থেকে শুরু এসবের? ওনার বাসায় থাকতে শুরু করার পর থেকেই নাকি তারও আগে অনি?’

‘একটু একটু করে ভাইয়া।’

‘কিন্তু উনি তো তোকে কোনো সুবিধা করে দেন নি। ওই সুবিধা নেওয়ার জন্যই কি তুই ওকে বিয়ে করতে চাইছিস?’

‘নিজের মানুষই ভুল বোঝে আগে। তুমিও এভাবে ভাবছ ভাইয়া? না, ওনার কাছ থেকে আমি কোনো সুবিধা চাই না। উনি দেবেনও না, আমি জানি। আমি শুধু ওনাকেই চাই।’

‘কীভাবে বিশ্বাস করব তোকে? তুইতো আবরারকেও ব্যবহার করছিস সিঁড়ি হিসেবে।’

‘না ভাইয়া। বিশ্বাস কর। হ্যাঁ, আবরার ভাইয়ের সাথে মিশছি, কিন্তু উদ্দেশ্য অন্যকিছু।’

‘কী উদ্দেশ্য? বল। শুনে কানদুটোকে ধন্য করাই। এমনিই যা শুনিয়েছিস তা আমার ঘুম উড়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।’

‘আবরার ভাইকে, রাজন স্যার পছন্দ করেন না। কেননা, আবরার ভাইয়ের অনেক গার্লফ্রেন্ড আছে। তাই, আমি ওনার সাথে মিশলে রাজন স্যার ক্ষিপ্ত হন। আমার প্রতি অধিকারবোধ আছে ওনার। এটা যে ভালোবাসা, সেটা উনি মানতে চান না। আমি চাই উনি বুঝুক, আমার মতো করে উনিও আমাকে ভালোবাসেন, সেটা উনি জানুক। ছেলেমানুষী হলেও আমার আবেগটা, ওনার প্রতি আমার অনুভূতি এটা তো মিথ্যা না।’

‘অনি একটু আগেই বললি, তোর বয়স মাত্র একুশ। সামনে পুরো জীবনটাই পড়ে আছে।’

‘কে বলেছে ভাইয়া? এমনও তো হতে পারে কাল সকালের সূর্যটাই দেখলাম না। আজরাইল হয়তো ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে।’

‘এভাবে কেউ ভাবে না, অনি।’

‘না ভাবলেও জীবন অনিশ্চিত, অনিশ্চিতই থাকে।’

‘আশ্চর্য, বিয়ে এখন করতে হবে কেন? একুশ বছর এমন কোনো বয়স না। বরং বলা যায়, এখনো তোর বিয়ের বয়স হয়ইনি। এসব বাদ দে, অনি। ক্যারিয়ার বানা আগে।’

‘তোমাকে কে বলল আমি এখন বিয়ে করতে চাইছি।’

‘কে বলল মানে? তুইই তো এইমাত্র বললি। ডাবল বয়সের ওই লোকটাকে তুই পছন্দ করিস, বিয়ে করতে চাস।’

‘পছন্দ করি বলেছি, ভাইয়া। বিয়ের কথা তুমি বলেছ।’

‘একই ব্যাপার দুটোই।’

‘না। একই না। তুমি রেগে যাচ্ছ ভাইয়া।’

‘তুই কি রাগ করার মতো কথা বলছিস না? আমার তো মনে হচ্ছে তুই ড্রিংক করা শুরু করেছিস। ড্রাগফ্রাগও নিচ্ছিস!’

‘এত রেগে গেলে আমার মনের কথা আমি কাকে বলব, বলো? তোমাকেই তো বলি সব। তোমার সব কথা আমি মেনে চলি। অবাধ্য তো হই না।’

‘অবাধ্য হোস না, মানে কী? বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিস, এত অনুরোধেও ফিরছিস না আবার অবাধ্য হোস না মানেটা কী?’

‘সেদিনের ব্যাপার আলাদা ছিলো, ভাইয়া। মাথা এলোমেলো ছিলো। পাগলামি করেছিলাম।’

‘পরে তো মাথা ঠান্ডা হয়েছে?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু ভেবে দেখো, ওরকম রোজরোজই হতো বা হবে। মা কখনোই আমাকে মিডিয়ায় থাকতে দেবে না। আবার ধরেবেঁধে, ইমোশন গুলিয়ে খাইয়ে বিয়ে দেবার চেষ্টা করবে। রোজকার সেই খিটিমিটি থেকে তো ভালো আছি। নিজেকে আগে একটা জায়গায় আনি, বলো? ফিরব না তো কী, ভাইয়া। তোমরা ছাড়া আমার কে আছে আর?’

‘ঠিক বলেছিস অনি। আমরা ছাড়া আমাদের কেউ নেই। তাহলে চল দুইভাইবোন মিলে মুম্বাই যাই। এসব রাজন টাজন মাথা থেকে ফেলে দে।’

অনি কিছু বলল না। চুপ করে তাকিয়ে থাকল। পরশ, রাজন মানিক ওর জন্য ঠিক মানুষ না বোঝাতে চেষ্টা করল আবার।

‘দেখ, বয়সের কত পার্থক্য। এডজাস্টমেন্টই তো সম্ভব না। সেও সেটা বোঝে বলেই তোকে প্রশ্রয় দিচ্ছে না। আমার তো লোকটাকে শ্রদ্ধা হচ্ছে রীতিমতো।’

অনির মুখ উজ্জ্বল হতে দেখে পরশ বুঝল ওর কথা ভুলদিকে যাচ্ছে। রাজন মানিকের প্রশংসা করার সময় এটা নয়। তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘আর দেখ লোকটা কিন্তু তোর কেয়ার করে না। তুই কত স্ট্রাগল করছিস সেই সবচেয়ে ভালো জানে, ইচ্ছে করলেই তোকে তুলে দিতে পারে কিন্তু দিচ্ছে না!’

‘না, ভাইয়া পারেন না। শুধু শোবিজ না, কোথাও কেউ কাউকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে না। রাস্তাটা দেখিয়ে দেওয়া যায়, কেউ হয়তো দুইকদম সাথে চলে , কিন্তু সাকসেস স্টোরি নিজে নিজেই তৈরি করতে হয়। আর লোকটা অনেক সৎ। জানো? এখনো ওয়াইফকে ভালোবাসে।’

‘উনি বিবাহিত? বলছিস কি, অনি? তাও তুই ওই লোকটাকে পছন্দ করিস, বলছিস?’

‘ভাইয়া নিঃশ্বাস নাও, প্লিজ। এমন কোরো না। আমি বলছি, আমার বলার ভুল হয়েছে, এক্স ওয়াইফ। বিয়ের ষোলোদিনের মাথায় ওনার ডিভোর্স হয়ে গেছে।’

‘কেন?’

‘রাজন স্যারের পিঠের দিকটা একেবারে ঝলসানো। আগুনে পুড়ে বিভৎস দেখায়।’

‘তবুও তুই এই লোকটাকে পছন্দ করিস? তুই কি পাগল?’

‘ভাইয়া প্লিজ। আমার সবচেয়ে শ্রদ্ধার জায়গা তুমি। সেটা ম্লান করে দিও না। এতটা ন্যারোমাইন্ডেড তুমি, এটা ভাবতে আমার ভালো লাগছে না। বয়স, সৌন্দর্য, সাকসেস এসব দেখে কি কেউ ভালোবাসে?’

‘লোকটা পুরো ব্রেইনওয়াশ করে দিয়েছে তোর।’

‘এভাবে বোলো না ভাইয়া। এভাবে নিজেকে ছোটো কোরো না।’

‘মানে, তোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। তুই আর কারো কোনো কথাই শুনবি না। ওই বুড়োটাকেই বিয়ে করবি?’

‘আমার সিদ্ধান্তে কিছু যায় আসে না ভাইয়া। আমি আমার উপলব্ধিটুকু তোমায় জানালাম। রাজন স্যার আমাকে নিয়ে একেবারেই ভাবেন না। এটা একদম একতরফা। শুধু আমিই ভালোবাসি। উনি এখনো ওনার এক্সকে আঁকড়ে আছেন।’

‘তবে তুইও ভুলে যা, সোনাবোন আমার।’

‘যদি ইচ্ছে করে কোনোদিন, ঠিক ভুলে যাবো। কথা দিলাম তোমাকে। এখন ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। এখন আমাকে জোর কোরো না।’

‘তুই কোনোদিনই কোনো কথা শুনিসনি অনি। বেয়াড়া সবসময়ই।’

‘দোয়া কোরো ভাইয়া। আগামীপরশুদিন একটা বড় কাজের কন্ট্রাক্ট সাইন করতে যাচ্ছি। মাকেও বোলো দোয়া করে যেন, পারলে।’

‘কোথায়?’

‘একটা ফেয়ারনেস ক্রিমের কমার্শিয়াল । ফেমাস ক্রিম। বেশ বড় প্রজেক্ট। আটজন মডেল নিচ্ছে। আটটা সলো হবে। একটা গ্রুপ। প্রডাক্ট এম্বাসেডর করে নেবে আটজনকেই। এজেন্সি সিলেক্ট করেছে আমাকে। ভালো কাজ হবে ভাইয়া।’

‘আচ্ছা। কার রেফারেন্স এটা?’

‘উহ! স্ক্রিনটেস্ট দিয়ে পাশ করেছি, রীতিমতো!’

‘যাহ, দোয়া করে দিলাম। হিট বিজ্ঞাপন হবে তোরটা।’

অনির বাসাটা থেকে বেরিয়ে এসেও আবার ফিরে এসে দরজায় দাঁড়ায় পরশ। অনি জানতে চায় ‘কিছু বলবা ভাইয়া?’

পরশ অনির হাতটা মুঠোয় নেয় ‘আমি জানি না, তোকে বলা উচিত হবে কীনা। বলার ইচ্ছে ছিলো না, তবে এখন মনে হচ্ছে বলেই ফেলি।’

‘এত আমতা আমতা করছ কেন? বলো?’

‘অনি?’ বুকভরে জোরে শ্বাস নেয় পরশ। তারপর দুম করে বলে ফেলে ‘ইমরান দেশে এসেছে গতকাল।’

অনির মুখচোখের পরিবর্তন হয় না। সহজ করে বলে ‘ইমরান কে?’

চলবে…

Afsana Asha

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here